তোমার সমাপ্তিতে আমার প্রাপ্তি ৩ পর্ব -০৩+৪

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩

পর্ব (৩)

তিহি বেহুঁশ হয়ে সোফা থেকে পড়ে যেতে নিলে ইশাদ বাহু আঁকড়ে ধরল। নিজের কাঁধের সাথে চেপে ধরলে পাশে এসে বসলেন রুকমিনি মুখার্জি। মাথা টেনে ধরে বার কয়েক বার ‘তিহি’ বলে ডাকলেন। কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হলেন। পর মুহূর্তে অস্থির হয়ে বললেন,
” ডাক্তারকে কল দিতে হবে! আমার ফোনটা কোথায়? ”

তিহিকে ফেলে তাপান মুখার্জির নিকট ছুটলেন বিদ্যুৎগতিতে। উত্তেজিত হয়ে বললেন,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছ যে? আমার মেয়েটার চিকিৎসা দরকার। ডাক্তারকে কল দাও। ”

তাপান মুখার্জির ভাবভঙ্গিতে চিন্তা দেখা গেল না। বরঞ্চ বিরক্তি জড়ো হলো ভ্রু জোড়ার মধ্যিখানে। তিনি ধীরপায়ে হেঁটে আসলেন তিহির দিকে। মেঝেতে পড়ে থাকা তাজের ছবিখানা তুলে কোর্টের একদিকে এমনভাবে ঘষলেন যেন কত বছরের ময়লা জমেছে! সেভাবেই বসার রুম ত্যাগ করলেন। স্বামীর এহেন আচরণে বিস্মিত হলেন রুকমিনি মুখার্জি। পরক্ষণে পূর্বের ন্যায় চপলতা দেখা দিল দেহ ও মনে। নিজের ফোন খুঁজতে শুরু করলে ইশাদ বলল,
” অস্থির হবেন না, আন্টি। আপনি ভুলে যাচ্ছেন এ বাসায় একজন ডাক্তার থাকে। ”

কথাটায় রুকমিনি মুখার্জি যতটা স্বস্তি পেলেন ততটাই চমকিত হলেন ইশাদের কোলে তিহিকে দেখে।

তিহিকে নিয়ে সোজা চিলেকোঠায় উঠে এলো ইশাদ। বিছানায় আলতো করে শুয়িয়ে দিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা শুরু করল। ততক্ষণে রুকমিনি মুখার্জি, শাহিনা শাইখা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ইশাদ তাদের দিকে তাকালেও কথা বললেন রুকমিনির মুখার্জিকে উদ্দেশ্য করে,
” ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। সকাল থেকে না খেয়ে আছে তার মধ্যে..”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইশাদ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বলল,
” হালকা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। ”

ইশাদের কথাটা শেষ হতেই রুকমিনি মুখার্জি এমনভাবে ছুটলেন যেন এই ফরমায়েশটার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন। তার পিছু পিছু শাহিনা শাইখাও গেলে, অন্য একটি নারী ছায়া লক্ষ্য করে ইশাদ। ছায়ার দিকে দৃষ্টি রেখে তিহির পাশ থেকে উঠে আসে। দরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে রুবিনা দাঁড়িয়ে আছেন। বিষণ্ণ মুখখানায় রাজ্যের জড়তা। শাড়ির আঁচল মুখের একপাশ দিয়ে টেনে মুখের ভেতর গুঁজে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
” আপনি? কিছু বলবেন? ”

ইশাদের কণ্ঠস্বরে বেশ চমকালেন রুবিনা। মৃদু কম্পনটা স্পষ্ট চোখে পড়ল ইশাদের। তার ভয় কাটাতে আন্তরিকতা বাড়িয়ে দিতে চাইল ইশাদ। ভীষণ নম্রস্বরে বলল,
” ভেতরে এসে বসুন, আন্টি। ”

রুবিনা জায়গা থেকে নড়ল না। শাড়ির আঁচলটা আরেকটু টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। ইশাদ এবার বাইরে এসে দাঁড়াল। রুবিনার দিকে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে মৃদু হেসে বলল,
” আমার মনে হচ্ছে, আমার সামনে মিহি দাঁড়িয়ে আছে! ”

