মেঘের পরে মেঘ-৩৩

মেঘের পরে মেঘ -৩৩

নুরসহ ওর পরিবারের সবাই চলে গেছে।আত্নীয় স্বজন যারা ছিলো তারাও চলে গেছে। বাড়ি এখন সম্পূর্ণ খালি।মা বাবা নিজেদের রুমে।
নিজেকে শাড়ি গয়নাগাটি থেকে মুক্ত করে একটা হট শাওয়ার নিয়ে নিলো রুপসা।এখন ফ্রেশ লাগছে।ফোস করে দম ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।
হাতের আংটিটার দিকে নজর পরতেই সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলো রুপসা।প্লাটিনামের উপর ডায়মন্ড বসানো আংটি।বেশ দামী নিঃসন্দেহে।কিন্তু প্রলয়ের এসব হীরে প্লাটিনামের চেয়ে স্বর্ন বেশি পছন্দের ছিলো। কারন ওর ধারনা ছিলো স্বর্নের গয়নায় যেসব সুন্দর সুন্দর ডিজাইন হয় তা নাকি ডায়মন্ডের গয়নার সম্ভব নয়।
কে বলেছে হয় না বলে রুপসা প্রতিবাদ করতেই সাথে সাথেই মত পাল্টে ফেলেছিলো প্রলয়।বলেছিল,”আচ্ছা, তাহলে তোমার ডায়মন্ড পছন্দ? এটা জানার জন্যই তো বললাম।ঠিক আছে। আমাদের এনগেজমেন্টে আমি তোমাকে ছোট ছোট অনেকগুলো ডায়মন্ড বসানো একটা আংটি দেবো।”

রুপসা কোন প্রতিবাদ করেনি।মুখ নিচু করে মিস্টি করে হেসেছিল শুধু। অথচ আজ ওর এনগেজমেন্ট হলো নুরের সাথে।এই আংটিটার মধ্যেও ছোট ছোট অনেকগুলো ডায়মন্ড বসানো মাঝের ডায়মন্ড টা বড়।খুব সুন্দর একটি আংটি।অথচ এর সৌন্দর্য রুপসাকে খুশি করতে পারছে না।চোখ বেয়ে পানির ধারা বয়ে চলেছে শুধু। বুকে অজস্র কস্টেরা এসে ভীড় করেছে।থেকে থেকে শুধু একটা কথাই মনে হয়,প্রলয় কেন এমন করলো ওর সাথে? এতোটা কস্ট কি না দিলেই হতো না?আমাকে কাঁদিয়ে নিশ্চয়ই খুব সুখে আছো?থাকো, খুব সুখে থাকো।তোমার রুপসা অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে, অন্য কেউ তাকে স্পর্শ করবে,তুমি এসব সহ্য করবে এখন।আগে তো কেউ আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকালেও তোমার সহ্য হতো না।এখন কি করবে প্রলয়?
পরক্ষনেই নিজের মাথায় আলতো করে চাপড় মারে রুপসা।ধুর, আমিও যে কি না?তুমি আর কি করবে?তুমি তো জানোই না আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।জানলেই বা কি করতে স্যার?কিছু করার থাকতো না তোমার।তুমি তো অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী। অন্য কাউকে নিজের বুকে জায়গা করে দাও ঘুমানোর জন্য। সেখানে রুপসা নামের কারো অস্তিত্ব নেই।
এ্যাই প্রলয় শুনছো?আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলছি।কতো না ইচ্ছে ছিলো তোমার আমার মুখে তুমি ডাক শোনার।শুনো,আমি তোমাকে তুমি বলছি।কেন বলছি জানো?
আর কিছুদিন পর আমার বিয়ে।তোমাকে তুমি বলার সুযোগ তো আর হবে না।তাই এখন ই বলে নিচ্ছি।
অস্ফুট স্বরে নিজের মনেই বিরবির করে রুপসা।
আর অবাধ্য চোখের পানি রা নিজের মনে বালিশ ভিজিয়ে চলে।

_______

“এ্যাই অফ হোয়াইট শাড়ি টা কেমন? মেরুনের কন্ট্রাস্টে বেশ ভালো লাগছে কিন্তু? ”
নুর বলে রুপসাকে।

“আপনার যে টা ভালো লাগে সেটাই নিন।”
মৃদুস্বরে বললো রুপসা।

“কেন?তোমার পছন্দ হয় নি?তাহলে অন্য টা নেই?”

