হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ২+৩

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব: ২ + ৩
৩.
টেউয়ের তালে কারও শরীরের উষ্ণতা মৌনি প্রবলভাবে অনুভব করতে পারছে।কেউ তাকে বুকের ঠিক বা পাশে পরম আদরে আগলে রাখার কারনে টেউলের তালে সেই আগন্তুকের হৃদয়ের শব্দ যেন চমৎকার সুর সৃষ্টি করেছে। মৌনির কাছে বিষয়টা কোনো ভ্রমের মতো লাগলো। তীর্যকভাবে সূর্যরশ্মিটি মুখে পড়াতে আনমনে চোখ খুলে সে।পরিস্থিতিটা অন্যরকম। নিভ্র নামের সেই ছেলেটা তাকে একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। ছেড়ে দিলেই যেন সে হারিয়ে যাবে। মৌনিকে পিটপিট করে তাকাতে দেখে নিভ্র উৎসুক চোখে তাকায় ওর দিকে। মায়াবী কন্ঠে বলে ওঠে………..
.
—এখন কেমন লাগছে তোমার?
নিভ্রর মায়াবী কন্ঠ শুনে মৌনির যেন ঘোর লেগে গিয়েছে। ছেলেটার কন্ঠে আসলেই জাদু আছে মনে হয়। নাহলে এত সুন্দর,নিখুঁত কিভাবে কারও গলা হতে পারে!নিভ্রর বুক থেকে সরে আসে সে। ঘুমের রেশটি এখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো….
.
—এখন একটু ভালো লাগছে।
—এই নাও। পানির বোতল। মুখটা ধুয়ে নিলে শরীরটা হালকা হয়ে আসবে।
নিভ্র থেকে পানির বোতলটি নিয়ে মৌনি এবার মুখটা ধুয়ে ফেলে। আসলেই মুখ ধোয়ার পর নিজেকে খুব সতেজ অনুভব করতে পারছে মৌনি।
আশেপাশে যেদিকেই তাকাচ্ছে চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। সেই পানির মধ্যেই বয়ে চলছে অনেকগুলো জাহাজ, স্টীমার আর লঞ্চ। মৌনির হঠাৎ একটু অদ্ভুদ অনুভব হতে শুরু করলো। গতকাল ঘোরের মধ্যে তো সে বোকার মতো একটা অপরিচিত ছেলের সাথে যেতে চাইলো। কিন্ত কাজটা কি ঠিক করেছে? মৌনি এবার পুনরায় তাকায় নিভ্রর দিকে। নিভ্র ব্যাগ থেকে কিছু কেক আর বিস্কুট বের করছে। মৌনির দিকে না তাকিয়েই সে বলে………
.
—খাবারগুলো খেয়ে নাও। এমনিতেও শরীর তোমার অনেক দুর্বল।
.
—আ-আসলে কিছু কথা ছিলো।
.
—বলো।
.
—আসলে । আমরা এখন কোথায়? আর কতক্ষণই বা লাগবে?
.
—চট্টগ্রাম বন্দরের সীমান্তে এসে পড়েছি বলতে পারো। এটা প্যাসেন্জার লঞ্চ না তো তাই যেতে আরও দ্রুত সময় লাগবে।
.
—ওহ!
মৌনির আরও কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলো। কিন্ত পেটে তার ক্ষুধা চাড়া দিয়ে বসেছে। তাই নিভ্রর সাথে বসে হালকা খাবার খেয়ে নেয় সে। মৌনির কাছে সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুদ মনে হচ্ছে। খুবই অদ্ভুদ। এই গুরুগম্ভীর যুবকের মায়াবী চরিত্রটা তার বুঝার বাইরে।। কারন মৌনির তাকে বেশি কিছু বলতে হচ্ছেনা। নিভ্র যেন সবই বুঝে যায় ওর মনের কথা। কোনো সুপার পাওয়ার আছে নাকি!
.
—আপনার কাছে কি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা আছে ভাইয়া?
