তুমি বললে আজ ২ পর্ব -০৯

#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ০৯.

.
অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মানুষ মুষড়ে পড়ে। পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং সময়টা থেকে ছিটকে ফেলে অনেককে। কিন্তু আমি? আমার কি করা উচিত এই অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত ঘটনায়। কি রিয়াকশন দেওয়া উচিত আমার? এখনো সেটাই স্থিতি করতে পারি নি। তাসফি ভাইয়া নিজের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে নিয়েছেন নড়াচড়া করারও শক্তি যেন হাড়িয়ে ফেলেছি। ওনার থেমে থেমে ফেলা নিশ্বাস বারংবার আমার ঘাড় ছুঁয়ে বুকে, পিঠে আছড়ে পড়ছে, শিরশির করে উঠছে যেন শরীরের প্রতিটা লোম গুলো।
এই মুহুর্তে ওনাকে তো দূরে ঠেলে দেবার কথা, কিন্তু সেই কাজটা কেন করতে পারছি না আমি, কেন নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি না ওনাকে? চার বছর পর ওনার একটুখানি ছোঁয়া কি আমাকে দূর্বল বানিয়ে দিলো? হোক না সেটা দ্বিতীয়বারের মতো।

প্রায় দশ মিনিটের মতো একই ভাবে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছেন তাসফি ভাইয়া। মনে হচ্ছে একটুখানি ছাড়া পেলেই পালিয়ে যাবো দূরে কোথায়, হারিয়ে যাবো ওনার থেকে বহুদূর। দীর্ঘ চার বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো ওনার ছোঁয়া থেকে কেন জানি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। মিশে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে নতুন তাসফি ভাইয়ের পুরোনো ছোঁয়া পাবার আসায়।
নিজেকে সংগত করে হালকা নড়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। একটু সময় নিয়ে যখন ওনাকে সরাতে পারলাম না, তখন আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ছাছ্..ছাড়েন…. কেক্..কেউ চলে আসবে তো।”

ছাড়লেন না উনি, একই ভাবে জড়িয়ে রাখলেন আমাকে। আমি আবারও নড়াচড়া করে ওনাকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলে উঠলাম,
“তাসফি ভাইয়া, ছাড়েন না প্লিজ! কেউ চলে আসবে তো, কি ভাববে এভাবে দেখলে?”

“প্লিজ রুপু, আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বলিস না, এতটা অচেনা হয়ে আমার সামনে থাকিস না, এত শত অভিমান আমার প্রতি রাখিস না। নিতে পারছি না আমি তোর এই বদলে যাওয়াটা, ভাবতে পারছি না আমার প্রতি তোর এই পাহাড় সমান অভিমানটা।”

আবারও কেঁপে উঠলাম আমি। কি ছিলো ওনার বলা কথাগুলোর মাঝে? এতটা আবেগ, এত শত অনুভূতি জ্বড়ানো কথাগুলো আমাকে যেন নাড়িয়ে দিলো, আর ভালোবাসা? ভালোবাসাটাও তো মিশে ছিলো ওনার বলা প্রতিটা কথায়।
কিন্তু আমি তে বদলে যেতে চাই নি, অচেনা হতে চাই নি ওনার সামনে, আর না চেয়েছি ওনাকে ছেড়ে যেতে। কিন্তু উনি…. উনিই তো আমাকে ছেড়ে গেছেন, ফেলে রেখে গিয়ে ছিলেন আমার এই ছোট মনে হাজারো আঘাত ও য*ন্ত্র*ণা দিয়ে। তবুও তো আমি চেয়েছিলাম ওনাকে, শত শত পাগলামি করেছিলাম ওনার জন্য। কিন্তু আমার ছোট মনটা কাঁচের মতো ভেঙে দিয়ে উনিই তো মেতে ছিলেন কিয়ানা তে…..

কিয়ানার কথা মাথায় আসতেই মনে পড়লো সাড়ে তিন বছর আগের একটি বিকেলের কথা, যদিও অ্যামেরিকার ফ্লোরিডা শহরে তখন গভীর রাত। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত তিক্ত স্মৃতিগুলো দৃশ্যপট হতেই হু হু করে উঠলো ভেতরটা। বারবার মনে হতে লাগলো ওনার ছোঁয়ায় দ্বিতীয় নারী আমি, কিন্তু আমি তো সেটা হতে চাই না…. চাই না আমার জিনিসে কাউকে ভাগ দিতে। কিন্তু উনি তো ওনার পুরোটাই অন্য কাউকে বিলিয়ে দিয়েছেন, কি করে মেনে নিবো আমি এটা?
ছটফটিয়ে তাসফি ভাইকে ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আবারও। সামান্য জোরেই বলে উঠলাম,
“তাসফি ভাইয়া…. বললাম না ছেড়ে দিতে? আমার এসব পছন্দ নয়, আর কতবার বলবো আপনাকে? ছাড়েন বলছি।”

