অচিনপুর পর্ব -১১

#অচিনপুর – ১১

য়েন য়েন দিদিকে এখানে দেখব এটা আমি ভাবতেও পারিনি৷ যারপরনাই অবাক হলাম৷ বিস্ময়ে আমার চোয়াল ঝুলিয়ে দিয়ে একটা সবুজ রঙের ঘাঘরা পরে ঢুকল ও। হলুদ, সবুজ চেক জামার উপর সবুজ রঙের ওড়নাটা আড়াআড়ি করে ভাঁজ করে রাখা। পেছন থেকে ঘুরিয়ে এনে সেই ওড়নাটার আরেকপ্রান্ত বাঁহাতের কবজিতে একটা প্যাঁচ দিয়ে রাখা। সদ্য রোদ লেগে ঝিলমিল করে হেসে ওঠা অবারিত শস্যক্ষেতের মতো দেখাচ্ছে ওকে। মাথায় সদ্য তোলা টকটকে দুটো জবাফুল। ওর অনিন্দ্য সুন্দর ত্বকে চাঁদের কিরণ খেলা করে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম!
য়েন য়েন দিদির হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার। ওটা টেবিলের উপর রেখে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা গামছা বের করল ও। প্রহ্লাদ দাদার ফাইল পত্র, টেলিফোন যা যা ছিল টেবিলের উপর, চটপট সরিয়ে নিয়ে গামছাটা পেতে দিলো সেখানে। ব্যাগ থেকে একটা প্লেট বের করে য়েন য়েন দিদি একটু বিব্রত চোখে তাকিয়ে থাকলে প্রহ্লাদ দাদা কথা বলল,
— কী রে স্বর্ণ, তুই জানতে চাইছিলি না, য়েন য়েন দিদির বাবা আমার সাথে য়েন য়েনকে বিয়ে দেবে কি না!
আমি কৌতুহলী হলাম।
প্রহ্লাদ দাদা য়েন য়েন দিদির দিকে তাকিয়ে বলল,
— ওরা ছোটো মানুষ, এসব খেতে পারবে না। বিব্রত হওয়ার কিছু নেই, তুমি বরং আমাকে দাও। আমি খেতে শুরু করি। ওদের তো আর ঠ্যাকা নেই এসব খাওয়ার! আর তুমি খাবার এনেছও একজনের জন্যই।
য়েন য়েন দিদি কথা বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
প্রহ্লাদ দাদা বলল,
— ওর মৌনব্রত চলছে রে স্বর্ণ। তোর সাথে কথা বলতে পারবে না। তুই আবার ভাবিস না ও ইচ্ছে করে তোর সাথে কথা বলছে না!
আমি অবাক হলাম। এইজন্যই য়েন য়েন দিদি কোনো সম্ভাষণ করল না আমাকে। একটু আগে আমার খারাপও লাগছিল। অচিনপুরে অভিজাত পরিবার দুটো। একটা প্রহ্লাদ দাদারা – রাজার বংশ কিন্তু তারা তো সমাজে ব্রাত্য। আর একটা এই য়েন য়েন দিদির বংশ। শহরের সবচেয়ে বড়ো, সবচেয়ে প্রাচীন আর কেন্দ্রীয় মন্দিরের পুরোহিত য়েন য়েন দিদির বাবা। তারও আগে তার দাদা, দাদার বাবা, দাদারও দাদা ছিলেন এই মন্দিরের পুরোহিত। ধনীর মেয়ে বলে আমাকে এড়িয়ে গেল য়েন য়েন দিদি, সেটাই মনে হচ্ছিল এতক্ষণ। প্রহ্লাদ দাদার কথায় ভুল ভাঙল।
য়েন য়েন দিদি প্রভাত দাদার দিকেও তাকিয়ে মাথা নিচু করে হাসল একটু। প্রভাত দাদা বলল,
— ভালো আছ তো?
য়েন য়েন দিদি মাথা নাড়িয়ে প্লেটে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করল। অল্প ভাত, সেদ্ধ সবজি, মরিচ ভর্তা আর গন্ধে বুঝলাম নাপ্পির তরকারি!
