অচিনপুর পর্ব -০৬

#অচিনপুর – ৬

মেখলি পাড়া, বরণ পাড়া তুলনামূলক দরিদ্র পাড়া। অধিবাসীরা সবাই একদম প্রান্তিক কৃষক। দিন আনে দিন খায়। বর্ষা এবং ফসল তোলার আগের মৌসুমটা প্রায় কচুঘেচু খেয়েই দিনাতিপাত করার মতো অবস্থা এদের সবার। যাদের ঘরে মজুদ করা চাল আছে, সারা বছরের খাবার মজুদ থাকে, শস্য ভরা গোলা, চারটে গৃহপালিত পশু আর হাতালে হাঁস-মুরগির জোগান থাকে – তারাই এখানে ধনী! আর আমরা তিন ঘর বাঙালি এদের হিসেবের বাইরে। আমাদের বাড়ি ইট আর পাথরে গড়া। আর আমাদের তিন বাড়িতেই গাড়ি আছে। প্রহ্লাদ দাদারা রাজার বংশ। তাদের বাড়িতে পাঁচটা গাড়ি আছে। দুটো রাস্তায় চলার উপযুক্ত নেই আর। দুটো জিপ ভাড়ায় দেওয়া আছে – বরণ পাড়া থেকে সোজা চেম্মুডু নদীর ঘাট পর্যন্ত যায় আসে। ট্রলারে বা স্পিড বোটে করে চেম্মুডু নদী পার হয়ে আমরা এরেলা যাই। এরেলায় গিয়ে বাস ধরে অচিনপুর শহর। স্কুল, কলেজ, শপিং মল, হাসপাতাল, অফিস-আদালত সব শহরেই। মেখলি পাড়া, বরণ পাড়া থেকে মূল অচিনপুর শহরে যেতে আসতে দুই ঘন্টা যোগ দুই ঘন্টা সমান চার ঘন্টা!
আর সৌমিকেরও জিপ আছে। গাড়ির ড্রাইভার মংসিক সারা বছর ভাড়ার জিপ চালায়৷ যে দুই মাস সৌমিক থাকে, সেই দুই মাস রাত দিন এই গাড়িতেই থাকে।
আর রইল আমাদের গাড়িটা! ওটা সারা বছর আমাদের চাতালের টিনের চালওয়ালা কাঠের গ্যারাজে আটকা থাকে। মাঝে মাঝে মামা গিয়ে ওকে গোসল করায় আবার তালাবদ্ধ হয়ে যায়। জ্বালানির দাম আর ড্রাইভারের বেতন দেওয়া মামির কাছে হাতি পোষার মতন। বাবার জিপটা তাই মেখলির রাস্তায় আর ডানা মেলে না। আমি গাড়ি চালাতে শিখে নেবো একদিন। সেদিন জিপটা নিয়ে রাস্তায় নামব। চেম্মুডু নদীর ঘাট নয়, ওই যে নীল পাহাড়টা, দূরে দিগন্তে মিশেছে, ওর কানাখুপচি দিয়ে একেবারে পৌঁছে যাওয়া যায় অচিনপুরে। ওদিক দিয়ে অচিনপুর শহরে যেতে চেম্মুডু নদী পার হওয়া লাগে না। তবে, ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা বলে সবাই সাধারণত এড়িয়ে চলে ওই রাস্তা। আমার বাবা অনেক সাহসী ছিলেন বলে সবসময়ই ওই রাস্তাতে জিপ ছুটিয়ে দিতেন। কল্পনায় আমিও ড্রাইভিং হুইলে হাত রেখে সেই রাস্তায় উঠে গেলাম। আঁকাবাঁকা চড়াই ছেড়ে খাড়িতে নামার সময় হালকা হয়ে যায় সমস্ত শরীরটা! মনে হয় আমি আর নেই আমাতে…
— তুমি এভাবে ঘর পালাও কেন?
সৌমিকের কথায় পাহাড় থেকে মাটিতে নামলাম। আস্তে করে বললাম,
— তোমাকে কে বলল?
— কালকে বিকেলে আমাকে ফুল দিতে যাওনি। আজ সকালেও গেলে না। বিকেল পেরিয়ে গেলেও মহারাণীর দেখা না পেয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। মামি বললেন, সকাল থেকেই তুমি হাওয়া!
— আমাকে এখানে পাবে সেটা কে বলে দিলো?
— তুমিই বলেছ!
— কখন!
