এক খোলা অন্তরিক্ষ পর্ব -০৪

#এক_খোলা_অন্তরিক্ষ
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪
সকালে শাহরিফ এসে পৌঁছায়। এখন ডাক্তার শাহরিফের কাছে এসে জানান, আশফাক সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে সে কথা বলতে চান। শাহরিফ কিছুক্ষণ আগে আর্শিয়াকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়েছে। আর্শিয়াকে বলেছে বাড়ি গিয়ে রেস্ট করতে। আর্শিয়ার অবস্থা অতোটাও ভালো না। বাড়ি গিয়ে আর্শিয়া দুইটা ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। শাহরিফ ওর বাবার কাছে গেলে তিনি অক্সিজেন মাক্স খুলে হালকা শব্দে আস্তে আস্তে বলেন,

–আশু ও মৃদু এখন তোর দায়িত্বে। এই দুইটা মেয়েকে কস্ট দিস না। ওদের দেখে রাখিস। আশুর জীবনটা তো আমার হাত ধরে নষ্ট হয়ে গেল। ওর সামনে আমি মুখ দেখাব কী করে? ওকে দেখে রাখিস।

তারপর আস্তে আস্তে দম ছেড়ে দিল। চলে গেল পার্থিব সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে। শাহরিফ স্তব্ধ হয়ে বাবার নিথর হাত ধরে বসে রইল। তারপর আস্তে করে উঠে বাহিরে গিয়ে মৃদুলার পাশে বসল। মৃদুলা শাহরিফকে চুপ করে মুখ ঢেকে বসে থাকতে দেখে সুধালো,

–কী হয়েছে? বাবা কী বলল?

শাহরিফ একদম নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার জবাব কী হতে পারে তা তার নিজেরও জানা নেই। মৃদুলা জবাব না পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অতঃপর উঠে গেল আইসিউর কাছে। সেখানে গিয়ে বাবার মুদিত নয়নজোড়া দেখে কিছু বুঝলো না। কিছুক্ষণ পর কর্তব্যরত ডাক্তার এসে তাকে মৃ*ত ঘোষনা করে। মৃদুলা জানতে পারা মাত্রই কান্নায় ভেঙে পরলো। অনেকক্ষণ কাঁদলো। শাহরিফ ওকে আগলে রেখেছে নিজের কান্না চেপে। খবর পেয়ে সবাই আর্শিয়াদের বাড়িতে ভীর জমিয়েছে কিন্তু শাহরিফ আর্শিয়ার মনের অবস্থা কল্পনা করে ওকে জাগাতে মানা করল। টেবিলের উপর ঘুমের ঔষুধের পাতা থেকে দুইটা ঔষুধ নেই তার মানে আর্শিয়া গভীর ঘুমে। বিকেলের মধ্যেই আশফাক সাহেবকে মাটি দিয়ে চলে এসেছে শাহরিফ, আরিফরা। শাহরিফ এসে বোনের রুমে ঢুকে দেখে ঘুমন্ত আর্শিয়ার পাশে গুটিশুটি হয়ে মৃদুলা বসে আছে। চঞ্চল মেয়েটা যেনো মুষড়ে পরেছে। শাহরিফও আর্শিয়ার পাশে বসল। সকালে ঘুম ভাঙলে না জানি কী তাণ্ডব করে সে! ঘুম ভাঙালে হয়তো আর্শিয়ার খারাপ কিছু হতে পারত।

নিহাদ সন্ধ্যা নাগাদ নিজের বাড়িতে পৌঁছালে রফিক সাহেব ছেলেকে সদর দরজাতে থাকতেই থা*প্পর দিয়ে ঘার ধা*ক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন। নিহাদ কিছু বলতে চাইলেও তিনি শুনতে নারাজ। নিহাদ কোনো এক আত্নীয়ের বাড়িতে রাতটা থেকে সকালে আবার ফিরে যাবে। রাতে তার কাছে মেইল আসে যে দুবাইয়ের অফিস থেকে নিহাদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নিহাদ আর ওই শাখায় ও আশফাক সাহেবের ব্যাবসাতে যুক্ত না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিহাদ। এখন থেকে সে সিঙ্গাপুরে নিজের ছোটো বিজনেস সামলাবে শেষ সময় পর্যন্ত। তাছাড়া সময় কম তার। ফোন করে দুবাইয়ের টিকিট ক্যান্সেল করে সিঙ্গাপুরের টিকিট কা*টলো। খুব ইচ্ছে ছিল একবার আর্শিয়াকে দেখবে। লুকিয়ে হলেও দেখবে। পরে আবার কবে দেখা হয় নাকি হবে না বলা তো যায় না।

