তোমার মনের মধ্যিখানি পর্ব -৩৮+৩৯

#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৩৮

আহনাফ দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই অমি দৌড়ে ছুটে এলো দরজার কাছে। ইফা পেছন থেকে উঁকি মেরে খানিকটা অবাক হলো। শান্ত কে দেখতে পেয়েই অমি “মিয়াও মিয়াও” বলে ডাকতে শুরু করল। ঘাড় বাঁকিয়ে বাকিয়ে দেখছে শান্ত কে। তার মনেও হয়তো এই প্রশ্ন শান্ত এতোটা চোট পেলো কি করে। শান্ত কিঞ্চিত হেসে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই না বললি কে আছে বাসায়, দেখতে পেলি তো। চিন্তায় আমার জন্য ঘুমাতেও পারে নি।”

আহনাফ হেসে কোলে তুলে নিল অমি’কে। সেদিনের পর অমি’র সাথে তার বন্ধুত্ব টা কিছুটা হলেও হয়েছে। অমি ছোটাছুটি করছে শান্ত’র কোলে যাওয়ার জন্য। শান্ত সোফায় বসে কোলে তুলে অমি কে। ইফা পানির গ্লাস এনে শান্ত’র সামনে রেখে তাকিয়ে রইল অমি’র দিকে। এতো ভালোবাসা দেখে অনেকটা অবাক হলো সে।

“বিড়ালটা তোমায় এতো ভালোবাসে শান্ত ভাইয়া।

“ওর নাম অমি!

“হ্যাঁ হ্যাঁ অমি তাই তো!

ডাক শুনতেই নড়চড় করলো অমি। গলার ঘন্টা টা বেজে উঠল তখন। হেসে উঠলো তিনজন’ই।

ইফা কে এই মাঝরাতেই বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে গেল আহনাফ। বাবা একা বাসায়, এখানে ইফা’র থাকা টা দরকার।
আবারো ব্যাক করলো শান্ত’র বাসায়। বিছানায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে শান্ত। তার বুকের উপর গুটিগুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে অমি। আহনাফ হেসে শান্ত’র মাথার নিচে বালিশ দিল। বা হাত টা ঠিক করে রাখল। অনেকটা ক্লান্ত লাগতে এখন তার।‌ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়ল আহনাফ। ডান হাতের কনুইয়ের খানিকটা ছি’লে গেছে তারও।‌ সামনের ডেসিন টেবিলে আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলো সে। হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠল তার। আহনাফ সেটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একজন বিনয়ী স্বরে বলল, “স্যার, ভর্তি করে দিয়েছি সব গুলোকে হাসপাতালে।”

“কোন হাসপাতাল?

“শান্ত স্যার কে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে।

“তোমার সাথে কি এখনো ওরা কেউ আছে।

“জি আহিম, নীলাভ্র আর আফিন স্যার এখানেই আছে।

“দাও ওদের দাও!

ফোনটা এবার ধরল আহিম। আহনাফ উঠে এলো বেলকনির কাছে।

“বল?

“তোরা ঠিক আছিস তো সবাই।

“হুম, আছি। শুধু আফিনের হাত খানিকটা কে’টে গেছে।

“বেশি কে’টেছে।

“না, ওতোটাও না। শান্ত’র খবর কি?

“ঘুমাচ্ছে, ওরা কি কিছু বলল?

“হুম,‌ঈশানের কাজ!

“আচ্ছা!

“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাদের আর না আগানোই ভাল।

“কেন?

“রায়ান আংকেল দেখছে বাকিটা, উনিই বলল ঈশানের ব্যাপারটা সে দেখবে।

“আচ্ছা, বের হয়ে যা এখন। সকাল হতেই শান্ত’র বাসায় চলে আসবি। আর হ্যাঁ খেয়াল রাখবি, কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে।‌ শান্ত ও না, আজকের রাতের ঘটনা ভুলে যাবি সবাই।

“ওকে!

আহনাফ ফোন কাটল। সামনে তাকাল সে, ভোর হতে আর দেরি নেই। রাতটা নির্ঘুম হয়েই কাটানো লাগল তার। খুব ঘুম পাচ্ছে এখন, চিনচিনে ব্যাথা করছে হাতের দিকটা আবার। বেলকনি থেকে বের হয়ে এসে শান্ত কে দেখল একটি নজর। যাদের জন্য শান্ত’র এই অবস্থা তাদেরও একই অবস্থা করে এসেছে চার বন্ধু। কিন্তু আসল জন’কেই ধরতে পারল না। যদিও মনে হচ্ছে রায়ান আংকেল’ই দেখবে বাকিটা। বসার ঘরে এসে ফার্স্ট এইড বক্স খুঁজে ঔষধ লাগাতে লাগল সে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে এসে শুয়ে পড়ল শান্ত’র‌ পাশে। অমি তা টের পেয়ে একটু নড়েচড়ে উঠল। আহনাফ অমি কে কোলে বসাল নিজের। সে একটি নজর আহনাফ কে দেখে উঠে পড়ল। ঘুম ভেঙে গেছে তার, এখন আর আসবে না। হেঁটে নিচে নেমে গেল, আহনাফ বেশ অবাক হলো। শেষ পর্যন্ত একটা বিড়াল ইগনোর করল বুঝি তাকে। সে উঠে যেতেই হঠাৎ করে শান্ত’র তার এক পা উঠিয়ে দিল আহনাফের গায়ে। আহনাফ খুব সাবধানে পা সরাতে যাবে অমনি হাত ও দিয়ে দিল তার গায়ের উপর। সেই ছোটবেলায় যেমন তার গায়ের উপর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতো শান্ত আজও তাই করছে। অন্যসময় হলে আহনাফ তাকে এক ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিত। কিন্তু আজ সেটা সম্ভব না, বেচারা এভাবেই আধ’মরা। মুচকি হাসল আহনাফ, আজ অনেকটাই মা’র খেলো বেচারা। ইশ! কি মা’রটাই না মার’ল.!

—–

শান্ত’র ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। অনেকজন একসাথে কথা বলার শব্দ আসছে তার কানে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব, এতোজন একসাথে তার ঘরে কি করছে? আহিমের গলার আওয়াজ আসছে, শয়’তান টা খুব জোড়ে কথা বলছে। অদ্ভুত, ও কি জানে না, শান্ত অসুস্থ, তার একটু শান্তিতে ঘুমানোর দরকার। এতো চেঁচাচ্ছে কে? শেষমেষ বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাল শান্ত। কয়েকটা কথা না বললেই নয়।

“এই তোরা কি শুরু করলি কি?

বলেই যেন নিশ্চুপ হয়ে গেল। কই এখানে তো কেউই নেই। মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখল নিঝুম তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক লাফ দিল শান্ত, নিঝুম হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই!

“তুমি! এখানে, এই সময় কি করছো?

“শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ তাই দেখতে এলাম, দেখি দেখি হাতটা। ইশ্ রে কি মা’র টাই না মারল আপনাকে।

“এই সরো তুমি এখান থেকে, আমার বাড়িতে ঢুকতে দিল কে তোমায়!

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আহনাফ বলল, “আমি!

“তুই!

“বল কি করবি, ব্রেকফাস্ট নাকি লাঞ্চ!

“মানে?