আশ্চর্য হলাম আমি। সৌমিক বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিকে তাকিয়েই বলল,
— তুমিই বলেছ। কখন বলেছ সেটা জানো না শুধু। অচিনপুরে তোমার যাওয়ার জায়গা খুব কম। আর সারাদিন প্রভাত, প্রভাত, প্রভাত শুনে শুনে আমার জানা হয়ে গেছে তুমি কোথায় পালাতে পারো!
সৌমিকের সাথে খুব সহজে গল্প করতে পারি আমি। ওকে সব বলা যায়। এত ভালো বোঝে ও আমাকে! শুধু প্রভাত দাদার কথা বললেই কেমন করে ওঠে! ছেলেদের এই ব্যাপারটাতে খুব হাসি পায় আমার। সুদর্শন ছেলেরা তাদের আশেপাশে অন্য কোনো সুন্দর দেখতে পুরুষকে সহ্য করতে পারে না, এমনকি কানেও শুনতে চায় না তাদের নাম!
বাড়িতে গিয়েছিল শুনে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম,
— মামি কি খুব রেগে আছে?
— না। আমার মনে হয় তোমার মামি বেশ খুশি হন এতে। তিনিও হয়তো মনে মনে চান না, তুমি তোমার চাচার সাথে দেখা করো!
— ঠিক। মামি খুব হিংসুটে। আমি যদি চাচাদের হয়ে যাই সেই ভয়ে মরে! আমাকে খুব ভালোবাসে কি না! বুকে করে মানুষ করল তো!
সৌমিক অন্য প্রসঙ্গ টানল,
— কলেজ খুলে গেছে, সে খবর আছে?
— না, জানি না তো! কবে?
— আগামীকাল ক্লাস হবে। তুমি বাড়িতে থেকো, মংসিক তোমাকে জিপে তুলে চেম্মুডু ঘাট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসবে।
— এত দরদ দেখাচ্ছ যে, কালকে যে বকলে সেটা ভুলে গেছ?
গতকালের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মুখ বাঁকালাম আমি।
সৌমিক মুখ টিপে হাসল। বলল,
— তার শাস্তিও তো দিলে! কালকে ওই মুখ দেখতে না পেয়েই ঘুমাতে হয়েছে, আর আজ এই এতক্ষণের অদর্শন! তুমি কেন এত কষ্ট দাও, ফুলপরী!
সৌমিকের কথায় কেমন একটা সুর, আমার বুকের বাঁপাশটাতে চিনচিনে একটা শব্দ হলো!
আমি বেশ খানিকটা অবাকও হয়েছি। তবে ওর কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝিনি। বড়ো আপা বলে, কারো কোনো কথা না বুঝলে বারবার জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে। তাহলে কথার ভুল মানে হয় না। আমিও জানতে চাইলাম,
— আমাকে দেখতে পারোনি বলে কষ্ট হয়েছে?
সৌমিক আমার মুখের উপর চোখে পেতে রাখল কিছুক্ষণ। হেসে দিয়ে বলল,
— ফুল আমার কত প্রিয় জানো না? কাল সারাদিন তুমি ফুল দাওনি আমাকে!
ওহ, এই কথা! ফুলের জন্য! আর আমি কী না কী কত কথা ভেবে বসলাম। বড়ো আপা ঠিক বলে, কোনোকিছু ভালোমতো না জেনে মন্তব্য করতে হয় না, কোনো সিদ্ধান্তে আসাও ঠিক নয়!
একটা আবছা কুয়াশা উড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাদেরকে। আমি উদাস হয়ে মেঘের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে বললাম,
— আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। কালকেই সবে বৃষ্টি থেমেছে! থামতে না থামতেই আবার বৃষ্টি!
মংসিক বলল,
— ঠিক কয়েছ দিদি, এমন বৃষ্টি হচ্ছে এই বছরটাতে, আমার জন্মে এত দেখিনি। আনারসগুলো তো সব গেছেই, ধানের চারা সবে মাথা তুলেছে! সব ভেসে যাবে গো!
আমার খুব দুঃখ হলো। স্বান্তনার সুরে বললাম,
— তোমার কতখানি জুমের ধান গো!
— আমার নাইকো দিদি। মাচাঙটা তুলেছি, ওটুকই আমার জায়গা। এত এত পাহাড় ছিল আমাদের। বছর ভরে ওই জুমের ধানই খেতাম! এখন সেসব কিছু নেই। আমার বাবা সব বেচে দিয়েছে৷ আমি গাড়ি চালাই, আমার এক দাদা বেতের ঝুড়ি বোনে আর এক দাদা শহরে রাস্তার ঝাড়ুদার!
— তোমাদের কারো কোনো জমি নেই?
