#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন
পর্ব— ১৭
রোদেলা মুখ ভেঙ্গিয়ে সামনে হাটা ধরলো.. হাসনাত তামান্নাকে ইশারাই রোদেলাকে দেখালো.. তামান্না দৌড়ে রোদেলার হাত ধরে বলল– ইয়ার,, এতো রাস্তা কি হেটে যাবি?? প্লিজ চল না.. আমার জন্য… এইবলে সে দুঃখী লুক দিল.. রোদেলা ওর মুখ দেখে আর কিছুই বলল না.. সে মুড অফ করে হাসনাতের গাড়ির সামনে দাড়ালো.. হাসনাত রোদেলার জন্য সামনের সিট খোলে দিল.. রোদেলা যেই পিছনে বসবে.. হাসনাত গম্ভির স্বরে বলল– আমি এখন এখানকার একজন টিচার আমার একটা সম্মান আছে..
রোদেলা এইকথা শুনে দাত কটমটিয়ে বলল– তো আপনার সেই সম্মান ধৌয়ে কি এখন সুপ খেতে হবে আমার?? হাসনাত ওর দিকে তাকিয়ে রেগে বলল– নাহ, শুধু সুপ না পারলে আমারেও কামড়ে কামড়ে খা..সামনে বস …
রোদেলা পাল্টা কিছু বলতে চায়লো কিন্তু কেন যেন তার সব কথাগুলো গলার মাঝখানে এসে আটকে গেল.. হাসনাতের এভাবে কথা যেন হঠাৎ রোদেলার হার্ডিবিট বাড়িয়ে দিল.. সে চুপচাপ হাসনাতের পাশে বসে পড়লো.. হাসনাত অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিল.. তারপর গাড়ি স্টার্ট দিল..
গাড়ি আপনগতিতে চলতে লাগলো.. হাসনাত আড়চোখে বারবার রোদেলার দিকে তাকাচ্ছে..মেয়েটা এতোটা কিউট কেন.. এই মেয়েটার জন্য দুনিয়ার সব কষ্ট সে একাই সর্য্য করতে পারবে.. এই দুই বছর কি পরিমান বই পড়েছে শুধু সে জানে.. সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতো শুধু এই জবটার জন্য.. শুধু রোদেলার কলেজ ছুটির সময়, খাওয়া, গোসল আর ঘুমের সময় সে ওঠতো টেবিল থেকে.. এইসব ভাবতে ভাবতে সে রোদেলার ভালোবাসায় সিক্ত হতে লাগলো।।মেয়েটাকে পার্পাল কালারে অতিরিক্ত কিউট লাগে..আর গালগুলো.. এইসব ভাবতে ভাবতে সে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইলো…
হঠাৎ রোদেলা সামনের দিকে তাকিয়েই বলল– মেয়েদের এইভাবে দেখা বেড ম্যানারস.. হাসনাত আমাতাআমাতা করে বলল– কই?? কাকে দেখতেছি??
রোদেলা— কেন আমাকে…
হাসনাত– তো তোমাকে দেখতে কি ট্যাক্স দিতে হবে.. এতোই যদি প্রবলেম হয় নিকাপ পড়ে ঘোরো গা..
রোদেলা রেগেমেগে বলল— তোমারে এইজন্যই হিটলার ডাকি আমি.. এতো বড় হয়ে গেছ কিন্তু মুখে মধু দেয় নি তোমাকে.. ছোট বেলাই কি মধু দেয়নি তোমারে??
হাসনাত — আমার কথা রাখ।। তোরে কি দিয়েছে বলবো..
রোদেলা তাকে থামিয়ে বলল– বলতে হবে জানি..তোমার নাকের ময়লা দেওয়া আন্গুল তাইতো.. সব মনে আছে আমার হাসনাত ভাই..
হাসনাত রোদেলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে.. রোদেলার হঠাৎ মনে পড়লো সে কি বলছে.. আর এইসব ঝগড়া করতে করতে সে কখন হাসনাতের অনেকটা কাছে চলে গেছে তার খেয়াল ই নেয়..
সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিজের জায়গায় বসে পড়লো.. তামান্না মিটিমিটি হাসছে.. রোদেলাকে এইভাবে দেখতে তার, অনেক ভালো লাগছে.. অন্যদিকে হাসনাতের তো খুশিতে ডান্স দিতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে.. রোদেলার মনে কি আছে হাসনাত ভালোই বুঝছে এইবার রোদেলাকে বোঝাতে হবে…
রোদেলা বাসার সামনে পৌছে গাড়ি থেকে চুপচাপ নেমে গেল..হাসনাত চায়ছিল রোদেলা একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখোক তাকে..