চোখ বুলাল ঘড়ির দিকে। ১ টা বাজতে আর কিছু সময় বাকি। শান্ত পা তুলে বিছানায় বসে বলল, “এতোক্ষণ ঘুমান আপনি,‌জানেন কতোক্ষণ ধরে বসে ছিলাম।

শান্ত বিছানা থেকে সরে গিয়ে আহনাফের কাছে এসে বলল, “এই মেয়ে এখানে কি করে? তানিশা, আহিম ওরা কেউ না এসে ও এখানে কি করছে?

“ফুসুড় ফুসুড় করে কি বলছেন আমার নামে।

চশমাটা ঠিক করে বলল নিঝুম। আহনাফ বলে উঠল, “ওরাও এসেছিল, আরো সকালে। দু’ঘন্টা ধরে বসেও ছিল। যেই চিৎকার চেঁচামেচি আর বক বক তাই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। বলেছি বিকালে আসতে।

বলতে বলতে রান্না ঘরে ঢুকল আহনাফ। শান্ত পিছন পিছন আসতে আসতে বলল, “এই মেয়েটাকে বার করলি না কেন?

“ও তো এলোই মাত্র, ইফা কে ফোন করে নাকি জানল তোকে কেউ মে’রে আধম’রা করে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে।

“কিইই? ইফা এসব বলল। তুই ওকে কিছু বললি না। আহনাফ, আমার মান সম্মান আছে, এভাবে কি করে বলতে পারে ও।

“নিঝুম ও তাই বলল, ইফা বেশি বেশি বলেছে। তোর তো তেমন কিছুই হয় নি।

“কে বলেছে কিছু হয় নি, তুই দেখছিস না আমার হাতের কি হাল!

আহনাফ মুখ টিপে হাসল। শান্ত বলে উঠল, “হাসছিস কেন?

“কিছু না।

“তুই…

কথা শেষ হবার আগেই নিঝুম ছুটে এলো। চেঁচিয়ে যাচ্ছে একনাগাড়ে। অমিও পেছন পেছন ছুটছে তার। নিঝুম সোফার উপর দাঁড়িয়ে বলল, “এএইই বিড়ালটাকে যেতে বলুন।”

“ওর নাম বিড়াল না অমি!

“অমি টমি সর এখান থেকে, আমার পিছনে কেন পড়ে আছে।

আহনাফ বলে উঠল, “নিঝুম লাফিও না ওভাবে, পড়ে যাবে।

“ভালোই হবে, কোমড় ভাঙ’বে।

*এএএই এইই অশান্ত!

শান্ত মুখ ভেংচি কেটে অমি কে কোলে তুলে নিল। নিঝুম যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। শান্ত হেঁটে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “ফ্রেস হতে যাচ্ছি, কেউ যেন আপনাকে ডিস্টার্ব করতে না আসে।

নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। শান্ত রুমের দিকে চলে গেল, নিঝুম মুখ ফিরিয়ে আহনাফ কে বলল, “কথাটা কাকে বলল?

আহনাফ কিছু না মুখ ফিরিয়ে হাসল।

আহনাফ রান্নায় ব্যস্ত। নিঝুম ঘুরে ঘুরে দেখছে তাকে। অবাক চোখে দেখছে আহনাফ কে। কতোটা যত্ন করে রান্না করছে আহনাফ। রান্না’র কৌশল বলে দিচ্ছে আহনাফ কতো ভালো রান্না করতে পারে। নিঝুম জিজ্ঞেস করে বসল, “আপনি বুঝি খুব ভালো রাঁধতে পারেন”

“মনে তো হয়, তুমি পারো না।

“পারি তবে এতোটা না।

আহনাফ কিঞ্চিত হেসে আবারো রান্নায় মনোযোগ দিল। নিঝুম এখন তার পিছন পিছন ঘুরছে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে আহনাফের রান্না। হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলল, “তিশা আপুকেও রান্না করে খাওয়াতেন তাই না, আপু আপনার রান্না অনেক পছন্দ করতো তাই না।

ক্যাপসিকাম কাটা থামিয়ে নিঝুমের দিকে ফিরল আহনাফ। ঠোঁটের কোনে হাসি রেখে মাথা নাড়ল। নিঝুম আবারো বলে উঠল, “ইশ আপনাকে যে বর হিসেবে পাবে কতোটা লাকি হবে বলুন তো। আপনি সবসময় রেঁধে খাওয়াবেন তাকে।”

আহনাফ ক্যাপসিকাম গুলো বাটিতে উঠিয়ে রেখে তাকাল নিঝুমের দিকে।‌ টুলে বসে গালে হাত দিয়ে তাকে দেখছে নিঝুম। আহনাফ চোখ সরিয়ে ফেলল। নিঝুম তবুও তাকিয়ে রইল, ভাবতে থাকলো, তানিশা কতোটা ভালোবাসে আহনাফ কে, তিশা আপুও কম ভালোবাসতো না। তার হাবভাব বলে দিত আহনাফ কে কতোটা ভালোবাসতো সে। সেদিন তিশা চলে যাবে বলে তানিশা কতোটা রেগে গেল। হঠাৎ সেই কথা মনে পড়তেই গা শিউরে উঠল তার। নিঝুম একটু নড়েচড়ে বসল। আহনাফ আসলেই একজন পারফেক্ট ছেলে, যাকে সব মেয়েরাই চাইবে!তাদের দলে কি সে নিজেও পড়বে তাহলে?

ভাবনায় ছেদ ঘটালো। চোখ ভিজে উঠছিল তার। নিঝুম উঠে দাঁড়াল। আহনাফ তার দিকে ফিরে বলল, “কি হয়েছে? কাঁদছো কেন?

“চোখ জ্বলছে আমার!

আহনাফ চোখ বুলাল।‌ পেঁয়াজ কাটছে সে, তার ঝাঁঝেই বোধহয় এমনটা হলো। আহনাফ মৃদু হেসে হাত ধুয়ে টিস্যু বক্স টা এগিয়ে দিল নিঝুমের সামনে। চোখের চশমা খুলে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে নিঝুম। আহনাফের হাতের স্পর্শ গালে পেয়েই শিউরে উঠল সে।

“এভাবে কেঁদো না, পেঁয়াজ কাটছিলাম বলে এমনটা হলো। তুমি বরং গিয়ে অন্যরুমে বসো।

চোখের জল মুছতে মুছতে কথাটা বলল আহনাফ। নিঝুম হা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। যদিও সবকিছুই তার কাছে ঝাঁপসা তবুও সে জানে এটা আহনাফ।‌ আহনাফ কাছে এসে তার চোখের উপর ফুঁ দিল।‌ নিঝুম সাথে সাথেই এক পা পিছিয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগল সে। দ্রুত চশমাটা পড়ে তড়িখড়ি বলল, “আমি চোখে মুখে জল দিয়ে আসছি!

