হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ২০

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ২০
#কায়ানাত_আফরিন

রিদানের উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর চুল ভেদ করে ঘাড় স্পর্শ করছে। তাই নিজেকে মোমের পুতুলের ন্যায় মনে হচ্ছে মৃধার। সবকিছুতেই যেন বিব্রতকর ছাপ। রিদানের জন্য মনে খেলা করছে আবেগের প্রকান্ড খেলা। এমন ভারসাম্যহীন পরিবেশে একে অপরের নিঃশ্বাস ছাড়া কিছুই অনুভব করা যাচ্ছে না।
রিদানের কোনো হুঁশ নেই। ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যদি মরতে হয় তবুও সে মরতে রাজি। কিন্ত আপনজনের তিক্ততা-ঘৃণা নিয়ে সে বাঁচতে পারবে না। রিদান কাতর গলায় বললো,

–”আমি ঘৃণা চাই না মৃধা। আমি ভালোবাসা চাই। আমায় একটু ভালোবাসতে পারবি?”

রিদানের এ কথাটি শোনামাত্রই মৃধার হৃদস্পন্দন যেন তুমুল গতিতে ছুটে চললো। এই ছেলে নেশা করে নির্ঘাত পাগল হয়ে গিয়েছে। রিদান অপেক্ষা করছে ওর উত্তর শোনার জন্য। মৃধা কাট কাট গলায় বললো,

–” এ-এখন ন-না।আগে তুমি রেস্ট নাও। ”

রিদানের কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে মৃধা তৎক্ষণাৎ খাটে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো রিদানকে। এখন নেশাগ্রস্থ অবস্থায় আছে বিধায়ই মৃধা এক ধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিতে পারলো। নাহলে কিছুই করতে পারতো না। মৃধা খেয়াল করলো যে খাটে শুয়ে পড়তেই রিদান ঘুমের অন্যরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জহির শেখের জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য রিদান গতকাল সারাদিন হন্য হয়ে ঘুরেছিলো আবার মৃধার কথার আঘাতে নির্ঘুমে রাত পার করলো বারে। আরও যে কত কি করেছে কে জানে?

চোখের কোণা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মৃধার। অনেকটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত রিদানকে মৃধা ঘৃণ্য ব্যক্তি মনে করতো। এতটা পাষাণ,চরিত্রহীন , নেশাগ্রস্থ ছেলেকে কোন মেয়েই বা পছন্দ করে। মানুষদের আঘাত দেওয়া ছাড়া রিদান কিছুই করতে পারতো না । মৃধা সবসময় ভাবতো ”এতটা নির্মম কেনো ওর দাভাই?” আজ হয়তো উত্তর পেয়ে গিয়েছে।
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো মৃধা। মিনমিনিয়ে বলে উঠলো,

–”তুমি বড্ড একরোখা দাভাই। যদি কখনও জানতে পারো যে তোমার অগোচরে আমি মৌনি আপুকে ছেড়ে দিয়েছি সেদিনই তুমি আমায় জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। আমি তোমার ভালোবাসা চাই না দাভাই ! আর না তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য!”

একথা বলে মৃধা রিদানের গায়ে কাথা মুড়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হচ্ছিলো ঠিক তখনই ওর চোখ যায় রিদানের ডেস্কটপের সামনে । সেখানে কুরিয়ার সার্ভিস থেকে আসা একটা কার্টন দেখা যাচ্ছে। হঠাৎই এক প্রবল উত্তেজনা কাজ করলো মৃধার। কার্টনটা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে এটা দেশের বাইরের থেকে আসা। মৃধা অদম্য কৌতুহলতা নিয়ে এগোলো সেটার দিকে। কার্টনের ওপর ইংরেজী আর স্প্যানিশ ভাষার সংমিশ্রনে কিছু লিখা আছে। মৃধা স্প্যানিশ ভাষার কোর্স করেছিলো বিধায় অক্ষরগুলো বুঝতে তেমন অসুবিধে হলো না। পার্সেলটি তবে স্পেন থেকে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মেডিসিনের পার্সেল।
মৃধা কার্টনটি খুলে ভেতরে উঁকি দিলো। কিন্ত এটা সম্পূর্ণ খালি আর এর তলে একটি কাগজ অবহেলায় পড়ে আছে। কাজটি বের করে পড়তেই অবাকের চরম শিখায় পৌঁছে গেলো মৃধা। স্পেন থেকে কোনো অবৈধ মেডিসিন আনা হয়েছিলো এখানে। ছোট ছোট শিশিতে মোট ১০ টা ইনজেকশনের ডোজ ছিলো। কাগজে স্পষ্ট লিখা আছে ,”সিজোফ্রেনিয়া”। মৃধা কিছুই বুঝতে পারছে না এসব বিষয়ে। রিদানের কিঞ্চিৎ নড়াচড়ার শব্দে সতর্ক হলো সে। কার্টনটি রেখে আনমনে বললো,

