আলো আঁধার, পর্ব:১২+১৩

#আলো_আধাঁর
লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

১২.
মহৎসাহে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে হিয়া। রাতে খাবার টেবিলে রাজিব বিদেশে যাওয়ার কথা বলতেই আজিজ সাহেব বলেছেন, ” যেখানে যাবে বৌমাকে নিয়ে যাও। বিয়ের পর বৌ ছাড়া কোথাও যাওয়া আমি সমর্থন করি না।” তারপর থেকেই প্রস্তুতি চলছে হিয়ার। অন্যদিকে রাজিব হিয়ার সামনে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে খুশি থাকার কিন্তু মনে মনে ঠিকই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। আসলে আমরা যা যে ভাবে চিন্তা করি সবসময় যে সেটাই হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একজন উপরে বসে সবকিছুর তদারকি করেন তার ইচ্ছাতেই সব হয়।
রাজিব শুধু ভাবছে ওর ভবিষ্যত কি? হিয়াকে ও ছাড়তে পারবে না এটা ওর মন বলছে আর সারার প্রতি ওর যে দায়িত্ব তা পালনের জন্য মস্তিষ্ক ওকে বাধ্য করছে। কিন্তু ভালোবাসায় ও তো দায়িত্ব থাকে। তাছাড়া স্ত্রীর প্রতি ওর যে দায়িত্ব সেটা? কোনটা পালন করা বেশি জরুরি? আর সবার আগে হিয়া কে ওর সব বলে দেওয়া উচিত। হিয়াকে অন্ধকারে রাখা হাসবেন্ড হিসেবে ওর উচিৎ হচ্ছে না। এখন ওর লাইফের সমস্ত কিছু জানা হিয়ার অধিকার। কিন্তু সেটাই বা কিভাবে বলবে? হিয়া কি বিষয় গুলো বুঝবে? এই মুহূর্তে রাজিবের মনে অনেক প্রশ্ন তবে এর একটিরও উত্তর ওর কাছে নেই।
আমার মনে হয় তুমি আমার যাওয়াতে খুশি না।
রাজিব কে চুপচাপ দেখে বলল হিয়া। উত্তরে রাজিব জোড় করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
তোমাকে কি একবারও আমি সে কথা বলেছি?
নাহ কিন্তু আমার যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে তোমাকে কেমন চিন্তিত লাগছে।
আরে ধুর তোমার যাওয়াতে আমি খুব খুশি। তোমাকে ছাড়া আমি কি থাকতে পারবো। বিজনেস নিয়ে একটু চিন্তিত তাই ওরকম মনে হচ্ছে।
সত্যি তো?
হুম। সত্যি।
আচ্ছা শোন আমি না খুব এক্সাইটেড। এই প্রথম দেশের বাইরে যাবো তাও তোমার সাথে।
এর আগে কোনদিন যাওনি?
বাসায় সেরকম পরিস্থিতিই তৈরি হয়নি কখনো। সবসময় হয় পড়াশোনা নাহয় দিয়া এর মাঝেই থেকেছি। দিয়াটা বাইরের কোলাহল বিশেষ পছন্দ করতো না। তাই বাড়ির সবাই ঘুরতে গেলেও আমার কোথাও যাওয়া হতো না। বলতে পারো আমিই যেতাম না। এখন রিয়াদের ভরসায় ওকে রেখে যাচ্ছি। আশাকরি ফিরে এসে আমি আমার সেই ছোট্ট দিয়াকে ফিরে পাবো। দিয়াকে এভাবে দেখতে ভিষণ কষ্ট হয় আমার।
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল হিয়া। তারপর বলল,
দিয়াকে অনেক বার নিয়ে বেরোতে চেয়েছি ও কখনো যেতে চাইনি। আর ইমরানের ঘটনার পর তো আমার থেকেও দূরে সরে গেল।
দিয়াকে এত ভালোবাসো যে ওর জন্যে নিজের চাওয়া পাওয়া কে এভাবে ইগনোর করেছো?
ঠিক ইগনোর করিনি আমার চাওয়া ছিল দিয়া একটু ভালো থাকুক। মামনির পর ওর দায়িত্ব তো আমার ওপরই ছিল। নিজের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতে তো আমি শিখিনি।
মামনি কেও মনে হচ্ছে খুব ভালোবাসতে। তাইনা?
এখনো ভালবাসি। জানো যখন হিমেল হলো পুরো বাড়ির এটেনশন গিয়ে পরলো ওর উপর। আমার তখন কত বয়স তিন বছর। মায়ের সমস্ত সময় হিমেলের জন্য। এটাই স্বাভাবিক ছিল। বাড়ির প্রথম ছেলে। তাছাড়া একজন মানুষের পক্ষে দুটো বাচ্চাকে সামলানোটা একটু টাফ ছিল। হিমেল যেহেতু ছেলে এবং ছোট তাই ওর দিকে বেশি যত্নশীল হওয়া টা স্বাভাবিক। মামনি তখন নতুন বিয়ে হয়ে এসেছে। সবাই যেখানে হিমেল কে নিয়ে ব‌্যস্ত সেখানে মামনি এসেই আমাকে খাওয়ানো গোসল করানো থেকে শুরু করে সবকিছুর দায়িত্ব নিয়ে নিলো। আমিও যখনই যা হতো সবার আগে মামনি কে বলতাম। আর দিয়া সেই মামনির অংশ। ওর জন্মের আগে থেকে ওর সাথে আমার সম্পর্ক। সে সময় মেজো বাবা কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতো। আমি মামনির সাথে সবসময় থাকতাম। মামনি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ” ভাই চাই না বোন।” আমি কি বলেছিলাম জানো? ” ভাইরা পঁচা আমার একটা পুতুলের মত বোন চাই। আমি ওকে নিয়ে খেলবো।” মামনি সেদিন খুব হেসেছিল। তারপর দিয়া যেদিন হলো, সবার আগে মামনি ওকে আমার কোলে দিয়ে বলেছিল, ” নে তোর পুতুল। আজ থেকে যত ইচ্ছা ওকে নিয়ে খেলিস।” দিয়া ওর ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে আমার হাত ধরে ছিল। সেটা আজ অবধি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অনুভূতি।
কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো ওর। অতীতের ভালো স্মৃতি গুলোও কিছু ঘটনার কারণে চোখে পানি নিয়ে আসে। ইস খারাপ স্মৃতি গুলো যদি একেবারেই মুছে ফেলা যেতো।