ওনার হাতটা একটু হালকা হতেই দু’হাতে ওনার বুকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিলাম। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস টেনে নিতেই তাসফি ভাইয়া আবারও এগিয়ে এলেন আমার দিকে। গালে দু’হাতে আলতো করে ধরে নরম গলায় বলে উঠলেন,
“এত কিসের অভিমান তোর, আমার প্রতি? কি করেছি আমি? কি ভুল করেছি আমি, বল রুপু? এতদিন আমাকে এড়িয়ে গেছিস, দিনের পর দিন লুকিয়ে থেকেছিস, আর কালকে আসার পর থেকে আমার সাথে এমন করছিস। কেন…. কি করেছি আমি?”

“কি করেছেন, জানেন না আপনি? নাকি বোঝার চেষ্টা করছেন না, কোনটা? এখন আমার থেকে জানতে চাইছেন, কি ভুল করেছেন?”

“হ্যাঁ… মানছি আমি, ভুল করেছি। অনেক বড় অন্যায় করেছি আমি তোর সাথে, কিন্তু কেন? এই কেন-র উত্তর তো জানতে চাইলি না?”

“জানতে চাই না আমি, আপনার কোন কিন্তু-র জবাব জানতে চাই না আমি। শুধু জানি আপনি আমায় ঠকিয়েছেন তাসফি ভাইয়া বলে, খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছেন। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ নিয়ে খেলা করেছেন, উড়ন্ত মনে প্রেম জাগিয়ে ধপ করে নিভিয়ে দিয়েছেন। আপনি খুব খারাপ তাসফি ভাইয়া, আপনি খুব খারাপ …. ”

ধরা গলায় কথাগুলো শেষ করেই ঝরঝর করে চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুধারা। সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে মুছে নিলাম। কিছুতেই এই মানুষটার সামনে কান্না করতে চাই না আমি, দেখাতে চাই না নিজের দূর্বলতা। দুই পা পিছিয়ে এসে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম, বারান্দার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাথা উঠিয়ে ওনার দিকে তাকালাম, অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার দিকে তাকিয়েই আস্তে করে বলে উঠলাম,
“ফুপি অনেক কষ্ট পাচ্ছে আপনার জন্য। ফুপিকে অতন্ত কষ্ট দিয়েন না আপনি।”

“আর আমার কষ্ট গুলো? প্রতিনিয়ত জ্বলতে থাকা আমার বুকের দহন গুলো কে নিভিয়ে দিবে?”

অকপটে বলে উঠলেন তাসফি ভাইয়া। তাকানোর সাহসটা আর হলো না আমার, পিছন ফিরে বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে এলাম ওনার রুম ছেড়ে। তা না হলে ওনার কথাগুলো মায়ায় আবারও জড়িয়ে দূর্বল বানিয়ে দিবেন আমায়, নতুন ভাবে আশা জাগাবেন ছোট মনের কুঠিরে, আবার এক পলকে সেটা ভেঙে গুড়িয়েও দিবেন। না…. আর কিছুতেই সেই সুযোগটা ওনাকে দিবো না আমি, দূর্বল হয়ে যাবো না ওনার সামনে।

.
রুমে ঢোকার আগেই আম্মু এসে আটকে দিলেন। সবাইকে ডেকে দিয়ে সকালের খাবার খেতে যেতে বললেন। যদিও এখন সকাল বলা যায় না। অন্যদিনের তুলনায় আজকে বাসার পরিবেশটা পুরোটাই ভিন্ন, সকালের খাবারটাও তৈরি হয় নি ঠিক সময়ে। আজকে আর আম্মু কথা পিঠে না বলার ইচ্ছে হলো না। মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের রুমে না গিয়ে রিফাপুর রুমে ঢুকলাম, আম্মু চলে গেল সামনের রুমে, মানে তাসফি ভাইয়ার রুমে ওনাকে ডাকতে। আমি রিফাপুর রুমে ঢুকে রিমি আপু ও রিফাপুকে আসতে বললাম। রিফাপু না যেতে চাইলেও রিমি আপুর জন্য আসতে বাধ্য হলো। তারপর সাহিল ভাইয়া, সাগর ভাইয়া ও রাহাত কেও ডেকে নিলাম।

প্রতিদিনের মতো আজকে আর হৈ হুল্লোড় হলো না খাবার টেবিলে, আর না কেউ কোন কথা বললো। সবাই চুপচাপ খেয়ে গেল শুধু। তাসফি ভাইয়া আমার সামনে বসায়, ওনার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম থেকে থেকে তাকাচ্ছেন উনি আমার দিকে। কেমন জানি অ*স্বস্তি হতে লাগলো ওনার আজকের তাকানো দেখে। তাই দ্রুত খাওয়া শেষ করলাম। টেবিল ছেড়ে ওঠার সময় একবার তাকালাম ওনার দিকে, মানুষটা তখনও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ওনাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আমি।