“না না তা নয়।এটা তো বেশ সুন্দর।অন্য টা যদি নিতে চান তো নিন।কিন্তু এই শাড়িটাও কিনতে হবে।”

“ঠিক আছে ম্যাম।তাই হবে।”
বলেই অন্য শাড়ি গুলোর দিকেও নজর বুলালো নুর।এরপর সেখান থেকেই আর চারটা শাড়িসহ অফ হোয়াইট শাড়ি টা নিয়ে নিলো।
আরো কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে ওরা অন্য একটা দোকানে ঢুকলো।নুর কি কি যেন চাইছে দোকানীর কাছে।
রুপসা লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।কেন যেন এই শপিং করতে ওর একদম ভালো লাগছে না।কেন লাগছে না? পাশের লোকটা নুর বলে? আজকে যদি নুর না হয়ে প্রলয় ওর পাশে থাকতো তবেও কি রুপসা এতোটাই নির্লিপ্ত থাকতো?
কিছুই ভালো লাগছে না।কিন্তু তা প্রকাশ করার কোন উপায় নেই।আজকের কেনাকাটার জন্য বাড়ি থেকে ওদের দুজন কেই পাঠানো হয়েছে।

বিয়ের কেনাকাটা বলতে শুধু কয়েকটা উপহারের শাড়িই বাকি ছিলো সেটাও আজ কমপ্লিট।বিয়ের আর মাত্র চারদিন বাকি।সমস্ত আয়োজন শেষ।
এখন শুধু অপেক্ষা।

দিন যত এগিয়ে আসছে ততই যেন বুকের ভার বেড়ে চলেছে রুপসার।সব ঠিক থাকবে তো?নতুন জীবনে অতীত কোন ঝড় তুলবে না তো?

_______

আজ রুপসার গায়ে হলুদ।হলুদ রঙের কাতান শাড়ি,সাথে খয়েরী রঙের ব্লাউজ আর ফুলের গহনায় রুপসাকে রুপের রানী লাগছে।ফুলেল কারুকাজে ভরা স্টেজ টায় যখন ও বসলো তখন যেন মুহূর্তেই চারিপাশ আলোকিত হয়ে উঠলো।
শত শত ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানি চারিদিকে। রুপসার নিজেকে একটা রোবট মনে হচ্ছে।যার কাজই অন্যের দেয়া ফাংশনে কাজ করা।হাফ ধরে যাচ্ছে। মনের অজান্তেই দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসতে চায়। চারিদিকে এতো আলো থাকা সত্ত্বেও বেহায়া মনের এক কোন জুড়ে অন্ধকার।সেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে রয়েছে একজন।তাকে বহু চেষ্টাতেও সরাতে পারছে না রুপসা।মনে মনে শিউরে উঠছে রুপসা।আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে চলেছে অনর্গল।
নতুন জীবনে যেন পুরোনো কোন কিছুর ছোঁয়া না সে প্রার্থনাই করে যাচ্ছে পরম করুনাময়ের কাছে।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে যায়।নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় একটু শুতেই নুরের কল এলো মোবাইলে। রুপসা দেখলেও ধরার জন্য ব্যস্ত হলো না।বরং মোবাইলের রিং টোন সাইলেন্ট মুডে রেখে দিলো।