মিহির প্রসঙ্গ উঠতে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করল রুবিনা,
” মিহি কোথায়? ”

ইশাদের মৃদু হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। এই এতক্ষণ পর মনে হলো মিহির বিয়ে সম্পর্কে আসল মানুষকেই জানানো হয়নি। মুহূর্তে অনুতাপের অদৃশ্য রঙ ছড়িয়ে পড়ল মুখজুড়ে। সেই রঙ মেটাতে রুবিনাকে জোর করে ভেতর রুমে আনল ইশাদ। খাটের কিনারে বসিয়ে ইমদাদ আর মিহির বিয়ের ঘটনা খুলে বলল। সবটা শোনার পর ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলেন কতক্ষণ। বিনাবাক্যে বসা থেকে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। কী ভেবে দরজার মুখের কাছে গিয়ে থামলেন। ঘাড় ঘুরে তাকালেন ইশাদের দিকে। কিছু একটা বলার পুরো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও না বলে দরজা পার হলেন। সিঁড়ি মুখের কাছে পৌঁছাতে পেছন থেকে শুনতে পেলেন,
” মিহির সাথে কথা বলবেন? কল দেই? ”

___________
ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়ল ইমদাদ। মিহিকে খাটে শুতে বলবে নাকি নিজে শুবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে একার সংসার দেখে দু-কামড়ার ফ্ল্যাট নিবে ভেবেও নেওয়া হয়নি। নিজের বেখেয়ালিপনায় নিজেকেই ভুগতে হচ্ছে! সে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির দিকে তাকাল। মেয়েটা খাটের এক কোণে বসে ঝিমুচ্ছে। যেকোনো সময় খাট থেকে পড়ে যেতে পারে। শেষে না মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ইমদাদ বাড়তি ঝামেলা থেকে মুক্ত পেতে ধমকের সুরে বলল,
” বসে ঘুমাচ্ছ কেন? শুতে পারছ না? ”

মিহি অনুমতি পেয়ে খাটের অর্ধেক দখল করে শুলো। চোখ বন্ধ করে আবার মেলল। ভার গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আমি কি ঐ বাসায় আর যাব না? ”

ইমদাদ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। রুমের আলো নিভিয়ে সুইচবোর্ডের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থেকে আচমকা বিড়বিড় করল, ‘ নিচে শুতে হবে কেন? ঐটুকু মেয়ের পাশে শুয়ে কী আর হবে? আমার রুচি কি এত খারাপ হয়ে গেছে যে বাচ্চার শরীরের গন্ধে বেতাল হয়ে যাব? আমার প্রিয়া আছে। আজ হয় হয়নি তো কাল হবে। ”

ইমদাদ দমকা নিশ্বাস ফেলে খাটের কাছে এগিয়ে গেল। মিহির থেকে বেশ দূরত্ব রেখে একদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে নিতেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ইমদাদ চমকে খাট থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। নিজেকে দ্রুত সামলে ফোন ধরল। কল রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ইশাদ বলল,
” মিহিকে দে। ”

ইমদাদ ফোন কানে নিয়েই মিহির দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে ভারী নিশ্বাস ফেলছে। চোখ ফিরিয়ে বলল,
” মিহি ঘুমাচ্ছে। ”

ঠিক তখনই চিৎকার করে উঠল মিহি,
” আমি জেগে আছি। ”

ইমদাদ আরও একবার চমকাল। অবাক চোখে তাকাল মিহির দিকে। যন্ত্রের মতো ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” ইশাদ কথা বলবে। ”

মিহি চট করে উঠে বসল। ফোন কানে ধরে বলল,
” ইশাদ ভাইয়া, কী কথা বলবে? ”
” আমি তোর মা বলছি। ”

মায়ের কণ্ঠ পেয়ে মিহির উচ্ছ্বসিত ভাব-সাব হারিয়ে গেল। মন খারাপের সুরে ডাকল,
” মা!”

