বিষাদের রঙ নীল (পর্ব-৩)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
সন্ধ্যের আযান কানে আসতেই দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো তূজা। চয়নের কাপড় গুলো ভাঁজ করে কাবার্ডে তুলছিল, ঠিক তখনি তনয় এসে আবার রুমে উঁকি দিল পূর্বের ন্যায়, ঢুকল না ভেতরে।
-ভাবি, মিজান ভাই আসছে। ডাকে তোমারে।
-আচ্ছা।
তূজা মাথায় ওড়না টেনে দিল। কাবার্ড লাগিয়ে বসার ঘরের দিকে এগুলো।
-কেমন আছেন ভাবি?
প্রফুল্লচিত্তে প্রশ্ন করলেন মিজান সাহেব। তূজা মৃদু হেসে জবাব দিল,
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি ভাই। আপনি ভালো আছেন? আপনার ওয়াইফ ভালো আছে?
-আমিও ভালো আছি, আমার সেও ভালো আছে।
-উনাকে নিয়ে কতবার আসতে বললাম, আসলেনই না!
-আসব কখনো। আসলে ও একটু ঘরকুনো স্বভাবের। বাসা থেকে সহজে বেরই হতে চায় না আর আমি নিজেও ব্যস্ত মানুষ!
-হুম, বুঝতে পারছি ভাই। কিন্তু কখনো আনবেন সময় করে। দেখবেন একবার এখানে আসলেই আপনার ওয়াইফের ভালো লাগবে। তখন বারবার আসতে চাইবে।
-আনবো ভাবি। একটা দরকারে এসেছিলাম। চয়নকে অনেকবার ফোন দিয়েও পাচ্ছি না আসলে। আর আমি এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম নিজেই নিয়ে নেই। ফাইলটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট আসলে।
-কোন ফাইল?
-একটু খুঁজে দেখুন। সবুজ রঙের, উপরে লেখা জার্মান শিপমেন্ট।
তূজা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
-আপনি একমিনিট অপেক্ষা করুন, আমি খুঁজে নিয়ে আসছি।
-আচ্ছা।
তূজা রুমে এলো আবার। চয়নের অফিসের যাবতীয় ফাইল রাখার জন্য একটা আলাদা র্যাক আছে ছোট্ট। সেখানে একটু খোঁজাখুঁজি চালাতেই ফাইলটা পাওয়া গেল।মিজান সাহেব চয়নের অফিসের বস, কিন্তু তাদের সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধু সুলভ। এর আগেও অনেকবার এই বাড়িতে এসেছে মিজান। সেই সুবাদে তূজার সঙ্গেও একটা ভালো সম্পর্ক। তাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করে তূজা। মিজানও তূজাকে ছোটো বোন স্বরুপ দেখে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথায় চলে আসলো তূজার, চয়ন কী অফিসে নেই? নইলে মিজান সাহেব আসলো কেন ফাইল নিতে? আর চয়নকে ফোনেও বা কেন পাওয়া যাবে না? ভারী নিঃশ্বাসটি ছেড়ে তূজা ফাইলটি মিজানের দিকে এগিয়ে দিল।
বলল,
-এটাই?
-হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাবি, এটাই। অনেক ধন্যবাদ। আজ উঠি তাহলে..
-সেকী! একটু বসুন, চা-নাশতা…
-একদম না ভাবি। আমার আজ ভীষণ তাড়া..
তূজা অল্প একটু হেসে বলল,
-আচ্ছা, না খেলেন। একটা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় হবে ভাই?
-অবশ্যই!