— কেমনে থাকবে দিদি? সেটলাররা এসে সব খেয়ে ফেলল। দুটো টাকা মুঠোয় বেঁধে দিয়ে দুচোখে দেখা যায় এত সব পাহাড় নিয়ে নিলো। আমাদের বাপ-দাদারা বোকা ছিল। বুঝল না। নগদ টাকার লোভে পড়ল। দুটো মাস ভালো খেতে-পরতে পাওয়ার বিনিময়ে সারাজীবন যে পালন করে গেছে, তাকেই বেচে দিলো৷ সেটেলাররা আমাদের পাহাড় কেড়ে নিয়ে তাতে শহর বানাল, তারা সব অফিসার, জুতো মচমচিয়ে চলে। আমাদের পাহাড়ে আমরাই এখন মুচি-মেথর!
— তা কেন মংসিক দাদা, পাহাড়ের ছেলে মেয়েরা যারা পড়াশোনা করেছে তারাও তো বড়ো চাকরি করছে, দোকান দিচ্ছে!
— সে কয়জন, দিদি! তুমি যত যাই বলো, পাহাড় তো আমাদেরই। মায়ের মতো আদর করি, ভক্তি করি একে আমরা। এর সুবিধে আমাদেরকেই তো বেশি দেওয়া উচিত। আমরাই তো এর ছেলেপেলে!
— তা তো ঠিকই। সরকারি চাকরিতে তোমাদের কোটাও তো আছে।
— ও না থাকারই সমান দিদি! এই যে দুই ঘন্টা পার হয়ে স্কুলে যাও তোমরা। জিপে, তারপর ট্রলারে, শেষে আবার বাসে ওঠো। আমাদের গরিব মানুষের ছেলেটা পারব সেটা? পথ খরচ আছে আমাদের? এইজন্যই তো তোমরা স্কুলে পড়ে বিদ্বান হয়ে বড়ো চাকরি নিবা আর আমাদের গরিব পাহাড়ের ছেলেগুলো আরো গরিব হবে! কোটার কথা বলছ, ও তো রাজবাড়ির ছেলেপুলেরা নইলে পুরোহিতের ছেলেমেয়েদের মতো বড়োলোক বাপ মায়ের ছেলেদের জন্য। মরশুম আসলে আমাদের ছেলেকে জুমে যেতে হয় আর মরশুম শেষে তাঁতে নকশা ওঠাতে ছুটতে হয়। আমাদের ছেলেরা স্কুলে যেতে পারে না, পড়াশোনাও হয় না। ব্যবহারের পানিটাও এখন নিতে পারি না, দিদি! বড়ো বড়ো হোটেল হয়েছে শহরজুড়ে। সারাদিন পানি লাগে তাদের কলগুলোতে। নদীগুলোতে মোটর লাগিয়ে সব পানি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক বছর আগেও পানি নিতে যতটুকু পথ গিয়েছি, এখন তার দ্বিগুণ হাঁটা লাগে। দুটো কলসি বয়ে আনতে আনতে মেয়েটা, বউটার কোমর লেগে যায়। নদীর ধারে নাইতে যেতেও পারে না ওরা, মানুষ আর মানুষে ভরে গেছে!
পাহাড়ে উন্নতি হতে হতে পাহাড়ের মানুষগুলোই যে বঞ্চিত হচ্ছে, মংসিক এত কথা বলার পরেও আমি মানতে নারাজ! জেদ করে বললাম,
— যতটা বলছ ততটাও নয়, মংসিক দাদা। এই যে পর্যটন বাড়ছে তাতে তো তোমাদেরই লাভ হচ্ছে। কত কত নতুন কাজ হয়েছে। কেউ আর বেকার বসে থাকছে না!
মংসিকের মুখ করুণ দেখাল। ও মন খারাপ করে বলল,
— ফাঁকিবাজিটা ওখানেই, দিদি। আমাদের ছেলেদেরকে কাজ দেয়। কেননা আমাদেরকে ঠকাতেই মজা। একটা বাঙালি ছেলেকে যে কাজে একশো টাকা দিতে হয়, পাহাড়ের ছেলেটা পেটের ভাতের জন্য সেই কাজ বিশ টাকাতেই করে দেবে। পাহাড়ের ছেলেরা কেউ বেকার থাকবে কেমন করে, বলো তো!
