অচিনপুর পর্ব -০৭+৮

#অচিনপুর – ৭ ও ৮

বরণ পাড়া হয়ে রাজবাড়ির সামনের দিক দিয়ে বেরিয়ে ডুলেদের গ্রাম হয়ে এদিক দিয়ে গেলে আগে সৌমিকদের বাড়ি পড়ে তারপর অনেকটা হেঁটে আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি গিয়েই আমার ভয় ভয় লাগল। আমি সৌমিককে বললাম,
— আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও না! আমি হেঁটে হেঁটে দিব্যি চলে যেতে পারব।
— এই রাতের বেলা এই রাস্তা দিয়ে একা একা যাবে?
আমি হাসলাম,
— এই মেখলি পাড়া আর এর মানুষগুলো আমার হাতের তালুর মতো চেনা। এই পাহাড় আর পাহাড়ের মানুষ সবই তো আমার, আমার নিজের! কিছু হবে না। আমি নেমে যাই। তোমার জিপ থেকে নামতে দেখলে মামি ভীষণ বকবে!
— বকবেন না। তোমার মামি আমাকে পছন্দ করেন। প্রায়ই তো দাওয়াত করেন।
— কিন্তু আমাকে অনেক শাসনে রাখে। আমি কোনো ছেলেদের সাথে মিশি এটা একদম দেখতে পারে না।
— শাসনে কি শুধু তোমাকেই রাখে?
— না, আমাদের চার বোনের জন্যই বড্ড কঠিন হয় মামি।
— তা তো মনে হয় না!
— বড়ো আপার কথা বলছ? কী বকুনি যে ওকে দেয় মামি, তা যদি দেখতে…
টেনে টেনে বললাম আমি।
সৌমিকের সেটা বিশ্বাস হলো না। ও বলল,
— আর মেজ আপা?
আমি তড়িৎ গতিতে তাকালাম সৌমিকের দিকে। অন্ধকারে ওর মুখটা দেখা গেল না। বুঝলাম না, ও কি মেজ আপার ব্যাপারটা জানে নাকি? কী জানে আর কতটুকু জানে? বেশি কিছু জেনে ফেলেছে এই ভয়ে আমি আর ওর কাছে কিছু জানতে চাইলাম না। কথা ঘুরিয়ে বললাম,
— সকালে জিপ পাঠাতে হবে না। একটু হাঁটলেই শল্ল্যার মোড়ে টোটো পাওয়া যায় এখন।
— না, আমারো শহরে যাওয়ার দরকার একটু। কিছু জিনিস আনা লাগবে।
— ওহ! তুমিও যাবে সাথে? অত সকালে কিন্তু অনেক কুয়াশা হয়। যে মেঘ করেছে, বৃষ্টিও হতে পারে। তুমি মংসিকের কাছে লিস্ট দিয়ে দিও। যা যা লাগবে আমি আর ছোটো আপা মিলে কিনে ওর কাছে দিয়ে দেবো!
— বিন্নিও যাবে তোমার সাথে?
— একা একা আমাদের কাউকে ছাড়ে না মামি।
সৌমিক বিদ্রুপ করে বলল,
— হুহ! একা একা আমাদের কাউকে ছাড়ে না মামি! আজকে যে একা একা রাজবাড়ি ঘুরে এলে!
— ও তো আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম বলে। কী ভীষণ বকা যে আজকে কপালে আছে। তবুও ভালো। ওই ভয়ংকর লোকটার সাথে কথা বলার চাইতে বকুনিও ঢের ভালো!
— তুমি কিন্তু একবার কথা বলে দেখতে পারো ওনার সাথে। হয়তো খুব খারাপ কিছুও বলবেন না। হয়তো ভালো কিছু বলবেন। হয়তো তোমার জন্য বেশ ভালো কিছুই বলবেন।
মাথা বাড়িয়ে মুখ ভেংচালাম আমি,
— লাগবে না আমার অত ভালোর। আমি ভালো আছি!
সৌমিক মাথা নাড়িয়ে বলল,
— তুমি ঠিকই বলেছ। অত কুয়াশার ভেতর ঘুম ছেড়ে উঠতে আমার কষ্ট হবে। মংসিক একাই আসবে। মংসিক, তুমি গাড়িটা নিয়ে দিদিকে চেম্মুডু ঘাটে দিয়ে এসো।
আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— কয়টায় যাবে?
— নয়টায় ক্লাস আছে। নয়টার ক্লাস আমি কোনোদিন ধরতে পারি না। নয়টার ক্লাস ধরতে গেলে সকাল সাতটার আগে বাড়ি থেকে বেরোনো লাগে। অত সকালে লছমি দিদি আসে না। পানি তোলা হয় না। গোসলের পানি থাকে না। গোসল না করে বাইরে বেরোতে ভালো লাগে না আমার। আমি এগারোটার ক্লাস করব। মংসিক দাদা আটটার দিকে ভেতর বাড়ির কাছে এলেই হবে।
— নাকি ফেরি পার করে শহরেই দিয়ে আসবে?
