আলো_আঁধার পর্ব ১০

#আলো_আঁধার [১০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

দীপ্ত আজ ভীষণ খুশি। আলোকে যে লোকটা কষ্ট দিয়েছিল, সে আজ লোকটাকে আলোর থেকেও দশগুণ বেশি কষ্ট দিয়েছে। আজ তো মাত্র প্রথম দিন ছিল। আরোও কয়েকদিন লোকটা টিকে থাকলে এই কষ্ট দশগুণ থেকে একশো গুণে পৌঁছে যাবে। হাসি হাসি মুখে সে আলোর ঘরে এলো। এতদিন মনের মধ্যে যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল আজ তা নিভে গেছে। কিন্তু আলোর গম্ভীর মুখ দেখে তার খুশি গুম হয়ে গেল। কী হয়েছে আলোর? আবার মেজ মা কিছু বলেছে নাকি?

-“আলো, কিছু হয়েছে?”

চিন্তিত আলো বলল,

-“দীপ্ত দিয়া কোথায়? এবাড়িতে আসার পর একবারও দিয়াকে দেখলাম না। ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?”

দীপ্ত কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতে পারল না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। দিয়া স্মৃতি হয়ে তার মনের গুপ্ত ঘরে এখনো বেঁচে আছে। তাই দিয়ার কথা সে মনে করতে চায় না। দিয়া পৃথিবীতে তার চোখের সামনে নেই তো কী হয়েছে? মনের চোখে তো চাইলেই সে যেকোনো সময় দিয়াকে দেখতে পারে। তার জন্য অকালে দিয়াকে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে, এটা মনে করলে দীপ্তর নিজেও শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে। তার একমাত্র আদরের ছোট বোন। যাকে সে পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ভালোবাসত। সেই বোন তার কারণেই আজ বেঁচে নেই। তার ভুলের জন্য দিয়াটাকে জীবন দিতে হলো। এটা কখনও ভুলতে পারবে না সে।
আলো পলকহীন ভাবে দীপ্তকে দেখছিল। হঠাৎ দীপ্তর চেহারার মেঘ আলোর চোখ এড়ালো না। সে কি কোন ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে?

-“দিয়া আমাদের মাঝে নেই আলো। সে এখন অন্য জগতের বাসিন্দা।’

আলো থমকে গেল। অন্য জগতের বাসিন্দা! তার মানে কি দিয়া বেঁচে নেই? তার চোখের সামনে সদাহাস্যজ্বল সেই মেয়েটির চেহারা, ওর বলা প্রতিটা কথা, ওর দুষ্টুমি, ওর হাসি সব ভেসে উঠছে। তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হওয়ার পর দিয়া একদিন মজা করে বলেছিল,

-“তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে আলো। আমার একটা পাগল ভাই আছে। ভাবছি ওকে দিয়ে তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার কাছে নিয়ে যাব। দু’জন একসাথে মজা করে সময় কাটাব।’

আলো মজার ছলে কথাটা সিরিয়াসলি নেয়নি তখন। দিয়াও যে সত্যিই তার মনের কথা বলছিল এটা সে বুঝতেই দেয়নি। তার মত বয়সের মেয়েটা, দুনিয়ায় নেই?
দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না আলো। বেড ধরে বসে পড়ল। দীপ্ত ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।

-“সেদিন যখন তোমার বিয়ের আসর থেকে আমি রাগ করে চলে আসছিলাম, তখন দিয়াও এসে আমার গাড়িতে উঠেছিল। ছোট্ট মেয়েটা গাড়িতে বসে আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, দেখ ভাইয়া আলো তোর ভাগ্যে নেই। ভাগ্যে থাকলে তুই ঠিকই আলোকে পেতি। যেকোনভাবে আলো ঠিকই তোর হতো।’

দীপ্তর গলা যেন একটু কেঁপে গেল। আলো মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করার মত শক্তি পাচ্ছে না।

-” আমার ছোট বোনটা। শুধু আমার কারণে মারা গেছে। আমি ওর খুনি। রাগের মাথায় ওভারে গাড়ি না চালালে অ্যাক্সিডেন্ট হতো না। আর দিয়াও মারা যেত না।”

-“অ্যাক্সিডেন্ট!’