প্রহ্লাদ দাদা হাত ধুয়ে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
— কী বলছিলি স্বর্ণ, অনেক ধনী হলেও তোর য়েন য়েন দিদির বাবা আমাদের দুজনের বিয়েতে রাজি হবে না, তাই তো? ঠিক বলেছিস রে! উনি কঠিন দুটো শর্ত দিয়েছেন। এক, তোর য়েন য়েন দিদিকে দুই মাস কঠোর উপবাস আর মৌনব্রত করে দোষ কাটাতে হবে আর দুই নম্বর শর্তটা আমার জন্য।
বাটি থেকে সবজি সেদ্ধটা প্লেটে ঢেলে নিলো প্রহ্লাদ দাদা। এই সবজিটাকে চিনি আমি। এর নাম খনা বা হনা। গাছে গাছে লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে। এখানকার বাঙালিরা কেউ খায় না। তবে পাহাড়িরা খুব মজা করে খায়। এর আরেকটা স্থানীয় নাম আছে – কানাইডিঙা। ওষধী গুণে ভরপুর এই গাছের বাকল, পাতা, ফুল, ফল সবকিছু। কিন্তু খেতে নাকি অতি বাজে। স্বাদটা কখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, আমার পাহাড়ের বন্ধুদের কাছে শুনেছি। বিশেষ করে শুনেছি লিটিনার মুখে। যেদিন ওদের বাড়িতে এই সবজি রান্না করা হয় ও পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। পালিয়ে কখনো কখনো আমাদের বাড়িতেও আসে। বারান্দায় বসে থাকে। কেননা ঘরে ঢোকায় মামির বারণ আছে। পাহাড়ের কারো সাথেই মামি মেশে না। যারা আমাদের হয়ে জুমে চাষ করে সেইসব কৃষকেরাও দূর থেকেই যেন পূজো দিয়ে যায়!
প্রহ্লাদ দাদা খনাসেদ্ধর সাথে মরিচভর্তা মিশিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলো। আমার বিস্ময়ে হা করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
— আমার শর্ত এটা!
— এই সবজি খাওয়া?
— যে খাবারগুলো আমার অভ্যাসে নেই সেগুলোতে অভ্যস্ত হওয়া। শর্ত অনেক ভয়ংকর ছিল। বেশিরভাগই আমাদের ধর্মমতে হারাম খাবার। শুধু এটাই ছিল হালাল। আমি এটা বেছে নিয়েছি। দুই মাস আমাকে এই খাবার খেয়ে ব্রত করতে হবে। আর এক বেলা আহার করতে হবে। তাও এই খাবারগুলোই!
— দুই মাস! সম্ভব?
— চেষ্টা করছি! এটা আসলে শর্ত নয়, শাস্তি। য়েন য়েনকে চাওয়ার স্পর্ধা করেছি সেই শাস্তি!
য়েন য়েন দিদির চোখ কাঁদছে। প্রহ্লাদ দাদা তাড়াহুড়ো করে আরেক লোকমা মুখে নিয়ে বলল,
— কিন্তু আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, স্বর্ণ। এখন খেতে অসুবিধা হয় না। এত দামি জিনিস চেয়েছি আমি, তার সঠিক দাম তো দিতেই হবে। তাই না? কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা! কয়েকদিন পরে তো এর সিজন শেষ হয়ে যাবে তখন য়েন য়েন এর বাবা করবেটা কী? হাহাহা।
প্রহ্লাদ দাদার হাসিতে হেসে কেঁদে ফেলল য়েন য়েন দিদি। মাথা ঝুকিয়ে যা ইশারা করল সেটা প্রহ্লাদ দাদা ঠিক বুঝে ফেলল,
— এ এখন কী বলছে রে, স্বর্ণ! আমি শেষ! আমার কী হবে এখন!
আমিও অবাক হয়ে জানতে চাইলাম,
— কী?
— এ জিনিস নাকি শুকিয়ে সারা বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়! ওর বাড়িতে কয়েক ডালা ভরে এত বেশি করে শুকিয়ে রাখা হচ্ছে যে আসছে বছরের মৌসুম পর্যন্তও শেষ হবে না!
প্রহ্লাদ দাদার চিৎকারে য়েন য়েন দিদি হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে মাটিতে পড়ে গেল। প্রভাত দাদা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল, সেও হাসি আটকাতে পারল না। হাসতে হাসতে উঠে এসে য়েন য়েন দিদির হাত ধরে ফ্লোর থেকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আমারও হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা ধরে গেল।
হাসি থামিয়ে আরেকটা বাটি দেখিয়ে আমি বললাম,
— কিন্তু এই বাটিতে তো নাপ্পি মনে হচ্ছে! এটা খাবে না?