আহনাফ এক নাগাড়ে তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার দিকে। বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখছে নিঝুম। কি হলো এতোক্ষণ তার সাথে, এটা আদৌও স্বপ্ন ছিল না তো! মুখে চোখে জল ছিটিয়ে রান্না ঘরে যেতে নিল, অমনি চোখ পড়ল অশান্ত’র ঘরের দিকে। দরজা ভিড়ানো ছিল, আচ্ছা অশান্ত এখনো কি করছে। নিঝুম ওদিকে যেতে নিবে অমনি দেখল অমি বের হচ্ছে। দ্রুত সরে দাঁড়াল সে, অমি বেরিয়ে গেল হেলেদুলে। নিঝুম এবার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আবারো তাকাল অশান্ত’র ঘরের দিকে।

শান্ত সবে ফ্রেস হয়ে বেড়িয়েছে। জামাকাপড় ও বদলিয়েছে। তার গায়ে কালো রঙের একটা শার্ট, শার্টের বোতাম গুলো খুব কষ্টে লাগিয়েছে সে। যদিও সব গুলো লাগাতে পারে নি, তাই ঘাড়ের দিকের আঘাত’টা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে শান্ত, এ কি হাল তার। যাদের জন্য এই হাল তাদের একজন কেও ছাড়বে না, কখনো না। চোয়াল শক্ত করে তাকাল ঘাড়ের দিকে। একটু ঔষধ লাগানো দরকার এখানে, ডান হাতের কনুইয়ের ব্যান্ডেজ টাও খুলে যাচ্ছে, এটা আবার নতুন করে লাগানো দরকার। আহনাফ কে বলতে হবে।‌ হাতে মলম টা নিয়ে সেদিকেই হাঁটা ধরল সে।

দরজার সামনে আসতেই দুজনেই থেমে গেল একসাথে। ধাক্কা লাগতে লাগতে লাগলো না। নিঝুম চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, “এতো তড়িখড়ি করে কোথায় যাচ্ছেন?

“তুমি এখনো গেলে না।

“না আহনাফ আমাকে দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছে, তাই।

শান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝেছি, আরো কিছুক্ষণ সহ্য করতে হবে তোমায়। সরো এখন এখান থেকে।

“কিন্তু আপনি এই অবস্থায় কোথায় যাচ্ছেন ( হাতের দিকে তাকিয়ে ) এই ঔষধ… ( ঘাড়ের দিকে নজর গেল নিঝুমের । হাতের আঙুল তুলে বলল, ) এখানে লাগাবেন নাকি।

“আহনাফ কোথায়?

“উনি তো রান্নায় ব্যস্ত, আচ্ছা আসুন আমি লাগিয়ে দিচ্ছি।

“না দরকার নেই?

“আরে কিসের দরকার নেই, আসুন আসুন।‌ আহনাফ এখন কাটাকুটি করছে, কিভাবে এতো কিছু করবে একা হাতে। আমি আপনাকে সাহায্য করছি, আসুন।

বলেই অশান্ত’র হাত টেনে ধরে বসিয়ে দিল বিছানায়।‌ শান্ত হতভম্ব, কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। নিঝুম মলম টা শান্ত’র হাত থেকে নিয়ে তার ঘাড়ে লাগাতে লাগল। এক হাত দিয়ে অশান্ত’র শার্ট ধরে আছে তো অন্য হাত দিয়ে ধীরে ধীরে মলম লাগিয়ে যাচ্ছে সে।‌ অশান্ত ধীরে ধীরে ফিরল নিঝুমের দিকে। চশমিস এখন তার খুব কাছে। তার চুল গুলো বার বার মুখে পড়ছে অশান্ত। শান্ত বলে উঠল, “এই সরো তো!

“আরে শেষ হয় নি তো।

“তোমার চুল গুলো কি বাঁধতে পারো না।

“কেন কেন?

“এই গুলো জ্বালাচ্ছে আমায়, উফফ কি বিরক্তকর।

নিঝুম তাকাল নিজের চোখের দিকে। হেসে বলল, “ও এই ব্যাপার! দাঁড়ান! বলেই দুই হাত দিয়ে চুল গুলো খোঁপা বাঁধতে লাগল সে। শান্ত এখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে।‌‌ হঠাৎ করে কেন এতো ভালোলাগা তার।‌ কেন মেয়ে খোঁপা বাঁধলে বুঝি এতোটা সুন্দর লাগে। চোখ সরিয়ে ফেলল শান্ত। তার মনের অনুভূতিকে তাকেই আটকাতে হবে। এভাবে তো আর চলতে পারে না।

নিঝুম আবারো ঔষধ লাগিয়ে দিতে লাগল। শান্ত চোখ ফিরল আবারো। মন মানতে চাইছে না তার। মোহিত হচ্ছে সে বার বার। চশমিস তার কতোটা কাছে, এই তো অনেকটা কাছে। তার ধীরে ধীরে নেওয়া নিঃশ্বাসের শব্দ পাচ্ছে সে। শান্ত ঢোক গিলল। নিঝুম খানিকটা দূরে সরে বলল, “এই তো শেষ!

শান্ত উঠে দাঁড়াল। নিঝুমের নজর পড়ল ব্যান্ডেজের দিকে। শান্ত কে হাত ধরিয়ে বসিয়ে বলল, “এইখানেই বসে থাকুন, আমি আসছি!

বলেই দৌড়ে চলে গেল। শান্ত অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ পর হাতে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে ফিরল নিঝুম। শান্ত’র ওপাশে বসে তার ডান হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ঔষধ লাগিয়ে আবারো ব্যান্ডেজ করে দিল। শান্ত একটিবারের জন্য সেদিকে ফিরল না।‌‌ অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার মাঝে থাকার পর নিঝুম শান্ত’র ঠোঁটের কাটা জায়গাটায় হাত রেখে বলে উঠল, “এই অশান্ত আপনি এতোটা মা’র খেলেন কি করে?

শান্ত হতচকিয়ে দূরে সরে গিয়ে,
“আমি কি আরেকবার মা’র খেয়ে দেখাবো তোমায়

নিঝুম হাসল, সেই হাসির শব্দ কানে এসে বাড়ি খেল শান্ত’র। নিঝুম মুখ ভেংচি কেটে বলল, “আহ! এতো রাগ করে না বোকা অশান্ত!

“এই এই তুমি আমায় বোকা অশান্ত বলবে না একদম।

“আমি তো একশবার বলবো

“তাহলে আমিও একশবার তোমায় বলব, ঝুম ঝুমাঝুম ঝুম।

নিঝুম ঠোঁট উল্টে তাকাল, শান্ত একটু নড়েচড়ে উঠতেই কাঁচি টা পড়ে গেল মেঝেতে। শান্ত যেমন সেটা উঠিয়ে নিতে নিচু হলো নিঝুম ও তাই। খোঁপা খুলে গেল তার, চুল গুলো সব এসে বাড়ি খেল শান্ত’র মুখে। বিরক্ত লাগছে এখন শান্ত’র। দুজনেই উঠে যেতেই চেঁচিয়ে উঠলো নিঝুম। শান্ত খেয়াল করল, নিঝুমের চুল আটকে আছে তার শার্টের বোতামে। কি অস্বস্তিকর পরিবেশ!

“আরে আরে অশান্ত কি করছেন? আমার চুল।

“আজব তো, চুল গুলো কি সামলিয়ে রাখতে পারো না

“পারি কিন্তু আপনি তো অসামাল ভাবে চলাফেরা করছেন।

“চশমিস।

“অশান্ত লাগছে আমার!

শান্ত কাঁচি এগিয়ে ধরে বলল, “চুল গুলো কে’টে ফেলি।

“আরে আরে কি করেন? আমার ওই তো একটু খানি চুল। ওগুলো কে’টে ‌ফেললে হবে কি করে?

“তাহলে ছোটাও তুমি?

“সবুর করুন, করছি!