দিয়া একটা অদ্ভুত কাজ করছে। ফোনটা হাতে নিয়ে রিয়াদের কলের অপেক্ষা করছে। দুই একবার নিজে কল দিয়ে সাথে সাথে কেটে দিয়েছে ও। কিন্তু এমন করার পিছনে কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না ও। রিয়াদ ফোন করলে ওর খুশি লাগে। তখনই রিসিভ করতে মন চায় কিন্তু নিজেকে অনেক ভাবে নিয়ন্ত্রনে আনে দিয়া। মন বড় খারাপ জিনিস। মনের কথা শুনে সাময়িক খুশি পাওয়া যায় কিন্তু তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। কালকে হুট করে রিয়াদের ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ওকে উদ্দেশ্য করে গান গাওয়া। প্রকৃতির বুকে এক সুন্দর বিকাল উপহার দেওয়া। ওকে অনবরত সিগারেট সুন্দরী বলে ওর মাথা খারাপ করে দেওয়া। কেন করছে রিয়াদ এগুলো? ইমরানের সাথেও তো কত ঘুরেছে ও। সবগুলোই ওর জীবনে সুন্দর স্মৃতি। কিন্তু কালকের মতো এমন অনুভূতি তো কখনো হয়নি। ইমরান ও তো ওকে ভালোবেসে জান, পাখি, ময়না কত সম্বোধন করেছে। কিন্তু সিগারেট সুন্দরী শুনলে যে অনুভূতি হয় তা তো কখনো হয়নি। আজকাল ইমরানের থেকে রিয়াদের কথাই ভাবতে ভালো লাগে ওর। এসব কি ভাবছে দিয়া ইমরানের সাথে ঐ লোকের তুলনা কেন করছে? উনিই বা কেন করছেন এগুলো। ও দেখতে সুন্দর বলে। কিন্তু উপরের সৌন্দর্যই কি সব? ওর মনের মধ্যে যে কালো অন্ধকার রয়েছে সেটা বাইরে এলে তো ওর সমস্ত সৌন্দর্যকে ডুবিয়ে নিয়ে যাবে। কথা বলতে হবে লোকটার সাথে। সে কেন এরকম করছে জানতে হবে। আজ ফোন দিলে সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলবে ও। রিয়াদকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতেই হবে। এবার আর মনকে ওকে নিয়ন্ত্রণের কোনো সুযোগ ই দেবেনা দিয়া। এই এত এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে ওকে। সুখ ভালো থাকা এসব ওর ভাগ্যে নেই। বড়াপুকে দেওয়া ওয়াদা রাখতে ওর মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবে ও যে বড়াপুকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছে। ওয়াদা ভাঙলে যদি বড়াপুর কোনো ক্ষতি হয়। এসব পাপ পূণ্য কিছুতে কিছু যায় আসে না ওর। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে চিন্তায় ছেদ পড়ল ওর। রিয়াদের ফোন ভেবে দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নাম দেখে কিছুটা হতাশ হলো দিয়া। এতে ভিষণ অবাক হয়ে নিজেকে কড়া ভাষায় মনে মনে ধমক দিল ও। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হিয়া বলল,
এতক্ষণ লাগে তোর ফোন রিসিভ করতে?
সরি বড়াপু।
আচ্ছা শোন সামনের সোমবার আমি তোর দুলাভাইয়ের সাথে দেশের বাইরে যাচ্ছি।
ওহ। ভালো ঘুরে এসো। আমার জন্য তো কোনোদিন কোথাও যেতে পারিসনি কোনোদিন।
আমি ইচ্ছা করেই যাইনি।
হয়েছে বুঝেছি। আমাকে বলছিস কেন অনুমতি নিতে?
নিতে ও যদি চাই। দিবি না?
তোর লাইফের ওপর এখন আমার কোন কন্ট্রোল নেই রে বড়াপু।
একটা চড় খাবি। খুব বড় দের মতো কথা বলা শিখে গেছিস তাইনা?
বড় তো হয়েছি। ভুলে গেছিস বেবিটা বেঁচে থাকলে আজ আমাকে মা বলে ডাকতো।
এসব কথা ভুলে যা দিয়া।
চাইলেই কি সব ভোলা যায়। আমি তো চাই সবকিছু ভুলতে। পারিনা তো।
কথাটা বলেই চুপ করে গেল দিয়া। হুট করে হিয়াও কিছু বলতে পারলো না। এভাবেই কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো। এরপর টপিক চেঞ্জ করতে হিয়া বলল,
শোন আমি তো অনেক দিনের জন্য যাচ্ছি এর মাঝে কিছু প্রয়োজন হলে রিয়াদ কে ফোন দিস। রিয়াদ কে মনে আছে তোর? ঐ যে সেদিন পরিচয় করালাম আমার দেবর।
রিয়াদের কথা আসতেই এক সূক্ষ্ম অভিমানে ভরে উঠলো দিয়ার মন। গলায় কিছুটা বিরক্তি ফুটিয়ে ও হিয়া কে বলল,
আমার কিছু প্রয়োজন হলে ওনাকে কেন বলতে যাবো?
এমন একটা প্রশ্নেরই ভয় করেছিল হিয়া। তাই উত্তরে বলল,
আমি না থাকলে তুই তো বাড়িতেও যাবি না। আর বাড়ির কাউকে তুই সহ্যও করতে পারবি না। তাই আমিই রিয়াদ কে বলেছি তোর খেয়াল রাখতে। ও খুব ভালো ছেলে।
“ওহ এই কারণে জনাব এত সব করছিলেন।” মনে মনে ভাবলো দিয়া। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল,
আমার কারোর সাহায্য দরকার নেই। আমি একা থাকতে শিখে গেছি। তুই ওনাকে বলে দিস উনি যেনো আমার জন্য কিছু না করে।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো দিয়া। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে কাঁদতেই হবে। এমন তো কোনোদিন ওর কাঁদতে ইচ্ছা করেনি। হুট করে এত কান্না পাওয়ার কারণ কি?
চলবে…………