.
মৌনির প্রশ্ন শুনে নিভ্র সেদিকে তাকায়। মৌনির ফ্যালফ্যাল চাহিনী দেখে নিভ্রর বেশ মজা লাগছে। অবাক স্বরে সে ওকে প্রশ্ন করলো……
.
—এমন কেন মনে হলো তোমার?
.
—আপনি যেভাবে আমার সব সমস্যার কথা বুঝছেন সেভাবে একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
.
নিভ্র আলতো হাসে।যারা সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা করে ওদের মনে কৌতুহলটা অনেক বেশিই থাকে। সিটে হেলান দিয়ে নিভ্র বললো……..
.
—তোমার মতো ইয়াং এজ সহ টিনএজের হাজারো ছেলেমেয়েদের ট্রিটমেন্ট করেছি আমি। বিষয়টা আমার কাছে স্বাভাবিক না!
.
—মানে? (কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে) আপনি সাইক্রেটিস্ট নাকি?
.
—জ্বী ম্যাডাম। তাছাড়া সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে নিউ নিউ লেকচারার হিসেবেও জয়েন হয়েছি।
.
মৌনি হতবিধহধস্ত হয়ে তাকিয়ে আছে নিভ্রর দিকে। এই ছেলে একজন সাইক্রেস্টিস্ট তা ওর ধারনার বাইরে ছিলো। আর ওর মতো সামান্য একজন মেয়ের বিপদে কত সুন্দরভাবেই না পাশে দাঁড়িয়েছিলো সে।
,
—কি হলো? কি ভাবছো ?
.
—না। তেমন কিছু না।
.
.
.
৪.
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর। দেশের সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র বন্দরের মধ্যে এটা একটা।মৌনি অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে এই বন্দরটিকে। লঞ্চ ইতিমধ্যে বন্দরে ভীড়তে ব্যস্ত।মৌনি এই প্রথম চট্টগ্রামে এসেছে।তবে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পর্কে ওর জানা ছিলো স্কুলজীবন থেকেই। জাহাজ নির্মান শিল্পের জন্য সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো চট্টগ্রাম বন্দরের নাম।হালিশহর, পতেঙ্গায় দেশীয় শিল্পীর কতৃত্বে অনেকগুলো জাহাজ নির্মান কারখানা যা এখনও আছে কি-না মৌনি তা জানেনা।
আকাশটা এখন বেশ পরিষ্কার। ইংরেজি পরিভাষায় যাকে বলা হয়….”Sunny weather”। নীল আকাশের স্বচ্ছতাটা পানির সাথে একেবারেই যেন মিলে গিয়েছে।
.
মৌনির এতটা অবাক হওয়া দেখে নিভ্র আলতো হাসে। মেয়েটা সম্ভবত নতুন কোনো বিষয়কে গভীরভাবে আগলে রাখতে ভালোবাসে। মিহি কন্ঠে বলে ওঠে……..
.
—Welcome to our district………মৌনি!
.
নিভ্রর মিহি কন্ঠ শুনে মৌনির শিরা-উপশিরা দিয়ে যেন ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেলো। বন্দরের এই সৌন্দর্য থেকে নিভ্রর কাছে ওর নামটি শুনে অন্যরকম লাগছে। এই ছেলেটা খুবই মিশুক। সবার সাথেই নিজের হাস্যোজ্জল মুখ দিয়ে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারে। মৌনি আলতো স্বরে বলে….
.
—ধন্যবাদ।
.
—তো এখন চলো। আমরা নেমে পড়ি ।
.
—হুম…..
.