দুজনেই দাঁড়িয়ে গেল। নিঝুম এগিয়ে এলো শান্ত’র কাছে। বোতাম থেকে খুব সাবধানে চুল গুলো ছুটিয়ে নিচ্ছে সে। শান্ত মন অন্যদিকে করার যত চেষ্টা করছে সবই বিফলে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত সে বুঝতে পারছে, চশমিসের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। এটা কি ঠিক হচ্ছে। না না হচ্ছে না? কিন্তু চশমিস কে দূরে সরানো যেন ততোটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কাছে।

শান্ত’র হৃদস্পন্দন বাড়ছে খুব দ্রুতভাবে। নিঝুমের এলোমেলোর চুলের কারণে তার মুখটা দেখা যাচ্ছে না। শান্ত ভাবল হাত বাড়িয়ে চুল গুলো সরিয়ে দেবার কথা, অমনি দরজায় কারো আসার শব্দ। আহনাফ এসে দাঁড়াল দরজার সামনে, নিঝুম বলে উঠল, “হয়ে গেছে?

“কি?

বলে উঠল আহনাফ। শান্ত দ্রুত সরে গেল নিঝুমে‌র কাছ থেকে। তার এই অনুভূতির যে আসলেই কোন মানে নেই সেটা আরো একবার বুঝে গেল সে। নিঝুম হেসে বলল, “চুল গুলো আটকে গিয়েছিল!

“মানে?

“কিছু না, দেখুন আহনাফ আমি শান্ত’র হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি।

“ভালো করেছো! শান্ত, তোর ঔষধ খাবার সময় হয়ে গেছে।

শান্ত মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল। নিঝুমও এলো পিছু পিছু!

——

কেটে গেল একমাস! শান্ত’র হাতের প্লাস্টার খোলা হয়েছিল গতকাল। আগের থেকে এখন অনেকটাই সুস্থ সে। এই এক মাস তার সমস্ত খেয়াল রেখেছিল আহনাফ। তার খাওয়া দাওয়া, ঔষধ পত্র সবকিছু। নিজেকে সাড়িয়ে তোলার সাথে সাথেই আরেকটা কাজ ও করেছে শান্ত, সেটা হচ্ছে নিজের অনুভূতি গুলোকে সরিয়ে ফেলা। কারণ এর মাঝেই নিঝুমের জন্য থাকা আহনাফের অনুভূতি গুলো বুঝতে পেরেছ সে। কিন্তু আহনাফ কিছু বুঝতে পারে নি, এটাই তার জন্য অনেক। কিন্তু আজ বুঝতে পারে নি বলে কখনো পারবে না এমনটাও নয়। আহনাফ শান্ত কে সেই ভাবে খেয়াল করছে না বলেই কিছু বুঝছে না। কিন্তু শান্ত খেয়াল করছে আহনাফ কে, প্রতিনিয়ত দেখছে তাকে। নাহ, একবার ভালোবেসে আহনাফ কষ্ট পেয়েছে, শান্ত এবার মোটেও চায় না তার জন্য এমন কিছু হোক। যেখানে আহনাফ আর চশমিস দুজন দুজনকে পছন্দ করে সেখানে তার এসব অনুভূতির কোন মানে নেই।

আজ একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে আহনাফ! শান্ত কে এখনো কিছু বলে নি, তবে বলবে। কিন্তু তার আগে আরেকজন কে বলা প্রয়োজন। সে হচ্ছে নিঝুম!
ভার্সিটিতে ক্লাস শেষে তার জন্য’ই অপেক্ষা করছিল আহনাফ। নিঝুমকে দেখতে পেয়েই তাকে ডেকে উঠল সে, “নিঝুম!

নিঝুম ও থেমে গেল সাথে সাথে! দূরে দাঁড়ানো তানিশা লক্ষ্য করছে সবটা। হঠাৎ করেই যেন কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছে তার। কিছু কি তবে হতে চলেছ, যেই ভয়টা এতো দিন পেয়ে এসেছিল তবে কি সেটাই হতে চলেছে। নিঝুম আর আহনাফ… থেমে গেল। গলা ধরে আসছে তার। দ্রুত হেঁটে চলে গেল সে। না এমন কিছুর স্বীকার মোটেই হতে চায় না।

“আরে আহনাফ আপনি!

“তোমার সাথে একটু কথা ছিল?

“বলুন!

“কফি খেতে যাবে আমার সাথে!

“এখন!

“হুম…

“আচ্ছা!

নিঝুম বেরিয়ে গেল আহনাফের সাথে। শান্ত দেখেও এড়িয়ে গেল। বাইক চেপে বসে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।

কফি খেতে এসেও একবারও কফির কাপে চুমুক দেয় নি আহনাফ। এদিকে নিঝুমের কফি খাওয়া শেষ। সে একটু পর পরই লক্ষ্য করছে আহনাফ কে। আজ হঠাৎ কেমন জানি লাগছে আহনাফ কে। নিঝুম হালকা কেশে বলল, “আহনাফ আপনি কি কিছু বলবেন আমায়।

আহনাফ খানিকটা দ্বিধা নিয়ে, “হুম!

“তো বলুন। এতো চিন্তার কি আছে।

“চিন্তা?

‘হ্যাঁ , এই তো ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছেন। অনেকটা বিচলিত লাগছে, কি নিয়ে এতো টেনশন করছি।

“কিছু না।

“তাহলে কফি খাচ্ছেন না কেন?

“ওহ হ্যাঁ!

বলেই কফি মগে চুমুক দিল আহনাফ। নিঝুম হেসে বলল, “আহনাফ কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।‌

আহনাফ হেসে ঠোঁট ভিজালো। আশ্চর্য! হঠাৎ কেন এতোটা ভয় লাগছে তার। এতোটা লজ্জা কেন পাচ্ছে সে। নিঝুমের হাসির শব্দ পাওয়া গেল। হাসি থামিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সে। আহনাফ এদিক ওদিক তাকালো। শপে তেমন একটা কেউ নেই, এমন দুপুরের দিকে কারো আসবার কথাও না। আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নিল। নিঝুম ভ্রু কুঁচকে নিল। চশমাটায় কিছু একটা পড়েছে। টিস্যু দিয়ে চশমা টা খুলে পরিষ্কার করতে লাগলো সে। আহনাফের মনে হলো, এখন হয়তো কিছুটা সাহস পাচ্ছে সে। চঞ্চল এই চোখ গুলো ছিল তার অস্বস্তির কারণ। সে দ্রুত বলে উঠল, “নিঝুম, তুমি কি পরশু আমার সাথে বেরুবে!

নিঝুম সামনে তাকিয়ে বলল, “মানে?

“মানে, আমার সাথে ঘুরতে বের হবে। পরশু তোমার পুরো সময়টা আমাকে দেবে। আই মিন… তুমি কি আমার সাথে ডেট এ যাবে!

কথাটা শোনামাত্র চশমাটা হাত ফসকে পড়ে গেল। একি শুনল সে, হতচকিয়ে উঠল সে। নিচ থেকে চশমাটা উঠাতে গিয়ে হাত লাগলো আহনাফের সাথে। দ্রুত সরিয়ে নিল নিজের হাত। আহনাফ চশমাটা টেবিলে রেখে বলল, “এতোটা ব্যস্ত হবার কোন দরকার নেই। আমি শুধু তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তোমার ইচ্ছে না করলে তুমি নাও বলতে পারো..

নিঝুম দ্রুত চশমা পড়ে বলল, “না মানে..