-“হুম। আমার গাড়ি ঠিক কিসের সাথে ধাক্কা খায় তা আমি নিজেও বলতে পারব না। হয়তো আমার হায়াত ছিল বলেই আমি সেদিন ছিটকে গাড়ি থেকে বেরিয়ে দূরে গিয়ে পড়ি। দিয়া গাড়িতেই ছিল। সাথে সাথেই মারা গিয়েছিল। গাড়িতে আগুনের লেগে গেলে ওর বডিটাও সেই আগুনে পুড়ে যায়৷ আমি তিনমাস কোমায় ছিলাম। ছোট মা নিজের মেয়ের পোড়া বডি দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে থেকেই ছোট মা কেমন অদ্ভুত আচরণ করে। এই কাঁদে তো এই হাসে। চিৎকার করে, একা একা কারো সাথে কথা বলে। তিন মাস পর আমার জ্ঞান ফেরার পর যখন জানতে পারলাম শুধু আমার কারণে আমার বোনটা মারা গেছে, তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিল। কয়েকবার সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিলাম। আসলে আমিও ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে কিছুটা ছোট মা’র মত অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়েছিলাম। অনেক ডাক্তারকে দেখিয়ে বাবা দাদু আমাকে সুস্থ করে তুলেন।”

আলোর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সবকিছুর জন্য এখন তার নিজেকে অপরাধী লাগছে। দীপ্তকে সে সেদিন বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে যা-তা বলে অপমান করেছিল। সে যদি দীপ্তকে অপমান করে তাড়িয়ে না দিত তাহলে তাদের অ্যাক্সিডেন্ট হতো না। আর দিয়াও আজ বেঁচে থাকত। ওসবে তো ওই মেয়েটার কোন দোষ ছিল না। তাহলে বিনা দোষে ওই মেয়েটা কেন শাস্তি পেল? কেন?

-“ছোট মা একা সময় দিয়ার সাথে কথা বলে। ছোট মা’র কাছে এখনো দিয়া জীবিত। দিয়াকে দেখতে পারেন তিনি। আমরা কেউ পারি না। কীভাবে পারব বলো, মেয়েটা এই পৃথিবীতে থাকলে তো ওকে দেখতে পেতাম। দু’টা বছর ধরে ছোট মা’র চিকিৎসা চলছে। তবুও ছোট মা’র অবস্থার এতটুকু উন্নতি হচ্ছে না। ছোট মা’র সামনে যেতে পারি না আমি। কোন মুখে যাব? ছোট মা’র একটামাত্র মেয়েকে আমিই তো মেরে ফেলেছি। আমার জন্যই তো ছোট মা’র এত কষ্ট। আমার জন্যই তো আমার হাসিখুশি ছোট মা পাগল হয়ে গেলে।”

আলো এখন বুঝতে পারছে এই বাড়ির মানুষ গুলো কেন তাকে এতটা ঘৃণা করে। কেন মেজ চাচী সেদিন ওকে এতগুলো কথা শুনিয়েছে। তার জন্য এ বাড়ির মেয়ে মারা গেছে। ছেলেটাও মরতে মরতে বেঁচে এসেছে। ওই কথাগুলো খুব কম ছিল। তাকে কীভাবে লোকগুলো বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে! তাকে যদি এখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, তবুও সে অবাক হবে না। মানুষগুলোর প্রতি তার কোন অভিযোগ থাকবে না।
আলো কাঁদছে। দীপ্তরও চোখ লাল হয়ে গেছে। সে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
____________________________

শুভ্র তার সম্পূর্ণ মনোযোগ সামনের রাস্তাটায় দিয়ে রেখেছে। পাশের সিটের মেয়েটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চিন্তিত মুখে ড্রাইভ করছে। রাহা চুপ করে বসে থেকে কতক্ষণ এক ধ্যানে শুভ্রকে দেখল। ছেলেটা মানুষ নাকি অন্য কিছু? মানুষ হলে একবার হলেও তার মত সুন্দরী মেয়ের দিকে আড়চোখে হলেও তাকাত। সে তো তাকাচ্ছেই না উল্টো এমন ভাব করছে যেন তার আশেপাশে কেউ নেই। রাহা নামের কোন মেয়েকে সে এই জন্মে চিনে না। রাহা শেষমেশ নিজে থেকেই কথা বলল,

-” শুভ্র! ”

রাহার দিকে তাকাল না শুভ্র। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে দেখল। রেড সিগন্যাল পড়েছে। থামতে হবে। সে বলল,

-” হুম।”

-“তুমি কি এলিয়েন? ”

-“কেন? ”

-” না। আমার মনে হয় তুমি অন্য কোন গ্রহের প্রাণী। তুমি পৃথিবীর মানুষ হও।”

-” কেন এরকম মনে হয় তোমার?”

