আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -১২

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(12)

উন্মু*ক্ত পেটে ডান হাত দিয়ে খাম*চে ধরে বাম হাত এগিয়ে দেয় অরুনিকার দিকে। আদাভানের খা*মচিতে ব্যাথা নয় বরং একরাশ লজ্জা ভর করলো অরুনিকার চেহারা জুড়ে। শিহর*ণে শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে চলছে এক শীতল স্রোত। ভালোলাগার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে দুই মন। বাম হাতের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছে ফেলে আদাভান প্রেয়সীর চোখের জল।

হুট করেই অরুনিকাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় আদাভান। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় মত্ত হয়ে ওঠে সে। মনে পড়ে যায় তাদের সম্পর্কের কথা, মনে পড়ে অরুনিকা আর পূরবের মাঝের সেই ঘনি*ষ্ট দৃশ্যের কথা। কমে যাওয়া রাগ আর কষ্ট সেই সাথে মাথা চারা দিয়ে ওঠে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোনোরকম ঝামেলা চাচ্ছেনা। পিছন ঘুরে একবার তাকায় সেই চোখের দিকে যে চোখে বারবার ডুবে যায় আদাভান। নাহ আর তাকাতে পারলোনা। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে বারবার, বোঝাতে চায় অন্য এক ভাষা যা সম্পূর্ণ ভুল। এই ভুল থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় সে। কোনোভাবেই এই ভুলে জড়াতে চায়না, কোনোভাবেই নাহ।

আদাভানের যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুনিকা। মলিন মূখে একবার তাকায় ব্যালকনির দিকে, দেখতে পায় এক আলো ছায়ার মাঝে বিরাজমান প্রতিবিম্ব। এক যুবকের প্রতিবিম্ব, তার স্বামীর প্রতিবিম্ব। আজ অরুনিকার মনও কেনো জানি নিজে থেকেই চাচ্ছে তার স্বামীর স্পর্শ। আদাভান যে তাকে অবহেলা করতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরে করুন হাসলো অরুনিকা। সবার অবহেলা পেতে পেতে আজ ক্লান্ত সে।

“আপা! তোমার মতো আমাকে আর কেউ বোঝেনা গো। আম্মু, আব্বুও আমাকে অবিশ্বাস করলো। আমি কী করবো এখন বলে দাও না। আমি আর পারছিনা এসব সহ্য করতে। তুমি চলে যাওয়ার পর পাল্টে গেছে আমার জীবন আপা। তোমার সেই ছোট্ট অরু বড়ো হয়ে গেছে।”

ভীষন কান্না পাওয়া সত্ত্বেও চোখ থেকে একফোঁটা পানি বেরোলোনা অরুনিকার। কষ্টেও বুঝি কেউ হাঁসে? হয়তো হাঁসে। অরুনিকাতো হাসছে, এক তাচ্ছিল্য ভরা হাঁসি। এই হাসিটা কাকে উপহার দিলো নিজের ভাগ্যকে নাকি ঘটতে থাকা সময়কে জানা নেই। তবে সেই হাসির মাঝে লুকানো ছিলো ব্যাথা, তীব্র এক য*ন্ত্রণাময় হাহাকার।
_____________

ফোন হাতে নিয়ে বেশ ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বসে আছে অরুনিকা। স্বপ্নেও না ভাবা জিনিসটা সত্যি হয়েছে আজ। তার প্রিয় লেখক তার কমেন্টের রিপ্লাই করেছে। প্রতিউত্তরে সে লিখেছে,

“চোখের তলায় জমছে দেখো,
এক জীবনের গল্পখানা
সন্ধ্যা হলেই ভীর করে সব
অনুভূতিদের মিছে বায়না।”

আবেগে আপ্লুত হয়ে হুট করেই ঢুকে পড়লো “নীল চিরকুট” আইডিতে। মেসেজ দেবে কিনা দেবেনা ভাবতে ভাবতেই হয়ে গেলো এক ভুল। হাতের টাচ লেগে কল চলে গেলো তার কাছে। তারাহুরো করে কাটতেও ভুলে গেছে অরুনিকা। উফফ কি এক বিরক্তিকর অবস্থা! ঠিক চেনা নেই জানা নেই এমন একজনের কাছ থেকে কল পেয়ে নিশ্চই বিরক্ত হওয়ারই কথা কারোর। তাই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো একটা মেসেজে নিজের ভুলটা স্বীকার করার কথা।