কিন্তু রোদেলা একবারও তাকালো না.. অন্যদিকে রোদেলার মনে হলো হাসনাত তাকে ডাকবে.. কিন্তু হাসনাত তাকে না ডেকে চলে গেল..রোদেলা অভিমান করে বাসা পৌছে ব্যাগটা আছড়ে খাটের ওপর ছোড়ে মারল তারপর বিরবিরিয়ে বলল– তোমাকে সত্যি সত্যি বার্বিকিউ বানিয়ে খেয়ে ফেলবো.. হাসনাত ভাই.. তাও সস সহ..যাতে তোমার তিতা মাংস খাওয়ার সময় তিতা না লাগে।। পারলে সাথে চিনিও এ্যাড দিব.
এইসব বিরবির করে সামনে তাকিয়ে দেখলো মুনিরা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে..রোদেলা ব্রু কুঁচকে বলল– কি হলো?? আমাকে কি আজকে নতুন দেখছো.. নাকি দুনিয়ায় আজকেই আসলাম আমি…
মুনিরা জোড়ে জড়িয়ে ধরে বলল– ওয়েলকাম ব্যাক রোদবেবি… সত্যি তোমাকে এই রুপ দেখতে কতো দোয়া করেছি তুমি জান না..মনে হচ্ছে হাসনাত ভাই আবার ব্যাক করেছে তোমার লাইফে..
হঠাৎ সানিয়া লাফাতে লাফাতে বলল– ওয়াও.. এইটা তো ব্রেকিংনিউজ…কি কি হলো রে…
রোদেলা অবাক হয়ে তার দু বোনের দিকে তাকালো.. মেয়ে দুইটার শুধু বয়স বেড়েছে ভিতরে এখনো আগের মতো দুইটাই.. মুনিরা মেডিকেল এক্সাম দিবে সামনে.. আর সানিয়া চট্রগ্রাম কলেজে ডিগ্রিতে পড়ে.. তার ইচ্ছা ছিল ওখানেই পড়বে.. অনার্স পায় নাই তাই ডিগ্রিতেই ভর্তি হয়ে বসে আছে..
কিন্তু স্বভাব পুরোনোটাই আছে.. সানিয়া মুচকি হেসে– তো কি কি কথা হলো ওনার সাথে..
মুনিরা— হুম.. বলনা.. সবকিছু ঠিক হয়েছে তোমাদের মাঝে…
রোদেলার এমনিতেই মুড অফ.. এদের কথায় আরো বিগড়ে গেল.. দাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল– তোদের আর কোন কাজ নেয়?? অকাজ ছাড়া. তোরা জানিস না ঐ মানুষকে ঘৃনা করি আমি.. ওর নাম যাতে আর না শুনি.
মুনিরা আর সানিয়া স্তব্ধ হয়ে তারদিকে তাকালো.. সানিয়া রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলল– বারবার বলিস ঘৃনা করিস.. কিন্তু কেন করিস তা তো বললি না.. বুঝবো কিভাবে.???
রোদেলা ধুপ করে বসে পড়লো আর পাচ বছর আগে দেখা সব বলল.. তার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে.. বুকের ভিতরের চিনচিনে ব্যাথাটা আবার বড্ড অনুভব হচ্ছে আজ..মুনিরা তার পাশে বসে তাকে শান্তনা দিতে লাগলো.. তারপর সানিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল.. শোনা শেষ?? এইবার তুমি আসতে পার..আমার আপুকে আর কষ্ট দেওয়ার দরকার নেই তোমার. যাও এখন.
সানিয়া চুপচাপ বেরিয়ে এলো আর ভাবলো— আসলেই কি হাসনাত ভাইয়ার ভূল.. নাকি অন্য কোন রহস্য আছে.. আমি কাল হাসনাত ভাইয়ের সাথে কথা বলবো..
চারিদিকে অন্ধকার বিরাজ করছে.. রাতে শহরটা অনেক বেশি সুন্দর দেখায়.. চারিদিকে নানা রংয়ের লাইট ঝিকিমিকি করে..
হাসনাত কফি হাতে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো. নিজের পকেট থেকে ফোন বেরকরে রোদেলার ছবিগুলো দেখে আনমনে হেসে দিল সে.. পুরো ফোন জুড়ে শুধু রোদেলার ই ছবি.. আর হাসনাতের হৃদয় জুড়ে তার বসবাস.. আজকে রিক্সা সমিতির মালিকটা পরিচিত না হলে হয়তো রোদেলার সাথে এতোটা সময় কাটাতে পারতো না সে.. হাসনাত মৃদু হেসে দিল রোদেলার আজকের কথাটা মনে করে..
