তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২১
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে। নভেম্বর কেটে ডিসেম্বর। চারিদিক এখন শীতের প্রবণতায় জড়। রোজ সকালে ধোঁয়ার মত ঘন কুয়াশায় ডাকা থাকে চারিদিক। পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সন্ধ্যা নেমে আসে। অন্ধকারে ডেকে যায় চারপাশ। বিকাল হতে না হতেই দোকানীরা ফুটপাতের পাশে পিঠার দোকান নিয়ে বসে। ভাপা পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণে মো মো ফুটপাত। বৃদ্ধাদের গরম কাঁপড় পরে রাস্তার ধারে আগুন জ্বালিয়ে শীত কমাতে আপ্রাণ চেষ্টা। ভোরের শিশির ছুঁয়ে যায় দূর্বাঘাস। সময়ের সাথে আরসাল সায়রার সম্পর্কের গভীরতাও বেড়েছে। দুই বাড়ির মাঝেকার আড়ষ্টতা সংকোচ কাটছে ধীরেধীরে ।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সূর্যের তাপ কমে কুয়াশা নামছে। থমথমে মুখ নিয়ে তুর্জয়ের বাবা মায়ের সামনে বসে আছে আরমিন। সামনের টেবিলে চায়ের কাপ থেকে ঘন ঘন ধুঁয়া উড়ছে। আরমিনের গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথা নুয়ে ওড়ানার কোণা শক্ত করে চেপে বসে আছে। তুর্জয়ের মা লতিফা ভীষণ সৌখিন মানুষ। চিন্তাভাবনাও ভীষণ ব্রাইট। যুগের সাথে পা মিলিয়ে চলতে জানেন তিনি। তার মতে, “ছেলেমেয়েরা তাদের মনের কথা বাবা মায়ের সাথে শেয়ার করবেনা তো কার সাথে শেয়ার করবে?” হাসি হাসি মুখ করে বললেন তিনি,
–” এখানে দেখাদেখি কি আছে। মেয়ে আমাদের ভারি পছন্দ। তুর্জয়ের পছন্দই আমাদের পছন্দ। আমরা আরো আগেই সম্বন্ধ নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সায়রা বলল সামনে আরমিনের ফাইনাল এক্সাম তাই দেরী করা।”
দাদী বিচলিত স্বরে বললেন,
–” রিদ্ধির পায়ে একটু সমস্যা আছে জানেন নিশ্চিয়!”
লতিফা বেগম স্মিত হেসে জবাব দিলেন,
–” আমরা সায়রা থেকে সবটা শুনেছি। তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এক্সিডেন্ট যেই কারো সাথে ঘটতে পারে। তা হাইলাইট করে কারো গুনগুলোকে কেন অদেখা করা?”
লতিফা বেগমের কথায় ভীষণ খুশি হলেন নুরজাহান বেগম। পাশ থেকে সিন্থিয়াও প্রশান্তির হাসি হাসলেন। মনে মনে এমনি একটা পরিবার আরমিনের জন্য খুঁজছিলেন তিনি। যে আরমিনের ক্ষুদ গুলোকে হাইলাইট না করে তার গুণ গুলো দেখবে। নুরজাহান বেগম হাসি মুখ করে বললেন,
–” তুর্জয় আরমিনকে পছন্দ করে সায়রা তা আগে থেকেই জানতো?”
–” হ্যাঁ, সায়রা থেকেই সবটা শুনেছি আমরা। সত্যি আপনাদের পারিবারিক শিক্ষার তারিফ করতে হবে। ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভদ্র শান্ত। আ’ম ইম্পেসড। ভীষণ শান্ত বুঝদার মেয়ে সায়রা।”
গর্বে বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল নুরজাহান বেগম। এসব প্রশংসার সকল কৃতিত্ব তার কড়া শাসনের। সিন্থিয়া তো সারাবছর অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সংসারের দিকে মন কই তার? সংসার তো তিনিই সামলায়। অতিশিক্ষিত চাকরীজিবী বউ ঘরে আনলে এই এক জ্বালা। শুধু রান্নাবান্না ঘর গোছানোই কি সংসার? এসব ভেবে তৃপ্তির হাসি হাসলেন নুরজাহান বেগম।
.