একথাটা বলে মৌনি উঠতে নিলেই আচমকা ব্যাথায় কুকড়ে উঠে। পায়ের গোড়ালি চেপে বসে পড়ে নিজের যায়গায়। নিভ্র এবার কিছুটা শঙ্কায় পড়ে গিয়েছে মৌনির কাতরতা দেখে। ওর কাছে হাটু গেড়ে বসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে পায়ের গোড়ালি দেখতে। গুলির স্থানটির তুলোর পট্টি খুলে দেখে শুকনো ঘা টি পুনরায় রক্ত দিয়ে ভিজে উঠেছে। নিভ্র এবার খুব সাবধানতার সাথে ব্যাগ থেকে একটা কিট বের করে ঘা এর স্থানটি পরিষ্কার করতে থাকে। নিভ্র কোমলভাবে সেই স্থানটি বারবার তুলো দিয়ে পরিষ্কার করছে যাতে মৌনি সামন্য ব্যথাও যেন অনুভব করতে না পারে।
ক্ষত স্থানটিতে স্যাভলন চেপে ধরতেই মৌনি অস্ফুটস্বরে গোঙিয়ে উঠে। যেন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সে ক্ষতটি। নিভ্রর হাত চেপে কাতরতার সাথে বলে……
.
—আমার খুব ব্যথা করছে নিভ্র ভাই।
.
নিভ্র সাথে সাথেই নিজের হাত থামিয়ে দেয়। মৌনির ব্যথাটা সে যেন সহ্য করতে পারছে না। নিজের কাছেই ব্যাপারটা বেশ আজব মনে হচ্ছে নিভ্রর কাছে। ওদের ট্রেনিংয়ের সময় বারবার বলে দেওয়া হয় পেশেন্ট যতই তোমার কাছের সম্পর্কের হোক না কেন ; তোমাকে প্যাশনেটভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে ; ইমোশনালভাবে নয়।
আর এই বিষয়টি মাথায় রেখে বহু মানুষের ট্রিটমেন্ট করেছে। কেউ কেউ ড্রাগ নেওয়ার জন্য ছটফট করতো……..কেউ আবার বারবার সুসাইড করতে চাইতো……..কেউ কেউ ”নেক্রোফিলিয়া” র মতো ভয়াবহ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতমানুষের সাথে যৌনসঙ্গম করতে চাইতো এমন সব ক্রিটিক্যাল কেসগুলোতে পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট পাষাণ হৃদয় নিয়ে করেছে সে। আর আজ একটি মেয়ের সামান্য কাতরতা ওর সহ্য হলো না?
.
—রিলেক্স ! আমি আর টাচ করবো না। তবে তুলোটা বেধে দেই। এটলিস্ট কোনো ইনফেকশন হবে না।
.
—আচ্ছা ।
.
.
.
৫.
চায়ের স্টলে বসে একরাশ বিরক্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে সবাই নিভ্রর জন্য। আজ অনেকদিন পর ওদের জানের দোস্ত নিভ্র ফিরে আসছে। নিশু এবার ফোস ফোস করে তুর্যকে বললো………..
.
—কিরে তুর্য ? নিভ্রটায় এখনো আসছে না কেন?এদিকে ওর জন্য রোদে দাঁড়িয়ে আমার স্কিন পুড়ে যাচ্ছে।
.
নিশুর কথা শুনে বিরক্ত হয় সোহান। ব্যঙ্গ সুরে বলে…..
.
—এল্লেগাই মাইয়্যা মানুষরে আমি নিয়া আসতে চাইনা যতই আমাগো দোস্তো হোক না কেন? আরে ওই ছেমড়ী ? আজকে কতদিন পর আমাদের দোস্ত আসবো তাই তুই আছোস তোর বদনা মার্কা চামড়া নিয়া?
.
—এক থাপ্পড়ে তোর সবকটা দাঁত আমি ফালায়া দিবো ব্যাটা? আমার স্কিনকে তুই বদনামার্কা চামড়া বলিস কোন সাহসে?
.
—আল্লাহর ওয়াস্তে একটু থামবি তোরা?
লিজা কটাক্ষ গলায় বলে। লিজার রাগ সম্পর্কে সবাই ভালোমতো জানে তাই সোহান আর নিশু চুপ হয়ে গেলো।
.
