অচিনপুর পর্ব -০৯+১০

#অচিনপুর – ৯ ও ১০

প্রভাত দাদা কী কী যেন বলল অনেকটা। আমি কিছু শুনলাম না। খুব অনুরোধ করে বললাম,
— আমার মেজ আপাকে বিয়ে করে নাও, প্লিজ!
দুম করে কড়া ব্রেক কষল ও। আমার কপালটা ওর সিটের পেছনটাতে জোরে ধাক্কা খেল। ‘উফ’ বলে চিৎকার করলাম আমি।
ডনও ভয় পেয়ে গেল। ক্রমাগত ঘেউঘেউ করতে থাকল আর ওর সামনের দুই পা দিয়ে ওর মনিবের হাত টেনে ধরল।
প্রভাত দাদা ওর ঘাড়ে হাত রেখে শান্ত করতে করতে বলল,
— আরে থাম তো! অনেক হয়েছে। আর চিৎকার করিস না। আমি ঠিক আছি!
ডন আরো কিছুক্ষণ কেউকেউ করল। তারপর চুপ হয়ে গেল। আমি কপালে হাত বুলাচ্ছি, প্রভাত দাদা বলল,
— তুই এখনই গাড়ি থেকে নেমে যা।
— মানে?
— মানে তুই এখনই গাড়ি থেকে নেমে যাবি আর টাউন সার্ভিস ধরে বাড়ি যাবি৷
আমি মুখ বাঁকালাম,
— এহ, বললেই হলো! আমি তোমার ঘোড়ার ডিমের লক্কর ঝক্কর মার্কা গাড়িতে উঠতে চেয়েছিলাম নাকি! তুমিই বলেছ বলে…
আমাকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই ও বলল,
— বেশ আমিই বলেছিলাম। অস্বীকার করছি না৷ ভুল হয়ে গেছে আমার। মাফ চাইছি তোর কাছে। এখন আমিই বলছি তুই নেমে যা।
দুহাত জোড় করে মাফ চাওয়ার ভঙ্গি করল প্রভাত দাদা।
আমি হঠাৎ বিপন্ন বোধ করলাম। ভয় পেয়ে বললাম,
— আশ্চর্য, এখানে আশেপাশে বাস স্টপেজ আছে নাকি? কমসেকম আধাঘন্টা হাঁটতে হবে আমাকে!
— সে তুই হাঁটবি নাকি দৌঁড়াবি দ্যাট ইজ নট মাই প্লেস অফ কনসার্ন! তুই এখনই নামবি আমার গাড়ি থেকে, এখনই! নাউ!
চিৎকার করল ও।
আমি কেঁদে ফেললাম। হিঁচকি তুলে বললাম,
— এমন ভয়ংকর জায়গায় আমাকে একা ছেড়ে দেবে তুমি?
— এই মূহুর্তে তোর চাইতে ভয়ংকর অপরাধী আর একটাও দুনিয়াতে নেই। তুই হাসতে হাসতে আমাকে খুন করে ফেলতে পারবি। তারপর একটুও অনুতাপ হবে না তোর!
— আমি কী এমন করলাম যে তুমি এমন করে বলছ? তুমিই তো বলেই যাচ্ছ, বলেই যাচ্ছ, আমি তো টুঁ শব্দটাও করলাম না!
— যাস্ট শাট আপ! নাম তুই আমার গাড়ি থেকে…
আমি এবার আরো জোরে কাঁদলাম, আর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হলাম।
— তোমার গাড়ি বলেই এভাবে নেমে যেতে বলতে পারছ। একদিন আমারও অনেক টাকা থাকতে পারে প্রভাত দাদা, তোমার গাড়ির চেয়ে বড়ো আর ট্রেন্ডি গাড়ি আমারও থাকতে পারে। সেদিন কিন্তু রাস্তার মাঝখানে এভাবে তোমাকে নামিয়ে দেবো না৷ দেখো তুমি!