এই রাস্তাটা বেশ আঁকাবাঁকা আর মোড়ে মোড়ে খাদ। খুব ভয়ংকর রাস্তা। বরণ পাড়া থেকে মেখলি যাওয়ার দ্বিতীয় রাস্তা এটি। মাতৃপ্রধান ডুলেরা থাকে এদিকটাতে। ডুলেদের পাড়াটা পেরিয়ে রাস্তাটার আরেকটা মাথা কোথাও না জিরিয়ে সোজা চলে গিয়েছে অচিনপুর শহরতলিতে। এদিকটাতে আসা হয় না কখনো। এই রাস্তাতেই আমার বাবার গাড়িটার এক্সিডেন্ট হয়েছিল! আমি উঁকি দিয়ে চোখে চেয়ে খাদগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করলাম। কীভাবে ধাক্কা খেলে মরে যায় মানুষ! আর কতটা কষ্ট হয় মরে যেতে যেতে…
— কালকে তোমাকে বকেছিলাম বলে এখনো রেগে আছ?
সৌমিকের হঠাৎ প্রশ্নে আমি তাকালাম ওর দিকে।
ও আবার জানতে চাইল,
— এত মন খারাপ করে আছ কেন? তোমার মুখ অমাবস্যা মানায় না!
আমি মুখ বাঁকালাম,
— নিজেই তো বকলে! বকা দিলে কি মানুষ মন খারাপ করবে না? তোমাকে যদি এখন আমি বকা দিই, তুমি কষ্ট পাবে না?
— খুব কষ্ট পাব। কিন্তু বুঝে দেখো তুমি যে কাজটা করেছিলে সেটা কি ঠিক ছিল? মাউথ অরগ্যানটা আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস ছিল। আমার খুব প্রিয় একজন বন্ধু ওটা আমাকে দিয়েছিল, এজ আ টোকেন অফ লাভ! কত এটাচমেন্ট ছিল ওটার সাথে আমার! আমি অত প্রিয় জিনিসটাকে তোমাকে দিলাম, তুমি ওর যত্ন করবে বলে। আর সেটাকে তুমি অবহেলা করেছে, সরিয়ে দিয়েছ নিজের কাছ থেকে সেটা জানলে আমার মন খারাপ করবে না? আমি রেগে যাব না?
— কিন্তু কাউকে কোনো উপহার দিলে সেটা তো দাবী ছেড়েই দিতে হয়। তারপর সেটা তো আমার হয়ে যাবে। আর আমার জিনিস আমি তো যে কাউকেই দিতে পারি!
সৌমিক আবার রেগে গেল সম্ভবত। মুখ লাল করে বলল,
— যে বোঝে না তাকে বোঝানো যায়। যে বুঝতে চায় না, তার অনেক পালটা যুক্তি থাকে। যাক, এই বিষয়ে গতকাল অনেকটা ঝগড়া হয়েছে। আজ আর ঝগড়া করব না!
এটাও কেমন যেন ঝগড়ার মতোই শোনাল। আমার মন খারাপ হতে শুরু করেছে।
সৌমিক আমার হাতটা টেনে নিলো।
— কথাপ্রসঙ্গে বলে ফেলেছি। তোমার চোখে পানি দেখতে চাই না আমি। আর আমার কোনো দোষের জন্য তুমি কাঁদবে এটাও একেবারে চাই না আমি। শুভজন্মদিন ফুলপরী!
আমি হাতটা টেনে নিলাম। মংসিককে বললাম,
— সামনেই ণৈলার চূড়া, না?
— হ্যাঁ দিদি।
— একটু রাখো না!
— এখানে? রাস্তা খুব খারাপ দিদি। জিপ স্টার্ট নিতে চায় না! অন্ধকার হয়ে আসলে বিপদ হবে। ডুলেরা ওদের এদিক দিয়ে কাউকে আসতে যেতে দেয় না।
আমার আরো মন খারাপ হলো। এদিকটাতে তো কখনো আসা হয় না। সৌমিক আজ এসেছে বলেই যাওয়া হচ্ছে৷ এই রাস্তার সংস্কার কাজ হয়নি কখনো। কাটা মাটির এবড়ো থেবড়ো শরীরের উপর ইটের চাকা বসেনি। কোন আদ্যিকালে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা করে রাখা হয়েছে, এখন সামান্য বৃষ্টি বা কুয়াশাতেই পেছল হয়ে থাকে।
সৌমিক বলল,
— রেখে যাও, মংসিক।
— দাদাবাবু, এই রাস্তায় জিপ থামালে আর স্টার্ট নেবে না!