—ওই দেখ্ । নিভ্র আসতেছে। (তুর্য)
নিভ্র সামনে আসতে আসতেই যেন সবাই বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে যায়। ওরা ভুল দেখছে নাতো। নিভ্রর পিঠে পাতলা গড়নের একটি যুবতী চড়ে আছে। মেয়েটার দুটো হাত নিভ্রর কাঁধ আর গলা জড়ানো। অন্য সবার কাছে বিষয়টা অস্বাভাবিক হলেও ওদের দুজনের কাছে ব্যাপারটা বেশ স্বাভাবিক লাগছে। সোহান মিশুর দিকে না তাকিয়েই বললো……..
.
—ওই নিশু? তুই না আমারে থাপ্পড় দিতে চাইছিলি? জলদি থাপ্পড় দে। আমি বুঝতে চাই কোনো ভুল কিছু দেখছি কি-না।
.
—না-রে সোহান………..আমরা সবাই ঠিকই দেখছি……।
.
—এর মানে ওর পিঠে সত্যিই মনে হয় কোনো পরীর আছড় চেপে বসেছে। কত্ত সুন্দর একটা পরী। ওই পরীটা ওই পাগলের ডাক্তারের (নিভ্রর) পিঠে ভর করলো কেনো………আমি আছি না ! কত্ত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে আমি!
.
সোহানের কদু মাথা যে পুরাই গেসে সবাই তা বুঝতে পারলো। এরে এখন সত্যিই নিভ্র কে দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে । তবে সবার মনেই একটা প্রশ্ন জাগছে……….নিভ্রর সাথে এই মেয়েটি কে?
.
.
.
.
.
~চলবে
ভুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। আজকের পর্বটা অনেক সময় নিয়ে লিখেছি। আপনাদের পর্বটি ভালো লাগবে ইনশাল্লাহ।

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব: ৩
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)

৬.সরু পথের এলোমেলো অঙ্গভঙ্গিতে মৌনি বারবার মিশে যাচ্ছে নিভ্রর সাথে। নিভ্রর উত্তাল নিঃশ্বাস বারবর স্পর্শ করছে মৌনির গলা আর মুখের এক অংশ। নিভ্র এমনভাবে মৌনির বাহু আগলে রেখেছে নিজের সাথে যেন ছেড়ে দিলেই সে হয়তো অটোরিক্সা থেকে পড়ে যাবে।আচ্ছা নিভ্রর এই ছোট ছোট কাজগুলো মৌনির এতটা ভালোলাগছে কেন? নিভ্র যখন নমনীয় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় তোলপাড় করে ওঠে ওর হৃদয়। যেন এই অস্বিত্বটা আজও আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছৈ নিভ্র নামের এই মানুষটার জন্য।
এদিকে নিভ্রর চার বন্ধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে এ দৃশ্য দেখে। নিভ্র কেয়ারিং ব্যাপারটা সম্পর্কে ওরা সবাই ভালোমতো অবগত তবে এই সদ্য যুবতী টাইপ মেয়েটার ক্ষেত্রে তা ভিন্ন রকম। নিভ্র সবই বলেছে ওদের মেয়েটার ব্যপারে। তবুও কৌতুহল যেন কিছুতেই তারা দমিয়ে রাখতে পারছে না।
.
মাথার উপর র তপ্ত রোদ নিয়ে অটোরিক্সাটি এগিয়ে চলছে ভিতরের দিকে যা এসে একটি ব সুপারি গাছের সামলে থামলো। মৌনির হঠাৎ কি হলো বুঝলোনা। আচমকাই ভয় চেপে বসলো মনের মধ্য। যতই হোক নিভ্র একজন অপরিচিত পুরুষ আর ও একটি মেয়ে। মৌনি না নিভ্র সম্পর্কে ভালোমতো অবগত আর না ওর বন্ধুগুলোর সাথে। যদি খারাপ কিছু করে বসে?
.
—কি হলো তোমার? আমরা এসে পড়েছি তো !
.