ক্লাস শেষে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে সায়রার। গায়ে ভারী সিঁদুর লাল কাশ্মীরি শাল। বাহিরে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। শালের ভেতর হাত ঘুটে শীতে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ঢুকছে সায়রা। মনটা বেশ ফুরফুরে। আজ তুর্জয়ের বাড়ি থেকে আরমিনের জন্য সম্বন্ধ এসেছে। তার উপর টিউশন শেষে আরসালের সাথে বাড়ি ফিরেছে। এতে খুশি দ্বিগুণ হয়েছে। হাতের নীল কাঁচের চুড়ি গুলো বারবার দেখছে আর মিটমিট হাসছে সে। মানুষটা এমন অদ্ভুত কেন? কি জানি সব ছেড়ে সায়রার হাতের প্রতি তার এত নেশা কেন! যখনি দেখা হবে তখনি হাত সাজাবে কখনো ফুলের মালা বেঁধে আবার কখনো কাঁচের আর কুন্দনের চুড়ি দিয়ে। আরসালের দেওয়া চুড়ি আর হাত সাজানোর উপহারে আলমারীর বড় তাকটা ভরে গেছে সায়রার। সেইদিন মানা করায় যা রাগটাই না দেখল সায়রাকে! কি যে পাগলমো করে মানুষটা!
নিজের ঘরে ডুকেতেই বিছানায় আরমিনকে দেখতে পেল সায়রা। কাঁধ থেকে ঝুলন্ত ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখল। গা থেকে শালটা ছাড়াতে ছাড়াতে হাসি হাসি মুখ করে আরমিনের উদ্দেশ্যে বলল সায়রা,
–” কি গো হবু নতুন বউ! বিয়ের কথা হতে না হতেই মুখ লজ্জায় লাল!”
অপর পাশ থেকে আরমিনের গম্ভীর আওয়াজ এলো,
–” তুর্জয় ভাই আমাকে ভালোবাসে তুই আগে থেকে জানতি সায়রা?”
–” জানতাম কি তুর্জয় ভাই সবার আগে আমার কাছেই তোমাকে ভালোবাসে তা স্বীকার করেছিল।”
–” আর তুই বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে বললি, তাইতো ?”
সায়রার ভ্রু কুঁচকে এলো। আরমিনের কন্ঠে ক্রুদ্ধতার আবাস। ছোট থেকে এক সাথে বড় হয়েছে দুজন। আরমিন কখনো সায়রার সাথে এই টোনে কথা বলেনি। তবে হ্ঠাৎ আজ কেন? সায়রা কি কিছু ভুল করেছে? তুর্জয় ভাইয়ের বাড়ির লোক কি উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে আরমিন আপুকে। কিন্তু সেদিন তো সব ঠিকই ছিল। লতিফা আন্টি জানাল উনাদের আরমিন আপুকে ভীষণ পছন্দ! তবে আজ এমন কি হলো যার জন্য আরমিন আপু এত রেগে! বিস্মিত হয়ে ভাবল সায়রা।
সায়রা আরমিনের হাত ধরতেই, সায়রার হাত ছিটকে দেয় আরমিন। চিৎকার করে বলতে লাগে,
–” নিজেকে কি ভাবিস তুই? সবার জীবন তোর ইচ্ছেমত চলবে? তুই যা চাইবি তাই হবে? সবার লাইফ কন্ট্রোল করতে পারবি তুই? তুই কেন বাড়িতে তুর্জয়কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বলেছিস?”
সায়রা এবার কেঁদেই দিলো, বুঝানোর স্বরে আরমিনকে বলল,
–” বিশ্বাস করো আপু, আমি তুর্জয় ভাইকে আগেই বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে বলিনি। আমি বলেছিলাম প্রথমে যেন তোমাকে জানায়, তারপর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। পরে যখন তুর্জয় ভাই রিজেক্টের ভয় করে জোর দিয়ে বলল, আগে পারিবারিক ভাবে সবটা হেন্ডেল করবে তারপর তোমাকে জানাবে। তাই আমিও আর মানা করিনি। তুর্জয় ভাই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে আপু!”
সায়রার কথায় আরমিন প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। এগিয়ে এসে সায়রার কাঁধ ঝাঁকিয়ে চিৎকার স্বরে বলল,
–” আমি তুর্জয় ভাইকে ভালোবাসি না সায়রা! আমি অন্যকাউকে ভালোবাসি। প্রচণ্ড ভালোবাসি তাকে! শুনেছিস তুই?”
