#তুমি_বললে_আজ_২
লেখনীতেঃ #রিধিমা_জান্নাত_রূপা
পর্বঃ ১১.
.
একটা বেলা বড্ড আলসেমি তে কা*টাতে ইচ্ছে করে, নিজের ভাবনার জগতে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে, কাউকে নিয়ে ছোট ছোট কল্পনায় হারিয়ে যেতে মন চায়, সদ্য কিশোরী বয়সে পা দেওয়া খামখেয়ালী স্বভাবগুলো হঠাৎ হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে বেড়িয়ে আনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু…. কিন্তু আমার সবকিছুর সমাপ্তি যেন এক জনেতেই আঁটকে গেছে, এক জনেতেই আবদ্ধ হয়ে গেছে আমার অবাধ্য মন। চাইলেও সেই তাসফি নামক মানুষটার মায়ার বাঁধন থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছি না, কিছুতেই না। গত সাড়ে তিন বছর ধরে, হাজারো চেষ্টা করেও পারি নি তাসফি ভাইয়ের প্রতি থেকে নিজের অনুভূতি গুলো ফিরিয়ে আনতে। বরং কিশোরী বয়সের ঠুনকো অনুভূতি গুলো ক্ষণে ক্ষণে বৃদ্ধি পেয়ে বিশাল আকারে রুপ নিয়েছে।
দূরত্ব নাকি আবেগ টাকে কমিয়ে দেয়, ভুলে যেতে সাহায্য করে আবেগে বশীভূত হওয়া মানুষটাকে। কিন্তু আমি তো ক্ষণে ক্ষণে তাকে মনে করি, প্রতিনিয়ত, প্রতিটি মুহুর্ত তাকে মনে করি। তাহলে এটাকে কি বলে? শুধুই ভালোলাগা? নাকি ভালোবাসা? আমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসি? নাকি তার অজস্র মায়ায় ডুবে গেছি?
চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ডায়েরির পাতায়। চোখটা মুুছে বন্ধ করে ফেললাম। অনেক দিন পর আজ তাকে নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো, তাকে নিয়ে ভাবনাগুলো সৃষ্টিবন্ধী করতে ইচ্ছে হলো। হোক না সে অন্য করোর, থাক না তাকে ছোঁয়ার অধিকার অন্য কারোর। আমি না হয় দূর থেকেই নিজের অনুভূতি গুলো সাজিয়ে যাবো।
মোবাইলে সময়টা দেখতেই দেখলাম, প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসে ডায়েরিটা নিয়ে লিখতে বসেছিলাম, এতটা সময় কেটে যাবে বুঝতেই পারি নি।
ভালোলাগা খারাপ লাগা, সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে হলে, বড় বাবা তাসফি ভাইয়াকে হঠাৎ বলে উঠেন, সাদিক ভাইয়ার পারিবারের সাথে কথা বলতে। তাদেরকে দুই এক দিনের মাঝেই বাসায় আসতে বলতে বলেছেন। দুই পরিবার একসাথে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। বড় বাবার কথা শোনার পর পরিবারের সকলের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলোও তাসফি ভাইয়ার ভাবভঙ্গি বোঝা যায় নি। একইভাবে গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে থেকেছেন। অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়েছেন আমার দিকে, সেই চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতাটা আমার ছিলো না, সাথে সাথে সরিয়ে নিয়েছিলাম।
পানি খাবার জন্য বোতলটা হাতে নিয়ে দেখলাম ফাঁকা হয়ে আছে। উফ্! আবারও এত রাতে বাইরে যেতে হবে, তাছাড়া তো আর উপায়ও নাই। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রুম ছেড়ে বের হলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেছে, সবাই হয়তো ঘমিয়ে পড়ছে। রাত তো আর কম হয় নি।
ছোট ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বড় বসার রুমে চলে আসলাম। যদিও আমাদের রুমের সামনের টুকুকে ড্রয়িং রুম বলা যায় না, একদমই ফাঁকা থাকে।