তারপর আর কোনো কথা বলতে হয়নি মিহির। চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুধু মায়ের কথা শুনে গেল। মাঝেমধ্যে ‘আচ্ছা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে অনুভব করল তার বিয়ে-সংসার-দায়িত্ব সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগছে। অথচ কয়েক ঘণ্টা পূর্বে বউ সাজার সময় এই কথাগুলোই তার ভালো লাগেনি। বার বার স্বামীর জায়গায় ইশাদের মুখটা কল্পনা করতে বললেই তার রাগ হয়েছে। মায়ের ভয়ে প্রকাশ করতে পারেনি। মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আমি বিয়ে করতে চাই না মা। ইশাদ ভাইয়াকে আমার ভাইয়া ডাকতে ভালো লাগে। তুমি কেন ভাইয়া ডাকতে মানা করছ?

মায়ের সাথে কথা শেষ করে ফোন ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখে ইমদাদ গভীর ঘুমে ডুবে আছে। মিহি বুঝতে পেরেও হালকা স্বরে ডাকল,
” এই যে, শুনছেন? ”

ইমদাদ কোনো উত্তর দিল না। শুধু কপাল থেকে হাতটা শরীয়ে বুকের উপর রাখল। মিহি সেই হাতের উপর নখের আঁচড় টেনে লিখল, ‘ আমার স্বামীর নাম ইমদাদ। ‘

___________

ইশাদের সামনে রুবিনার কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল বুঝতে পারে ইশাদ। তাই তাকে ব্যক্তিগত সময় দিয়ে তিহির পাশে এসে বসে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে চুলে আঙুল ডুবায়। অজান্তেই ঠোঁটদুটো ছুটে যায় তিহির কপালে। তারপর কানের কাছে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
” এত ভয় পেলে চলবে তিহিপাখি? এবার যে ভয়কে জয় করতে হবে। অসুস্থতাকে হারিয়ে সুস্থ হতে হবে। ”

ইশাদের কণ্ঠস্বর মস্তিষ্কে পৌঁছাতে সাড়া দিল তিহি। আধো চোখে তাকাল ইশাদের দিকে। তারপরেই চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেলে দিল ইশাদের উরুতে। শেরওয়ানির এক অংশ খামচে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,
” তোমাকে পাশে পেলে আমি সব পারব। ”

ইশাদ মুচকি হাসল। কোমল স্বরে কিছু একটা বলতে গিয়ে সামনে তাকায়। দরজার সামনে রুকমিনি মুখার্জিকে দেখতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লজ্জা,ভয়, অস্বস্থিতে বিশাল দেহখানা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যেন! এক প্রকার জোর করেই তিহিকে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। টেনে টেনে বলল,
” প্লেটটা আমার কাছে দিন। আমি খায়ি…”
” তুমি এখন যেতে পার। বাকিটা আমি সামলে নিব। ”

ইশাদের নরম দৃষ্টি শক্ত হয়ে আটকায় রুকমিনির মুখে। তারপরে তিহির দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে বের হয়ে আসে।

_________
ঘুম থেকে উঠে সোজা গোসলখানায় ঢুকেছিল ইশাদ। শরীর ভিজিয়ে সাবান লাগাতে কড়াঘাত পড়ে বন্ধ দরজায়। বার বার ‘কে’ জিজ্ঞেস করার পরও বাইরের মানুষটির থেকে কোনো উত্তর পায়নি। তন্মধ্যে দরজায় আঘাত করতে করতে ভেঙেই ফেলবে এমন অবস্থা! সে বাধ্য হয়ে দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিতে চাইল। তার আর সুযোগ হলো না। তিহি জোরপূর্বক গোসলখানার ভেতরে ঢুকে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি কোথাও যাব না। আম্মাকে বলে এসো আমি তোমার সাথে থাকব। ”

ইশাদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই অনুমান করে ফেলল তিহিরা আজ চলে যাচ্ছে। তার মন খারাপ হলো, বুকে ব্যথা উঠল, সেই ব্যথাকে উপেক্ষা করে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তিহির অশ্রুতে ভেজা মুখটায়। আপনমনে বিড়বিড় করছে, ‘ তুমি অন্য কাউকে ভালোবেসেছ তিহি, তার জন্য পরিবার ছেড়েছ, সকলকে ফাঁকি দিয়ে সংসার করেছ, ইনার মা হয়েছ। এই সব কিছু জেনেবুঝে কী করে তোমাকে আটকাব? কোন অধিকারে বলব, তিহি আমার কাছে থাকবে? ‘