সায়রা প্রচণ্ড বিস্ময়ে পাথর হয়ে রইল। আরমিন সায়রাকে ছেড়ে ঘরের যা সামনে পাচ্ছে সব কিছু ভাঙচুর করছে। ক্রোধে আজ সে পাগল। বেশ শান্ত মেয়ে বলেই আরমিনকে চিনতো সায়রা। আজ তার এই অগ্নিরূপ থেকে পুরোপুরি আশ্চর্য সে। যে মেয়ে উঁচু স্বরে আজ অবধি কারো সাথে কথা বলেনি। সেই মেয়ে কিনা আজ এমন পাগলামো করছে? ঘরের জিনিস ভাঙচুর করছে। আরমিনের এমন রূপ দেখে জড়সড়ভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। চোখ থেকে অনবরত জল পড়ছে তার। এই মুহূর্তে আরমিনকে প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে সায়রার। বার বার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে কাকে ভালোবেসে এমন পাগলামো করছে আরমিন!
শান্ত মানুষ সাধারণত স্রোতহীন নদীর শান্ত জলের মতই নীরব থাকে। যখনি তাদের ভেতর সহ্য সীমানা অতিক্রম করে তখনি তারা অগ্নিগিরির জ্বলন্ত লাভার রূপ নেয়। আরমিন সেই শ্রেণীরই মানুষ। আজ তার সব সহ্য সীমানা অতিক্রম করেছে। জ্বলন্ত অগ্নিগিরির রূপ নিয়েছে সে।
এদিকে আরমিন চিৎকার করছে।
–” আমার কমতির সুযোগ নিয়ে ছোট থেকে সবাই যার যার সিদ্ধান্ত আমার উপর ঠেলে দিচ্ছে। আমি কি চাই, না চাই কেউ একটাবার ভেবে দেখেছে? মানুষ না আমি? রাস্তার জানোয়ার মনে হয় আমাকে? কারো কথা মানবো না। কারো কথা না। আমি ভালোবাসি তাকে। আমার তাকে চাই!”
পুরো ঘর এলোমেলো হয়ে আছে। আরমিন হাডবোর্ডের ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাড়িয়ে রাগে গরগর করছে। পেছনের ড্রেসিংটেবিলের আয়না নড়বড় করছে। মাসেক খানিক আগে ড্রেসিংটেবিলের আয়না ভেঙেছে। চার পাঁচদিন হলো নতুন আয়না লাগানো হয়েছে। পিয়াস লাগিয়েছে, ভালো করে লাগাতে পারিনি সে। মাহির আহমেদ বলেছে সার্ভিসিং এর লোক ডেকে ঠিক করে নিবে। ব্যস্ততায় আর ডাকা হয়নি। আয়নাটা নড়বড় করছে সামান্য ধাক্কা লাগলেই পড়ে যাবে। সায়রা তা লক্ষ করেছে। আরমিনকে সেখান থেকে দূরে সরাতে তার দিকে আসতেই আরমিন সায়রাকে জোরে ধাক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেড়ে দুজন দু দিকে পরে। আরমিনের মাথা বিছানায় লেগে কপাল কাটে। আর অন্যদিকে পেছনের আয়নার সাথে ধাক্কা লেগে সায়রা নিচে পরে। তার শরীরের ডান পাশটায় পড়ে আয়না। কাঁচ ভেঙ্গে শরীরে ঢুকেছে। চুড়ি ভেঙ্গে হাতে বিঁধেছে। শরীর থেকে গরগর করে রক্ত যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে সায়রার, নিশ্বাস থেমে থেমে যাচ্ছে। আধবোজা ঘোলা চোখে দেখল সায়রা। আরমিনের কপাল কেটে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পরে আছে । মনে পরে গেল ছোট বেলার সেই ইন্সিডেন্টের কথা। উঠে আরমিনের দিকে যেতে চাইল সায়রা। কিন্তু শরীরের শক্তি সাঁই দিলো না তার। ধপ করে আবারো কাঁচের উপর পড়ে গেল সে। চোখ বুজে এলো। তলিয়ে গেল গভীর অন্ধকারে।
বাড়ির সামনে শোরগোল আর এম্বুলেন্সের আওয়াজে রুম থেকে বেরিয়ে এলো আরসাল। সায়রাদের বাড়ির সামনে লোকজন জড় হতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল। আজকাল দাদী ভীষণ অসুস্থ থাকে। উনার কিছু হয়নি তো আবার! ভাবল আরসাল। দ্রুত পায়ে নিচে গেল। বাড়ির সামনে যেয়ে ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই আরসাল দেখল- স্টেচারে করে সায়রাকে এম্বুলেন্সে তুলছে। গায়ের সাদা কামিজটা রক্তেমাখা। সন্ধ্যায় পড়িয়ে দেওয়া নীল চুড়ি গুলো ভেঙে হাত থেকে গরগর রক্ত ঝরছে। আরসালের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। থমকে গেল সে। পাথর হয়ে গেল ঠাই দাঁড়িয়ে! অতি শোকে কি অনুভূতি জিনিসটা হারিয়ে ফেলল আরসাল!