— না না, ফেরিতে আরো বেশি সময় লাগে। স্পিড বোটে চেম্মুডু পার হতে সাত আট মিনিট লাগবে। ফেরিতে পুরো ত্রিশ মিনিট লাগে। পানি কম তো নদীতে! পাথরে ধাক্কা লেগে শুধু ফেরি আটকে যায়৷ কখনো তো সেই পাথর সরাতে সরাতে ঘন্টাও পেরিয়ে যায়!

জিপটা একেবারে বাড়ির গেটেই থামল। বুনো টগরের দুটো গাছে ধুমছে সাদা সাদা ফুল ফুটেছে। মেঘের কুয়াশা ঘিরে ধরেছে আমাদেরকে। মংসিক জিপের আলোটা নিভিয়ে দিতেই অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশটা। জিপ থামার আওয়াজ পেয়েছে মামি। নিচতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করল,
— কে এসেছে?
আমি ভয়ে কাঁটা হয়ে উত্তর দিলাম,
— আমি এসেছি, মামি!
— জিপ কার? সৌমিকের?
এই প্রশ্নের উত্তরটা দিলো সৌমিক,
— জি আন্টি, আমি নিয়ে এসেছি স্বর্ণকে।
— কোথা থেকে আনলে ওকে? সারাদিন কোথায় ছিল ও?
সন্ধ্যের পরেই আমাদের বারান্দায় একটা হারিকেন জ্বালানো হয়। বাতিও আছে এখানে, কিন্তু হুটহাট ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায় বলে হ্যাসল কমাতে এই ব্যবস্থা। আর উঠোনে আসতে গেলেও হারিকেনের আলো ছাড়া এক পাও চলা দায়। এদিক ওদিক বুনো সাপখোপের ছড়াছড়ি! হারিকেনটা নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে মামি। মামির প্রশ্নের উত্তরে সৌমিক বলল,
— সারাদিন আমাদের বাড়িতে ছিল ও।
মামি হেসে হেসে বলল,
— বিকেলে তুমিই খুঁজতে এসেছিলে ওকে, আর বলছ তোমার বাড়িতেই ছিল! বন্ধুকে বাঁচাতে মিথ্যে যখন বলবেই, একটু সাজিয়ে গুছিয়ে বলো!
সৌমিকের মুখে আর উত্তর এলো না। রাজবাড়ির কথা শুনলে মামি সাংঘাতিক রেগে যায়। ওখানে গিয়েছি এই কথা মামিকে মোটেও বলা যাবে না। আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম,
— বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল, মামি। ণৈলার চুড়ায় গিয়েছিলাম!
মামি আঁতকে উঠল।
— সে তো ডুলেদের পাড়া। কী ভয়ংকর কথা! গোটা দিন কাটিয়ে আসলি ওখানে? ধন্যি মেয়ে তুই! তাড়াতাড়ি ঘরে এসে কাপড় ছাড়। কিছু মুখে দিয়ে আমাকে উদ্ধার কর!
আমি প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি ঢুকতে চাইলাম।
মামি সৌমিককে বলল,
— তুমিও এসো ভেতরে। স্বর্ণর চাচা এসেছিল। রান্নাবান্না হয়েছে বেশ। চালের আটার রুটি আর মুরগির ঝোল করেছি। বিন্নি বলছিল, তুমি নাকি পছন্দ করো খুব। এসো খেয়ে যাবে।
— না আন্টি। সবে সন্ধ্যা হয়েছে। আমি বেশ রাত করে খাই।
— আচ্ছা বেশ খেতে হবে না। একটা টিফিন বাটিতে দিয়ে দিচ্ছি। পরে খেও। ঘরে এসে বসো। চা অন্তত খেয়ে যাও। বিন্নি খুব ভালো চা করে। মংসিক তুইও আয়। বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বস। জিপটা উঠোনের ওই কোণে ঢুকিয়ে রাখ।
পাহাড়ের কোনো যুবক ছেলের আমাদের বাড়িতে প্রবেশাধিকার নেই। বাঙালি বলেই হয়তো সৌমিককে বেশ প্রশ্রয় দেন মামি। আর এখানে একা একা থাকে বলে মামির বেশ মায়া লাগে ওর জন্য। মাঝেমাঝেই ভালো মন্দ রান্না হলে ওকে ডেকে খাওয়ায় নইলে টিফিন বাটিতে করে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
ঘরে ঢুকতেই আমি ছোটো আপার মুখোমুখি হলাম। ও কিছু বলার আগেই আমি বললাম,
— নীল জামাটা পরে মুখটা ধুয়ে এসো তো!
— কেন?