ইশাদের মন যখন নানা ভাবনায় ব্যস্ত তখন তিহির চিন্তা-ভাবনা পিছিয়ে গেল সেই দিনটিতে। যেদিন তিহিরা এ বাসায় উঠেছিল। এই গোসলখানায় গোসল করছিল। ইশাদের মতো এমন সাবান মাখা শরীরে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়েছিল। মুহূর্তেই ইশাদের করা সেই প্রথম চু্ম্বন চোখের তারায় স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। শরীরজুড়ে শীতল শিহরণ ছুটে চলতে তিহি নিজেকে ভুলে গেল, পরিস্থিতি ভুলে গেল, সম্পর্ক ভুলে গেল। সবকিছু ভুলে গিয়ে অমস্মাৎ গভীর চুমু খেল ইশাদের ঠোঁটে।
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৪)

তিহির অকস্মাৎ ওষ্ঠ চুম্বনে ইশাদের চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। ভালোবাসার এক নিষিদ্ধ অধিকার চেপে বসল অন্তরে। মস্তিষ্কের প্রাচীরগাত্রে একটাই নাম ঠাসাঠাসি হলো, সে হলো তিহি!

” তিহি? কোথায় গেলি, মা? ”

রুকমিনি মুখার্জির ডাকাডাকিতে সম্বিৎ ফিরল ইশাদের। তিহিকে চট করে সরিয়ে নিল নিজের কাছ থেকে। দরজার দিকে চোখ ফেলে বলল,
” তোমার আম্মা আসছে! ”

তিহি নির্ভাবনায় বলল,
” তো? ”

ইশাদ দরজা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল তিহির মুখপানে। সন্দেহ চাহনি ফেলে বলল,
” তোমার ভয় করছে না? ”
” কিসের ভয়? ”
” আমাদের দুজনকে একসাথে দেখা ফেলার ভয়। ”
” এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? ”
” ভয় পাওয়ার নেই? ”

তিহি ইশাদের দিকে একপা এগিয়ে আসল। তার বুকে লেগে থাকা সাবানের ফ্যানা হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
” না। আমরা তো ভালোবাসছি। আম্মা আমাদের ভালোবাসার কথা জানেন। ”

কথাটা বলেই ইশাদের ভেজা বুকে মাথা রাখল তিহি। আহ্লাদি হাসতেই ইশাদ কাঁপা স্বরে বলল,
” জানে বলেই আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে! ”

তিহি মাথা তুলল। গভীরভাবে খেয়াল করল ইশাদের কণ্ঠনালী কাঁপছে! সেই কণ্ঠনালিতে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
” আমি কোথাও যাব না। আমি আমার নষ্ট পুরুষের কাছে থাকব। ”

মুহূর্তে ইশাদের বুকটা গাঢ় ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হলো। মাকড়শার মতো নতুন উদ্যমে জাল বুনতে ইচ্ছে হলো। তার নরম শরীরটুকু দু-হাতে আগলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ কোথাও যেতে দিব না। তিহিপাখি তুমি আমার কাছে থাকবে। আমার বুকের খাঁচায় বন্দী হয়ে। ‘ তা আর বলা হলো না। রুকমিনির গলার স্বর এদিকে জোরাল হয়ে বাজতে তিহিকে গোসলখানা থেকে বের করে দিল ইশাদ। সজোরে দরজা আটকে নিশ্বাসটুকু আটকে নিল।

______
রুকমিনি মুখার্জি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তিহির হাত চেপে ধরলেন। তিহির জেদ ধরতে ইচ্ছে হলো, পালিয়ে যেতে ইচ্ছ হলো, ছুটে গিয়ে ইশাদের বুকে পড়তে ইচ্ছে হলো। অথচ এতগুলো ইচ্ছে চাপা পড়ল নিবিড় অভিমানে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইশাদের দিকে। ছলছল চোখে বিস্ময় ভর্তি চাহনি! যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এই মানুষটা তাকে আটকাছে না। একবারের জন্য বলছে না, ‘ তিহি থেকে যাও। ‘ তিহি সদর দরজার আড়ালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইশাদের চোখে আকুলতা খুঁজছিল। তার জন্য একটু ব্যাকুলতা! কিন্তু পেল কি?