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ২২
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ )
প্রভাতের কুয়াশা মাড়িয়ে সোনালি আলো সুড়সুড় করে ক্যাবিনে ঢুকছে। অন্ধকার ঘরটা আস্তে আস্তে আলোকিত হচ্ছে। বেঘোরের ঘুমাচ্ছে সায়রা। ভোরের দিকে একবার জ্ঞান ফিরেছিল। শরীর ভীষণ দুর্বল। স্যালাইন চলছে হাতে। দুহাত মা শরীরের বিভিন্ন জায়গা ব্যান্ডেজ করা। শরীরে তেমন গাঢ় ভাবে না দাবলেও আঁচড় লেগেছে বেশ কয়েক জায়গায়। ডান দিকে গালের পাশেটায়ও আঁচড় লেগেছে। ভারী ভারী আঁখি পল্লব ধীরেধীরে খুলল সায়রা। মাথার উপর এত এত মানুষের আবছায়া দেখে প্রথমে বেশ ভড়কাল। তারপর খানিক সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। চোখ খুলে স্পষ্ট ভাবে তাকাল। ছায়া গুলো তার অপরিচীত নয়, বেশ পরিচিত। আপন মুখ গুলো। ক্ষান্ত নিশ্বাস ফেলল সায়রা। ডান দিকে মুখ ফিরাতেই মা সহ বাড়ির অন্য সবাইকে দেখল। সবার চোখমুখ চিন্তায় গভীর। আস্তে আস্তে সবটা পরিষ্কার হলো সায়রার। মায়ের মুখটা মলিন। চোখজোড়া লাল হয়ে ফুলে আছে। মা কি খুব কেঁদেছে? নিজেকে প্রশ্ন করল সায়রা। সিন্থিয়া কিছু বলতে চাইল কিন্তু কান্না গুলো বারবার দলা পাকিয়ে আসছে। কষ্ট হচ্ছে খুব । চোখজোড়া ভীষণ জ্বালা করছে। কিছু বলা হলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সিন্থিয়া। মাহির আহমেদ স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। অনেকটা সময় পর শান্ত হলো সিন্থিয়া। মাহির আহমেদ সায়রার পাশে বসে চুলে হাত গলিয়ে দিলো। শান্ত স্বরে বললেন,
–” এখন কেমন লাগছে মা?”
সেহের চোখের ইশারায় ইঙ্গিত করল ‘ভালো’! আচমকা দরজা খোলার প্রচণ্ড শব্দ হলো। হুড়মুড় করে কেবিনে ঢুকল আরমিন। মাথায় ব্যান্ডেজ তার। চোখে জল। দ্রুত ঝাপটে এসে সায়রাকে ধরল। চোখ বুঝে শব্দ করে কেঁদে দিলো আরমিন। চোখ মুখ অনুতাপের জলে পূর্ণ। কান্না স্বরে আধোআধো করে বলল আরমিন,
–” মাফ করে দে সায়রু। আমি ইচ্ছে করে করিনি। রাগের বসে কি থেকে কি হয়ে গেছে বুঝি আমি। সত্যি রাগের মাথায় খেয়াল করিনি আমি। আমি ইচ্ছে করে করিনি…..”