— সৌমিক আসছে ঘরে। চা খাবে।
ছোটো আপা হুড়োহুড়ি করে ভেতরের দিকে চলে গেল। আমিও গেলাম সাথে। আমি হাত পা ধুয়ে বসতে বসতে ওর সাজ কমপ্লিট হলো। এই একটুখানি সময়ে অপ্সরা সেজে ফেলেছে৷ কাজলে চোখ আঁকাও শেষ। বাইরের ঘর থেকে মামি ডাক দিয়ে বলল,
— বিন্নি, চা কর তো! সৌমিক এসেছে।
ছোটো আপা রান্নাঘরে দৌড়ে যাওয়ার আগে আমি বললাম,
— আমাকেও এক কাপ চা দিও তো, ছোটো আপা!
খোলা চুলে চিরুনির ফাইনাল টাচ দিতে দিতে ও বলল,
— ছোটোদের চা খেতে মা নিষেধ করেছে।
আমি চোখ সরু করে বললাম,
— আজকে যদি চা না পাই, তাহলে কোনো একজন একজনকে কী জানি একটা উপহার পাঠিয়েছে, সেটা নিয়ে আমি বারান্দায় দাঁড়াব। হাত বাড়িয়ে, একটু জোরে ছুঁড়ে ফেলে দেবো খাদের ভেতর!
ছোটো আপার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল সাথে সাথে।
মুখ কাচুমাচু করে বলল,
— লক্ষী সোনা বোন আমার, বল না কী উপহার দিয়েছে ও?
পায়ের উপর পা তুলে একটা বেশ ভাব নিয়ে বললাম,
— উহু বলব না! আগে চা, তারপর উপহার…! আগে চা, তারপর উপহার।
স্লোগান দিতে থাকলাম আমি।
— দেবো তো চা। কিন্তু কী উপহার সেটা একবার দেখা না সোনা!
— উঁহু!
মাথা নাড়লাম আমি।
— চা খাওয়াও কড়া করে। তারপর কথা হবে।
— সৌমিক নিজে দিয়েছে তোর কাছে?
— নাহ, ডাকপিয়ন ধরেছিল! ডাকঘরের ঠিকানায় পোস্ট করেছিল। তারপর আমাকে নিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে সেটা নিয়ে এলো।
— ও নিজেই যদি পোস্ট অফিস থেকে নিয়ে তোর কাছে দেবে, তবে ডাকে কেন দিলো?
— বোকারাম তুমি। আমার কাছেই দিয়েছে। ডাকে টাকে দেয়নি!
ওর মুখ উজ্জ্বল হলো। মুখ নাড়িয়ে বলল,
— ও নিজের মুখে বলেছে আমাকে দিতে!
— তা নয়তো কী? নিজে মুখে না বলে ঘোড়ার মুখে বলবে? আশ্চর্য তো তুমি! যাও ভাগো! এক্ষুনি মামি চিল্লাবে। চা বানাতে কয় ঘন্টা লাগাবে? শেষে চা না খেয়েই সৌমিক চলে যাবে কিন্তু, আমি সাবধান করে দিচ্ছি…
ছোটো আপা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল। আমার মনে হলো আকাশ পরীরা ওকে দুটো ডানা দিয়েছে। সেই ডানায় ভর দিয়ে ও উড়ে উড়ে চলে গেল। কী আনন্দিত মুখখানা ছোটো আপার। আমারও ভীষণ আনন্দ হলো!
আমি ব্যাগ খুলে প্রভাত দাদার আনা বইগুলো শেলফে গোছাতে চাইলাম। সব আমার পছন্দের বই। প্রতি মাসে দুবার আসে প্রভাত দাদা। প্রমিদের বাড়িতে খুব কম যাওয়া হয় আমার। তাই সব বার দেখা হয় না প্রভাত দাদার সাথে। যেবার যেবার দেখা হয়, এমন একটা লম্বা বইয়ের লিস্ট ধরিয়ে দিই। ও সব নিয়ে আসে।
একটা বইয়ের মলাট উলটে দিতেই ছোটো একটা চিরকুট নিচে পড়ল। মেঝে থেকে ওটা কুড়িয়ে নিতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। মোমবাতি সবসময়ই থাকে কাছাকাছি। আমি একটা মোমবাতি ধরিয়ে, তার আলোর উপর ধরলাম কাগজের টুকরোটা। প্রভাত দাদা লিখেছে,
“আমার বুকের ভাঙচুর তুই কি কিছু শুনতে পাস না, বোকা ফুল? এই যে দড়াম দড়াম করে পাঁজরের হাড় ভেঙে যাচ্ছে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছি আমি! ভীষণ ঝড়ে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়ে মরোমরো হয়ে যাচ্ছি! ঝড়ের এই কানফাটানো শব্দও কি তুই শুনতে পাস না? তুই কি কানে কালা?”