রুমে এসে দরজাটা স্বযত্নে লাগিয়ে দিয়ে পায়চারী করে চলেছি রুম জুড়ে। ভেবে চলেছি তাসফি ভাইয়ার বলা কথা। কি বোঝাতে চাইছিলেন উনি? কেন চলে গেছিলেন? তখন ফুপিও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল, ফুপির না বলা কথাতেও কিছুটা বুঝে গেছি তাসফি ভাই আমার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন, কিন্তু কেন? আমার জন্য কেন-ই বা চলে গেলেন উনি? কই…. আমি তো কিছু করি নি, ওনাকে বারবার আটকাতে গিয়েও তো আমাকে উপেক্ষা করে চলে গেছিলেন। তাহলে? তাহলে ফুপি কেন বললো আমার জন্য? উফ্…. সব কিছু কেমন জানি জট বেঁধে যাচ্ছে মাথায়। ভাবতে পারছি না কিছু।
মাথাটা প্রচন্ড ভার ভার লাগছে, এই মুহুর্তে কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন আমার। বাসার এত ঝামেলায় কলেজেও যাওয়া হয়ে উঠে নি। কিছুক্ষণ পরেই বারোটা বেজে যাবে, তাই গোছলটাও সেরে নিতে হবে, এতে যদি কিছুটা হলেও মাথার ভার ভার ভাবটা কমে যায়।
ওয়াশরুমে ঢুকে চটজলদি গোছল সেরে বেরিয়ে এলাম। কিছুটা হলেও মাথা ভারী ভারী ভাবটার লাঘব হলো। চুলটা ভালোভাবে মুছে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। উপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ দু’টো বন্ধ করে নিলাম। বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠলো অতীতের মিষ্টি কিছু স্মৃতির পাতা।

.
মাত্র তিন দিন আগে আমার এইটের বোর্ড পরীক্ষা শেষ হয়েছে, তার মধ্যে শীতের শুরু। আমাকে আর পায় কে, সারাদিন উড়নচণ্ডীর মতো উড়ে উড়ে বেড়ানো টাই যেন আমার একমাত্র প্রধান কাজ ছিলো। তাসফি ভাইয়াও ইন্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে লম্বা ছুটিতে এসেছিলেন বাসায়। প্রতিটি পরীক্ষাতেই আমাকে সাথে করে নিয়ে গেছেন আবার নিয়েও এসেছেন। প্রতিটা পরীক্ষায় ওনার সাথে ঘোরাঘুরিটা না হলেও শেষ পরীক্ষার দিনে একদম জেদ করেই আমাকে ঘুড়তে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। উনি একটু ধমক দিলেও ঠিকই সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছিলেন। সেদিন আমাকে বাসায় রেখে রাতের বেলা চলে যান, তারপর আর এই কয়েকদিনেও এই বাডায় আসেন নি।
তবে আজকে নাকি ফুপিদের আসার কথা। সেই সাথে আসবেন আরও একটা ভালোবাসার মানুষ। মাত্র গোছল সেরে নিজেকে পরিপাটি করতে ব্যস্ত হয়ে গেছি। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠলাম কিছুটা। ইস্ ফুপিরা চলে এসেছে হয়তো। তাড়াতাড়ি পিঠময় ছড়িয়ে থাকা ভেজা চুলটা আঁচড়ে নিলাম। বিছানা থেকে ওড়নাটা গলায় পেচিয়ে ছুটে গেলাম বাইরে।

এক ছুটে ড্রয়িং রুমের দিকে যেতেই হঠাৎ দরজার কাছে ঠা*স করে ধাক্কা খেলাম কারোর সাথে। মুখ থু*বড়ে মাটিতে পড়তে নিলেই পুরুষালী হাত দু’টো আঁটকে নিলো আমাকে। ভয়ে চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে দু’হাতে খা*মচে ধরলাম সামনের মানুষটির টি-শার্ট। কিছু সময় অতিক্রম হবার পর যখন মিটমিট করে চোখ দু’টো খুললাম, ভেসে উঠলো তাসফি ভাইয়ার অতি পরিচিত মুখটা। তাসফি ভাইয়াকে দেখে যেন মনের মধ্যে হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটাতে লাগলো। কিন্তু আমার সেই উড়ন্ত প্রজাপতিদের এক ধমকে থামিয়ে দিলেন তাসফি ভাইয়া। হালকা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

“পেঙ্গুইনের মতো এতো লাফাস কেন? বেয়াদব! সারাদিন নেচে নেচে না বেড়ালে শান্তি পাস না? আমার কোলে ওঠার জন্য হাত পা ভাঙার প্ল্যান করছিলি?”

.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here