–”দাভাই? আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে মামার কথায় তুমি অনেক বড় কোনো ভুল করেছো। আদৌ কি তুমি তা উপলব্ধি করতে পারবে?ভালোবাসা যে বড্ড দায়হীন। তুমি ভালোবাসা পেতে চাইলে প্রথমে তো তোমায় তোমার ভুলগুলো অনুভব করতে হবে।”

২৮.
নিভ্রর সামনে বসে আছেন মৌনির বাবা আশরাফ হোসেন। এই দুদিনে চেহারায় মলিনতার ভার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বয়স যেনো ১০ বছর বেড়ে গিয়েছে।কাচাপাকা দাঁড়িগুলোও বেশ ভারক্রান্ত দেখাচ্ছে। এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। গতরাতে মৌনির নিধার সাথে করা যে ব্যবহারটার কথা তিনি নিভ্রকে শুনিয়েছেন সেটা ভাবলে যে কোনো বাবাই বিচলিত হয়ে পড়বেন।ঠিক সেরকমই একটা অবস্থা হয়েছে আশরাফ হোসেনের ক্ষেত্রে।

নিভ্র জিজ্ঞেস করলো,
–”মৌনি কি এর আগে কখনও নিধার সাথে এরকম করেছে?”

–”কখনোই না। নিধা পড়াশোনা না করলে একজন বড় বোন হিসেবে একটু আধটু শাসন করতো কিন্ত কখনোই এত খারাপ ব্যবহার নিধার সাথে করেনি। তাও আবার তোমাকে নিয়ে। মৌনিকে এতটা পজেসিভ হতে আমি কখনোই দেখিনি।”
আশরাফ সাহেবের চোখে-মুখে হতাশা। মেয়েটার কথা ভাবলেই বুকটা হু হু করে কেদে ওঠে তার।

–”নিভ্র বাবা আমি কি ভাবছি জানো?”

–”কি?”

–”মৌনিকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেবো। কিছু মনে করো না বাবা। আমি জানি তুমি যথেষ্ট ভালো ছেলে। কিন্ত মৌনির এ অবস্থা তুমি কতদিনই বা মেনে নিবে? এই রোগের কোনো সুস্থতা নেই বাবা। মেয়েটার জন্য আমিও বোধহয় পাগল হয়ে যাবো। একজন বিবেকবান মানুষ হয়ে আমি কখনোই তোমায় চিন্তায় ফেলতে পারবো না।”

স্মিত হাসলো নিভ্র। এই হাসিটাতে ওর শুভ্র মুখের উদ্বিগ্নতা চরমভাবে ফুটে উঠেছে। নিভ্র এবার বললো,

–” তো আপনার কি মনে হয় আঙ্কেল আমার থেকে দূরে সরে গেলেই ও ঠিক হয়ে যাবে?”

–”আমি সেটা বলতে চাইনি বাবা। আমি আসলে বলছি যে………….”

–”আগে আমার কথা মন দিয়ে শুনুন আঙ্কেল। মানসিক রোগের নাম নির্ণয় করা খুবই কঠিন। একেক মানুষের একই রকম রোগে একেক ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যে মৌনির বোধহয় কোনো ডিসঅর্ডার আছে। এমনকি লক্ষণ অনুযায়ী রিপোর্টসও পজেটিভ ছিলো। কিন্ত যেদিন রিদান শেখ মৌনিকে কিডন্যাপ করে সেদিক আমি চট্টগ্রামের আমার একজন পরিচিত সাইকোলজিস্ট এর কাছে মতামত জানতে গিয়েছিলাম। বয়সে আর কর্মদক্ষতায় আমার থেকে উনি ছিলেন যথেষ্ট বড়। যখন মৌনির হাবভাব আর স্বভাব সম্পর্কে আমার ধারনাগুলো বললাম তখন উনারও মনে হয়েছিলো ওর বোধহয় কোনো ডিসওর্ডার আছে। কিন্তু…………”

–”কিন্ত কি?”
আশরাফ সাহেবের ব্যাকুল কন্ঠ।

–”মৌনির অজান্তে ওর ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে আমি আমার সেই সিনিয়র ডক্টরের কাছে পাঠিয়ে দেই। পরে ওর ব্লাড টেস্ট করে দেখি ওর রক্তে ”সিজোফ্রেনিয়ার” স্যাম্পল আছে। গতরাতেই আমি তা জানতে পারি।

–” সিজোফ্রেনিয়া কি ?”

–”সাধারনত এ ধরনের রোগী অবচেতন মনের কল্পনাকে বাস্তবে মনে করে।যেমন এমন কিছু অস্তিত্ব অনুভব করা যেটা বাস্তবে কোথাও নেই। (তথ্যসূত্র: গুগল) তবে মৌনির এই রোগের ধরনটা ভিন্ন।”

বিস্মিত হলেন আশরাফ সাহেব। অবাক কন্ঠে বললেন,
–মানে?”

