এক খোলা অন্তরিক্ষ পর্ব -০২

#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
বিকেল হতেই আর্শিয়া মৃদুলাকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়িতে ছুটে গেছে। সেখানে তার ননদ নিধি দরজা খুলে ভাবিকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরতে এলে আর্শিয়া রূঢ়তার সাথে তা এড়িয়ে যায়। ভিতরে ঢুকে আর্শিয়া চিৎকার করে সকলকে ডাকে,

–কে কোথায় আছেন? এখানে আসুন। আপনাদের গুণধর ছেলের কীর্তি শুনবেন না? আসুন। বাবা, মা? কোথায় আপনারা?

আর্শিয়ার ডাকে উনার বেরিয়ে আসে। আর্শিয়া মাঝেমাঝেই নিহাদের নামে নালিশ করতে এখানে আসে। নিহাদ ওকে খেঁপিয়েছে, ব*কেছে, আরও কতো কি! খুঁনশুটিতে ভরা সকল অভিযোগ ছিল। হায়! আজও ওরা ভেবে বসেছে আর্শিয়া সেরকম কোনো অভিযোগ নিয়ে এসেছে। আর্শিয়ার সাথে নিহাদের বিয়ে হয়েছে এক বছর হয়েছে। কাবিননামাতে স্বাক্ষর করলেও নিহাদের বক্তব্য ছিল, ‘নিজে কোনো কিছু করে বউকে দেওয়ার সামার্থ্য অর্জন করবে তারপর আর্শিয়াকে তিন কবুল পড়ে ঘরে তুলবে।’ এরপরেই আর্শিয়ার বাবা নিহাদকে দুবাই অফিসের অর্ধেক দায়িত্ব দেয়। এমনিতে নিহাদ মানা করেছিল কিন্তু আর্শিয়ার বাবা মানেননি।

নিহাদের বাবা এসে আর্শিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আর্শিয়ার মনোভাব পর্যবেক্ষণ করছেন। আর্শিয়া প্রতিবার মন খারাপ করে আসে কিন্তু আজ মুখশ্রীতে রাগের আভাস। নিহাদের বাবা রফিক সাহেব নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

–কী হয়েছে মা? তোর চোখ-মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? বাঁ*দড়টা আবার কিছু করেছে? নিশ্চয়ই তোকে আবার খেঁপিয়েছে?

আর্শিয়া তাচ্ছিল্য হাসল অতঃপর আফসোস কন্ঠে বলল,
–হাহ্! তোমাদের ছেলে যা করেছে তা কোনো স্বামী তার স্ত্রীর সাথে না করুক এই আর্জি আমি আমার রবের নিকট জানাই। এতো নিকৃষ্টমনা সে কী করে হয়? তোমাদের অনুরোধে তাকে আমি সুস্থ করতে রাজি হয়েছি পরে নিজেই মায়ায় পরে গিয়েছি বলে তোমাদের প্রস্তাবেও রাজি হয়েছি। এখন তোমাদের ছেলে তো অন্যত্র নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছে তো তার আমার কী দরকার!

রফিক সাহেব বিচলিত হলেন। তিনি তার স্ত্রীর দিকেও তাকালেন। তার স্ত্রী আফসানা বেগমও বুঝতে পারছেন না কিছু। রফিক সাহেব এবার বিচলিত কন্ঠে সুধালেন,

–কী হয়েছে মা? কী করেছে নিহাদ? বল আমাকে। আমি যোগ্য শাস্তি দিবো ওর।

আর্শিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–সত্যি বাবা তুমি তার যোগ্য বিচার করবে? পারবে করতে? সে তো তোমার নিজের ছেলে। আমি তো আর নিজের মেয়ে না। পর তো আমি।

–কে বলেছে তুই পর? তোর আর নিধির মধ্যে আমি ও তোর মা কখনও পার্থক্য করেছি?