আগে তো সে রোজ এসকল কথা শুনতে পারতো.. কিন্তু এখন সব যেন স্বপ্ন তার কাছে.. হাসনাতকে আজ পাচ বছর আগের স্মৃতি খুব তাড়া করছে….সে তার অতিতের স্মৃতিতে ডুব দিল…
রোদেলার সাথে শুধু সময় কাটানোর আশায় ওকে দিয়ে কাজ করাতো হাসনাত.. রোদেলার হাতে ধোয়া ড্রেসগুলো আজো হাসনাত সাজিয়ে রেখেছে.. ইস্তিরি ও করে নি যদি রোদেলার ছোয়া চলে যায় সেই ভয়ে.. আজো সেই ড্রেস থেকে রোদেলার স্মেল পাই সে..এইসব ভাবতে ভাবতে রোদেলার হাতের ঝুমকো চুড়িজোড়া নিজের পকেট থেকে বের করে সে. এই চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ হাসনাতকে পাগল করে দিত.. খুব করে কাছে পেতে মন চায়তো সেই পিচ্ছি মেয়েটাকে.. তাইতো মেয়েটাকে সে এই চুড়ি পড়তে দিত না.যদি তার দ্বারা কোন ভূল হয়ে যায়.. সেই ভয়ে..
মেয়েটা এতোটা সুন্দর হাসনাতের যেন দেখেও তেষ্টা মেটে না কখনোই.. কথা বলার সময় তাকে আরো বেশি আকষর্নিয় মনে হয় তার কাছে.. তার রাগী চোখ, বকা দেওয়ার স্টাইল.. হাসনাতকে পাগল করে ছাড়ে.. তাইতো কারো সাথে কথা বলা তার কাছে ভালোই লাগতো না..
হাসনাতের আজো মনে আছে.. সেইদিন রাতের কথা যেদিন জানালার হুকটা আগে থেকে ভেঙ্গে রেখেছিল সে!! যাতে ঘুমন্ত রোদেলাকে দেখতে পারে সে…পুরো রাত জেগে শুধু মেয়েটাকেই দেখেছে..আর সকালে যখন রোদেলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল হাসনাতের মনের ভিতর যে ঘূর্ণিঝড় ওঠেছিল তা শুধু হাসনাত ই জানে.. তাইতো মেয়েটাকে শুধু জ্বালাতো সে.. এইসব ভাবতে ভাবতে আনমনে হাসতে লাগলো আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু.. হঠাৎ রোদেলার বিচ্ছেদের কথা মনে হতেই ধক করে ওঠলো হাসনাতের হৃদয়.. হাসনাতের নিজের ওপর ই রাগ লাগছে কেন সেইদিন হাসনাত বাড়িতে ছিল না.. সেইদিন ক্রিম মাখানোর পর হাসনাত ভেবেছিল রোদেলাকে নিজের মনের কথা বলে দিবে কিন্তু হঠাৎ তার কিছু কাজে জরুরীভাবে বেরিয়ে যেতে হয়.. শুধু সে নয় সাথে তার পুরো ফ্যামিলি.. হাসনাতের কেন যেন সেইদিন মনে হচ্ছিলো আর একবার রোদেলার সাথে দেখা করে যাক সে.. কিন্তু সেইদিন সবাই এতোটা তাড়া দেয় তাকে,, রোদেলার চেহারাটা শেষ বারের মতো দেখাও হয়না তার…
একদিন পর যখন সে ফিরে আসে.. পুরো ঘরে রোদেলাকে পায় খুজে পায় না..শেষে ছোট চাচি তাকে সবটা জানায়…
হাসনাত যেন রাগে ফেটে পড়ে. অনেক চিল্লাচিল্লি করে সে বাইরে বেরিয়ে যায়..পুরো রাত রোদেলাকে কল দেয় কিন্তু তার নাম্বার বন্ধ.. ফুফির অবস্হা ও বেগতি… হাসনাতের হাতে আর কিছুই করার থাকে না..সবটা শেষ হয়ে যায়.. এইসব ভাবতে ভাবতে হাসনাত ধুপ করে বসে পড়লো..এই পাচ বছর তারকাছে যে পাচশত বছরের মতো..লিপ্সরিডিংটাও সে রোদেলার জন্য শিখেছিল.. কারন যেদিন সে রোদেলাকে নিজের মনের কথা বলার জন্য ভার্সিটিতে যায় সেইদিনই সে জানতে পারে রোদেলা তাকে ঘৃনা করে.. সেইদিন রোদেলা মুনিরাকে বলছিল — সে হাসনাত নামের মানুষটিকে জিবনের সবচেয়ে বেশি ঘৃনা করে… আর তার চেহেরাও সে দেখতে চায় না…
সেদিন কষ্টে কুকড়ে ওঠেছিল হাসনাত.. নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল.. আত্নহত্যা মহাপাপ বিধায় সে মৃত্যুর অন্যপথ বেচে নেয়.. খুব বাজে ভাবে পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ে যাতে আছে প্রতিসময় মৃত্যুর ভয়.. রোদেলার কাছ থেকে দূরে দাড়িয়ে রোদেলার বলা কথাগুলো বোঝে নিত.. আর আনমনে হেসে দিত…
হঠাৎ কেউ পিছন দিক থেকে তার কাধে হাত রাখলো..সে চমকে পিছনের দিকে তাকালো.. আর সেই ব্যাক্তিকে জোরে জড়িয়ে ধরলো.. সেই জিবন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যে আজ এইমানুষটাই দ্বায়ী….
চলবে