নিশুর কথা শুনে মৌনি নিশুর দিকে তাকায়। যদিও মেয়েটার নাম সে জানে না। কিন্ত অজান্তেই ওদের সাথে দুটো মেয়েকে থাকতে দেখে মনে একটা ভরসা তৈরি হলো। যতই হোক দুজন মেয়ে কখনোই অন্য একটি মেয়েকে বিপদে ফেলে আসতে পারবে না।
.
সোহান বিরক্ত হয় নিশুর কথা শুনে। কটাক্ষ গলায় ওকে বলে………
—তুই আমারে পাগল কস আর তুই নিজে কিরে? মেয়েটা পায়ে আঘাত পাইছে জানোস না?ঠিকমতো হাটতে পারবে?
.
নিশু একেবারে চুপ হয়ে যায়। নিভ্র সেসব উপেক্ষা করে আবারও কোলে তুলে নেয় মৌনিকে। উচুনিচু রাস্তা পেরিয়ে সামন্য ভিতরে ঢুকতেই মৌনি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। গাছপালার ভীড়ে একতলার মধ্যে হালকা ছিমছাম একটি বাড়ি যা উচু ঢিবিতে অবস্থান করেছে বিধায় দূর থেকে ফার্মহাউসের মতো লাগবে। বাড়িটার চারিদিক সুপারি গাছ দিয়ে বেষ্টিত। মৌনি আশ্চর্য সুরে বলে,,,,,
.
—মাশাল্লাহ্ ! নিভ্র ভাই আপনাদের বাড়িটাতো বেশ চমৎকার?
নিভ্র আলতো হাসে মৌনির কথা শুনে। বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার এখানে ভালোলেগেছে। আসলে জায়গাটিই এমন। কোনো ডিপ্রেসড মানুষ যদি হালকা রিলেক্সের জন্য নিভ্রদের বাড়িতে আসে তবে তারা সবাই নিজের টেনশন ভুলে এই সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে পড়বে।
.
তুর্য বাড়ির তালাটি খুলে দিতেই ভিতরে প্রবেশ করে সবাই। নিভ্র আসবে বলে আগেই তুর্যকে বলেছিলো কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রাখতে। বসার ঘরে রয়েছে কিছুসংখ্যক সোফা, টেবিল আর দেয়াল বিস্তৃত একটি পরিবারের ছবি। সেখানে নিভ্রকে সহ একজন বৃদ্ধবয়স্ক লোক আর অপরূপা সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। আরও দেখা যাচ্ছে দুজনের বাল্যকালীন ছবির সাথে একজন মহিলার ছবি। মৌনির একপ্রকার মনে হলো ওই মহিলার মতই হয়েছে নিভ্রর চেহারটি।
নিভ্র ওকে বারান্দার পাশের একটি বড় ঘরে নিয়ে আসে। রুমটা আসলেই খুব সুন্দর। এক দেয়ালজুড়ে বিস্তৃত রয়েছে হরেক রকমের বাংলা আর ইংরেজী সাহিত্যের বই। খাটের পাশে দেয়ালে বড় করে টাঙানো আছে সেই মেয়েটির হাসিমাখা ছবি।
মৌনিকে খাটে নামিয়েই নিভ্র ওর পাশে বসে। কিন্ত মৌনির যেন সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। নিভ্র ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ছবিগুলোর দিকে তাকায়।
.
—আমার বড় বোনের ছবি এগুলো।
নিভ্রর কথা শুনে মৌনি তাকায় ওর দিকে। সে নির্লিপ্তভাবে বসে থাকলেও চোখে-মুখে প্রকাশ পাচ্ছে একপ্রকার মলিনতার ছাপ। নিভ্র আবারও বলে………
.
—মা কে হারিয়ে ফেলেছিলাম অল্প বয়সেই। তারপর আপু আর বাবাই ছিলো আমার পুরো পৃথিবী। সে অনেক আগের কথা। দু বছর আগেই আপু আর বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।
.