কী? আমি কালা? প্রভাত দাদা আমাকে কালা বলল? আমি কানে শুনি না! কী খারাপ ও! অসহ্য! আমার মেজাজটাই খাস্তা হয়ে গেল! ওর আনা বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খাটের উপর উঠলাম দড়াম দিয়ে। কার্ডিগ্যানটাও খুলে ছুঁড়ে দিলাম। কম্বলটা মোড়া দিয়ে শুয়ে পড়তেই অন্য কথা মনে এলো। প্রভাত দাদার কোনো কঠিন অসুখ করেনি তো! নাকি একসিডেন্ট করেছিল? হাড় ভেঙে গিয়েছিল নাকি? বলেনি তো। হাড় ভেঙে গেলে কি খুব কষ্ট হয়েছিল ওর?
আহ, বড্ড মায়া লাগল আমার! কী যে পছন্দ করি আমি ওই মানুষটাকে। অসহ্যকর পছন্দ! আমার এই অনেকগুলো বছরে নিস্তরঙ্গ ছোটো জীবনে অত পছন্দ আমি আর অন্য কাউকে করিনি!
বড়ো আপাকে সে বিয়ে করে নিলে খুব ভালো হতো! যে মানুষ দুটোকে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি তাদেরকে একসাথে দেখতে দারুণ আনন্দ হতো আমার!

#অচিনপুর – ৮

অচিনপুরের মাঝখানটাকে একদম চিরে দিয়ে দুই ভাগ করে বয়ে গিয়েছে স্রোতস্বিনী চেম্মুডু। পাহাড় ভাসিয়ে বহু পথঘাট জনপদ পেরিয়ে এই নদী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে বহু পথ গেলেও আড়াআড়িতে এর পেটটা অতো পুষ্ট নয়। তরুনী ব্যালেরিনার তন্বী কোমরের মতোই মেদহীন আর আকর্ষণীয়। নদীর তলে বালি আর পাথরের প্রাচুর্যে স্বচ্ছ আর সুন্দর। জো-মাও বলেন চেম্মুডু হচ্ছে চিরকিশোর নদী। কিশোরীর মনের মতো এরও স্রোতধারা অগভীর। এতটাই অগভীর নদী যে তলাটা আয়নার মতো ভাসতে থাকে। আসলে নদীর তলের চকচকে পাথরগুলোই এই সৌন্দর্যের উৎস। ওরা অনেকটা আলোর প্রতিফলন ঘটায়। এইজন্যই মনে হয় আকাশতলে বিরাট এক আয়না!
এই চেম্মুডুরই আড়াআড়িতে একপাশে এরেলা ঘাট, আরেক পাশে আমাদের চেম্মুডু ঘাট। চেম্মুডুর এই পাশে বরণ পাড়া, শাল্যা, মেখলি পাড়া, ডুলে পাড়া – শহুরে হাওয়া বাতাস থেকে একটু দূরে- এখনো এখানে পাহাড়ের মাটির ঘ্রাণ ভাসে। নদীটা পার হলেই পুরোদস্তুর শহরের আয়োজন! বাইরে থেকে আসা বাঙালিরা মূলত এরেলা ঘাটের এইপাশেই থাকে। চেম্মুডু ঘাট পার হয়ে আমরা অল্প কয়েকটা বাঙালি পরিবার এরেলায় ঢুকি। প্রমি রাজবাড়ির মেয়ে – সে সবসময়ই গাড়িতে চড়ে আসে, ফেরিতে পার হয়ে হুশ করে শহরে পৌঁছে যায়। আমি আর আমার বোনেরা স্পিড বোটে করে চেম্মুডু পার হই নইলে ট্রলারে করে। এরেলায় গিয়ে বাস ধরলে ছোটো আপা আগে নেমে যায় ওর কলেজে, তারপর বড়ো আপা, তারপর মেজ আপা আর সবচেয়ে পরের স্টপেজে আমি নামি। আমি যেখানটাতে নামি, তারপর অচিনপুরের লোকাল বাস রুটের আর মাত্র দুটো স্টপেজ বাকি থাকে! আমার কলেজে যাওয়া আসা কাজটা একটা দুনিয়ার সমান হুজ্জত।
এই রুটে মাত্র দুটো বাস চলে। দুই ঘন্টা পরপর গাড়ি ছেড়ে যায় এরেলা স্টপেজ থেকে। একটা বাস মিস হলে আরো দুটো ঘন্টা বসে থাকতে হয়। আমি আর ছোটো আপা দৌড়ে বাসে উঠলাম। মেজ আপা আর বড়ো আপার নয়টায় ক্লাস ছিল, ওরা আটটার বাস ধরেছে, ভোর ছটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আমি এগারোটার ক্লাস ধরব। এখন দশটা বাজে। বাস ছেড়ে দেবে। আধাঘন্টাও লাগবে না মহিলা কলেজ স্টপেজে পৌঁছাতে।
শহরের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে ভালো লাগে। জানালা দিয়ে রাস্তায় উঁকি দিলে দুপাশ জুড়ে শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, কর্পোরেট অফিস, পার্ক, সিনেমা হল, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস – আধুনিক আর ব্যস্ত শহর। আমি গালে হাত দিয়ে ভাবি, সামান্য দূরত্বে অবস্থিত অচিনপুর গ্রামটা আর এই অচিনপুর শহরটা – অথচ কী দুস্তর ব্যবধান দুটোতে!
