#আমার_হৃদমাঝারে_তুমি_প্রিয়
#পর্বঃ১৬
#Sohana_Akther
রাতে যখন খেয়ে দেয়ে রুমে বসে বই পড়ছিলাম তখন খুব জোরে জোরে বারান্দার দরজা বারি দেয়ার শব্দ শুনতে পেলাম । দ্রুত যেয়ে দরজা খুলে দেখি নিহান দাড়িয়ে আছে হাতে তার একটি শপিং ব্যাগ ।
” তোমাকে না বলেছিলাম রাতে বারান্দার দরজা খোলা রাখতে, খোলা রাখো নি কেনো ” ।
” মনে ছিল না , আর আপনি মেইন ডোর দিয়ে না ঢুকে এইদিক দিয়ে কেনো আসলেন ” ।
” মেইন ডোর দিয়ে আসলে বাবা মা কি মনে করতো”।
” আপনি আসলে তারা কেনো কিছু মনে করতে যাবে , এভাবে চোরের মতো না এসে মেইন ডোর দিয়ে আসতেন ”
” বোকা মেয়ে এভাবে যদি মেইন ডোর দিয়ে আসি তাহলে বাবা মা মনে করবেন কেমন নির্লজ্জ জামাই বউকে ছাড়া একদিন ও থাকতে পারে না । তখন তো আমায় লজ্জা পেতে হতো “।
” মনে করার কি আছে আপনি তো নির্লজ্জই , কিভাবে এক্কেবারে কাজী নিয়ে এসেছে বিয়ে করার জন্য ” বিড়বিড় করে কথাটা বললাম ।
” কিছু বলেছ তুমি? মনে হলো কিছু শুনতে পেলাম ” ।
” নাহ আমি কি বলবো তা আপনি হঠাৎ এখানে কেনো আসলেন ” ।
” চুরি করতে এসেছি গাধী মেয়ে, বিয়ে করা লোক তার বউয়ের কাছে যাবে না তো কোথায় যাবে আর আমার বউ তো এখানে তাই আমি এখানে এসেছি ” ।
তার কথা শুনে একদম চুপ হয়ে গেলাম, বিয়ে করেছে মাত্র একদিন হলো এখনই এই অবস্থা বাকি দিন কি হবে আল্লাহ জানে ।
” এই ব্যাগটাতে কি ” ?
” এখানে আমার রাতে পরার ড্রেস আর তোমার জন্য ….
” আমার জন্য কি এখানে ” ?
” নিজেই দেখে নেও ” । বলে তার নিজের জামা কাপড় বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেল । আমিও ব্যাগটি হাতে নিয়ে খুলে দেখলাম কালো রঙের মধ্যে সোনালী রঙের কাজ করা কাতান শাড়ি । অপূর্ব দেখতে শাড়িটি , নিহানের চয়েস আছে বলতে হবে । রান্নাঘরে যেয়ে তার জন্য কফি নিয়ে আসলাম । ঘরে এসে দেখি নিহান ফ্রেশ হয়ে খাটের উপর পা তুলে বসে আছে আর আমার বই নেড়েচেড়ে দেখছে ।
” আপনার জন্য কফি, নিন ধরুন ” ।
” আরেহ বাহ তুমি কি করে বুঝলে আমার এখন কফি প্রয়োজন, অবশ্য বুঝারই কথা “আমার হৃদমাঝারে তুমি প্রিয়” আর “তোমার হৃদমাঝারে আমি” তাই না । বলে হো হো করে হাসতে লাগল ।
কি অদ্ভুত প্রশ্ন নিজে করছে আবার উত্তর ও সে নিজে দিচ্ছে , মাথাটা কি এক্কেবারে গেছে নাকি।
শোয়ার সময় আবার কাল রাতের মতো অবস্থা , তার বুকেই নাকি ঘুমোতে হবে ।
” দেখুন আপনি ঐপাশে ঘুমান আমি এই পাশে , ঘুমানোর সময় কেউ জরিয়ে ধরলে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার “।
” আজকেই এই কথা বলেছ আর কখনো যেনো না শুনি , তোমার জীবনের বাকি প্রতিটি রাত তুমি আমার বুকে ঘুমাবে । কখনো আমাদের মধ্যে ঝগড়া বা মান অভিমান যাই হোক না কেনো ঘুমানোর জায়গা যেনো কখনো পরিবর্তন না হয়। এখন চুপচাপ ঘুমাও তো দেখি লক্ষী মেয়ের মতো”।
তার কথার প্রত্বত্তুরে কিছু বললাম, চুপচাপ তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরলাম । সকালে নিহানের ডাকে ঘুম ভাঙলো, ওঠে দেখি মাত্র সাতটা বাজছে । উফফ এই সাজসকাল বেলা আমার ঘুমটা না ভাঙলেই কি হতো ।
” নিরা ওঠো বাড়িতে যাবো এখন আমি “।
সম্পূর্ণ চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি নিহান একদম রেডি হয়ে আমার সামনেদাড়িয়ে আছে । ঘুমে আমার চোখ বারবার বন্ধ হয়ে আসছে ।
” এই নিরা যাও জলদি ফ্রেশ হয়ে আসো তাহলে ঘুমটা কেটে যাবে ” বলে আমাকে টেনে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিল । ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি নিহান তার পায়ে জুতা পরছে ।