রাত গভীর হতেই নিহাদ বেরিয়ে পরল। আর্শিয়াদের বাড়ির সামনে এসে দেখে নিলো আশেপাশে কেউ নেই। নিহাদ বাড়ির পেছোন সাইডে গিয়ে পকেট থেকে বারান্দার গেটের চাবি বের করল। এটা আর্শিয়াই তাকে দিয়েছিল বিয়ের পরপর। কিন্তু কখনও কাজে লাগায়নি তাই আজ এক ঝলক দেখতে চাবিটা বের করল। নিঃশব্দে অতি সাবধানে তালা খুলে ধীর পায়ে আর্শিয়ার রুমে প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করে চাঁদের আলো ও বাহিরে সোডিয়াম লাইটের আলোয় ঘুমন্ত স্ত্রীকে দেখে মুগ্ধ হলো। কী নিষ্পাপ দেখতে লাগছে। বিছানার মধ্যিখানে সোজা হয়ে কাথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। লম্বা ঘন চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়ানো। নিহাদ অতি সন্তপর্ণে আর্শিয়ার পাশে বসে ওর কপালে হাত রাখে। আলো আঁধারিতে আর্শিয়ার দিকে কিছুক্ষণ বিমুগ্ধচিত্তে দৃষ্টি স্থির রেখে ওর ললাটে নিজের অধর স্পর্শ করিয়ে ধীর স্বরে বলতে থাকে,

–খুব খুব ভালো থাকবে তুমি। প্রথমে কস্ট হবে, খুব ঘৃণা করবে কিন্তু দিনশেষে আমি তোমার হাসির মাঝে বাঁচব। তুমি হাসবে। আমি বিহীন হাসবে। তোমার আমার বিচ্ছেদে তোমার জীবনকে রঙহীন করার থেকে বাঁচাবে।

নিহাদ নিজের চোখের জল মুছে উঠে গেল। আর্শিয়া জানতেও পারল না।

_________

সকালে আর্শিয়ার ঘুম ভাঙলে সে তড়িঘড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নেয় বাবাকে দেখতে যাবে বলে। আর্শিয়া বাড়ি থেকে বেরোতে নিলে শাহরিফ ওকে ডাক দিয়ে বলে,

–কোথায় যাচ্ছিস?

–হসপিটালে বাবার কাছে।

–যেতে হবে না।

–কেনো? বাবাকে নিয়ে আসছিস?

–নাহ্! একেবারের জন্য ঘুমিয়ে গেছে তো তাই তাকে স্বস্থানে রেখে এসেছি।

হঠাৎ বুক ধুক করে উঠল আর্শিয়ার। অস্থিরচিত্তে হড়বড়িয়ে বলল,
–কী বলছিস তুই? আমার কিন্তু ভয় করছে ভাই।

–বাবা আর নেই আশু। আমাদের একেবারের জন্য এতিম করে চলে গেছে।

আর্শিয়ার শ্রবণেন্দ্রিয়তে কথাটা পৌঁছাতেই শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। আর্শিয়া নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহরিফ গিয়ে আর্শিয়াকে জড়িয়ে ধরে। ভাইয়ের বুকে পরে কাঁদতে থাকে আর্শিয়া। ছোটোবেলায় বুঝ হওয়ার আগেই মাকে হারিয়েছে আর এখন বাবাকে। নিজেকে কেমন শূণ্য শূণ্য লাগছে। আঁকড়ে বাঁচার মানুষটাও ধোঁকা দিলো। নিজেকে অর্থহীন লাগছে। দুই ভাই-বোনের কান্নার দৃশ্য মৃদুলা ও আর্শিয়ার চাচি রান্নাঘর থেকে দেখছে। চাচিকে ধরে মৃদুলাও কাঁদছে।