কোনরকম এতটুকু বলেই আবারো চিৎকার করে কেঁদে উঠল আরমিন। আশেপাশে অন্যসবাই আরমিনের কান্না জড়ানো কথা গুলো না বুঝলে সায়রা ঠিক বুঝছে। আরমিনকে শান্ত করার চেষ্টা করে আলতো স্বরে বলল,
–” শান্ত হও আপু! তোমার কোন দোষ ছিল না এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট।”
আরমিন থামল না। কেঁদেই যাচ্ছে। আরমিনের শক্ত ভাবে ঝাপটে ধরায় কষ্ট হচ্ছে সায়রার। ব্যান্ডেজে চাপ লাগছে। হাতের ক্যানোলায় টান পড়ছে। সায়রা আস্তে করে আরমিনকে ছেড়ে, সরে এলো। পেছনের বালিশে হেলান দিয়ে বসল। পুরো কেবিন ভর্তি লোকজন। সবার আড়ালে সায়রার চোখ পড়ল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরসালের উপর। বেশ শান্ত লাগছে তাকে। ঠাই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। গায়ের শার্টটা রক্তেমাখা। চোখমুখ ক্লান্ত, লাল। বেশ শান্ত মুখশ্রী। কিন্তু চোখজোড়া! চোখজোড়া ভীষণ অশান্ত তার। এই চোখে যেন হাজারো প্রশ্ন হাজারো অভিযোগ। তার চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে- সে সায়রাকে আঁকড়ে ধরে তার অশান্ত বুককে শান্ত করতে চাইছে। পিটপিট দৃষ্টি মেলে অপলক চেয়ে আছে সায়রা। বাবা মাহির আহমেদের আওয়াজে টনক নড়ল তার। চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। মাহির আহমেদ প্রশ্ন করল,
–” গতকাল কি হয়েছিল সায়রা?”
সায়রার নজর ঝুঁকে গেল। ছোট ঢোক গিলল। থুতনি গলার সাথে লাগিয়ে আমতা আমতা স্বরে বলল,
–” আপু আর আমি কথা বলছিলাম। অমনি দুষ্টামির ছলে পেছন থেকে ড্রেসিংটেবিলের আয়না আমার উপর এসে পড়ে, আমাকে বাঁচাতে আরমিন আপু ছুটে আসতেই পা পিছলে বিছানার কাঠের সাথে বারি খায়।”
আরসালের ভ্রু কুঁচকে গেল। সায়রার উত্তরে সুক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। সায়রার জবান যেন বিশ্বাস হলো না তার। সায়রার চোখের চঞ্চলতা স্পষ্ট বলছে কিছু লুকাচ্ছে সায়রা। আরমিন অনুতপ্ত দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে সায়রাকে। কাল বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। তার রাগের কারণে সায়রার আরো বড় কোন অঘটন হতে পারত। এত কিছুর পর সায়রা তারই দোষ ডাকছে! চোখ জলে ভরে এলো আরমিনের। সিন্থিয়া ভীষণ বিচক্ষণ মহিলা। মেয়েকে বেশ ভালো করে চিনেন তিনি। সায়রা যে মিথ্যা বলছে এটা স্পষ্ট মুখ দেখলেই বুঝা যাচ্ছে। সন্দিহান স্বরে বললেন সিন্থিয়া,
–” এমনি এমনি এত কিছু হয়ে গেল?”
সায়রা উত্তর দিলো না। শুধু উপর নিচ আলতো মাথা নাড়াল। সায়রা অসুস্থ বলে বিষয়টা নিয়ে ঘাটল না সিন্থিয়া চুপ রইল।
.