সকাল সকাল মংসিক জিপ নিয়ে এসেছিল। ওকে দেখে ছোটো আপা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল,
— সৌমিক আসলো না?
— আসতে চেয়েছিল। আমি মানা করেছি। অত সকালে ও ঘুম থেকে উঠতে পারে না। আর কেমন ঠান্ডা পড়েছে আজকে!
চটাস করে একটা থাপ্পড় উড়ে এসেছিল আমার গালে। রেগে বোম হয়ে ও বলেছিল,
— তোর সবটাতেই পাকনামি, স্বর্ণ! তুই আগ বাড়িয়ে কেন ওকে আসতে মানা করলি? ও হয়তো কিছু বলত আজ!
আমি কান্না কান্না গলায় বলেছিলাম,
— স্যরি!
— মংসিককে যেতে বলে দে। আমরা কি হাভাতে নাকি যে, দয়া নিতে হবে মানুষের। আর জিপ পাঠিয়েছে বলে তাতে হৈহৈ করে উঠে পড়তে হবে নাকি? যা, ওকে যেতে বলে দে!
— আমরা কীভাবে কলেজ যাব?
— কীভাবে আবার? যেভাবে রোজ যাই সেইভাবে৷ বাসে করে।
সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোর ব্যস্ত সময়ে বাসে জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আর দুই ঘন্টার অন্তর থাকে বলে অনেক যাত্রী বাসের জন্য অপেক্ষারত থাকায়, যাত্রীর ভীড় বেশিই হয়। যা হয় তাই, আমরা সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ছোটো আপা আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল। ভীড়ের চাপ খেয়ে এখন আমার থেকে দুই হাত পেছনে সরে গেছে। ওখান থেকেই জোরে জোরে বলল,
— স্বর্ণ, এইদিকে আমার কাছে আয়। এই সিটটা ধরে দাঁড়া। নইলে ব্রেক কষলে ধাক্কা সামলাতে পারবি না, পড়ে যাবি।
ছোটো আপা আর আমি একই বয়সী। মাত্র দুই মাসের বড়ো ও আমার থেকে। অথচ এমন ভাব করে যেন ও কত বড়ো আর আমি পিচ্চি খুকী! এটা শুধু ছোটো আপাই নয়, পরিবারের সবাই তো বটেই এমনকি পাড়ার সব ঘর প্রতিবেশীরও মনে হয়। ওদের বেশি আহ্লাদেই মনে হয় আমি আরও বেশি করে ন্যাকা খুকীতে পরিণত হয়েছি! রাগ করে বললাম,
— তুমি এদিকে এসে দাঁড়াও। তুমি আগে নামবে, গেটের কাছে থাকো!
— আচ্ছা আমি আসছি।
ছোটো আপা ভীড় কেটে কেটে এসে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। দুই হাত দিয়ে আমাকে ঘিরে রাখল, বাস ব্রেক কষলে যেন কোনোদিকেই পড়ে না যেতে পারি, সবদিকেই ওর হাতের ব্যারিকেড থাকল!
সামান্য বাসের ঝাঁকুনি থেকেও আমাকে আগলে রাখার কী প্রচেষ্টা ওর। এত স্নেহের বিনিময় আমি কিভাবে দেবো! চোখে পানি এসে যায় আমার। হাত দিয়ে পানিটা মুছে ফেলতেই ছোটো আপা চিৎকার করে,
— ব্যথা পেয়েছিস? কোথায় লাগল?
— লাগেনি।
— তাহলে কাঁদছিস কেন? সত্যি কথা বল, কোথায় লেগেছে?
— লাগেনি বললাম না?
— আমি দেখছি তুই কাঁদছিস!
— ভালো করছি। তোমার স্টপেজ এসে গেছে। দয়া করে নেমে যাও তো!
চোখ সরু করে তাকাল ও,
— সত্যি বলছিস তো স্বর্ণ, ব্যথা পাসনি?