রান্না ঘরে গিয়ে বোতলটা ভরে নিলাম। সোজা বড় ড্রয়িং রুম পেরিয়ে এপাশে আসতেই টুংটাং আওয়াজ কানে এলো, সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। মধ্য রাতের শুনশান নীরবতায় যেন আওয়াজটা বেশ স্পষ্টই ভেসে আসছে। একটু দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, ঠিক কিশোর আওয়াজ।
মিনিট দুয়েক সময় অতিক্রম হতেই বুঝতে পারলাম গিটারের টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছে তাসফি ভাইয়ার রুম থেকে। এত রাতে গিটার বাজাচ্ছেন উনি? অবশ্য এটা আর নতুন কি, চার বছর আগে তো, প্রায় প্রতি রাতেই আমার বায়না কে প্রশ্রয় দিয়ে গিটারের টুংটাং আওয়াজ তুলতেন, গেয়ে শোনাতেন আমার পছন্দের গান গুলো।
হাজারো কৌতুহল নিয়ে তাসফি ভাইয়ার রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই আরও স্পষ্ট ভাবে ধরা দিতে লাগলো সুরটা। আমাকে টানতে লাগলো যেন, ওনার তোলা সুরের ধ্বনি। অজান্তেই ভিরিয়ে দেওয়া হালকা ফাঁক করে দরজাটা ঠেলে ভেরতে এক পা রাখলাম। সাথে সাথে গিটারের টুংটাং আওয়াজের সাথে সাথে ভেসে আসলো আমার অতি পছন্দের একটা গানের সুর।
একা.. একা.. বেঁচে থাকা…
তোকে ছাড়া চলে না জীবন…
লাগে যেন… সবি ফাঁকা,
বুকের ভেতর একি দহন….
চেনা… চেনা. একি পথে,
তোরি আসায় এখনো বসে, পাশাপাশি হাটবো সাথে… আবারও খুব ভালোবেসে,…
জ্বলছে হৃদয়… উড়ছে সময়, তুই কেন থাকিস বল তবু দূরে… সবি ভুলে আয় না চলে,
বাঁধবো… প্রেমেরি বাহুডোরে…
এলোমেলো ইচ্ছে যত, ভালোবেসেছি তারি মতো, ডুবে আছি আজও তোরি প্রেমে জীবন সঁপেছি তোরি নামে.….
তাসফি ভাই গানটা থামিয়ে দিতেই চমকে উঠলাম আমি। কখন যে ওনার এতটা কাছে চলে এসেছি, বুঝতেই পারি নি। ইস্! এটা কি করলাম আমি? তাড়াতাড়ি পিছন ফিরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই ফট করে আমার হাতটা টেনে ধরলেন তাসফি ভাইয়া। আগের চেয়েও দ্বিগুণ চমকে উঠলাম যে, সাথে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো পুরো শরীর। চুপিসারে বেরিয়ে আসতে চাইলেও ওনার নজরে পরে গেলাম কিভাবে, সেটাই বুঝতে পারছি না। তাসফি ভাইয়া হাত ধরে টেনে আমাকে ওনার দিকে ফিরিয়ে নিয়েই বলে উঠলেন,
“অভ্যাস তো সেই আগের মতোই আছে, শুধু আমার কাছে বায়না করাটা হারিয়ে গেছে।”
হাত ধরে আরও টেনে এনে মাঝের দুরত্বও ঘুচিয়ে দিলেন। আলগোছে এক হাত কোমরে রেখে কাছে টেনে নিলেন। ওনার টুকরো টুকরো আলতো ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলাম আমি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে নিলাম,
“কক্..কি করছেন ভাইয়া, ছ্ছ…ছাড়েন আমায়….”
“ছাড়ার জন্য তো ধরি নি রুপু। এভাবেই আগলে রাখতে চাই, বেঁধে রাখতে চাই ভালোবাসায়।”
“ছছ্…ছাড়েন আমায়…”
ওনাকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য ছটফট করতে লাগলাম। ইস্! কেন যে আসতে গেলাম এই ব/জ্জা/ত লোকটার রুমে? এখন নিজের মাথা নিজেরই ফা/টা/তে ইচ্ছে হচ্ছে। তাসফি ভাই আমাকে ছাড়া বদলে অপর হাতেও শক্ত করে চেপে ধরলেন আমাকে, ছটফট করতেই টেনে আটকে নিলেন ওনার বুকের সাথে। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“ছেড়েই যদি দিতাম, তাহলে বেঁধে কেন নিলাম? শত চেষ্টা করেও এই বাঁধন ছিন্ন করার ক্ষমতা নেই তোর।”
একটু থামলেন উনি, সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলেন,
“এখন বল, লুকিয়ে লুকিয়ে আমার রুমে কি করছিলি? নিশ্চয়ই এতদিনের জমানো আদর খেতে এসেছিস?”