রোগীর রেস্টের প্রয়োজন। নার্স এসে কেবিন খালি করেছে। মাহির আহমেদ নিচে ঔষধ আনতে গেছে। পিয়াস পাখি বাড়িতে একা। তাই বাড়িতে ফিরেছে সিন্থিয়া। দুপুরের পর আবার আসবে তিনি। সায়রা কেবিনে একা। নার্সের কড়া নির্দেশ , এখন কেউ যেন কেবিনে না ডুকে। রোগীর প্রোপার ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে সায়রার প্রশ্ন! সেখানে দুনিয়ার কোন নিষেধাজ্ঞাকে পরোয়া করে না আরসাল। পৃথিবী সব নিয়ম কানুন আইনকে ভাঙতে রাজি সে। ধীর পায়ে আলতো করে সায়রার পাশে এসে বসল আরসাল। গভীর দৃষ্টিতে দেখছে সায়রাকে। ফর্সা মুখশ্রী মলিন হয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া শুষ্ক। রোদের আলতো আঁচ চোখে মুখে পড়ছে বারংবার। গালে আঁচড়ের দাগ। দুহাত ব্যান্ডেজ। গলায় আঁচড়ের দাগ। কপালটা পড়ন্ত চুলে ঢেকে। চেহারায় ব্যথাতুর ছাপ স্পষ্ট। বুকটা কেঁপে উঠল আরসালের। আলতো হাতে সায়রার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিলো। চোখ কুঁচকে নড়েচড়ে উঠল সায়রা। আলতো করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল আরসাল। কাছ থেকে খুব গভীর করে দেখছে তার পুতুল বউকে। কারো গভীর সান্নিধ্য আঁচ পেয়ে পিটপিট চোখ মেলে তাকাল সায়রা। চোখে মেঘবৎ এক ছায়া ভাসছে। নাকে কড়া সুঘ্রাণ। সেই মোহিত ঘ্রাণে আরো কিছুক্ষণ ডুবে থাকল সায়রা। চোখ বুজেই বলতে পারছে খুব আপন একজন তার সন্নিকটে। আরসালের আলতো হাত সায়রার ক্ষতগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। নিমিষ স্পর্শ গুলোকে গভীর ভাবে অনুভব করছে সায়রা। ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি তার। মৃদু দৃষ্টি মেলে তাকাল সে। আরসালের গভীর দৃষ্টি তখনো তার দিকেই। চোখে মুখ চুপসে আছে আরসালের। এই প্রথমবার আরসালকে এত ভীতিগ্রস্ত দেখছে সে। কপালে চিন্তার ছাপ। এর আগে আরসালকে অনেকবার অস্থির অগোছালো দেখেছে। কিন্তু এতটা! এতটা অগোছালো কখনো দেখেনি সে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছে সায়রার। আঁখি পল্লব নিদ্রায় ভার। চোখ মেলে তাকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারছেনা সে। ঘুমকাতুরে মিলিয়ে যাওয়া স্বরে বলল সায়রা,
–” এত ভয় পাচ্ছেন কেন আরসাল ভাই!”
সায়রা আরো কিছু বলতে চাইল, কিন্তু পারল না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আরসাল সায়রার গালে স্পর্শ করে প্রগাঢ় স্বরে,
–” কারণ তুই আমার প্রাণ ভোমরা পুতুল বউ!”
সায়রার ব্যান্ডেজ করা হাত নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নিলো। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
.
আজ বাড়ি ফিরবে। সায়রার মন বেশ ফুরফুরে। চারদিন পর হসপিটাল নামক জেলখানা থেকে রেহাই পাবে সে।বাবা ডক্টরদের সাথে কথা বলছে। মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাড়িতে গেছে। বাবা, দাদী আর আরমিনের সাথেই বাড়ি ফিরবে সে। বিছানায় বসে থাকতে ভালো লাগছেনা সায়রার। কোমর বেঁকে এসেছে। নেমে এদিকওদিক হাঁটা হাঁটি করছিল, সামান্য দরজা খুলে দাঁড়াতেই বাহির থেকে আরমিনের কান্নাভেজা আওয়াজ ভেসে এলো।
–” আমি আরসাল ভাইকে ভালোবাসি নানীমা!”