আমি জানি এই আবেগভরা ডায়লগেই কাজ হবে, হলোও তাই। প্রভাত দাদার রাগ পড়ে গেল। ও যেন নিতান্তই অনিচ্ছায় বলল,
— নামতে হবে না। বস।
আমি বসলাম। একটু মুখ গোঁজ করে বললাম,
— কিন্তু তুমি কেন এতটা রেগে গেলে তাই তো বুঝলাম না!
গাড়ি চলতে শুরু করলে ডন কেউকেউ করে উঠল আবার। জিভ বের করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগল। প্রভাত দাদা কথা বলছে না বলে আমিই খোঁচালাম ওকে,
— কী বললে না? কেন রেগে গেলে?
— বাদ দে, চাঁপা! চুপ করে বসে থাক!
— না। বলতে হবে।
— তুই কী বলছিলি সেটা বল। মেজ আপাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হলি কেন? আমি তো মনে হয় মুন্নিকে দেখলামও। ওই গাছটার নিচে, ওটা একটা বিদেশী ছেলে ছিল, তাই না?
তার মানে সত্যি সত্যিই প্রভাত দাদা দেখেছে মেজ আপাকে। আমার আর লুকোনোর জায়গা নেই। আমি মিনমিন করে বললাম,
— তুমি কি কাউকে বলে দেবে?
— তুই সবটা খুলে যদি না বলিস…
আমি হাত উঠিয়ে থামালাম ওকে।
— না, না, না। বলছি বলছি।
প্রভাত দাদা হাসল। সামনের ঝুলে থাকা আয়নাটাতে ওকে দেখতে অপূর্ব লাগছে। লম্বা, পুরোপুরি বাঙালি চেহারায় একটু গাঢ় গায়ের রং, চুলগুলো একটু ঢেউ খেলানো অ্যাফ্রোটাইপ, উজ্জ্বল দুটো চোখ আর সাজানো দাঁতের মনোহরী হাসি! জো-মাও বলেন,
— আমার দুটো মাটির চোখে, প্রভাতের মতো সুন্দর হাসি আর কারো দেখিনি!
আমিও দেখিনি! এই হাসি দিয়েই কত কত মেয়েকে ও দিব্যি খুন করে ছেড়ে দেবে, কে জানে! আমার বড়ো আপা বা মেজ আপা কেন এর হাসিতে মরে গেল না!
প্রভাত দাদা আবার ধমকের সুরে বলল,
— কোথায় চলে গেলি? কী হলো বললি না?
আমি উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। এমন সুন্দর ছেলের চাইতেও ওই দেমির কুমিরকে বেশি পছন্দ মেজ আপার!
মন খারাপ নিয়েই বললাম,
— ওর নাম দেমির। এদেশের ছেলে না। টার্কিতে বাড়ি।
— এই দেশে থাকে?
— না, না, থাকেও টার্কিতে।
— তাহলে এখানে কেন এসেছে? আর মুন্নির সাথে কীভাবে পরিচয়? খুলে বল। বারবার প্রশ্ন করতে পারব না।
বড়ো করে নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
— মেজ আপার ফেসবুক বন্ধু। বড়ো আপা আর মেজ আপার মোবাইল আছে। চেম্মুডু পার হলেই নেটওয়ার্ক পায়। ডাটা কানেকশনও পায়। ফেসবুক একাউন্ট আছে দুজনেরই।
— তোর নেই?
— আছে। মেজ আপা খুলে দিয়েছিল৷ কিন্তু আমার তো মোবাইল নেই!
— কী নামে আছে একাউন্ট?
আমি মুখ নিচু করে বললাম,
— অ্যাঞ্জেল স্বর্ণা!
প্রভাত দাদা হোহো করে হেসে ফেলল। আমি লজ্জা পেলাম। ও হাসি থামিয়ে বলল,
— তো ডানাকাটা অ্যাঞ্জেল, এবার আপনার গল্প কন্টিনিউ করেন, প্লিজ!