— নারে আপা। প্লিজ তুমি নামো এখন।
— তুই এইদিকে আয়। এই আপু এখানে নেমে যাবে। ওর সিটটাতে তুই বসবি। আমি ধরে রাখছি সিটটা।
আমাকে সিটে বসিয়ে তারপর নামল ও। বাসের ভীড় পাতলা হতে শুরু করেছে। ঠান্ডা বাতাস ঢুকে যাচ্ছে। আজকে সকালে বৃষ্টি হয়েছে। ঠান্ডাও জাঁকিয়ে ধরেছে। বেশ মোটা সোয়েটার আমার গায়ে। কানটুপিতে মাথা ঢেকে রাখা। তবুও শীত শীত লাগছে। আমার ঝিমুনি লেগে গিয়েছে। একটু ঘুমানো দরকার। কিন্তু ঘুমানো যাবে না আজকে। অনেক দিন পরে কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে। ফার্স্ট পিরিয়ডের পরে আর ক্লাস নাও হতে পারে। এমনিতেই লেট করে ফেলেছি। আমার স্টপেজ আসতে আমি নেমে পড়লাম।
কলেজের চেহারা আমূল পালটে গেছে। পাহাড়ি বর্ষার ঢলে মাটি নরম হয়ে ধ্বসে পড়েছে। সাথে ভেস্তে দিয়েছে আমাদের কলেজের একাডেমিক ভবন, বিজ্ঞান ভবন আর লাইব্রেরি। একটা ভবনও মাথা উচু করে নেই। এর বদলে তৈরি হয়েছে বাঁশ আর বেড়া দিয়ে তৈরি অস্থায়ী ঘর।
আমার একটু মন খারাপ হলো। বিজ্ঞান ভবনটা নতুন ছিল। কী সুন্দর ল্যাবরেটরি ছিল আমাদের! ফিজিক্স ল্যাব, কেমিস্ট্রি ল্যাব, বায়োলজি ল্যাব! নীচতলার পুরোটাই জীববিজ্ঞানের। আর দোতলায় ফিজিক্স, কেমস্ট্রির ল্যাব। ল্যাবের সাথেই ক্লাসরুম। দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে গেটের বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যেত। মহিলা কলেজের গেটের চারপাশে শুধু ছেলে আর ছেলে। প্রায় সবাইকেই আমার চেনা। কোনো না কোনো বন্ধুর বয়ফ্রেন্ড!
সমস্ত অচিনপুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাঙালিদের আধিক্য। কালকে মংসিকের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। আসলেই তো, আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতার কারণে পাহাড়িরা ওদের প্রাপ্য শিক্ষাটুকু পাচ্ছে না। অথচ পাহাড়ের সম্পদ ব্যবহার করে সমস্ত সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে বহিরাগতরা। আমাদের কলেজেও প্রায় সবাই বাঙালি। পাহাড়িদের জন্য একটু মন খারাপ করেই আমি দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাস খুঁজে নিলাম। ক্লাস প্রায় পরিপূর্ণ। অনেক দিন পরে কলেজ খোলায় মোটামুটি সবাই এসেছে আজ। আমাকে দেখে শম্পা জায়গা ছেড়ে ছুটে এলো।
— তুই এত দেরি করলি কেন?
শম্পা আমার কলিজা বান্ধবী। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ও। আমি গানের সুরে বললাম,
“রূপ নগরের রাজকন্যা আমি, রূপের যাদু এনেছি
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি”

শম্পার চুলের গোছা হালকা টেনে দিয়ে বললাম,
— আমি কোথা থেকে এসেছি, সেটা বুঝি এই কয়দিনের অদর্শনে ভুলে গেছিস, উল্লুক?
— আসলে রে অনেকগুলো দিন। তার উপর তোর তো মোবাইলও নেই। এই এই…
ভীষণ উত্তেজিত শম্পার মুখটা,
— সেই আগেরদিনের মানুষের মতো করবি? পায়রা পুষবি? চিঠি লিখে পায়রার পায়ে বেঁধে দেবো। ও উড়ে উড়ে তোর জানালায় গিয়ে বসবে…
— হুহ! মাঝখানে প্যালের উঠোন পড়বে। ও গুলতি দিয়ে পায়রাটাকে নামিয়ে খোপে ভরে দেবে!
শম্পা রেগে গেল,
— ফ্যান্টাসি জাতীয় কথাবার্তা কি কিছু তোর মাথায় ঢোকে না! এই যে তোকে মিস করেছি বলে কীভাবে তোর সাথে যোগাযোগ করা যায় সেটা দিয়ে রোমান্টিসাইজ করার চেষ্টা করলাম, সবটাতে পানি ঢেলে দিলি! এই ছেমড়ি তোর বয়স উনিশ-কুড়ি, এমন নিব্বি ভাব নিয়ে কেন থাকিস?
— আমি অতখানি অকারণ কল্পনা করতে পারি না। আমি বাস্তববাদী মানুষ!
— হ্যাঁ! বর যখন খুব আবেগাপ্লুত হয়ে গদগদ হয়ে গান ধরবে, ‘এসো হে প্রিয়া, তোমার খোঁপায় দেবো তারার ফুল!’ তুই তখন মুখ ভোঁতা করে বলবি, ‘থিওরেটিক্যালি ব্যাপারটা সম্ভব নয়। আকাশে তারাগুলোকে অনেক ছোটো দেখালেও বাস্তবে তা অনেক বড়ো। কোনো কোনো তারা তো সূর্যের চেয়েও বড়ো। শুধুমাত্র দূরত্বের কারণে তাদেরকে ছোটো দেখায়! খোঁপায় তারা গুঁজে দেওয়াটা অসম্ভব!’