থেমে যায় নিভ্র। স্পষ্টভাষী মানুষের মতো সে কথাগুলো বললো। চোখে-মুখে প্রকাশ করছে সে যেন অনুভূতিশূণ্য। মৌনি এ ব্যাপারে বিনিময়ে কিছুই বলে না। কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে মৌনি বলে ওঠে………..
.
—আমি একটু ফ্রেস হতে চেয়েছিলাম। গতকাল থেকে একই জামা পড়ে আছি; কেমন যেন ময়লা ময়লা লাগছে। আপনি কি ওই আপুদের ডাকতে পারবেন?একটু হেল্পের প্রয়োজন ছিলো।
.
—আচ্ছা তুমি বসো। আমি ডেকে দিচ্ছি…………
.
.
.
৭.
মৌনির কাছে নিভ্রকে দুর্দান্ত একটি ছেলে মনে হয়। ওর প্রতিটা কাজকরহমেই যেন চিৎকার দিয়ে বলছে…….”নিভ্র একটা চমৎকার ছেলে”। ছেলেটার কথার বাচনভঙ্গি, কখনও কখনও গম্ভীরতা ; আবার কখনও কখনও স্বতস্ফূর্ত হাসি সব মিলিয়ে ছেলেটা যেন আবেগ-অনুভূতির বাহার। কখন কোন পরিস্থিতিতে কি রিয়্যাক্ট করতে হবে সবই ওর কাছে যেন দুধভাত টাইপের। সোফার এক কোণে গুটিশুটি মেরে আড়চোখে বারবার আড়চোখে নিভ্রকে দেখছে মৌনি।
বাকি সবাই নিজ আলাপনে ব্যস্ত। সবাই মূলত কথা বলছে ওদের ভবিষ্যৎ লাইফপার্টনার কেমন চায় এ নিয়ে।
.
—আমি একটা হাবাগোবা ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। আমি যাই করিনা কেন ; কিছুই বলতে পারবে না। সারাদিন আমার আঙ্গুলের ওপর নাচবে। (নিশু)
.
—কোনো নাচনেওয়ালা বিয়ে করবি নাকি? আমার কথা শোন…………একটা কসমেটিকওয়ালারে বিয়ে কর। তো যা কসমেটিক লাগে রে বইন ! বাপ রে বাপ , আমি আমার ব্র্যান্ডেড আন্ডারপ্যান্ট কিনতেও এর থেকে কম খরচ করি। (তুর্য)
.
—তোরে চুম্মা দিতে মন চাইতাসে দোস্ত। এক্কেবারে ঠিক কথা বলছোস……(সোহান)
.
—চুপ কর শালা। কিছু হলেই খালি জড়াজড়ি-চুম্মাচুম্মি করতে মন চায়। আমি কি মাইয়্যা নাকি ! শালা গে কোথাকার। (তুর্য)
.
—ওই কুত্তা ! কোন সাহসে তুই আমারে গে কইলি? (সোহান)
.
—তো কি বলবো? একটা উচিত কথা কইলেই আমারে চুম্মা দিতে মন চায় তোর। ক’দিন পর তো বলবি যে আমার সাথে বাসর করবি।
.
মৌনি শুধু পারছে না হো হো করে হাসতে। কিন্ত এদিকে নিভ্র তো হেসে কুপোকাত। মৌনি আবার তাকায় নিভ্রর দিকে। ছেলেটার প্রাণখোলা হাসি দেখে ওর খুব ভালোলাগছে। প্রজেক্ট আর ক্রাইমের চাপে একটা লম্বা সময় জীবনটা উপভোগ করেনি সে। লিজা এবার বলে ওঠে………
.
—নিভ্র? তুই কি টাইপ পার্টনার চাস।
.
সবাই এবার নিভ্রর দিকে দৃষ্টিপাত করে। নিভ্র কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে প্রতিউত্তরে বলে…………
.
—তেমন কিছু এখনও ভাবিনি।
.