প্রভাত দাদা কি আমাকে বিদ্রুপ করল? ও যদি জানত ওকে আমি কতটা পছন্দ করি, তাহলে কখনো আমাকে কষ্ট দিতে পারত না। আনমনে মাথার বিনুনী খুলতে খুলতে বললাম,
— ফেসবুকেই দেমিরের সাথে পরিচয় হয়েছে মেজ আপার। মেজ আপা এই পাহাড়ে একদম থাকতে চায় না। এই দেশেই থাকতে চায় না। দেমিরের সাথে তুরস্কে চলে যাবে। মামা মামি কেউ কিছু জানে না। দেমির কিন্তু খ্রিস্টান ছেলে। ওর সাথে মেজ আপাকে বিয়ে দিতে মামা মামি কখনো রাজি হবে না।
— ছেলেটা এই দেশে চলে এসেছে মানে ওরা রিলেশনে আছে, তাই না চাঁপা?
আমি উপর-নিচে মাথা ঝাঁকালাম।
প্রভাত দাদা হাসল,
— তবুও তুই চাইছিস, আমি মুন্নিকে বিয়ে করি?
— হুম! নইলে ও তো বিয়ে করে চলে যাবে অনেক দূরে! আর কখনো ফিরে আসবে না। বড়ো আপা উজ্জ্বল দাদাকে বিয়ে করে চলে যাবে৷ মেজ আপাও ভীনদেশে চলে গেলে কেমন করে হবে? আমি যে একা হয়ে যাব প্রভাত দাদা! বাবা চলে গেলে যখন একা ছিলাম, খুব ভয় পেয়েছিলাম। একা থাকা অনেক কষ্ট গো! আমি আর কখনো একা হয়ে যেতে চাই না!
— আর তুই?
— আমি কী?
— তুই বিয়ের পরে দূরে চলে যাবি না? নাকি মেখলিতে কেউ আছে তোর পছন্দের!
আমি লজ্জা পেলাম। কান গরম হয়ে গেল আমার। মুখ টিপে লাজুক হাসি দিয়ে বললাম,
— আমার বাড়ি মেখলির পাহাড়ে। আমার তো অন্য কোথাও যাওয়ার জো নেই গো! চেম্মুডু পার হয়ে ওই পাহাড়ের কোলের গ্রামটাই আমার ঠিকানা যে।
— তো, ওখানকার কেউ যদি তোকে বিয়ে করতে চায়!
আমি ভীষণ অবাক হলাম,
— কে? কে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে? বলো না, প্লিজ! সৌমিক কি?
প্রভাত দাদা একটা খেঁকশিয়াল, আমি নিশ্চিত! নইলে কথায় কথায় এমন খ্যাঁকখ্যাঁক করে কেউ? রেগেমেগে হাউকাউ করে বলল,
— সৌমিক ছাড়া মেখলি, বরণ পাড়ার আর কাউকে তোর চোখে পড়ে না?
আবারও জিপটা আগের মতো শক্ত ব্রেক কষল! এবার আমি সামনের সিটটাতে হাঁটু দিয়ে টিক দিয়ে ধরেছিলাম, ধাক্কা খেলাম না। ব্যথাও পেলাম না। কিন্তু অবাক হয়ে এটা খোঁজার চেষ্টা করলাম, প্রভাত দাদা কেন এত রেগে গেল? কাকে চোখে পড়েনি আমার? অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে না পেরে প্রভাত দাদার কাছেই প্রশ্ন করলাম,
— চেম্মুডুর ওই পাড়ে বাঙালি ছেলে আর কে আছে? আমি তো আর কাউকেও চিনি না…! কে আমাকে বিয়ে করতে চায়? বলো না প্লিজ!