তিহিদের গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার শব্দ পেতে শাহিনা শাইখা ইশাদের কাছে ছুটে এলেন। কিছু বলার আগেই ইশাদ বলল,
” ওর স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন, আম্মু। মারা যাননি। ”

_________
প্রিয়াকে নিয়ে একটি কফিশপে এসেছে ইমদাদ। দ্রুত কফি অর্ডার করে ওয়েটারকে বিদায় দিল। চোখে-মুখে দুষ্টু ভাব নিয়ে প্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। হাতটা ধরতে প্রিয়া অভিমানের ভাব ধরে বলল,
” ছুঁবে না আমাকে। ”

ইমদাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল এমন ভাবে বলল,
” কেন? ”
” কাল আমার ফোন ধরোনি তাই। ”

ইমদাদ মিথ্যে অভিনয় করে বলল,
” তুমি কল করেছিলে, আর আমি ধরিনি? এত বড় অন্যায় কী করে করলাম? আমার নামে তো কেস হওয়া উচিত। থানায় এখনই যাবে নাকি কফি খেয়ে? ”

প্রিয়া কিছু বলার আগেই ইমদাদ গালে চুমু খেয়ে বলল,
” কফি খেয়ে যাবে তাই তো? আমি জানি তো। দেখ, কী সুন্দর তোমার মনের কথা বুঝে গেলাম? উফ! আমি তোমাকে এত কেন ভালোবাসি! ”

ইমদাদ মুখটাকে এমন ভাব করল যেন বেশি ভালোবাসা লজ্জার ব্যাপার! প্রিয়া গলে গেল। অভিমান ভুলে আহ্লাদে ঢলে পড়ল ইমদাদের কাঁধে। আপ্লুত গলায় বলল,
” আমার বাবুটা একটুতে বেশি সিরিয়াস হয়ে যায়। কল না ধরলে কেস করতে হয় নাকি? ”

ইমদাদ বরফ আরও দ্রুত গলানোর জন্য উত্তপ্ত বাড়িয়ে বলল,
” অবশ্যই করতে হবে। তোমার কল না ধরা খুনের চেয়ে বড় অপরাধ। খুনের আসামীকে মুক্তি দিলেও আমাকে দেওয়া যাবে না৷ ”

প্রিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে ইমদাদ শান্তি পেল। মনে মনে বলল, ‘ আমি কেন ডাক্তার হলাম? আমার তো অভিনেতা হওয়া উচিত ছিল। ‘

ঠোঁটে কুটিল হাসি নিয়ে প্রিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিল ইমদাদ। ঠোঁটে চুমুটা এখনই খাবে নাকি কফি দিয়ে যাওয়ার পর এই চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে সময়টুকু গণনা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে ফোন বাজল। হিসাবনিকাশে ভীষণ ব্যস্ত থাকায় ফোনের রিংটোন টের পাচ্ছিল না। প্রিয়া বাধ্য হয়ে বলল,
” তোমার ফোন বাজছে। ”

ইমদাদ ভারি বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। ভেবেছিল কেটে দিবে, কিন্তু ইশাদের নাম দেখে কাটতে সাহস পেল না। রিসিভ করে বলল,
” হ্যাঁ, বল। ”
” কোথায় আছিস? ”
” হসপিটালে। ”
” আমিও তো হসপিটালেই। তোর চেম্বারে আছি। ”

ইমদাদ প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে টেনে টেনে বলল,
” তুই হসপিটালে? ”
” হ্যাঁ। তুই কি পেশেন্টের কাছে? কোন ওয়ার্ডে? ”

ইমদাদ কী বলবে খুঁজে পেল না। মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়ে গলা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ! তাৎক্ষণিক কোনো উপায় না পেয়ে বলল,
” আমি তো বাসায়। ”