প্রহ্লাদ দাদা অল্প খাবার খেলো। খাওয়া শেষ করে বলল,
— ওটা হালাল নাপ্পি। অনেক বাঙালিরাও খায়। শিঁদল নামে চেনে অনেকে। শুকনো মাছের গুঁড়ো দিয়ে বানানো হয়েছে। তবুও এটা আমি খাই না। তাই এটাও খাবারের শর্তে যোগ হয়েছে। এই ঘোড়ার ডিমের সবজি তাও খেয়ে নিচ্ছি সোনামুখ করে, ওই নাপ্পি খেতে হলে আমি ঠিক তোর য়েন য়েন দিদিকে ভুলে ভূত হয়ে যাব। বুঝেছিস রে, স্বর্ণ!
— এই খাবারের শর্ত পালন করতে পারলেই য়েন য়েন দিদির বাবা তোমাদের বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে!
— এটা কোনো শর্ত নয়, স্বর্ণ। য়েন য়েনের বাবা জানেন, ভিন্ন ধর্মের বিয়েটা এখন পাহাড়ে অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। সমাজে হাজার পঞ্চাশ টাকা দান করলেই যথেষ্ট। আমাদেরকে বাধা দেওয়াটা উচিত হবে না – এটা য়েন য়েনের বাবা বুঝে গিয়েছেন। কিন্তু আমাদের তো শুধু ধর্মই আলাদা না। আমাদের জীবনযাপন আলাদা, সংস্কার আলাদা, খাদ্যাভ্যাস আলাদা। তাই য়েন য়েনকে তিনি এমন শর্ত দিয়েছেন যাতে করে আমাদের পরিবারে এসে ও কত সহজে আমাদের সমস্ত আচার ব্যবহার আপন করে নিতে পারবে, কতটা সহনশীল থাকবে ও, এই পরীক্ষা দিয়ে সেটা প্রমাণ হবে। আমরা এবং ও নিজেও সেটা বুঝতে পারব। আর খাবারের অভ্যাসের পরীক্ষা দিয়ে আমাকে প্রমাণ করতে হবে আমি য়েন য়েনের জীবনকে, ওর আচারকে কতটা ধারণ করতে পারব। বিয়ের পরে একসাথে থাকতে পারব কি না তার পরীক্ষা এটা। এই শর্তে ফেইল করলে আমাদের দুজনকেই এই সম্পর্কটাকে ভুলে যেতে হবে।
আমি অবাক হয়ে শুনলাম সবটা। আমার মনে হচ্ছে আমি এতদিন ভুল ছিলাম। য়েন য়েন দিদি আর প্রহ্লাদ দাদা একেবারে মেড ফর ইচ আদার৷ এদের দুজনকে আলাদা করে দেওয়াটা পাপ হবে। সেটা যেন য়েন য়েন দিদির বাবাও ঠিকঠাক বুঝে ফেলেছেন। আর আমিও আজ বুঝলাম।
প্রহ্লাদ দাদা হাত ধুয়ে এসে আবার নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
— পিণ্ডি চটকিয়ে খাওয়ানো তো শেষ! এবার যাও তবে! তোমার বাবার ষণ্ডা পাণ্ডারা তো অপেক্ষা করছে! আমার সাথে একা ছাড়লেই যেন তোমাকে আমি খেয়ে ফেলব। দেখো য়েন য়েন, যেই না বিয়েটা হবে, তোমাকে নিয়ে আমি উড়াল দেবো। তোমার বাবা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটবে আর কাঁদবে! আমাকে এই খনার ঘন্ট গেলানোর প্রতিশোধ যদি আমি না নিয়েছি তো আমি য়েন য়েনকে ভালোবাসি না!
য়েন য়েন দিদির পাতলা, গোলাপি ঠোঁটদুটো একদিকে বেঁকে গেল। মুখ বাঁকিয়ে ও উঠে দাঁড়াল। খোঁপা থেকে একটা ফুল খুলে আমাকে দিয়ে আমার কপালে চুমু দিলো। তারপর হাত নাড়িয়ে আমাদের সবাইকে বিদায় দিয়ে চলে গেল।
ও চলে যেতেই আমি দেখলাম একটা টিফিন বাটি রেখে গিয়েছে। আমি বললাম,
— এই রে, নাপ্পির বাটিটা তো নিলোই না! ভুলে রেখে গেল!