—বয়স তো ২৮ হয়ে এলো। বুড়া হয়ে বিয়ে করবি নাকি চিরকুমার থাকার প্ল্যান আছে?
.
—উহু……….বিয়ে তো করবোই। এই পৃথিবীতে কেউ একা থাকতে পারে না।আর প্রত্যেরকটা ছেলের লাইফেই একজন মেয়ে প্রয়োজন হয়। ছোটবেলায় থাকে মা…….কিশোর বয়সে বোন………..যৌবনকালে স্ত্রী আর বার্ধক্যে স্ত্রী অথবা সন্তান। নারী ছাড়া প্রত্যকটা ছেলেই অগোছালো যতই সে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করুক না কেন ! আমার গোছালো লাইফটা আরও গোছালো করার জন্য একজনকে তো আমার চাই।
.
—কবে আসবে সে?
.
—হয়তো এসে পড়েছে! .
.
নিভ্রর কথায় মৌনির স্বাভাবিক বুদ্ধি যেন হারিয়ে গেলো। নিভ্রর সাথে কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই শরীরটা গুলিয়ে যাচ্ছে ওর। এ কি মায়ায় ফেলে দিয়েছে নিভ্র ওকে?মাথাটা এক হাত দিয়ে চেপে ধরতেই নিভ্র তা দেখে সাথে সাথে মৌনির কাছে যায় সে।এহেন কাজে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। নিভ্র ওর ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বলে……
.
—কি হলো? মাথা ব্যথা করছে?
.
—হুম……..কিন্ত হঠাৎ কেন হলো ? বুঝলামনা।
.
নিভ্র বুঝতে পারলো আবারও কোনো খারাপ স্ট্রেস নিয়েছে সে। মৌনিকে নরম সুরে তাই বললো……….
.
—-কিছুক্ষণ রেস্ট নাও তুমি। তাছাড়া রাত হয়ে গিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। হাঁটতে পারবে………?
.
—হ্যাঁ। তবে…..
.
—আচ্ছা আমি তোমার হাত ধরছি।
.
নিভ্র হাত ধরেই আস্তে আস্তে রুমে আসে সে। বাম পায়ের গোড়ালিতে সামান্য চাপ লাগলেই অনেক ব্যথা হয় মৌনির। তবুও নিভ্রকে তা বুঝতে দেয়নি। আজ হঠাৎ ওর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। হয়তো এসময় ওর বাবা-মাও ঠিক এ কাজ করতো। কিন্ত সেদিকে নিভ্র নিতান্তই অন্য মানুষ।
মৌনি খাটে শুয়ে পড়তেই নিভ্র ওর গায়ে কম্বল জরিয়ে দেয়। মৌনি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিভ্র মায়াবী সুরে ওকে বলে…….
.
—তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। লিজাও তোমার সাথে ঘুমাবে। তাই ভয় পেয়ো না। Good night,,,,,,,
.
নিভ্র উঠে চলে যেতে নিলেই হাতে টান অনুভব করে। মৌনি ওর হাত চেপে আছে। কাতর স্বরে বলে…….
.
—আমি সুস্থ হয়ে যাবো তো?যদি ওরা আবার আমায় খুঁজে পায়?
.
নিভ্র স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এই মিষ্টি মুখের ভয়টা যা একেবারে বেমাননসই। নিভ্র এবার হাত চেপে ধরে মৌনির। মিহি কন্ঠে বলে………
.
—তোমার শুভাকাঙ্খী হিসেবে থাকবো সবসময়। থাকবো তোমার হৃদয়ের সিন্ধু পাড় হিসেবে।❤️
.
.
.
.
.
~চলবে
রাতে আরও একটি পার্ট দেয়ার চেষ্টা করবো।গল্পটা কেমন লাগছে আপনাদের কিছু বুঝতে পারছি না । গুটিকয়েক গঠনমূলক মন্তব্য ছাড়া সবগুলো nice, nxt , n ইত্যাদিতে ভরপুর। তবে কি ভালোলাগছে না?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here