চলবে…
আফসানা আশা

(নবম পর্ব চলে একটু তো রিচ বাড়া উচিত, নাকি? এই পর্বে সবার রিএক্ট/কমেন্ট চাই, নইলে আমিও চাঁপার মতো বোকা হয়ে থাকব। বলবেন যেটা আমি কিছুতেই সেটা বুঝব না 🫣)
ক্যুইজ – ১। প্রভাত এখন কী করবে চাঁপার সাথে?
২। প্রভাতের জায়গায় আপনি থাকলে কী করতেন?

#অচিনপুর – ১০

প্রভাত দাদা ভীষণ রেগে আছে। ওর চোখদুটো ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি নিশ্চয়ই কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছি। যদিও বা আমি জানি না কী এমন বলেছি যে এতটা রেগে যেতে হবে, তবুও আমি ওকে আর ঘাঁটাতে চাইলাম না।
ও খুব বেশি রাগ দেখাতে পারল না কেননা আমরা প্রহ্লাদ দাদার ফ্যাক্টরিতে চলে এসেছি।
এটা একটা রাবার ফ্যাক্টরি। পাশেই বিশাল জায়গা নিয়ে রাবার বাগান। বিশাল জায়গা বললেও ভুল হবে। একরের পর একর জায়গা নিয়ে রাবার বাগান! একরের পর একর বললেও ভুল বলা হবে, কয়েকশো একর জায়গা নিয়ে একেকটা রাবার বাগান। যেদিকে চোখ যায় সারি সারি রাবার গাছ। মাঝখানে ঝিল আছে, রাস্তা, পাহাড়, বাড়িঘর সব আছে। অসংখ্য ছোটো বড়ো টিলা আর পাহাড় নিয়ে দৃষ্টির সীমানায় শুধুই রাবার গাছ। প্রতিটি গাছের নিচ থেকে দুই বা তিন হাত উপরের ছাল বিশেষ ভাবে কোণাকুণি করে কাটা। সেই কাটার সাথে কাঠি ঝুলানো। কাঠি বেয়ে বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রাবার গাছের কষ জমা হয় নিচে ঝুলানো পাত্রে। এই কষ ঘন, আঠালো আর একেবারে দুধ সাদা রঙের।
এই কষ সংগ্রহ করে ফ্যাক্টরিতে এনে ঢেলে দেওয়া হয় বিশাল বিশাল টাবে। টাবে থাকে ঠান্ডা পানি আর ফর্মিং এসিড। এরা তরল রাবারকে জমে যেতে সাহায্য করে। চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে তরল রাবার জমে থকথকে পুডিংয়ের মতো বস্তুতে পরিণত হয়। একে সুবিধামতো কেটে কনভেয়ার বেল্টে ফেলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিং মেশিনে। সেখানে চেপে রাবারের ভেতরের পানি ফেলে একে লম্বা ও পাতলা শীটে পরিণত করা হয়। ধবধবে সাদা এই শীটগুলো ধরতেও যেমন মসৃণ, দেখতেও আদুরে। আর রাবারের ঘ্রাণও আমার খুব ভালো লাগে। তবে ফিনিশড প্রডাক্ট এমন সাদা থাকে না। আরো অনেকগুলো ধাপে অনেকগুলো প্রসেসিংয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে হালকা ব্রাউনিশ হয়ে যায়। তারপর প্যাকিং করে বাজারজাত করা হয়। এই রাবার দিয়েই তৈরি করা হয় মোটরগাড়ি, বাস, ট্রাক, সাইকেলের চাকার টায়ার ও টিউব। প্লেনের চাকায়ও এর ব্যবহার আছে। ইলেক্ট্রিক তারে উপরে যে আবরণ দেওয়া থাকে তাতেও রাবার ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পানিরোধী জিনিস, খেলনা, ব্যাগ, জুতো, চিকিৎসা সরঞ্জাম এসবে বহুল ব্যবহৃত হয় এই প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি রাবার। এই রাবার বাগান আর কারখানা ছিল রাজা দেবাংশুর। উত্তরাধিকার সূত্রে জো-মাওয়ের হাত ধরে এটা পেয়েছে প্রহ্লাদ দাদা আর প্রভাত দাদা। সম্প্রতি সরকারের ফরেস্ট ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের অংশ হয়ে এই কারখানা আরো ফুলেফেঁপে উঠেছে। প্রহ্লাদ দাদা রাবার প্রসেস করার পাশাপাশি টায়ার ও টিউব তৈরির কারখানাও বসিয়ে ফেলেছে। রাজার উত্তরাধিকার তো ও ছিলই আগে থেকে, এখন দেশের অন্যতম শিল্পপতির তালিকায় নাম লেখাতে আর বেশি দেরি নেই। অচিনপুরে এদের কত শত শত সম্পত্তি আছে তা মনে হয় এরা নিজেও জানে না!