নুরজাহান বেগম আরমিনের হাত খামচে ধরল। বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন,
–” তোর মাথা খারাপ হয়েছে আরমিন! এর আগেও বলেছি এই কথা মুখে আনবিনা। ঐ ছেলের সাথে তোর বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তোর ভাগ্য ভালো তুর্জয়ের মত একজন ছেলে তোর মত পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করছে। চুপচাপ ভণিতা ছাড়া তুর্জয়কে বিয়ে করতে রাজি হ।”
নানীমার দিকে চেয়ে আছে আরমিন। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝোরছে তার। ছোট থেকে সবকিছুতেই অপ্রাপ্তি তার। নিজের পঙ্গুত্বের জন্য কম কথা শুনেনি। হাজারো অপমান সহ্য করে। অনেক অধিকার ছেড়েছে। তাই বলে আজ নিজের ভালোবাসার মানুষকেও তার ছাড়ছে হবে? নিজের সব অপ্রাপ্তি গুলো আজ প্রতিবাদের স্বরে ঝরে পড়ল।
–” আমি পঙ্গু হয়েছি এতে আমার কি দোষ নানীমা। আমি আরসাল ভাইকে ভালোবাসি সেই ছোট থেকে। আরসাল ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছি এতে আমার কি দোষ? জোর করে তো বাসিনি। সায়রার সাথে বিয়ে ঠিক হবার আগে থেকেই আরসাল ভাইকে পছন্দ করি। সায়রার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল বলেই নিয়তি মেনে বোনের সুখের কথা ভেবে দূরে সরে এসেছি আমি। তাই বলে তাকে ভালোবাসা ছাড়িনি। হয়তো আরসাল ভাই সায়রার নিয়তিতে কখনো ছিলোই না। তাই তো বিয়েটা ভেঙে গেছে।”
নুরজাহান বেগম রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আরমিনের বেয়াদবি দেখে তিনি বিস্মিত, হতভম্ব! আরমিনের চোখ জ্বালছে। বড় বড় নিশ্বাস বেরিয়ে আসছে। নিজের কান্নাকে আটকে আবারো বলল,
–” সায়রা নিজে আমাকে বলেছে- সে আরসাল ভাইকে পছন্দ করে না। আর আরসাল ভাই! আরসাল ভাই তো সায়রাকে ঘৃণা করে নানীমা।”
–” তাই বলে কি তোকে বিয়ে করবে আরসাল?”
নুরজাহান বেগম ধমক দিয়ে বলে। আরমিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দিলো,
–” তা জানিনা নানীমা। আমি তুর্জয় ভাইকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি শুধু আরসাল ভাইকে ভালোবাসি। আমার জীবনে অপ্রাপ্তির তালিকা বড়। বাবা মা কারো ভালোবাসা কোনদিন মিলেনি। নিজের ভালোবাসা হারিয়ে বাঁচতে পারব না আমি। তুমি সায়রার জন্য ভাবছ তো? সায়রা কিছু মনে করবে না। সে আমাকে বলেছে তার আরসাল ভাইকে পছন্দ না। ও কিছু মনে করবেনা। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। ও ওর আরমিন আপুকে বুঝবে। তাইতো আরসাল ভাইকে চাইবার সাহস করেছি।”
আরমিন ভারসাম্যহীনদের মত আচরণ করছে। কাঁদতে কাঁদতে নুরজাহান বেগমের পা চেপে ধরেছে। সারাজীবনের অপ্রাপ্তি গুলো আপ্রাণ জিদ ধরে বসেছে তার মনে । আরসালকে তার চাই- ই চাই!
নুরজাহান বেগম তেজি স্বরে বললেন,
–” তুই যাই করিস না কেন। বিয়ে তো তুই তুর্জয়কেই করবি।”
এতে আরমিনের কান্নার বেগ বাড়ল। দরজা বন্ধ করে দিলো সায়রা। আর নিতে পারছেনা সে। মাথা চক্কর দিচ্ছে তার। দেয়াল ধরে দাঁড়াল সে। প্রথম থেকে সবটা ভাবছে সায়রা। ছোট থেকে আরসাল ভাইয়ের কাছে আরমিনের টিউশন পড়া, উনার প্রতি এত টান, এই চারবছর উনার খোঁজখবর নেওয়া সবকিছুর আড়ালে ছিল আরমিনের ভালোবাসা। তারমানে, সেদিন রিদ্ধির বিয়েতে সায়রাকে সেই প্রশ্ন গুলো আরমিন এর জন্যই করেছিল। সে নিশ্চিত হচ্ছিলো, তারা একে অপরকে ভালোবাসে কিনা?
মাথা ধরছে সায়রার। আর ভাবতে পারছেনা। এত যন্ত্রণা হচ্ছে কেন মাথায়? যন্ত্রণায় মাথা কি ফেটে যাবে! চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসছে। শরীর অবশ। নিশ্বাস বন্ধ হচ্ছে তার। সামনে সব কালো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। সামনের দিকে পা বাড়াতেই অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে সায়রা।
চলবে…..