— নেবে। আর একেবারেই না নিলে ঠেলে দেবো। তুমি রাখো এখানে।
জংলা জায়গাটাতে বাঁশ আর ঘন বেতবন। ঘাসের উপর জংলা ডুমুরের ঝোঁপ। ঘাসগুলো ভেজা ভেজা। একটু হেঁটে খাদের কিনারায় দাঁড়ালাম আমি। এই সেই ণৈলা পাহাড়। এর বাঁক বড়ো ভয়ংকর। দক্ষ ড্রাইভারও ভয় পায় এই বাঁক থেকে মোড় ঘোরাতে। আর খাদটা একেবারে চড়া। ঘাড় উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন! কী কালো অন্ধকার নিচটাতে! জিপের হেডলাইটের আলোতেও অন্ধকার কাটছে না। লজ্জাবতীর ঝোঁপের উপর একগাদা জোনাকি। জ্বলছে আর নিবছে!
ঐ দূরে ডুলেদের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। ওদিকে ইলেক্ট্রিসিটি যায়নি। ওদের আগ্রহও নেই তাতে। কুপিবাতির হালকা আলোয় মিটমিট করে জ্বলছে ছোটো মাচাগুলো। দূর থেকে সেগুলোকেও মিটমিটে জোনাকির মতোই দেখাচ্ছে। ওরা বাস করে গহীনে, কাজ করতে যায় আরো গহীনে!
আমি দূরে একবার তাকিয়ে থাকলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
— বড়ো অপয়া মেয়ে আমি। জন্মেই মাকে খেয়েছি। ঠিক জন্মদিনের তারিখটাতেই বাবাকেও হারিয়েছি। জন্মদিনটা আমার জন্য মোটেও ভালো দিন নয়! এই দিনটাকে আমি কখনো মনে রাখতে চাই না। অন্য কেউ মনে রাখুক সেটাও আমার ভালো লাগে না, সৌমিক!
সৌমিক চুপ করে রইল। তারপর বলল,
— তোমাকে এমন দুঃখী দুঃখী কথায় একদম মানাচ্ছে না! কিছু কিছু মুখে শুধু চঞ্চল প্রজাপতি ছুটে বেড়াবে। একদম ভালো লাগছে না, ফুলপরী! হেসে ফেলো তো চট করে!
আমি সত্যিই হেসে ফেললাম।
— শুধু হাসলে হবে না। জন্মদিনের উপহারও নিতে হবে!
আমি চোখ কপালে তুললাম,
— উপহারও এনেছ? এতক্ষণ কেন দাওনি? দাও তাড়াতাড়ি।
সৌমিক ঘাসের উপর হাঁটুমুড়ে বসে বলল,
— তোমার ডান পা টা আমার পায়ের উপর তুলে দাও!
— ছিঃ!
— ছিঃ কেন?
আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
— অসম্ভব! কারো গায়ে পা দিলে পাপ হয়!
— পাপ-পূণ্যের হিসাব-নিকাশ এত সহজ নয়, ফুলপরী! কিছু পাপ হবে না। পা টা উঠিয়ে দাও দয়া করে।
আমি অনেক সংকোচ নিয়ে ওর গায়ে পা তুলে দিলাম।
ও একটা পায়েল বের করে আমার পায়ে বাঁধতে শুরু করল। আমার খুব লজ্জা লাগলেও আমি কিছু বললাম না। পায়েল বাঁধা শেষ হলে, জিপের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
সৌমিক চেঁচিয়ে বলল,
— কী আশ্চর্য মেয়ে, একটা ধন্যবাদও দিলো না!
আমি আবার মুখ বেঁকিয়ে বললাম,
— ধন্যবাদ মশাই!
সৌমিক দৌড়ে কাছে এসে বলল,
— এই উপহারটা আবার কাউকে দিয়ে দেবে না তো?
আমি মাথা নাড়লাম।
সৌমিক পকেট থেকে আরেকটা পায়েল বের করে আমাকে দিতে দিতে বলল,
— এটা তোমার ছোটো আপাকে দিও। একই ডিজাইনের এনেছি। এবারে তোমার জিনিসে সে আর লোভ করবে না। আর লোভ করলেও অসুবিধা নেই। দিয়ে দিও ওকে। আমিও অনুধাবন করেছি, উপহার দেওয়া নেওয়ার যে অপূর্ব মুহূর্তটা সেটাই আসলে স্মৃতি, জিনিসটা কখনো নয়!
পায়েলটা হাতে নিয়ে আমি মনে মনে হেসে ফেললাম, ‘আমার হাত দিয়ে ছোটো আপার জন্য গিফট পাঠানো হচ্ছে! হুহ, ডাল মে জরুর বহুৎ কুচ কালা হ্যায়….!

চলুক…🙂
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here