–নাহ্। আসলে দোষ তো আমার ভাগ্যের। তাই তোমাদের মতো বাবা-মা পেয়েও হারাতে হচ্ছে।

–তোর কথাগুলো ভালো ঠেকছে না আমার কাছে। খোলশা করে বলতো।

রফিক সাহেবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর্শিয়া। তারপর মলিন কন্ঠে বলল,

–তোমাদের ছেলে বিদেশিনীর প্রেমে মজেছে। আমাকে কী লাগে! আমি তো তার ফার্স্ট প্রায়োরিটিও কখনও ছিলামই না। তার প্রয়োজন ছিলাম। প্রিয়জন হয়তো হুর ছিল বা এই বিদেশিনী!

রফিক সাহেব হতবাক হয়ে চেয়ে আছেন। হুরের পর আর্শিয়াকেই তো নিহাদ ভালোবাসে। নয়তো হুরের মৃত্যুর শোকে বদ্ধ পা*গলে পরিণত হওয়া ছেলেটা আর্শিয়ার যত্নে সুস্থ হয়ে যায়! যেখানে ডাক্তাররা নিহাদকে এসাইলেমে পাঠানোর কথা বলেছিল। তারপর ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিলো! রফিক সাহেব নিজেকে সামলে বলেন,

–কী বলছিস তুই? তিনদিন আগেও তো তোর জন্য বেনারসি শাড়ি পাঠালো আমাদের কাছে। বলল, ‘সামনে তোদের ২য় বিবাহবার্ষিকীতে যেনো দেই।’ তারে বুঝিয়ে পারলাম না যে বিবাহবার্ষিকী আসতে আরও আট মাস বাকি। তোর জন্মদিন তো কয়েকদিন পর। সেটার জন্য নাকি? জিজ্ঞাসা করাতে ছেলে বারবার বিবাহবার্ষিকীর কথাই বলছে।

আর্শিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
–তোমার ছেলেকে এখন ফোন করো তো। এখন দুবাইতে দুপুর হতে চলল। ফোন করে দেখো তো সে কোথায় আছে? কার সাথে আছে?

রফিক সাহেব আর্শিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে তার ছোটো ছেলে রাফিকে বলল ফোন করতে। রাফি ফোন করলে পরপর দুইবার রিং হয়ে ফোন কেটে যায় তা দেখে আর্শিয়া হাসতে হাসতে বসে পরে বলে,

–হাহ্! তার এখন সময় আছে নাকি! দেখো সেই বিদেশিনীর সাথেই আছে হয়তো।

রফিক সাহেব আর্শিয়ার পাশে এসে বসলেন। পাশে বসে তিনি লক্ষ্য করলেন দরজার কাছে মৃদুলা চোখ-মুখ শক্ত করে সকলের দিকে তাকিয়ে আছে। ভেবে নিলেন যে, আর্শিয়া মানা করাতেই মৃদুলা চুপ আছে। রফিক সাহেব আর্শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

–সবটা বল আমায়। তোকে কেউ মিথ্যা তথ্যও দিতে পারে।

–মিথ্যা! নিজের চোখে ভিডিওতে দেখেছি আমি। আমার বলতেও ঘৃণা হচ্ছে।

রফিক সাহেব আর ঘাটালেন না। আর্শিয়া মিথ্যে বলবে না তা তিনি জানেন। তৎক্ষণাৎ ছোটো ছেলের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে নিহাদকে ফোন লাগালো। এবারও তিনবার রিং হয়ে কে*টে গেলো। চতুর্থবার নিহাদ ফোন রিসিভ করে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

–হ্যালো।
–কই তুই?

রফিক সাহেবের রূঢ় স্বর শুনে নিহাদ চোখ কস্ট করে টেনে খুলে বলল,
–ঘুমাচ্ছি।

–অন্যের ঘুম কেড়ে নিয়ে নিজে কী করে ঘুমাস! উঠ বলছি।

ফোনের অপর পাশ থেকে চিৎকারে হুড়মুড় করে উঠে বসল নিহাদ। রফিক সাহেব আবারও রুক্ষস্বরে বললেন,
–তোর সাথে কে? কার সাথে অপকর্ম করছিস?

নিহাদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল রুমটা তার না তবে রুমে সে একা। গতকাল রাতে অফিশিয়াল পার্টি ছিল একটা। সেখানে হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ার পর কী হয়েছে তার মনে নেই। রফিক সাহেব ছেলের জবাব না পেয়ে আবারও ধ*মকে উঠলে নিহাদ আঁতকে উঠে বলে,

–কাল পার্টিতে প্রচন্ড মাথাব্যথা হবার পর আশফাক আঙ্কেলের বন্ধুর মেয়ে আমাকে তার কাছে পেইনকি*লার আছে বলে টেবলেট সহ একটা গ্লাস এগিয়ে বলল, সোডা আছে আপাততো সোডা দিয়ে টেবলেটটা খেতে। পানির ব্যাবস্থা করছে। তারপর….! তারপর আমি!..কী হয়েছিল?

ফোনটা লাউডে ছিল বলে ঘরে উপস্থিত সকলেই শুনতে পেলো। আর্শিয়া রেগে গিয়ে বলে উঠে,

–আর কতো মিথ্যা বলবেন? আমি নিজের চোখে ভিডিওতে দেখেছি। আপনি ওই মেয়ের সাথে.. ছিহ! লজ্জা করেনা? আরে আপনি নিজেই বলেছেন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা গাড়ো হবে আমরা নিজেদের মতো রাত জেগে ফোনে কথা বলব। সবই তো হলো। কিন্তু নিজের চরিত্র খুইয়ে বসলেন!

নিহাদ হকচকিয়ে উঠল। সে এসবের কিছুই জানে না। আর্শিয়ার কথা শুনে রুমের আশেপাশে ভালো করে চেয়ে দেখল রুমে সত্যি আর কেউ নেই। তাহলে আর্শিয়া কী বলছে! আর্শিয়াকে কিছু বলবে তার আগেই আর্শিয়া রফিক সাহেবের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কে*টে দিলো। নিহাদ মা*থা চেপে ধরে বসে আছে। সাথে মাথাব্যাথাটাও আছে।

আর্শিয়া মৃদুলার থেকে ফোনটা নিয়ে তার ভাইকে ফোন করল তারপর ভিডিওটা মৃদুলার ফোনে পাঠাতে বলে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল। ভিডিওটা এলে আর্শিয়া রফিক সাহেবকে দেখান। রফিক সাহেব, তার স্ত্রী ও ছোটো ছেলে ভিডিওটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। আর্শিয়া উনাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

–ভাইয়া একটু আগে ভিডিওটা আসল না নকল চেক করিয়েছে। ভিডিওতে থাকা প্রতিটা দৃশ্য সত্য। লাস্টের টুকুতো আমার দেখার শক্তি ছিল না। তারপরের ক্লিপ আমাকে পাঠায়নি আর ভাইয়াকেও না। কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে কী মনে হচ্ছে ওরা কাজ করছিল!

রফিক সাহেব মাথা নিচু করে বললেন,

–ক্ষমা করে দিস মা। আমার ছেলের যে বিদেশ গিয়ে এতো অধঃপতন হবে জানতাম না। তোকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে তোর জীবনটাও নষ্ট করে দিয়েছি। তখন সন্তানের শোকে আর কিছু চিন্তা করতে পারিনি। তোকে আমি বলব না সম্পর্কটাতে জোর করে থাকতে।

আর্শিয়া আর কিছু বলল না। সে বহু কস্টে চোখের পানি আটকে রেখেছে। নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। সেখানে আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে মৃদুলার হাত ধরে বেরিয়ে আসে। পেছোনে সকলের সব ডাক উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরে যে ওরা আরেকটা ঝটকার সম্মুখীন হবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here