ওপাশ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল,
” বাসায়! মাত্রই না বললি হসপিটালে? ”
” ছিলাম। একটু আগে চলে এসেছি। ”

ইশাদ আর কথা প্যাঁচাল না। সরাসরি বলল,
” ঠিক আছে। আমি বাসায় আসছি। ”

ইশাদ কল কেটে দিলে ইমদাদ টুপ করে বসে পড়ল। সেই সময় প্রিয়া বলল,
” তুমি ঘামছ কেন, বাবু? কী হয়েছে? এনিথিং রং? ”

প্রিয়ার কথার উত্তর দিতে পারল না ইমদাদ। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল মিহিকে রুমে রেখে বাইরে থেকে তালা মেরে এসেছে। ইমদাদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে প্রিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
” সব রং, বেবি। তুমি বিল দিয়ে দিও। ”

ইমদাদ ছুটে বের হলে পেছন থেকে প্রিয়া চিৎকার করল,
” মানিব্যাগটা তো নিয়ে যাও। ”

ইমদাদ পেছন ঘুরল না। মানিব্যাগ নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করল না। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, ‘ ইশাদের আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। ‘

_______
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে পারল না ইমদাদ। নিজের ভুলের জন্য কপাল চাপড়ে, বিনয়ের সাথে জানাল, ভেতর থেকে এনে দিচ্ছে। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল একটা মানুষ বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে দোতলায় উঠে যাচ্ছে।

ইমদাদ জানত তার আগেই ইশাদ পৌঁছে যাবে। তবুও মনে মনে হাজার বার দোয়া করছিল যেন ইশাদ তার পেছনে থাকে। কোনো ঝামেলা না হয়। এবারের মতো বেঁচে যায়। তার সেই দোয়া কবুল হলো না। দরজায় তালা ভাঙা দেখে ইমদাদ পাথরের মতো জমে গেল। শরীরের বল হারিয়ে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুকনো গলায় ঢোক গিলতে গিলতে ভবিষ্যৎ কল্পনা করছে। ইশাদের হাতে মার খেয়েছে অসংখ্যবার কিন্তু এবার তার থেকে ভয়ংকর কিছু হবে না তো?

” ঐ তো উনি এসে গেছেন। ”

মিহির গলা পেয়ে ইমদাদ ভয়ে কুঁচকে গেল। ইচ্ছে হলো এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কোন দিক দিয়ে পালাবে? ইমদাদ পালানোর সুযোগ পেল না তার আগেই ইশাদ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। শক্ত হাতে ইমদাদের কাঁধ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” দরজায় তালা ছিল কেন? ”

ইমদাদের মনে হলো ইশাদের হাতের চাপে পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। বুকের হাড়গুলো এখন মড়মড় শব্দ করে ভেঙে ঝরে পড়বে। সে অসহায় চোখে তাকাতেই মিহি বলল,
” তোমাকে বললাম না আমি ঘুমিয়েছিলাম? তালা না দিলে তো চোর এসে সব নিয়ে যেত। তাই তালা দিয়েছিলেন। ”

ইমদাদ এতক্ষণে ঠোঁট নাড়ল,
” হ্যাঁ, তাই তো। মিহি বুঝে গেল আর তুই বুঝতে পারলি না? দেখলি আমাকে কত ভালোবাসে? না বলতেই সব বুঝে যায়! ”

ইশাদ সন্দেহ চোখে তাকাল। পরক্ষণে দৃষ্টি নরম করে বলল,
” তোদের দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। ”

ইমদাদ জোর করে হাসল। নিজেকে ছাড়িয়ে মিহির একটা হাত ধরল। মিষ্টি করে বলল,
” ভেতরে চলো, বউ। ”

মিহি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ভেতরে ঢুকল। পেছন পেছন ইশাদ আসলে বলল,
” ইশাদ ভাইয়া, তোমরা কথা বলো। আমি আসছি। ”

মিহি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে ইমদাদ বলল,
” হঠাৎ আমার হসপিটালে গেছিলি যে, কিছু হয়েছে? ”