প্রহ্লাদ দাদা হাসল,
— ভুল করে নয়। প্রতিদিন ওরকম একটা বাটি আনে ও। একেকদিন একেক রকম করে মাছের গুঁড়োর নাপ্পি রাঁধে। কোনোদিন সবজি দেয়, কোনোদিন ভর্তা করে। ওটা জো-মাওয়ের জন্য। আমাদের বাড়িতে তো নাপ্পি ঢোকে না। দাদাজান খেতে পারত না, মা-বাবা কেউ খায়নি কোনোদিন। মা তো গন্ধই সহ্য করতে পারে না। আমরা তিন ভাই বোনও খাই না। জো মাও খুব পছন্দ করে। অনেক আগে চিনার মা রাঁধত জো-মাওয়ের জন্য। একদিন ওরকম রান্না করলে ওর গন্ধে প্রমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেই থেকে অত প্রিয় জিনিসটা জো মাও আর বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। য়েন য়েন এর মা তাই জো মাওয়ের জন্যই রান্না করে দেয়। ওরা ওদের রাজা, রাণীকে খুব ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত। জো মাওকেও যে ওরা মন থেকেই খুব ভালোবাসে সেটা সমাজের জন্য মুখে আনতে পারে না। জো মাওয়ের বয়স হয়েছে। কোনোদিন হয়তো থাকবে না। তাই ওরা মনের আঁশ মেটায় এইভাবে ছলচাতুরী করে ওকে খাইয়ে। আর ওই পঁচাত্তুরে বুড়িকেও দেখবি, এই বয়সেও তিন হাত জিভ বের করে বসে রয়েছে, কখন আমি যাব আর কখন সে এই জিনিস খাবে!
প্রহ্লাদ দাদা আড়চোখে তাকাল প্রভাত দাদার দিকে। বলল,
— এমনিতেই জো মাওয়ের সবচেয়ে প্রিয় নাতি বলে আমার বদনাম আছে। ভাবছি নাপ্পি খাইয়ে মেখলিপাড়ার জুমঘরের জমিগুলোও আমার নামে লিখিয়ে নেবো কি না!
প্রভাত দাদা হেসে ফেলল। প্রহ্লাদ দাদাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
— নাও না! তারপর আমার নামে ট্রান্সফার করে দিও! হাহাহা!
টিফিন বাটিটা হাতে নিয়ে প্রহ্লাদ দাদা বলল,
— চল, স্বর্ণ! আজ আমিও বাড়ি যাই তোদের সাথে। একটু আগে আগে গিয়ে বুড়িকে তরকারিটা দিই আর ফোঁকলা দাঁতের গালভরা হাসিটা দেখি গিয়ে!
প্রহ্লাদ দাদার নতুন গাড়িটাতে চড়লাম আমরা। প্রভাত দাদার গাড়িটা ড্রাইভার পৌঁছে দেবে বাড়িতে। ড্রাইভার আর প্রভাত দাদা সাম্নের সিটে বসলে আমি আর প্রহ্লাদ দাদা পেছনে বসলাম।
প্রহ্লাদ দাদা হুট করে বলল,
— তোর কি জ্বর এসেছে রে, স্বর্ণ?
আমি নিজের কপালে হায়ের তালু ছোঁয়ালাম, হাতের পিঠও ছুঁইয়ে বললাম,
— কই না তো!
— তবে যে বার্গারটা খেলি না! আর চোখদুটোও ছলছল করছে!
— কেমন যেন লাগল। হয়তো তুমি খেলে না তাই!
প্রভাত দাদা হঠাৎ করে উলটো ঘুরে সিটের উপর দিয়ে আমার কপালে হাত চেপে ধরল, তারপর অবাক গলায় বলল,
— বেশ জ্বর, কপাল পুড়ে যাচ্ছে! জ্বর এলো কেন?
আমি অপরাধী গলায় বললাম,
— প্রহ্লাদ দাদা, আমার তো ‘মাইঢ্যা সায়েন্স!’ আমি কি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারব?

চলবে….
আফসানা আশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here