” আপনি এই সকালবেলা চলে যাবেন, এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি ” ।
” এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি তাই তো এখন চলে যাচ্ছি যাতে কেউ জানতে না পারে আমি এখানে এসেছি । যেভাবে এসেছি ঠিক ঐভাবে চলে যাবো ” ।
” ওহহ তাই বলেন ”
” হুম ” এখন এইদিকে এসো । বলে আমাকে কয়েক মিনিট জরিয়ে ধরলেন এবং কপালে একটি চুমু দিয়ে বারান্দা দিয়েই চলে গেলেন । নিজের অজান্তেই কপালে হাত চলে গেল , এখানে কিছুক্ষণ আগেই নিহান তার ভালোবাসার পড়শ দিয়েছে । ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো ।
এভাবেই দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেলো , এরমধ্যে নিহানের ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ । এখন সে তার ফ্যামিলি বিজনেস জয়েন করছে , দু’সপ্তাহ পরেই আমাকে ওঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো । আমার আর নিহানের সম্পর্ক আগের থেকে অনেক স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে । একজন বন্ধুর মতো আমার পাশে থাকে সবসময় । সবকিছু ঠিক থাকলেও আমাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এখোনো আগের মতো । আমিও কখনো তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেইনি আর নিহান ও কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে আমার কাছে আসেনি । নিহান তার কথা রেখেছে । তার ভালোবাসা প্রদানের একমাত্র মাধ্যম হলো কপালে একটি চুমু । তার ভাষ্যমতে শুদ্ধ বহিঃপ্রকাশ নাকি কপালে দেয়া একটি চুমুতেই প্রকাশ পায় । বাকি সবকিছু তো আমরা শরীরের প্রতি কামনা বা আকর্ষণ থেকে করি ।
এখনো সে রাতের অন্ধকারে আসে আবার সকালের আলো ঠিকভাবে ফোটার আগে চলে যায় । মাঝে মাঝে সবার সামনে দিয়েও আসে , এখানেও তার নিজস্ব যুক্তি আছে । তাদেরকে দেখিয়ে না আসলে পরবর্তীতে ভাবতে পারে জামাই তাদের আদরের মেয়েকে বিয়ে করে ভুলেই গেছে । তার প্রতি সম্মান , শ্রদ্ধা, বিশ্বাস সব আছে কিন্তু ভালোবাসাটা হয়তো এখনো ঘড়ে ওঠতে পারেনি । কখনো মনে হয় তাকে অনেক ভালোবাসি আবার কখনো মনে হয় , না এই শুধু ভালোলাগা, মায়া তার প্রতি আর কিছু না ।
দিন দিন প্রতিনিয়ত তার মায়াজালে নিজেকে আটকে নিচ্ছি , এই জাল থেকে ছুটা যে অসম্ভব তা ভালো করেই জানি । মাঝে মাঝে মনে হয় নিহান আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছে কিন্তু তা কি জানার চেষ্টা করেও জানতে পারি নি । তারপরও নিহানের প্রতি আমার সম্মানের কোনো হেরফ হয়নি । তাকে যে নিজের জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসি তা বুঝতে পারলাম বিয়ের অনুষ্ঠানের দুইদিন আগে । বিয়ের দুইদিন আগে শপিং মলে কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম ঠিক তখনি একটি অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো,
” হ্যালো , কে বলছেন “?
” হ্যালো , আপনি কি মিসেস: নিহান চৌধুরী বলছেন ” ?
” জ্বী , কে আপনি ” ?
” আমি সিটি হাসপাতাল থেকে বলছি , আপনার হাজবেন্ড এক্সিডেন্ট করেছে । অনেক মারাত্মক অবস্থা তার আপনি এক্ষুনি আসুন ” ।
নিহানের এক্সিডেন্টের কথা শুনে একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, এই কি শুনছি আমি নিহান এক্সিডেন্ট করেছে আমার নিহান!