শাহরিফ আর্শিয়া বসিয়ে চোখ মুছিয়ে ধরা কন্ঠে বলে,

–তোর জীবন আমি ঠিক করে দিবো। সব ঠিক করে দিবো বোন। তোর বড়োভাই এখনও আছে। ওই নিহাদকে আমি অফিস থেকে বের করে দিয়েছি। তোকে আমি নিহাদের থেকে মুক্তি এনে দিবো। চিন্তা করিস না। নিহাদকে তো আমার খু*ন করতে মন চাচ্ছে। তোকে আমি বাহিরে ভার্সিটিতে ভর্তি করব। নিজের যোগ্যতায় দাঁড়াবি একদিন।

আর্শিয়া চুপচাপ শুনছে আর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। শাহরিফ আবারও বলে,

–ইন্টারের পর তো ছয় মাস যাবত এখানের ভার্সিটিতে পড়ছিস। এখানে থাকলে পুরানো স্মৃতি ভুলতে কস্ট হবে। আমি তোর পাসপোর্ট বানানোর ব্যবস্থা করছি।

শাহরিফ চোখ মুছে চলে যায়। আর্শিয়া মন্থর গতিতে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়।

______

দেখতে দেখতে সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো আর্শিয়ার বাবার মৃত্যুর। এর মধ্যে নিহাদ আর্শিয়াকে ফোন করেনি। রাত গভীর হলেই আর্শিয়ার ইচ্ছে করে একটাবার নিহাদের সাথে কথা বলতে। এটা যে তার বহুদিনের অভ্যাস। নিহাদের বাবা-মা দুয়েকবার বাড়িতে এসে দেখে গেছে। তাদের থেকে আর্শিয়া জানতে পারে নিহাদ দেশে এসেছিল। আর্শিয়া তাচ্ছিল্য হাসে। এতোটা পর কীভাবে করে দিল! অনেকদিন ফেসবুকে ঢুকা হয় না। মেসেঞ্জারেও যাওয়া হয়না। আজ ঢুকে দেখল অনেক মেসেজের ভীরে নিহাদেরও মেসেজ। মুখে হাসি ফুটলেও পরক্ষণেই বিলীন হতে বাধ্য হলো। কেমন আছো? এসব জিজ্ঞেস করে লিখেছে ডিভোর্স পেপার পাঠাবে কিনা?

আর্শিয়া লিখলো,
–আপনি কী জানেন? আপনার জন্য আমার মনে ঘৃণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্লাই আসে,
–হ্যাঁ জানি। তোমার ঘৃণা দিয়ে আমি কী করব? যা খুশি করো শুধু আমাকে মুক্তি দেও।

–পেয়ে যাবেন। অতিশীঘ্রই।

মেসেজ করেই আর্শিয়া নেট অফ করে দিল। আজ রাতে সে ঘুমাবে না। চন্দ্রবিলাশ করবে একাকি রজণীতে। অপরদিকে নিহাদও কাউচে বসে একাকি চাঁদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। তারকাময়ী অন্তরিক্ষে রূপালী থালার মতো চাঁদ আজ বড্ড টানছে। শূণ্য বুকে হাহাকার। পেয়েও স্বইচ্ছাই হারিয়ে ফেলার বেদনা নিহাদকে আরও গ্রাস করছে। নিহাদের পাশে ওর সিঙ্গাপুরের বন্ধু রাসিফ এসে বসে। সে বলে,

–কেনো আর্শিয়াকে কস্ট দিচ্ছিস? ওসব যে মিথ্যা তা আর্শিয়াকে জানিয়ে দে।

–তুই এই কথা বলছিস? তুই তো সবটাই জানিস। আমার এই জীবনে থেকে ও কস্ট ছাড়া আর কিছুই পাবে না। খুব ইচ্ছে করে ওকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ভাগ্যে যে নেই!

রাসিফ হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। সব পূর্ণতা চিরকাল কেনো থাকে না? কেনো সেটা শূণ্যতায় পরিণত হয়?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here