প্রহ্লাদ দাদার কেবিনে ঢুকতেই বলল,
— আরে এটা কে? স্বর্ন? আয় আয় বোস!
আমি সামনের চেয়ারটা টেনে বসতেই প্রহ্লাদ দাদা বলল,
— তাহলে স্বর্ণ, কেমন আছিস? বহু বছর পরে তোকে এই রাবার ফ্যাক্টরিতে দেখলাম মনে হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে যাস তো? কয়েকদিন দেখিনি তোকে। প্রমির সাথে ঝগড়া হয়েছে?
প্রভাত দাদা যে আমাকে বকেছে সেটা নালিশ করে দিতে ইচ্ছে করল আমার। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম,
— আমি কারো সাথে ঝগড়া করি না। তোমাদের বাড়িতে আমি মাঝে মাঝেই যাই। তুমি থাকো না তখন!
— ওহ তাই? কিন্তু তোর মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন? কেঁদেছিস? খিদে পেয়েছে?
বলেই প্রভাত দাদাকে ডেকে বললেন,
— টায়ার কারখানায় বিদেশি অনেকেই কাজ করে। ওদের জন্য ভালো কয়েকটা দোকান হয়েছে। ফ্যাক্টরি থেকে বের হলেই একটা খাবারেএ দোকান হয়েছে দেখতে পাবি। ভালো বার্গার, পিৎজা করে। স্বর্ণর জন্য নিয়ে আসবি। আর দেশি বিদেশি ভালো ব্র‍্যান্ডের চকলেটও পাবি। একটা বড়ো দেখে চকলেট বার নিয়ে আয়। স্বর্ণর খিদে পেয়েছে। মুখ কেমন শুকিয়ে আছে! বেলাও তো হয়েছে।
অফিস রুমের এক কোণে একটা ডিভান পাতা আছে। সেটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল প্রভাত দাদা। চোখ বুজে বলল,
— ওর সবকিছুই দেরিতে হয়, দাদা। ও বোঝেও দেরিতে, ওর খিদেও দেরিতে পায়। এখনো ওর খিদের সময় হয়নি।
প্রহ্লাদ দাদার কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল,
— সে কী হয়েছে আমি বুঝব। তোকে বলেছি আনতে, তুই নিয়ে আয়।
— আমার মেজাজ খারাপ, দাদা। ভীষণ খারাপ। যেকোনো সময় চিৎকার, চেঁচামেচি করে একটা হাউকাউ লাগিয়ে দিতে পারি। তুমি অন্য কাউকে বলো ওসব চকলেট ফকলেট আনতে। তোমার পিয়ন নোটনকে ডাকো।
কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়ল সে।
প্রহ্লাদ দাদা আমাকে স্বান্তনা দিয়ে বলল,
— কোনো ব্যাপার না রে, স্বর্ণ। প্রভাত ছাড়া কি দুনিয়ায় আর লোক নেই? আমি বলেছি বার্গার খাওয়াব তো খাওয়াব। খেয়ে দেখবি, কেমন ভেলকি লেগেছে অচিনপুরে। আমার হাত ধরে কেএফসিও এসে যাবে এখানে। পাহাড়ের কোলে বসে আমরা মুরগি ভাজা খাব। দারুণ হবে না?