ইশাদের হাসি হাসি মুখটা মুহূ্র্তে মলিন হয়ে গেল। একটা ব্যথা হৃদয়ে ঝিম ধরিয়ে দিল। ভার গলায় বলল,
” তোকে অনেক কিছু বলার আছে। ”
” বল। ”

ইশাদ বলার জন্য প্রস্তুত হতে ইমদাদের নজর গেল দরজার পেছনে। যেখানে কাগজ টানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ বাইরে থেকে তালা মেরে যাচ্ছি। একদম চুপচাপ থাকবে। বাইরে থেকে কেউ যেন তোমার গলার স্বর না পায়। ‘ এমন কঠিন সতর্ক দেওয়ার পরেও ইশাদ কী করে জানল মিহি ভেতরে আছে? এই প্রশ্নটা যেমন মাথায় আসল তেমন ভয়ও পেল এই ভেবে যে, ইশাদ না আবার দেখে ফেলে!

ইমদাদ ইশাদকে থামিয়ে বলল,
” চল, ছাদে যাই। খোলা হাওয়ায় মনোযোগ বেশি দিতে পারব। ”

ইশাদ আর দ্বিমত করল না। তিহির ব্যাপারে মিহি না জানলেই ভালো।

ছাদের রেলিং চেপে ধরে একটানা সবটা বলতে থাকে ইশাদ। তিহির অতীত শুনতে শুনতে ইমদাদের নজর গেল ছাদের অন্যপাশে। রুম্পি দাঁড়িয়ে আছে। সে এ বাড়ির মালিকের মেয়ে। ইমদাদ যখন নতুন উঠেছিল তখন থেকেই ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভাব তো দূর, প্রশ্ন করলে কখনও উত্তরই পায়নি। সেই মেয়ে আজ সকালে নিজ থেকে এসে বলল,
” তালা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে? ”

ইমদাদ অবাক হয়েছিল, খুশিও। সেই খুশিতে ভুল করে রুমে তালা মেরেছিল। আসলে ভুল নয়, মেয়েটিকে খুশি করতে তালা মেরেছিল। সাথে এটাও ভেবেছিল, দরজা খোলা থাকলে রুম্পি জেনে যাবে মিহির কথা। যে মেয়ে ইমদাদ ব্যাচেলর জেনেও পাত্তা দেয়নি, সে মেয়ে ম্যারিড শুনলে তো দূর দূর করবে! সে চাচ্ছিল না দূর হতে। মেয়েটা যখন এতগুলো দিন পর নিজ থেকে কথা বলতে এসেছে সেহেতু একটা সুযোগ নেওয়াই যায়। সেই সুযোগ নিতে গিয়ে যে তার নাস্তানাবুদ হতে হলো এর দোষটা সম্পূর্ণ গিয়ে পড়ল রুম্পির উপর। বিরক্তে চোখ ফিরিয়ে নিবে তখনই কলার চেপে ধরল ইশাদ। তর্জন করে বলল,
” সালা, এখনও ঠিক হোসনি? তোর চোখদুটো আজ আমি উপরেই ফেলব। ”

চোখ উপড়ে না নিলেও একটা ভারি ঘুষি পড়ল ইমদাদের নাকে। মাথাটা পেছনে বেঁকে গিয়ে দেয়ালে লাগল। আরেকটা ঘুষির প্রস্তুতি নিতে মিহি দৌড়ে এলো,
” ইশাদ ভাইয়া, তিহি আপু কল করেছে। ”

মিহিকে দেখে ইশাদ নিজেকে সংযত করে নেয়। তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে ইমদাদের কাছে ছুটে যায় মিহি। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কী হয়েছে আপনার? এভাবে পড়ে আছেন কেন? ”

ইমদাদ তার উত্তর না দিয়ে ইশাদকে বলল,
” কী হলো চুপ করে আছিস কেন? তিহির সাথে কথা বল। ”

ইশাদ ইমদাদের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল,
” হ্যালো? ”

সাথে সাথে ওপাশ থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল তিহি। নাভিশ্বাস তুলতে তুলতে বলল,
” আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। ”

চলবে
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here