আহনাফের মুখটা মলিন হয়ে গেল সাথে সাথে। খানিকটা বিব্রত হয়ে বলল, “তুমি কি না করছো?

নিঝুম চোখ অন্যদিকে ঘুরাল। হঠাৎ করেই কেন জানি বেশ লজ্জা লাগছে তার। হাত পা দ্রুত সব ঠান্ডা হয়ে আসছে। কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে গেল সে। আহনাফও দাঁড়িয়ে গেল সাথে সাথে। চট করে বলে উঠল, “নিঝুম তুমি কি রাগ করলে আমার উপর!

অনেক সাহস করে আহনাফের দিকে মুখ ঘুরালো নিঝুম। মাথা নেড়ে বলল, না তো।

আহনাফ খানিকটা কাছে এগিয়ে এসে বলল, “তাহলে তুমি কি আমার সাথে যাবে না।

নিঝুম ক্রশম ঠোঁট কামড়াচ্ছে। হাত একবার মুঠো করছে তো আরেকবার খুলছে। অনেকটা অস্বস্তিতে ভুগছে সে। আহনাফ হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল। চমকে উঠল নিঝুম। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে বলল, “এখন উওর দেবার কোন দরকার নেই। পরশু সকালবেলা আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য, এই কফি শপের বাইরে। যদি তুমি চাও, তাহলে আসবে। না চাইলে আসবার দরকার নেই ঠিক আছে!

নিঝুম এতো শত চিন্তার মাঝে শুধু মাথা দুলাল। কোনমতে ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল সে। অনেক দূর অবদি হেঁটে এলো। এখন প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল দমটা বন্ধ হয়ে আসছিল। দ্রুত ফোনটা বের করে কল করলো আহনাফ। শান্ত কল রিসিভ করে শীতল গলায় বলল, “কি হয়েছে?

“অনেক কিছু! অশান্ত আজ অনেক কিছু হয়েছে, আহনাফ আমাকে, আহনাফ আমাকে ডেটের জন্যে বলেছে।

শান্ত আবারো শীতল কণ্ঠে বলল, “এতে কি হয়েছে? এতো হাইপার হবার কি আছে? তুমি তো এটাই চাইতে.

“কিন্তু অশান্ত আমি..

কথা শেষ হবার আগেই শান্ত বলে উঠল, “চশমিস সেদিন তোমার কার্ড পড়েছিল ও!

নিঝুম থেমে গিয়ে, “কিহ?

“তোমার সেই লাভ লেটার, যেটা গাড়িতে ফেলে এসেছিল তুমি। আহনাফ জানে সেটার কথা।

“কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন..

“হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম ওটা ও পড়েনি। কিন্তু আহনাফ কিছুুদিন আগেই আমাকে বলেছে সেই কার্ডের কথা। কার্ডের ভেতর লেখা তোমার মনের কথা জানে আহনাফ!

ব্যস নিঝুম কল কেটে সেখানেই নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পুরো শরীর থমকে গেছে। এর অর্থ আহনাফ জানে সবটা! এখন.. এখন কি করবে সে!

শান্ত ফোনটা বিছানায় রেখে দিল। অমি কে কোলে নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। হঠাৎ করেই খুব ঘুম আসছে তার, খুব!
#তোমার_মনের_মধ্যিখানি 🌼
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৩৯

কলিং বেল বেজে যাচ্ছে পর পর, শান্ত’র ইচ্ছে করছে না বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে। অমি থরমড়িয়ে উঠে তাকাল দরজার দিকে। তারও বুঝতে বাকি নেই কেউ একজন এসেছে। এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে গেল।‌ছুটে গেল দরজার কাছে, ঘাড় বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। অনেকটা বিরক্তি নিয়ে শান্ত এবার উঠল বিছানা ছেড়ে। বিরক্তি টা দ্রুত রাগে পরিণত হয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। বেশ রাগ নিয়েই দরজা খুলল। খানিকটা অবাক হলো তবুও বিরক্তি স্বরে বলল, “তুমি!

চশমিস হাঁপিয়ে উঠেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে, দেখি সরুন তো।

ধাক্কা দিয়ে শান্ত কে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল নিঝুম। দৌড়ে গেল রান্না ঘরের দিকে, ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেতে লাগল। শান্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সোফায় এসে বসল। শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি হয়েছে? এতো তাড়াহুড়ো করে কেন এলে?

“কি হয়েছে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, এটা কি আমার জিজ্ঞেস করা কথা নাহ!

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথা গুলো বলল নিঝুম। শান্ত দৃষ্টি সরিয়ে কথাও ঘুরয়ে জিজ্ঞেস করল, “খেয়েছ কিছু?

“না, ক্ষিধে পেয়েছে।

“ভাত আর ইলিশ মাছের তরকারি আছে, খাবে!

“নাহ, ইলিশ মাছ খাবো না।

“কেন?

“ইচ্ছে করছে না, তাই!

শব্দ করে শ্বাস ফেলল শান্ত। রান্না ঘরে ঢুকে ফ্রিজ থেকে ডিম করে বলল, “ডিম ভাজা দিয়ে খাবে!

“আপনি আমায় ভাত ভাজা করে দিবেন।

“আমাকে তোমার কি মনে হয় বলো তো, আমার বাসায় এসে আমাকেই এভাবে অর্ডার করছো।

“আপনার ভাগ্য ভালো, আমি আপনার সাথে স্বাভাবিক ভাবে এখনো কথা বলছি। এখন রেঁধে দিন খুব ক্ষিধে পেয়েছে আমার।

বলেই মুখ ঘুরিয়ে নিল নিঝুম। শান্ত’র ইচ্ছে করল কিছু কঠিন কথা বলতে, কিন্তু কেন যেন আর বলতে পারল না। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সে পেঁয়াজ কাটতে লাগল। চোখ ঘুরিয়ে তাকাতে লাগল নিঝুমের দিকে। বুঝতে পারছে না এই মেয়েটা কিসের এতো অধিকার দেখাচ্ছ। রাগ তো এখন নিজের উপর উঠছে। সেও কেন তার কথা শুনছে!

নিঝুম চট করে উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, “আমি ফ্রেস হয়ে আসছি!

শান্ত খুন্তি হাতে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলে উঠল, “কি হচ্ছে টা কি, তুমি কি পেয়েছ বলো তো।

কথার পাত্তা দিল না নিঝুম। ফ্রেস হয়ে এসে দেখল শান্ত প্লেটে খাবার রেখে সোফায় বসে আছে। নিঝুম এক গাল হেসে বলল, “ধন্যবাদ অশান্ত!

“খেয়ে দেয়ে বের হও জলদি!

“আপনার সাথে আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।

শান্ত কৌতুহলী স্বরে, “কি?

“খেয়ে নেই, পরে বলছি!

নিঝুম খেতে আরম্ভ করল। শান্ত নিশ্চুপ হয়ে দেখছে তাকে। শান্ত’র দিকে ফিরে চামচ উঠিয়ে বলল, “অশান্ত আপনার রান্না তো অসাধারণ। এক চামচ খেয়ে দেখবেন।

“আমি রোজ’ই খাই, তুমি খাও!