এর কিছুক্ষনের মধ্যেই শায়েরী ঢুকে ঘরে।কানের কাছে মোবাইল রাখা।কারো সাথে কথা বলতেই বলতেই ঘরে ঢুকেছে।মোবাইল টা নিচে নামিয়ে হাত ধরে চেপে ধরে রুপসার দিকে এগিয়ে এলো। রুপসা সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে নিরবে অশ্রু বির্সজন দিয়ে যাচ্ছে।
ঘরে কেউ ঢুকেছে এ দিকে ও কোন খেয়াল আছে কি না বোঝা গেলো না।
শায়েরী মেয়েকে ডাকলো না।
ওপাশের ব্যক্তিকে বললো,
“বাবা,ও তো ঘুমিয়ে গেছে।তাই হয়তো তোমার কল রিসিভ করতে পারে নি।সেই সকাল থেকে একটুও রেস্ট পায়নি।ক্লান্ত লাগছে বোধহয়।বুঝোই তো।”

ওপাশ থেকে নুর মৃদু হাসলো।
“সমস্যা নেই আন্টি। ও ঘুমাক।আমি সকালে কথা বলে নেবো।”

“ঠিক আছে।”

বলেই কল কাটলো শায়েরী।এরপর মেয়ের পাশে এসে মাথায় হাত রাখলো।
“কি হয়েছে রুপ?মন খারাপ? ”

কথাটুকু শেষ হতে না হতেই রুপসা মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পরলো।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
জড়ানো গলায় বলতে লাগলো,

“আমার ভীষণ কস্ট হচ্ছে মা।ভীষণ কস্ট হচ্ছে। প্রলয় কে ছাড়া আমি কি করে বাঁচবো মা?কিভাবে নুরের সাথে মানিয়ে নেবো? আমার তো অনেক কস্ট হচ্ছে মা।কি করে কি করবো?”

রুপসা কেঁদেই চলে।শায়েরী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।কাঁদতে কাঁদতে একসময় রুপসার কান্না থামলো।এখন শুধু হেঁচকির শব্দ শোনা যাচ্ছে,, শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। শায়েরী আরো একটু সময় নিয়ে মেয়েকে বোঝালেন।

“সব ঠিক হয়ে যাবে মা।তুই ভেঙে পরিস না।প্রলয় যদি বিয়ে না করে কোথাও হারিয়ে যেতো বা নিখোঁজ থাকতো তাহলে সারাজীবন ও যদি তুই অপেক্ষা করতে চাইতি আমি রাজি হতাম।এখানে তো অপেক্ষার কিছু নেই মা।ও ওর নতুন জীবনে ভালো আছে।তাহলে তোর খুশি থাকতে সমস্যা কোথায়?আর একা একা এতো বড় একটা জীবন পাড়ি দেওয়া তো যায় না মা। আর মা বাবা হিসেবে আমাদের ও তো মন চায় তোকে খুশি দেখার। বিয়ের আগের প্রেমই কি শুধু প্রেম?বিয়ের পরেও তো প্রেম হয় না?ভালোবাসা হয় না?হয়।সবই হয়।একটু নিজেকে সময় দে।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মায়ের কথায় ঠান্ডা হয় রুপসা।শায়েরী দু-হাতে মেয়ের চোখের পানি মুছে দেয়।রুপসার কপালে চুমু খেয়ে আবারো হাত বুলিয়ে দেন।

“এখন ঘুমিয়ে থাক।কাল তো খুব সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে।”

মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় রুপসা।তারপর বালিশে মাথা এলিয়ে দেয়। শায়েরী ঘরের লাইট বন্ধ করে দরজা লাগিয়ে চলে যায়।

পরদিন সকালে শায়েরী মেয়েকে ডাকতে গিয়ে দেখেন রুপসা বিছানায় নেই।প্রথমে ভাবলো ওয়াশরুমে হয়তো কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই খেয়াল করলো ওয়াশরুমে কেউ নেই।শায়েরী ভাবলো হয়তো বাগানের দিকে গেছে।রুপসা প্রায় ভোরবেলায়ই বাগানে হাঁটাহাঁটি করে। মিনিট দশেকের মধ্যে শায়েরী পুরো বাড়ি খুঁজেও রুপসাকে পেলো না এবং পরবর্তী আধঘন্টায় সবাই জানলো রুপসা বাড়ির কোথাও নেই।যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে রুপসা।

চলবে…….

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here