ওনার শেষ কথায় চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল আমার। আদর খেতে আসছি মানে? পাগল হয়ে গেলেন নাকি উনি? আমতা আমতা করে বলে উঠলাম,
“কি্ক…কি বলছেন আপনি? আদর খেতে এসেছি মানে, কিসের আদর? আমি তো পা….”
“কিসের আদর? সেটা না হয় সেটা না হয় প্যাক্টিক্যালি দেখায়। কি বলো?”
“দে..দেখুন ভাইয়া, আ..আপনি কিন্তু আমাকে….”
“চার বছর তো বহু মাইল দূরেই ছিলাম, দেখাও তো সুযোগ ছিলো না। তুমি বললে আজ পুরোটাই দেখতে পারি। অবশ্য আমার কিন্তু সেই অধিকারটা আছে।”
তাসফি ভাইয়ার কথা শুকনো ঢোক গিললাম, মুহুর্তেই গলাটা যেন শুখিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে গেছে। বার কয়েক ঢোক গিলেও গলাটা ভেজাতে পারলাম না। শুকনো গলায় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলাম,
“কক্..কিসের অধিকারের কথা বলছেন?”
“কিসের অধিকার?”
পাল্টা প্রশ্ন করেই আমাকে একটু উঠিয়ে কোলে তুলে নিলেন। আবারও ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো পুরো শরীর। হাতে থাকা পানির বোতলটা ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাসফি ভাই আমাকে কোলে নিয়েই বিছানায় গিয়ে বসলেন। দু’হাতে আবারও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আস্তে করে বলে উঠলেন,
“আমার মামাতো বউ হবার অধিকার। মামাতো বউকে আদর করার অধিকার, তাকে আলতো করে ছোঁয়ার অধিকার, টপাটপ চুমু খাবার অধিকার, একটুখানি ভালোবাসার অধিকার।”
শিরশির করে উঠলো আমার পুরো শরীর, প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠলাম আমি। অজান্তেই আমার এক হাতে ওনার গলার কাছে টি-শার্ট খামচে ধরলাম। চোখে হাজারো বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। এভাবেও কি ভালোবাসার জাহির করা যায়? আসলেই কি আমাকে ভালোবাসেন? নাকি আবারও অভিনয়ের সূত্রপাত? হাজারো দ্বিধা নিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই বলে উঠলাম,
“আদোও কি আপনার মামাতো বউ হতে পেরেছি? না-কি মামাতো বোনই রয়ে গেছি?”
“কেন…. জানো না তুমি? না-কি বুঝেও বোঝার চেষ্টাও করো না, কোনটা?”
“আপনাকে আমি বুঝতে পারি না তাসফি ভাইয়া, কিছুতেই বুঝতে পারি না। মেলাতে পারি না সেই আগের আপনিটার সাথে।”
জোরে একটা নিশ্বাস ছাড়লেন তাসফি ভাই। একহাতে আমার গালে ছুঁয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁটের পরশ শুয়ে দিলেন। আস্তে করে বলে উঠলেন,
“তোমাকে বলতে হবে কেন? ভালোবাসি আমি।
হাঁটু গেড়ে গোলাপ হাতে,
কেন-ই বা প্রেমের অনুনয় করতে হবে?
যে গলার স্বরে, তোমার নামের জ্বর নামে,
তোমার নিঃশ্বাসে, আমার আকাশে
স্বস্তির ছোঁয়া জাগে,
সেই কে কেন বলতে হবে, ভালোবাসি।
তুমি বুঝি ভালোবাসা বোঝ না? প্রেম তো বোঝো?
তবে আমায় কেন বোঝো না?”
.
.
চলবে…..