তূজা একটুক্ষণ চুপ থেকে সময় নিয়ে বলল,
-ও কী অফিসে যায়নি আজকে? না মানে আপনি ফাইল নিতে চলে আসলেন তো…
-আরে না, না…ও অফিসে যাবে না কেন? এছাড়া আর কই যাবে! অফিসে গেছে আজকে। কিন্তু আমি যাইনি। এতক্ষণে তো বাসায় ব্যাক করার কথা। হয়তো রাস্তায় আছে। আমি ফোন দিছিলাম, টের পায়নি বোধহয়। আর আমিও এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম ফাইলটা নিয়ে নেই। কষ্ট করে ও আবার কাল অফিসে নিয়ে যাবে! তার চেয়ে ভালো হলো আমিই নিয়ে নিলাম। আবার কাজগুলোও আজ রাতেই কমপ্লিট করতে পারব তাহলে।
-ওহ আচ্ছা! আর…
তূজা আরেকটা প্রশ্ন করতে চেয়েও করতে পারল না। মিজানের ফোনটা বেজে উঠল। সে ফোন রিসিভ করে কিছু জরুরি কথা সাড়তে সাড়তে ইশারায় বিদায় জানিয়ে চলে গেল। থম ধরে বসে রইল তূজা। চায়না থেকে ক্লায়েন্ট আসবে, কীসব মিটিং আছে- এগুলো সম্পর্কে সত্যমিথ্যা জানতে পারলে ভালো হতো। তাহলে আসলেই বোঝা যেত, চয়নের সত্যতা কতটুকু! নাকি তূজাই একটু বেশি বেশি ভাবছে? চয়নকে বিনা কারণে সন্দেহ করছে? তূজার মাথাব্যথা করে এসব ভাবতে বসলে। কিচ্ছু ভালোও লাগে না। সে এক হাতের দুই আঙুল কপালে চেপে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
★
সন্ধ্যের অনেকটা সময় পর বাসায় ফিরল চয়ন। এশার আযানও পড়ে গেছে খানিকক্ষণ আগে। বাসার গেট দিয়ে ঢোকার সময় ছাদে কারও অবয়ব দেখেছে সে, তাই বাসায় না ঢুকে সোজা ছাদে চলে এলো। তার ধারণাই ঠিক, তূজা দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে, ভিজছে। ঝমঝম শব্দে আছড়ে পড়ছে ছাদের জমিনে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা গুলো। বাতাসে কাঁপন ধরে যায়। তূজার সেলোয়ার-কামিজ ভিজে লেপ্টে রয়েছে গায়ে। সে একদৃষ্টে অদূরে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ, কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে চোখমুখ। ওই সময়ে চয়নের ধমক খেয়ে অভিমান করেছে মেয়েটা? চয়ন হাসল। মেয়েটা অল্পতেই রাগ করে, আবার অল্পতেই গলে পানি হয়। বৃষ্টির পানিতে নিজেকেও মেলে ধরে ধীর পায়ে তূজার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল চয়ন। তূজা তখনো টের পায়নি। চয়নের হাত যখন তার কোমড় আঁকড়ে ধরল,তূজা চমকালো না। এই স্পর্শ তার চেনা। এই স্পর্শ পাওয়ার অপেক্ষায় পাগল প্রায় তূজার চোখ ভেঙে পানিরা হৈহৈ করে নামছে। চয়ন দেখল না। বৃষ্টির পানির কারণে সেই জল আলাদা করা যায় না।
ঘাড়ে অধর স্পর্শ দিয়ে থুতনিটা রাখল চয়ন। হালকা গলায় বলল,
-সরি।
-হুঁ।
-কী হুঁ?
-কিছু না।
তূজা সরে দাঁড়াল। চয়ন একটু অবাক হয়। তার কাছ থেকে নিজেকে কখনো সরিয়ে নেয় না তূজা, তাহলে আজ নিল কেন? চয়নকে আরো অবাক করে দিয়ে তূজা বলে উঠল,
-নিচে আসো। ভিজলে ঠান্ডা লাগবে। তখন আবার ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং গুলো মিস যাবে তোমার! আসো।
বলে নিজে আগেভাগে নেমে গেল। চয়ন তখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এই তূজাকে বড্ড অচেনা লাগছে তার কাছে!
(চলবে)