বলেই উঠে পড়ল। ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে গরম করতে লাগলো সে। ক্ষিধে এখন তারও পেয়েছে। নিঝুম উঠে এসে দাঁড়াল শান্ত’র পাশে। অমিও এসে হাজির। নিঝুম খানিকটা দূরে সরে গেল। বাটিতে ক্যাট ফুড ঠেলে অমি’র কাছে এগিয়ে দিল শান্ত। নিঝুম হঠাৎ বলে উঠল, “অশান্ত আমি এখন কি করবো?

শান্ত অপ্রস্তুত গলায়, “কোন ব্যাপারে?

“আহনাফ পরশু তার সাথে ডেটে যেতে বলেছে আমাকে।‌

ক্ষীণ স্বরে কথাটা বলল নিঝুম। চামচ দিয়ে খাবার নড়াচড়া করছে সে। শান্ত’র এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই বলেই উঠল, “তো বেশ তো যাও!

নিঝুম এবার ওদিকে গিয়ে, “আপনি ফোনে বললেন আহনাফ আমার কার্ড পড়েছে, সত্যি!

“হুম।

নিঝুম অস্থির হয়ে, “এখন আমি কি করবো?

“কি আর করবে, এতোদিন যেটা চেয়েছিলে সেটাই তো পেয়ে যাচ্ছো।

“কিন্তু অশান্ত আপনি বুঝতে পারছেন না।

“না বোঝার কি আছে।

নিঝুম খাবার মুখে নিয়ে কিছু একটা বলল,‌শান্ত সেটা বুঝতে না পেরে তার দিকে ফিরল। অতঃপর নিজের খাবারের প্লেট হাতে সোফায় এসে বসল। পিছন পিছন আসছে নিঝুম। শান্ত খাবার মুখে দিয়ে বলল, “এতো টেনশন করো না, আহনাফ যখন ডেটে যেতে বলেছে এর অর্থ ও নিজেও তোমাকে নিয়ে কিছু অনুভব করছে।

“আপনাকে বলেছে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত মাথা নাড়ল। নিঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শান্ত এবার উঠে গিয়ে আবারো গেল রান্না ঘরের দিকে। ফ্রিজ থেকে সফট ড্রিংকের ক্যান বের করে মুখে পুড়ল। পেছন পিছন আবারো এলো নিঝুম। মুখে চামচ নিয়ে শান্ত’র সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “অশান্ত এখন আমি কি করবো, খুব ভয় করছে আমার।

“ভয়ের কি আছে?

“জানি না, অশান্ত!

“কি হলো কি?

“জানি না, অন্যরকম লাগছে আমার। কেমন জানি মনে হচ্ছে।

শান্ত’র চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল নিঝুম। শান্ত চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “আমাকে কেন এসব বলছো?

‘নিঝুম আবারো ঘুরে ওদিক গিয়ে শান্ত’র‌ সামসামনি এসে দাঁড়াল।

“অশান্ত!

‘এই তুমি থামবে, তোমার নাম চশমিস না দিয়ে বাচাল দেওয়া দরকার ছিল।

“অশান্ত আমি কিছু বুঝতে পারছি না, আহনাফ বলেছে তিনি কফি শপের বাইরে থাকবে, আমার যেতে ইচ্ছে যেতে না হলে দরকার নেই। টেনশনে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, অশা..

কথা শেষ করবার আগেই শান্ত রেগে বিরক্ত হয়ে নিঝুম কে দেওয়ালে চেপে ধরল। থতমত খেয়ে গেল নিঝুম। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল শান্ত,
“কি বুঝতে পারছো না তুমি, তুমিই তো একসময় বলেছিলে আপনাকে কে পছন্দ করো তুমি। তার জন্য কার্ডে লিখো নি, ওকে তুমি ভালোবাসো। তিশা কে প্রথমবার আহনাফের সাথে দেখে কাদো নি, যতবার ওদের একসাথে দেখেছ ততোবার রেগে যাও নি। আমায় এসে বলো নি, ওদের একসাথে সহ্য হচ্ছে না। এতো দিন এসব আহনাফ না জানলেও তোমার অনুভূতি’র কথা এখন জানে সে। আহনাফও পা বাড়িয়ে দিয়েছে, তাহলে তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন। পিছিয়ে পড়তে চাও, এসবের পর এতো কিসের দ্বিধা তোমার। তুমি কি এখনো বুঝতে পারছো না কাকে ভালোবাসো। তোমার অনুভূতিটা কার জন্য! কাকে চাও তুমি…
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থেমে গেল শান্ত। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিঝুমের দিকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিঝুম। ঢোক গিলল শান্ত। নিঝুমের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। মোহিত হয়ে পড়ে সে, ভুল করে বসল নিঝুমের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে। নিজের অনুভূতি গুলোকে সামলাতে ব্যর্থ হলো শান্ত আরেকবার। একা এই সময়টা যেন তার আবেগ কে নিজের আয়ত্তে রাখতে ব্যর্থ হলো। মুখ ঘুরিয়ে নিল নিঝুম! বোধ হলো শান্ত, এমন অস্বস্তিকর পরিবেশ হবে এটা কল্পনাও করে নি সে। দ্রুত পিছিয়ে এলো সে। কি করবে কিছুই বুঝতে পারল না। বিচলিত হয়ে আবারো এসে বসল সোফায়। নিঝুমের দিকে ফিরে তাকানোর মতো সাহস এখন আর তার নেই। নিঝুম ফিরে এলো রান্না ঘর থেকে। শান্ত’র বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল মুহুর্তেই। নিঝুম নিশ্চুপ হয়ে এসে বসল তার’ই সামনে। নির্বিকারে খেতে লাগল, ভাবটা এমন কিছুই হয় নি।
শান্তও চুপচাপ খেতে লাগল। কিন্তু এখন আর খাবারে মন নেই তার। সময়টা নিরবেই গেল, খাওয়া শেষ করে রান্না ঘরের দিকে গেল নিঝুম।‌ শান্ত বহু কষ্টে ওদিকে মুখ করে তাকাল। নিঝুম পানি খাচ্ছে, অমিও তার খাওয়া শেষ করে শান্ত’র পায়ের কাছে এসে বসল। খাওয়া হচ্ছে না শুধু শান্ত’র। পানি খেয়ে এসে আবারো সোফায় এসে বসল নিঝুম। শান্ত’র ভাবটা এমন সে খুব মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। নিঝুম শান্ত’র দিকে ফিরে বলল,‌”অশান্ত! এখনো খাচ্ছেন আপনি!

খানিকটা কেঁপে উঠল শান্ত। দ্রুত তা সামলে নিচের দিকে তাকিয়েই বলল, “হুম!

“আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি, আর ধন্যবাদ!

শান্ত জবাবে মাথা নাড়ল। নিঝুম ব্যাগটা কাঁধে নিল। পা বাড়িয়ে দরজার দিকে আগাতে নিল। শান্ত মুখ ফিরে তাকালো পিছনের দিকে অমনি নিঝুম আবার পিছন ফিরল। সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিল শান্ত। নিঝুম ডেকে উঠল, “এই অশান্ত, দরজা বন্ধ করুন!

“আসছি!

শান্ত উঠে দাঁড়াল। নিঝুম দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা সাহস জুগিয়ে সামনের দিকে তাকাল শান্ত। নিঝুমের মুখোমুখি হয়ে বলে উঠল, “কি করবে তুমি এখন?

“ভেবে নিয়েছি!

“তাহলে যাচ্ছো পরশু।

মৃদু হাসল নিঝুম। শান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিঞ্চিত হাসল!