আমিও মাথা নাড়লাম। পাহাড় আধুনিক হচ্ছে, বিশ্বায়নের ঢেউ এখানেও নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
বার্গার আনাতে পাঠিয়ে প্রহ্লাদ দাদা আমাকে বলল,
— অনেক দিন পরে এলি, তাই না রে? সেই অনেক আগে আসতি, শাহাদাত আংকেলের হাত ধরে। লাল রঙের ফুলে থাকা ফ্রক পরে আসতি। কপালের দুপাশে দুটো অসমান ঝুঁটি ঝুলত তোর। আংকেল পারত না ঠিকঠাক চুল বেঁধে দিতে। কত বয়স তোর তখন? ছয় সাতের মতো হবে। আমি চৌদ্দ পনেরো৷ তুই স্কুল শুরু করেছিস কেবল আর আমি ছাড়ব ছাড়ব! তুই এসেই কী করতি মনে আছে তোর?
আমি মাথা নাড়লাম। মনে নেই আমার।
প্রহ্লাদ দাদা হেসে হেসে বলল,
— জমে থাকা রাবার ধরে ধরে দেখতি। আদর করতি। ঘ্রাণ নিতি। আর যাওয়ার সময় এক তাল রাবার প্যাকেট করে দিয়ে দিতে হতো তোকে। তুই বাড়ি নিয়ে যেতি সেটা।
আমার সাথে কথা বলতে বলতে প্রহ্লাদ দাদার একটা ফোন এলো। পাহাড়ি নদীর বালি, চুনাপাথর আর নুড়ি পাথরের যে ব্যবসাটা ছিল ওদের সেখান থেকেই ফোন এসেছিল।
ফোন রাখার পরে আমি জানতে চাইলাম,
— তোমার কি অনেক ব্যবসা?
— আমার কিছু না, স্বর্ণ। রাজামশাই অনেক কিছু রেখে গিয়েছে রে! সেসব নষ্ট না করে কী করে বাড়িয়ে তোলা যায় তাই চেষ্টা করছি রে।
— তুমি অনেক ধনী। অচিনপুরের সবচেয়ে ধনী তোমরা৷ তবুও য়েন য়েন দিদির বাবা ওকে তোমার সাথে বিয়ে দেবে না। ওরা অনেক গোঁড়া। তখন তুমি কী করবে?
একটু আঁধার হলো প্রহ্লাদ দাদার মুখটা। তারপরের হাসিতে ছটফটিয়ে বলল,
— কী করা যায় বল তো! তুইই বলে দে না!
— তুমি আমার বড়ো আপাকে বিয়ে করে নাও। নইলে মেজ আপাকে!
প্রহ্লাদ দাদা জোরে হেসে উঠলে প্রভাত দাদাও শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
— দে তো দাদা, ঠাস করে ওর গালে দুটো চড় মেরে দে তো!
প্রহ্লাদ দাদা ঠিক জবাব দিলো ওকে। মুখ শক্ত করে বলল,
— বলছে তো আমাকে, তুই কেন এত রেগে যাচ্ছিস?
— তোকে বলছে এখন। আর আমাকে সেই কালকে বাড়িতে আসা থেকে বলে যাচ্ছে। বোনেদের জন্য সবাইকে ওর বিয়ের পাত্র মনে হচ্ছে। ফাজিল একটা!
— সে ওর বোনেদের জন্য ও কাউকে অনুরোধ করতেই পারে। তাতে তুই কেন রেগে যাবি এতটা? তোর রাগ কোথায়?