–”সিজোফ্রেক রোগীর সাথে মৌনির শতভাগ মিল নেই। মৌনি সিজোফ্রিনিক রোগী ঠিকই তবে সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার। এ ধরনের রোগী মনের কল্পনাকে বাস্তবে দেখে তবে মৌনির হয়েছে উল্টো। ও ওর বাস্তবকে কল্পনায় দেখে। আর গতকাল ঠিক এ কারনেই মৌনি অজ্ঞান হয়েছিলো। আমি , রিদান , জহির শেখ এগুলো ওর বাস্তবিক চরিত্র হলেও এগুলোকে কল্পনায় অনুভব করে মৌনি।”

ধীরে ধীরে চিন্তার ভারে নুয়ে পড়ছেন তিনি। মৌনির এই রোগে নিভ্রও দায়ী আছে এটা উনার মন কিছুক্ষণ ভাবলেও মাথা থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে দেন। সামনের সবকিছু তার কাছে অন্ধকার লাগছে। বিষন্ন গলায় বললেন,

–”এখন তাহলে কি করবে তুমি?”

–”আপনার অনুমতি নিয়েই তাই ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি আঙ্কেল। ওর চিন্তাধারাকে কিছুতেই এককেন্দ্রিক করা যাবেনা। এজন্য দরকার ঘনঘন পরিবেশ বদলানো। ক্যাম্পাস, বন্ধু , পড়াশোনা এগুলোর চাপে থাকলে ইনশাল্লাহ কিছুটা হলেও মৌনি নিয়ন্ত্রনে থাকবে।”

–”মৌনিকে তবে ঠিকমতো ওর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিও। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই আমায় জানাবে।”

–”ঠিক আছে।”

আশরাফ হাসানের সাথে বাড়ির বাইরে বের হলো নিভ্র। গাড়ির কাছে মৌনি , নিধা আর ওর মা দাঁড়িয়ে আছে। নীল শাড়ি পরিহিতা মৌনিকে দেখে নিভ্রর মনে একরাশ প্রশান্তি ছেয়ে গেলো। মৌনিকে দেখাচ্ছে বেশ প্রাণোচ্ছল। মৌনিকে এই প্রথম নিভ্র শাড়িতে দেখলো। শাড়িতে যে মৌনিকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে নিভ্র কখনোই তা ভেবে দেখেনি।
নিভ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে মৌনি মুচকি হাসলো। নিভ্র বললো,

–”সব গুছিয়ে নিয়েছো তো? এখনই রওনা হবো।”

–” Don’t worry , সব গুছিয়ে নিয়েছি। ”

সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো দুজনে। তারপর রওনা হলো রাজধানী ঢাকার উদ্দেশ্যে।

———————————-
গাড়ি ছুটে চলছে তুমুল গতিতে। বাতাসের দাপটে প্রকৃতি হয়ে উঠেছে স্নিগ্ধ। সেই সিগ্ধতা অনুভবের জন্য নিভ্র গাড়ির কাচ খুলে দিতেই অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করলো মৌনির মনে। খোলা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বিধায় নিপুণতার সাথে খোপা করে ফেললো মৌনি। ফর্সা মুখের ওপর এখনও কিছু কাটা চুল পড়ে আছে। নিভ্রর দিকে মনোনিবেশ করে এবার।

নিভ্র আপনমনে ড্রাইভ করছে। ব্লুটুথ সাউন্ডবক্সে বাজিয়ে রেখেছে একটা রোম্যান্টিক সং। নিভ্র ঠোঁট দুটো হালকা চাপ দিয়ে বারবার আয়না দিয়ে পেছনে দেখছে গতিবিধি ঠিক রাখার জন্য। তো একটু পরপর স্টেয়ারিং ডানে তো বামে ঘুরিয়ে দিয়েছে। চোখের পলকও ফেলছে বারবার। নিভ্রকে এই মুহূর্তে অদ্ভুদ সুন্দর লাগছে। এই ছেলেটার সবকিছুই মৌনির কাছে দৃষ্টিনান্দনিক মনে হয়।
প্রকৃতিও যেন উচ্চসবরে বলছে যে,

–”নিভ্র দুর্দান্ত একটা ছেলে। ওর সুদর্শনতা আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রমে যে কেউ পড়তে বাধ্য।”

মৌনির ঘোরলাগা কন্ঠে বললো,
–”আপনার সৌন্দর্য আমায় গ্রাস করে ফেলছে ডাক্তারসাহেব। সমুদ্রের টেউয়ের মতো আপনার সমস্ত সৌন্দর্য মাঝে মাঝে অমৃতের মতো শুষে নিতে ইচ্ছে করে।”
.
.
.
.
.
~চলবে তো?
কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here