——

শান্ত কে কল করেছে অনেকক্ষণ, কিন্তু এখনো এসে পৌঁছাল না। অস্থির হয়ে আহনাফ কল করল আরেকবার! রিসিভ করে ওপাশ থেকে শান্ত কিছু বলার আগে আহনাফ বলে উঠল, “এতোক্ষণ লাগে তোর আসতে!

“দরজাটা খুল।

“আসছি!

কলটা কেটে এগিয়ে গেল আহনাফ। শান্ত কে দেখতে পেয়ে অস্থিরতাটা কিছুটা কমল। দুজনেই উঠে এলো ছাদে। শান্ত গ্রিলের উপর বসে পড়ল, পাশে দাঁড়িয়ে আহনাফ!

“কি হয়েছে এতো জরুরি তলব।

“কিছু না, এমনেই তোকে দেখতে ইচ্ছে করছিল।

“তোর কি মনে হয় না তুই একটু বেশি টেনশন করছিস।

“নিঝুম তোকে বলেছে তাই নাহ।

“তাতে কি? তুই তো কিছু বলিস নি।

“আমি বলতাম, কিন্তু এটাও জানতাম বের হয়ে তোর সাথেই প্রথমে কথা বলবে।
শান্ত’র দিকে ফিরে কিঞ্চিত হেসে কথাটা বলল আহনাফ। শান্তও মুচকি হাসল।
হাতের ব্রেসলেট টা ঘুরাতে ঘুরাতে কথাটা বলল শান্ত। এই ব্রেসলেট টা আহনাফ’ই গিফট করে ছিল। মজার বিষয় ছিল, ব্রেসলেটের এক কোনে নাম লেখা ছিল। শান্ত’র‌‌ হাতে যেই ব্রেসলেট তাতে লেখা আহনাফের নাম আর আহনাফের টাতে শান্ত’র নাম। শান্ত’র মন টা যেন হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গেল। মন ভালো করার আরেকটা বিষয় ছিল আজকের চাঁদ। আহনাফ চাঁদের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে বলল, “চাঁদ টা আজ বড্ড সুন্দর!

“হুম অনেকখানি, আজ পূর্ণিমা নাকি!

“হুম। আচ্ছা শান্ত, তোর কি মনে হয়। নিঝুম কাল আসবে।

“বোধহয় আসবে!

“এর অর্থ তুই নিজেও সিউর না।

“তুই কি সিউর।

“শান্ত জানিস, আমি খুব করে চাই কাল ও আসুক।

“একটু বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিস দেখি।

“ভালোবাসা কি না জানি না, তবে কিছু একটা তো আছে।

শান্ত হাসল। ইচ্ছে করল একবার তানিশার কথাটা বলতে। কিন্তু বলল না, থাক বলে আর কি হবে। তানিশাও কম কিছু ভালোবাসে না ওকে। কিন্তু সত্যি কথাটা তো এটাই, “যে আমাদের ভালোবাসে আমরা তার কদর দেই না, বরং যাকে আমরা ভালোবাসি তার পিছুই ছুটতে থাকি।” সেই দশা এখন তানিশার।

শান্ত হাত বাড়িয়ে আহনাফের পকেট থেকে ফোনটা বের করল।‌অন করতেই তিশার ছবি ভেসে উঠল।‌ শান্ত হেসে বলল, “এখনো এটা চেঞ্জ করিস নি।

“কালকের পর করবো।

শান্ত ভ্রু কুঁচকে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক না আহনাফ।

“কেন?

“আমার ফোনে তোর আর আমার ছবি। তুই তো পারতি তোর ফোনে আমার আর তোরটা রাখতে।

“না, রাখবো না বলেই ভেবে রেখেছি।

“আহনাফ!

“অনেক রাত হয়েছে, চল খেতে আয়। বাবা আজ রান্না করেছে তোর জন্য।

আহনাফ এগিয়ে গেল। শান্ত দাঁড়িয়ে বলল, “আহনাফ দাঁড়া!

“কি?

“আজ তো একটা ফয়সলা হয়েই যাবে?

“কোন ব্যাপারে?

“বল কে? আমি নাকি নিঝুম? বন্ধুত্ব নাকি ভালোবাসা!

শান্ত জানত আহনাফ হেসে বলবে, “পাগল হলি নাকি, বাচ্চাদের মতো কথাবার্তা বলছিস। কিংবা নিবে তার নাম। কিন্তু না, এবার তা না করে আহনাফ বলে উঠল, “ভালোবাসা!

“তুই ভালোবাসার জন্য আমাকে ছেড়ে দিবি আহনাফ!

“যা ছেড়ে দেব কোথায় বললাম।

“যা! কথা নেই তোর সাথে!

হন হন করে বের হয়ে গেল শান্ত। ওই এতো টুকু ব্যাপারে শান্ত মারা*ত্মক রাগ করে বসল। আহনাফ তার নামটা নিল না কেন?
রাতে খাবার শেষে বাসায় ফিরে আসা অবদি আহনাফের সাথে একটু কথা বলল না শান্ত। আহনাফ বেশ অবাক হলো কিন্তু বেশ মজা লাগছিল তার। তাই আর কথা বাড়াল না। কিন্তু বাসায় পা রাখতেই শান্ত’র মন বদল হয়ে গেল। কেমন এই নিস্তব্ধ রুমে নিজেকে খুব একা লাগছিলো তার। নিঃসঙ্গতা যেন ঘিরে ধরল তাকে। নিঝুমের কথা মনে পড়তে লাগলো বেশ। বেডরুমটা অন্ধকার করে রেখে বিছানার কাছে এসে মেঝেতে বসে পড়ল সে। ফোনটা বের করে অন করতেই ভেসে উঠল তার আর আহনাফের ছবি। মনে পড়ে গেল আহনাফের ওই কথা। নিজেকে আরো একা বলে মনে হলো। রাত অনেক, তবুও কি ভেবে ফোন করতে নিল নিঝুম কে। কিন্তু ফোন যাবার আগেই তড়িখড়ি করে কেটে দিল ফোনটা। অন্যদিন হলো অনেক মেসেজ আসতো নিঝুমের থেকে। কিন্তু আজ এলো না, ফেসবুকে নিঝুমের আইডি থেকে কোন নৌটিফিকেশনও না। আইডিটা আরো ১ ঘন্টা আগেই এক্টিভ ছিল তবুও কি মনে পড়ল না চশমিসের অশান্ত কে। ক্লান্তি চলে এলো মনের ভিতর। হাঁপিয়ে উঠেছে শান্ত নিজের সাথে লড়তে লড়তে। চোখ বন্ধ করে বসে রইল চুপটি করে।

আজকের সকালটা সুন্দর! ভোরে উঠা আহনাফের স্বভাব। হঠাৎ আজকের সকালটা অন্যরকম বলে মনে হচ্ছিল তার। তিশা তাকে ছেড়ে চলে গেছে আজ ৪ টা মাস হতে চলল। নিজেকে এতো তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিতে পারবে ভাবতে পারে নি আহনাফ!
আজ সাদা পরনে সবকিছুই সাদা। সাদা রঙের মাঝে আহনাফ কে শুভ্রর মতো লাগে। কেমন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে আহনাফ, কফি শপের বাইরে। ঘড়ির কাঁটা চলছে নিজ গতিতে, একে থামাবার কেউ নি। কিন্তু যতোই সময় আগাচ্ছে ততোই যেন ভয় বেড়ে যাচ্ছে আহনাফের। শান্ত কে ৫ বার কল করেছিল, শান্ত ধরল না। গতরাতের রাগ নিয়ে কি এখনো বসে আছে নাকি। ভেবে রেখেছ নিঝুম না আসলে শান্ত’র কাছেই যাবে সে।