-“আমি কি তোমার দেখা যথেষ্ট সুন্দরীদের মধ্যে পড়ি না? হতে পারে আমার থেকেও অনেক সুন্দরী মেয়েদের সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে। তাই বলে কি আমি এতটা ফেলনা? ”

-” তুমি ফেলনা হলে আমার মা নিশ্চয় তোমাকে ছেলে বউ হিসেবে পছন্দ করতেন না।”

-“মা পছন্দ করেছে বলেই কি তুমি বিয়েটা করতে রাজি হয়েছ? তোমার নিজের কোন পছন্দ নেই? আই মিন তোমার কখনও কাউকে ভালো লাগেনি?”

-” সময় পাইনি রাহা। আরও কয়েকটা বছর সময় পেলে অবশ্য ওসব নিয়ে ভাবতাম।”

-“তুমি আশ্চর্য মানুষ। তোমাকে আমি বুঝতে পারি না।”

-” চেষ্টা করতে থাকো আস্তে আস্তে একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাহা।

-” হুম চেষ্টাই তো করে যাচ্ছি।”

-” তুমি কি আগে শপিংমলে যাবে? তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি ক্লিনিকে যাব? নাকি আমার সাথে যাবে?”

-” তোমার সাথে যাবার জন্যই তো একসাথে এসেছিলাম। বিয়ের শপিং আমি একা করব। তোমার কি বেশি দেরি হবে?”

-” না। এক ঘন্টা বা তার থেকেও কম সময় লাগতে পারে। ”

-“তাহলে আগে ক্লিনিকে চলো।”

রাহা মনে মনে শুভ্রকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে। কিন্তু কোনোদিনও মুখে বলেনি। শুভ্র ওরকম ছেলে না। সে সবার থেকে আলাদা। আর তাই তো এত অবহেলা সহ্য করেও সে শুভ্রকে ভালোবাসে। শুভ্র যে শুধু তাকে অবহেলা করে এমনটা না। শুভ্র পৃথিবীর কোন মেয়ের দিকেই ভালো করে তাকায় না। সেই সময় কই ওর? ছোটবেলায় পড়াশোনা ওর ভালোবাসা ছিল। আর এখন তার ডাক্তারি পেশা। তার রোগীদের নিয়েই শুভ্র খুশি। বিয়ের বয়স হয়েছে, মা মেয়ে পছন্দ করায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে। কোন আপত্তি বা নিজের পছন্দের কথা জানায়নি।

-” শুভ্র!”

-“বলো।”

-” কেমন মেয়ে তোমার পছন্দ? ”

প্রশ্নটা শুনে ভাবনায় পড়ে গেল সে। কিছুক্ষণ ভেবে বলল,

-“যে আমার মাকে নিজের মা’র মতন সম্মান করবে। আমাকে বুঝবে। এবং মা’কে আর আমাকে ভালোবাসবে।”

-“ব্যস! এইটুকুই? ”

-“আর কি?”

-“মেয়েটা সুন্দর হবে? লম্বা হবে? লম্বা নাক, কোমর পর্যন্ত চুল…

-“ওসব তো বাহ্যিক সৌন্দর্য রাহা। মনের সৌন্দর্য হলো আসল৷ বাইরের সৌন্দর্য কতদিন থাকবে? বয়স বাড়ার সাথে সাথে গায়ের চামড়াও কুঁচকে যায়। মনটা কিন্তু সারাজীবনই একরকম থাকে।”

রাহা মুগ্ধ হয়ে ছেলেটাকে দেখছে। এই ছেলেটা এমন কেন? কেন তাকে এভাবে পাগল করলো?
রাহা শুভ্রর দিকে চেয়ে মনে মনে বলল,

-“আমি তোমার মনের মত হয়ে উঠব শুভ্র। তুমি যেমন চাইবে আমি নিজেকে সেভাবেই বদলে ফেলব। আমিই তোমার পারফেক্ট লাইফ পার্টনার হয়ে উঠব।”

চলবে___

বানান ভুল ক্ষমা করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here