“এইযে লেখক সাহেব,

আপনি আমার প্রিয় লেখকের মধ্যে অন্যতম। আপনার সব গল্পই মোটামুটি বারবারই পড়ি আমি। তবে আজ ভুল করেই আপনার আঙিনায় পদার্পণ করে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা একদমই ভুলবশত ছিলো। কখন যে পা পিছলে পড়ে যাই সেখানে বুঝতেই পারলাম নাহ। আমার ভুলকে ফুল মনে করে ক্ষমা করবেন প্লীজ।”

মেসেজটা লিখে সেন্ড করার পর আবারো ডিলিট করে দিলো। এমন ঘোরানো পেঁচানো কথা সে কবে থেকে আয়ত্ব করতে শিখলো আবার? এসব তার জন্য মোটেও নয়। এসব সাহিত্যিকদের জন্য, কোনো সাহিত্য বা কাব্যে মানায়। সে তো সোজাসাপ্টা একটা সরি চেয়েই খান্ত হাওয়ার মেয়ে। তাই সরি লিখেই সেন্ড করে দিলো।
______________

কলেজে তাদের আড্ডার জায়গাটা এখন খালিই পড়ে থাকে। সেদিনের পর আদিত্য আর নূরের কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। আদিত্যর ফোন বন্ধ পেয়েছে বারবার তারা, আর নূর কারোর কল ধরছেনা। আলেয়া আর অরুনিকা বিরক্তিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে ঠিক সেই সময় সামনে করোর পা লক্ষ করে সেদিকে তাকিয়ে সক হয়ে যায় দুজনে। এক মুহূর্তের জন্য যেনো ভয় পেয়ে গেছিলো তারা। এ তো তাদের নূর না, অন্য কেউ যেনো। তাদের নূর ছিলো ঠিক নূরের মতোই নূরানিময়। চেহারার সেই ঔজোল্য কোথায় হারালো তবে? মাত্র দুই সপ্তাহের মাঝেই দেহ হয়ে উঠেছে কঙ্কালসার। চোখের নীচে কালো স্তর, দেখলে যে কেউ বলবে ঘন কালো কাজল যেনো খুব যত্নে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে সেখানে। সারা মুখে কেমন কলো কালো দাগ, যেনো কতো কাল মুখে পানি পড়েনা। ধবধবে ফর্সা শরীরটা কেমন শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। যেনো কতো কাল তাদের যত্ন নেওয়া হয়না।

এই কঙ্কালসার নূরকে দেখেই জাপটে জড়িয়ে ধরলো অরুনিকা। নিজের মাঝের অবাক ভাবটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। এগুলো কিভাবে সম্ভব? আগের নুরের সাথে যে আকাশ পাতাল ফারাক তার। তবে তাদেরকে কিছু বলার সুযোগ না দেওয়ার পরিকল্পনা যেনো নূর আগে থেকেই করে এসেছিলো। ব্যাগ থেকে তিনটে কার্ড বের করে এগিয়ে দিলো তাদের দিকে।

“সামনের মাসে আমার বিয়ে, তোদের ছাড়া আমার তো কোনো ফ্রেন্ড আর নেই। সবাই আসবি কিন্তু। আর আ…আদিত্য কোথায়? ওকে দেখছিনা যে?”

আদিত্য নামটা নিতেও আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নূরের। তাকে এক পলক দেখার জন্যই তো ছুটে এসেছে সে সব বাধা পেরিয়ে শেষ বারের মতো একবার দেখবে তার আদিত্যকে।

“তুই যেদিন থেকে কলেজে আসা বন্ধ করেছিস সেদিন থেকে আদিত্যরও কোনো খোঁজ পাইনি আমরা। ফোনটাও বন্ধ জানিনা আমরা কেউ ওর ব্যাপারে।”

আলেয়ার কথা শুনে বুকের ভেতরটা মো*চড় দিয়ে উঠলো নূরের। শুষ্ক উত্তপ্ত মরুর ন্যায় খাঁ খাঁ করছে তার বুক। দু*মড়ে মু*চড়ে শেষ করে দিচ্ছে সব। তবে কি শেষ বারের মতো ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার সৌভাগ্যও তার নেই? এতো অভাগা হয়ে কেনো জন্ম নিলো সে? এতো অপ্রাপ্তি নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে সে?

এতোক্ষণে নিজের অবাকের সীমা থেকে বেরিয়ে এসে দুই হাতে ঝাঁকিয়ে ধরলো নূরকে অরুনিকা। কড়া দৃষ্টিতে চোখ রাখলো প্রানপ্রিয় বান্ধবীর চোখে।

“সত্যি করে বল নূর কি হয়েছে তোদের মাঝে। তোরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসিস আমরা সবাই সেটা জানি। তবে এসব কি? হটাৎ করেই তুই বিয়ে করছিস, হটাত করেই আদিত্যর কোনো খোঁজ নেই। তোর কি আমাদের বাচ্চা মনে হয়? কিছু বুঝিনা আমরা?”