আধঘন্টা পার হয়ে গেল, নিঝুমের এখনো দেখা নেই। আহনাফ ভেবে নিল নিঝুম বোধহয় আর আসবে।‌ এতোটা দুঃখ পাবার কথা ছিল না, তবুও মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। গাড়ির দরজা খুলে শেষবারের মতো চোখ বুলাল রাস্তায়। হঠাৎ করেই দেখল নিঝুম আসছে। কাঁধের ব্যাগটা আলতো করে ধরে হেঁটে আসছে নিঝুম।‌দুজনের চোখাচোখি হতেই নিঝুম একগাল হাসল। স্বভাবমতো উঁচু করে হাত উঠিয়ে হাত নাড়াল সে। আহনাফ কিঞ্চিত হেসে পা বাড়াল। নিঝুম আজ পরেছে সাদা রঙের একটা টপস। গলায় বেবী পিংক রঙের একটা উড়না। কাকতালীয় ভাবে হলেও দু’জনের চয়েজ এতোটা মিল হয়ে গেল অদ্ভুত ভাবেই। আহনাফের মনে হচ্ছিল নিঝুম কে অন্যদিনের চেয়ে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। সে এগিয়ে এসে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।

“যাহ, এসে পড়লাম তো।

আহনাফ মৃদু হাসল। হাত বাড়িয়ে বলল,‌”চলো যাওয়া যাক।

মাথা নেড়ে চোখের চশমা ঠিক করে পা বাড়াল নিঝুম!

সময়টা পেরিয়ে গেল দারুন ভাবে, কিছুটা এগিয়ে নেওয়া যাক তাহলে। রাত তখন শুরু। এই ৮ বাজে বোধহয়! আজানের আওয়াজে চারদিক মুখোরিত। ঝড়ের গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে শান্ত! মুখ চোখ লাল হয়ে আছে তার, নিজেকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। গায়ের শার্টটা ঘেমে একাকার। শ্বাস নিতেও এখন কষ্ট হচ্ছে অনেক। কষিয়ে গাড়ি ব্রেক করল করল শান্ত। হাতের ব্রেসলেট টা খুলে রেখে দ্রুত বের হয়ে এলো সে। আর একটু থাকলে যেন মরেই যেত সে। শ্বাস নিতে এখনো কষ্ট হচ্ছে তার।‌ ইচ্ছে করছে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বুক করে শ্বাস নিতে। সামনের ভবনের দিকে তাকাল সে।

এতো উঁচু ভবনের একদম উপরে শান্ত। নিজেকে এতোটা নিঃশ্ব বোধহয় আগে কখনো মনে হয় নি তার। ছাদের এক কোনে ধপাস করে বসে পড়ল সে। না মন মানাতে পারে নি সে , পারে নি নিঝুমের জন্য আনা সেই অনুভূতিগুলো ভুলে যেতে। এমনটা কি খুব দরকার ছিল, না হলেই কি হচ্ছিল না। অজান্তেই চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আহনাফ আর নিঝুমের ঘনিষ্ট মুহূর্তের কথা। যতোই ভাবছে ততোই যেন একাকী হয়ে পড়ছে। খুব জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে এখন। উঠে দাঁড়িয়ে গ্রিলের এপাশ হয়ে বসে পড়ল।‌ উপরের দিকে তাকাল, চাঁদ কে অনেকটা অস্পষ্ট দেখছে। নিচে তাকাতেই গম্ভীর হয়ে গেল। জায়গাটা ভীষণ ফাঁকা, ওপারে রাস্তায় ব্যস্ত হয়ে গেছে গাড়ির ছোটাছুটিতে। কানে বাজছে আহনাফের কথা। আহনাফ বলেছিল ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের মাঝে সে ভালোবাসা বেছে নেবো। কেন বলল এই কথা আহনাফ। মন মানাতে পারছে না শান্ত। তাকে যদি বলা হতো তাহলে সে বন্ধুত্ব’ই বেছে নিতো। কিন্তু ভালোবাসা! সত্যি কি তাকে এতো অবহেলা করা যেত। শুকনো ঢোক গিলল শান্ত, মাথায় চেপে বসল অন্যকথা। উঠে দাঁড়াল সে।
১০ তলা এই উঁচু ভবনের গ্রিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে শান্ত শক্ত হাতে। রাতের আঁধারে ঢেকে যাওয়া চাঁদ এবার উঁকি দিয়েছে। নিজে তাকিয়ে হাজারো ব্যস্ত গাড়ি ছোটাছোটি করতে দেখছে। কি করবে এখন শান্ত, এক পা কি বাড়িয়ে দেবে। কেন বা দেবে না। আজ সে হেরে গেছে। একজন বন্ধুর কাছে হেরে গেছে, হেরে গেছে ভালোবাসার কাছে। তাকে বেছে নিতে হতো হয়তো বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসা। কিন্তু সত্যি কি তা সম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়াল শান্ত। অতঃপর….

রাত তখন ১০ টা! আহনাফ অনেকটা ক্লান্ত।‌আজকের দিনটা বেশ স্মরণীয় তার কাছে। ইচ্ছে মতো একটি ছবি সেট করে রাখল ওয়ালপেপারে। হঠাৎ মনে পড়ল শান্ত’র কথা। ঘন্টা খানিক আগেও কল করছিল তাকে। অবাক করার মতো কান্ড ছিল শান্ত তাকে একবারও কলবেক করল না। বিব্রত হয়ে আবারো নিজেই ফোন করল। আশ্চর্য! ফোন এখন ব্যস্ত। কার সাথে কথা বলছে শান্ত। আহনাফ কল কাটলো। দু মিনিট কল করতে যাবে অমনি ফোন বেজে উঠল। প্রথম শান্ত ভাবলেও পরক্ষণে আহিমের নাম চোখে পড়ল। হালকা কেশে কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যালো!

“আহনাফ!

“হুম, আচ্ছা শান্ত কি তোর সাথে এখন। শয়*তান টাকে কখন থেকে কল করছি , ধরছে না কেন? দে তো একটু ওকে।

অনেকটা অপ্রস্তুত গলায়, “আসলে আহনাফ…

“কি হয়েছে?

জোরে জোরে শ্বাস নেবার শব্দ ভেসে আসছে কানে।প্রতিমুহূর্তে হুমড়ি*ধুমড়ি করে বাড়ি থেকে বের হলো আহনাফ। কানে এখন একটাই কথা বাজছে তার। শান্ত’র এক্সি*ডেন্ট হয়েছে। শান্ত কে কল করতে গিয়ে পুলি*শ ফোনটা রিসিভ করে আর বলে। ব্যস যথেষ্ট ছিল এতোটুকু। কোথায় কি হলো কখন হলো কিছুই শুনলো না। ছুটে বেরিয়ে গেল শুধু। সারা শরীরে এখন অদ্ভুত এক ধরণের অনুভব। এই মনে হচ্ছে তার সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে তার থেকে। চোখের সামনে সবকিছু ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here