— উনিশ বছরের মেয়ের মুখে তেরো বছরের খুকী খুকী কথা শুনতে আমার রাগ হয়! অসহ্য লাগে। ওকে টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। সকাল থেকে নিজের মনটা খুলে ওর সামনে রেখে দিলাম। ও কী বলল জানিস? বলে, ‘আমার মেজ আপাকে বিয়ে করে নাও, প্লিজ!’ ফাজিল একটা! অন্য কোনো মেয়ে হলে বলতেও হতো না, চোখের ভাষাতেই অনেক আগেই সব বুঝে নিতো!
— আর দশটা মেয়ের সাথে ওর মনস্তত্ত্বকে মেলানোটা বোকার কাজ হবে, প্রভাত। ওর শৈশব, বেড়ে ওঠা আমাদের মতো স্মুদ যায়নি। একে মা হারা এতিম মেয়ে। তার উপর শাহাদাত আংকেলের অকাল মৃত্যু একটা ট্রমা হয়ে রয়ে গিয়েছে। আংকেল যেদিন মারা গেল তার পর ওকে অনেকগুলো দিন একা থাকতে হয়েছে। ওই দিনগুলোর বিভীষিকা ওর মনে দাগ হয়ে রয়ে গিয়েছে এখনো! অত ছোটো বয়সে অতগুলো দুর্ঘটনার কারণে শরীর থেমে না থাকলেও মনের উপর তো একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছাপ রেখে গেছেই। তাতে ওর মানসিক বিকাশ যে বাধা পেয়েছে, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না! মানসিকভাবে বড়ো হয়ে উঠতে ওর একটু দেরি হতেই পারে। ওকে কিছু বোঝাতে চাইলে, আগে তোর ওকে বুঝতে হবে! ওর মনের জায়গা চাইতে হলে, আগে তো ওর মন আর মানসিক অবস্থাটাও জানতে হবে! আমরা যখন একটা ঘরে বিছানা পাতি, ওই ঘরের আলো বাতাস দেখি। কোথাও ড্যাম পড়েছে কিনা সেটা খেয়াল করি। উষ্ণতা কোথায়, কোথায় বৃষ্টির ছাঁট আসে সবটা খেয়াল করি। আর মন তো অনেক দামী জায়গা! সেই অমূল্য মনের ঘরে স্থায়ী জায়গা ফেলতে তার মনের অবস্থাটাও জানা জরুরি নয় কি?
প্রহ্লাদ দাদার কথা কিছু বুঝলাম না আমি। শুধু বাবার নামটা শুনে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললাম।
প্রহ্লাদ দাদা বলল,
— শাহাদাত আংকেল কেমন সাহসী মানুষ ছিলেন, সেটা তোর একদম মনে নেই স্বর্ণ। তাহলে এমন হুটহাট কেঁদে দিতি না। আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী আর মেধাবী মানুষ ছিলেন তিনি। রাজধানীর বুকে অত নামি চাকরি, অত নামকরা বাড়ির ছেলে, অত সুনাম আর বিলাসী জীবনটা একেবারে ছেড়ে দিয়ে এই সভ্যতা বিবর্জিত পাহাড়ে এসে বসবাস করাটা কম সাহসের কথা নয়! এই যে টায়ার-টিউব ফ্যাক্টরিটা – এটার সমস্ত পরিকল্পনা, ডিজাইন আংকেল নিজে করেছিলেন। তার মেয়ে এমন বোকা হলে চলে? একদম না। ঠিকঠাক পড়াশোনা করিস রে। আংকেলের অনেক ইচ্ছা ছিল, তিনি আর তোর মা যেখানে পড়াশোনা করেছিল – তুইও সেখানেই পড়াশোনা করবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে? কেউ কোনোদিন সেটা বলেনি তো আমাকে!
প্রহ্লাদ দাদা অবাক হলো,
— কেউ বলেনি! কিন্তু আংকেলতো হরহামেশাই এই কথাটা বলতেন…! আমি তো ভেবেছি তুইও সেভাবেই তৈরি হচ্ছিস!

চলবে….
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here