অরুনিকার কন্ঠে রাগের সাথে মিশে আছে বন্ধুদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। ওরা চারজনই একেঅপরের প্রাণের থেকেও প্রিয়। তবে ভাগ্য যে তাদের বিচ্ছেদ টেনে এনেছে। ঘনিয়ে এসেছে তাদের চারজনের শক্ত বাঁধন আলগা হওয়ার সময়। নূরের করুন দৃষ্টি অরুনিকার চোখের আড়াল হলোনা।

“দেখ অরু তুই যেটা ভাবছিস এমন কিছুই নাহ। আমাদের মাঝে যেটা ছিলো সেটা আবেগ। আর আবেগ দিয়ে তো জীবন চলেনা তাইনা? জীবনে ভালো থাকার জন্য টাকার দরকার হয়। তাই বাড়ী থেকে যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে আমার, আমি রাজি হয়ে গেছি। ব্যাস আর কিছুই না।”

“আমার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে নূর তুই টাকার জন্য আদিত্যর সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিস। কেনো নূর? কিভাবে পারলি এমনটা করতে? ভালোবাসার চেয়ে টাকা তোর কাছে বড়ো কবে হয়ে গেলো? তুই তো এমন ছিলিনা? আদিত্য তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তোকে চিনতেও আজ আমাদের কষ্ট হচ্ছে।”

“তুই তো বড়ো ঘরেই জন্মেছিস। ছোটো থেকে যা চেয়েছিস তাই পেয়েছিস, টাকার জন্য জীবন কোথায় দাড়ায় তুই কিভাবে বুঝবি? আর তুই বলছিস ভালোবাসার কথা? নিজে তো বিয়ে করেছিস আদাভান স্যারকে। কলেজের প্রফেসর না হলে করতিস নাকি? আরে এগুলো কাউকে জ্ঞ্যান দেওয়ার সময় ভালো লাগে বাস্তবটা বড্ড কঠিন।”

এটুকু বলে আর এক মুহূর্তও দাড়ায়নি নূর। একবার পিছনে ফিরলে দেখতে পেতো কারোর করুন চাহনি। সে চাহনিতে রয়েছে অবিশ্বাস। যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে সে। ধপ করে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে অরুনিকা। জীবনটা কোথা থেকে কি হয়ে গেলো তার? এক এক করে সবাইকে হারিয়ে ফেললো। তার আপন বলতে আর কেউ নেই। কেউ নেই তার সুখ দুঃখের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার। কেউ নেই হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখার। কেউ নেই যত্ন করে আদুরে হাত মাথায় বুলিয়ে দেওয়ার। কোন ধ্বং*সখেলা খেলতে নেমেছে জীবন তার সাথে? এর শেষই বা ঠিক কোথায়?
___________

বিধ্ব*স্ত অরুনিকাকে নিজের বুকের মাঝে ধরে রেখেছে আদাভান। অরুনিকাও লেপ্টে আছে তার বুকে নির্দ্বিধায়। সর্বস্ব হারানো বুকটা এখানে একটু হলেও শান্তি খুঁজে পেয়েছে। ভাবনার গভীরে গিয়ে এক সময় তার মনে হলো অতীতকে আঁকড়ে তো কখনো ভালো থাকা যায়না। অতীত ঠিক উইপোকার মতো কুরে কুরে শেষ করে দেয় জীবনটা। যে চলে যায় সে কেনো তার সাথে করে যন্ত্র*নাগুলোও নিয়ে যায়না? এক বুক হাহাকার কি তবে উপহার স্বরূপ দিয়ে যায়? মানুষ কেনো এতো রঙ বদলায়! মানুষ চেনা তবে কি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ?

জীবন হলো অলিখিত বোঝাপড়া!
মেনে নিলে ভালো, নয়তো সবই ছন্নছাড়া।

চলবে?
#Fiza_Siddique

আসসালামু আলাইকুম, আইডি রেস্ট্রিকশনের জন্য এতদিন পর গল্প দেওয়া। আশা করি সবাই বুঝবেন। ফেসবুক কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড এর জন্য আমি লেখালেখি ছেড়ে দেবো ভাবছি। আর ভালো লাগছেনা। ছয় বার চেক করার পরও গ্রুপে অ্যাপ্রুভ হয়না। ফেসবুক রিমুভ করে দেয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here