আমি হেসে ফেললাম শম্পার কথায়। ওকে চিমটি কেটে বললাম,
— মামি বলে, এসব প্রেম ভালোবাসার বয়স হয়নি আমার। যখন হবে তখন ওসব গান, কবিতার অর্থ ঠিক বুঝে যাব!
— তুই যতটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব করিস, অতটা কম বয়স তোর মোটেও নয় স্বর্ণ! এই বয়সে বিয়ে হয়ে আমাদের মা-খালারা বাচ্চার মা হয়ে গিয়েছিল।
আমার একটু মন খারাপ হলো শম্পার কথায়। এসব প্রেম-ভালোবাসা বোঝার ব্যাপারে আমি একটু ঢিলাই, শম্পা আমাকে টিউবলাইট বলেই ডাকে। কিন্তু মামি শুনলে আস্ত কাচা খেয়ে ফেলবে আমাকে! বড়ো আপার যে অবস্থা বাড়িতে, আসতেও বকুনি খায়, যেতেও বকুনি খায়!
শম্পা আড়চোখে তাকাল আমার দিকে। বকা দেওয়ার ভান করে বলল,
— তোর কি মন খারাপ হলো? আরেকটা খবর আছে আমার কাছে সেটা শুনলে আরো মন খারাপ করবি।
— কী?
— টেস্টের রুটিন টাঙিয়ে দিয়েছে, নোটিশবোর্ডে দেখে এলাম।
— হুহ!
মুখ ঝামটা দিলাম আমি।
— এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? পরীক্ষা সামনে, রুটিন তো দেবেই!
শম্পা মাথায় হাত দিলো,
— অর্ধেক সিলেবাসের ক্লাস তো হলোই না। কীসের পরীক্ষা হবে?
— ক্লাস হয়নি বলে কি তোর পড়া বন্ধ ছিল? বই তো সব কাভার করা শেষ!
— আর তোর কী অবস্থা?
— আমার আর কী? আমাদের গ্রামে টিউশন পড়ানোর মাস্টার নেই, আর এক্সট্রা অতগুলো টাকার ব্যবস্থা করতে মামির অনেক কষ্ট হবে বলে আমি শহরে এসে টিউশন নেওয়ার কথা বলিও না বাড়িতে।
— তোর সব বোনেরা প্রাইভেট পড়েছে। যতীন স্যারের বাড়ি আমার বাড়ির কাছেই। এইচএসসির আগে তোর তিন বোনকেই রেগুলার সেখানে যেতে দেখেছি আমি।
— ওরা মামির কষ্ট বোঝে না। মামিও ওদেরকে কিছু বলে না। মামির যত কষ্ট, যত সুখ-দুঃখ – আমিই শুধু জানি। আমাকে বলেই মামি হালকা হয়!
— এইরকম পড়ে রেজাল্ট ভালো হবে? বিজ্ঞান না নিলেই হতো তাহলে!
আমি একটু ভেবে বললাম,
— মোটামুটি একটা রেজাল্ট হলেই হবে।
— রাজধানীতে যেতে চাস না? বড়ো ইউনিভার্সিটিতে পড়তে ইচ্ছে করে না? তোকে অচিনপুরে রেখে যেতে আমার খুব খারাপ লাগবে। এই অল্প কয়েকদিনেই তোকে কী যে মিস করেছি!
— আমিও তোকে খুব মিস করেছি!
— গ্রামে টিউশন পড়ানোর ব্যবস্থা নেই বললি, তবে প্রমি কী করে? ওর কত ভালো রেজাল্ট হয়!
শম্পার বাবার হোটেল ব্যবসা। ও বুঝবে না জুমের ফসলের একাংশের টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে আমাদের পড়াশোনা করাতে মামিকে কত টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমার সাথে কি প্রমির তুলনা হয়? হেসে হেসে বললাম,
— ও তো রাজার বাড়ির মেয়ে। মাস্টাররা সব দলে দলে চেম্মুডু পার হয়ে ওর বাড়িতে গিয়ে পড়িয়ে আসে!

ক্লাস হলো না সত্যিই। কলেজ থেকে বেরোবো বলে গেইটে এসেছি অমনি প্রভাত দাদার জিপ এসে রাস্তা আটকাল,
— উঠে আয়, চাঁপা!
বাঃ, জিপে উঠতে উঠতে বললাম,
— প্রমিকে নিতে এসেছ? কিন্তু এখন তো ও বাড়ি যাবে না। ওর তো আজ নাচের ক্লাস আছে।
— হুম সেটাই শুনলাম।
শেতলা ঝিরির দিকে গাড়ি যেতে দেখে বললাম,
— কোনদিকে যাচ্ছ? মেখলি যাবে না?
— যাব। প্রহ্লাদ দাদার ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে একটু। অসুবিধা আছে তোর?
— নাহ!
— মামি বকবে না?
— এত তাড়াতাড়ি ছুটির কথা ছিল না। মামি জানবেই না!