এক্সিডেন্টের কথা শুনেই আমি পাগলের মতো ছুটতে লাগলাম । কাউকে কিছু বলার মতো অবস্থাতেই ছিলাম না আমি । হঠাৎ করে আমার এমন পাগলের মতো দৌড় দেখে বাবা মা অবাক হয়ে তারাও আমার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো আর ডাকতে লাগলো । তাদের প্রতিটি ডাক আমার কানে এসেও মনে হচ্ছে আসেনি আমি আমার মতোই ছুটতে লাগলাম । আমার যেই করেই হোক নিহানের কাছে পৌঁছাতে হবে ।
একটি অটো বসে অটোচালককে বললাম দ্রুত সিটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে আমার স্বামীর অবস্থা খুব খারাপ । অটো তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তবুও আমার যেনো মনে হচ্ছে অটো চলছেই না । অনেক কষ্টে মুখ খুলে বললাম ,
” ভাইয়া প্লিজ জলদি চালান , আমার স্বামীর অবস্থা খুব খারাপ । আমাকে দ্রুত তার কাছে যেতে হবে ” ।
” দেখেন আফা অটোর স্পিড যতটুক আমিতো অতটুকই চালাতে পারমু এরচেয়ে বেশি না ” ।
” দেখুন ভাইয়া আমি আপনাকে দুইগুন ভাড়া দিবো তারপরও জলদি চালান ” ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে এসে পৌঁছালাম। কোনো রকম ভাড়া দিয়ে দৌড়ে হাসপাতালে ঢুকলাম , ভিতরে ঢুকে নিহান বলে চিৎকার করতে শুরু করলাম । আমার পিছু পিছু ততক্ষণে মা বাবাও এসে পৌঁছেছে । তারা আমার কাছে এসে কি হয়েছে জানতে চাইছে ।
” কি হয়েছে নিরা তুই এভাবে পাগলের মতো এখানে ছুটে আসলি কেনো আর নিহান বলে এভাবে চিৎকার করছিস কেনো ” ?
“মা..মা.. নিহানের এক্সিডেন্ট হয়েছে, অনেক খারাপ অবস্থা নাকি তার । বাবা ও বাবা তুমি দেখো না নিহান কোথায়, কেমন আছে ” ।
আমার কথা শুনে বাবা হাসপাতালে নিহানের খোঁজ নিতে লাগলো । মা আমায় ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে । কিন্তু আমি কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছি না । হঠাৎ বাবা ও একজন ডাক্তার এসে বললেন নিহান ১০২ নাম্বার কেবিনে আছে । তার খোঁজ পাওয়ার পর আমি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে তার কাছে চলে গেলাম । গিয়ে দেখি বেডে আকাশ ভাইয়া শুয়ে আছে আর তার পাশেই নিহান দাড়িয়ে আছে । তার হাতে ও মাথায় ব্যান্ডেজ করা । কেবিনে যেয়েই তাকে জরিয়ে ধরে কান্না করতে লাগলাম । আমার কান্না দেখে ওনি তাজ্জব বনে গেল , আমার এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে কিন্তু আমি কিছুতেই কান্না বন্ধ করতে পারছি না । অবশেষে ওনি আমাকে তার বুকের সাথে মিশিয়ে জরিয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন । তাকে জরিয়ে ধরে পাগলের মতো বকবক করতে লাগলাম ,
” নিহান প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না কোথাও, আমি তোমাকে ছাড়া বেচে থাকতে পারবো না । অনেক ভালোবাসি তোমাকে অনেক । তোমাকে ছেড়ে এক মূহুর্তও থাকার চিন্তা করতে পারবো না আমি । তোমাকে সেই প্রথম থেকেই ভালোবাসি আমি । কিন্তু নিজের মনের কথা নিজেই বুঝতে পারিনি কখনো “আমার হৃদমাঝারে তুমি প্রিয়” । আমার এই হৃদয়ের মাঝে শুধু তুমিই, তুমি ছাড়া আর কারোর অস্তিত্ব নেই ” ।
কথাগুলো বলে তার বুকে চুপচাপ মাথা রেখে দাড়িয়ে রইলাম । রুমের ভিতরে যে আরো কেউ আছে সেদিকে খেয়াল নেই । নিহান আমার কানে কানে বললো,
” এই ছাড়ো দেখো সবাই কিভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে , আমার কিন্তু ভিষন লজ্জা লাগছে ” ।
তার কথা শুনে হুশ হলো আমার যে আমি সবার সামনে নিহানকে জরিয়ে ধরে আছি । লজ্জা পেয়ে ছুটে আসতে নিলে নিহান আবারতার সাথে জরিয়ে ধরে বললো ,
” এতক্ষণ লজ্জা পাওনি এখন পাওয়া হচ্ছে তাই না ”
তার হাত থেকে ছুটে সোজা হয়ে দাড়ালাম। বাবা মা , ডাক্তার, আকাশ ভাইয়া সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে । নিহান আমাকে এভাবে ছুটে আসার কথা জিজ্ঞাসা করলো , আমি তখন তাকে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসার কথা বললাম ।
” চিন্তা করো না নিরা , আমার কিছু হয়নি সামান্য একটি এক্সিডেন্ট তাও আকাশ একটুবেশি ব্যথা পেয়েছে এরচেয়ে বেশি কিছু না । আর এই ফোন কল অবশ্যই আমার শত্রুরা করেছে তোমাকে হয়রান করার জন্য যাতে তোমার এই করুণ অবস্থা দেখে আমি কষ্ট পাই ”
যাক নিহান সুস্থ আছে দেখে শান্তির নিশ্বাস ফেললাম । এখন ঘরে ফেরার পালা ….
চলবে…