ঘাড়ের কাছে উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম কিছু একটার। লাফ দিয়ে উঠে তাকাতেই দেখলাম ডন। আঁতকে উঠলাম আমি,
— ও এখানে কী করছে!
— এমন করিস না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ও অনেক শান্ত ছেলে। কিছু করবে না।
— মোটেও না! হয় আমাকে নামিয়ে দাও। আমি টাউন সার্ভিস ধরে বাড়ি চলে যাব। নইলে ওটাকে ছেড়ে দেও।
প্রভাত দাদা বকুনি দিয়ে উঠল,
— এখন ওকে ছেড়ে দেবো কীভাবে? ও তো এতটাও বড়ো হয়নি যে টাউন সার্ভিস নেবে!
আমাকে টিটকারি দিলো প্রভাত দাদা। তাতে কিছু আসে যায় না আমার। আমার ঠিক পেছনে হাঁ করে থাকা, জিভ বের করে রাখা জ্যান্ত সারমেয় এটা ভাবলেই আমার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
প্রভাত দাদা গাড়ি থামিয়ে বলল,
— আচ্ছা বেশ। তুই পেছনে গিয়ে বোস। আমি ডনকে নামিয়ে সামনের দিকে বসাচ্ছি!
জায়গা বদলের পরে প্রভাত দাদা জানতে চাইল,
— এবারে হয়েছে?
বুকে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস নিলাম আমি,
— হ্যাঁ, শান্তি পাচ্ছি এখন।
শেতলার মোড় ঘুরতে ঘুরতে প্রভাত দাদা বলল,
— কালকে আমি চলে যাচ্ছি। আবার আসতে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে। তোকে কিছু কথা বলে ফেলাটা খুব দরকার। এমনিতেও বেশ দেরি করে ফেলেছি। ভেবেছিলাম তুই এমনিতেই বুঝে যাবি। চোখের ভাষা এভাবে মিস করে যাবি ভাবিনি। কিন্তু তুই তো বোকা ফুল। তোকে বানান না করে দিলে তুই কিছু বুঝবি না!
আমি উৎসুক হলাম প্রভাত দাদার কথা শুনতে। সে বলল,
— আমার চিঠিটা পড়েছিলি? বইয়ের মাঝে দিলাম যে!
হুট করে মনে পড়ল আমার,
— হ্যাঁ গো প্রভাত দাদা। তোমার বুকের ব্যথাটা কি কমেছে? ডাক্তার দেখিয়েছিলে?
প্রভাত দাদা হেসে ফেলল,
— তুই কি আসলেই এতটা বোকা? নাকি ভান করিস!
আমি মুখ প্যাচার মতো করে বললাম,
— কীসের ভান? লিখেছিলে ব্যথা পাচ্ছ। তাই জানতে চাইলাম ডাক্তার দেখিয়েছ কিনা!
— দেখিয়েছি, কিন্তু তাতে ব্যথা আরো বেড়ে গেছে।
চোখ কপালে নিলাম আমি।
— সে আবার কেমন ডাক্তার!
— ঠিক বলেছিস, ডাক্তারটা বড্ড বোকা! না আমার রোগ ধরতে পারে, না ঠিকঠাক ওষুধ দেয়!
ডন কেউকেউ করে উঠে ঘার ঘুরিয়ে দেখল আমাকে। আমি আবার আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। কী কুতকুতে কালো চোখ ওটার!
— যা বলছি চাপা, মন দিয়ে শোন! অমন ছটফট করিস না! তুই জানতে চেয়েছিলি না, আমার মুখ না আঁকা ছবিটাগুলোর মুখটা কার? আমার রাজধানীর বাসায়ও এরকম অনেকগুলো ক্যানভাস আছে। সেই ক্যানভাসে আমি তার মুখ এঁকেছি। চোখের সামনে ওই মুখটা দেখতে ভালো লাগে আমার। অনেকগুলো ক্যানভাসে এঁকেও আমার শান্তি হয় না! ছবিটাকে যত কথা বলি, ছবির আসল মানুষটাকে সেসব বলে দিতে খুব ইচ্ছে করে। এখন মনে হচ্ছে সময় হয়ে গেছে, কিংবা বড্ড দেরি হওয়ার আগেই তোকে জানিয়ে দিই ছবির মুখটা কার!
প্রভাত দাদার কথায় মনোযোগ নেই আমার। আমার চোখ শেতলার ঝিরির একপাশে বড়ো গাবগাছটার দিকে। ওর নিচে বসে থাকা মানুষ দুটোর দিকে। মেজ আপা আর ওর তুর্কি ফ্রেন্ড দেমির! ওই তুর্কি ব্যাটা কখন এই দেশে এলো? ওদের মাঝে সম্পর্কটা কতদূর? প্রভাত দাদা কি দেখে ফেলেছে ওদেরকে….!
আমি ফট করে বললাম,
— তোমার পায়ে পড়ি প্রভাত দাদা, তুমি আমার মেজ আপাকে বিয়ে করে ফেলো!

চলবে….
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here