#আলো_আধাঁর

লিখা- জেসিয়া জান্নাত রিম

১৩.
আজকে পেশেন্টের চাপ বেশি থাকায় হসপিটাল থেকে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেল রিয়াদের। ডাক্তারির এই সেক্টরে কোন দিন কতজন রোগি হবে সেটা বলা মুশকিল। কোনোদিন এক দুজন তো কোনোদিন রোগি ঠেলেও ফেলা যায় না। অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের সাইকায়ট্রিস্ট দের নিয়ে সবসময় একটা ভুল ধারণা থাকে। তারা মনে করে সাইকায়ট্রিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার। কিন্তু সাইকায়ট্রিস্টরা যে মানসিক সমস্যা সলভ্ করার জন্য এটা মানুষ বুঝতে চায় না। তারা ভাবে কেউ ওদের কাছে এসেছে মানে তারা পাগল। অবশ্য সময়ের সাথে মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তন হচ্ছে। রিয়াদের এই পেশাটা ভালো লাগে। নানান মানুষের নানান সমস্যা। কত মানুষকে যে মৃত্যুর পথ থেকে স্বাভাবিক লাইফে ফিরিয়ে এনেছে ওরা। এখন দিয়াকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার পালা। যাতে ওর জীবনটাও সুন্দর হয়। তাইতো প্রফেশনালি ব্যাপারটা না নিয়ে পার্সোনালি দেখছে। এই প্রথম ব্রেইন গেম না খেলে ইমোশন ইউজ করছে। ওর প্রফেশনের কারণে ও জানে কোথায় কতটুকু ইমোশন ইউজ করতে হয়। এসব নানান জিনিস ভাবতে ভাবতে ও দিয়ার হোস্টেলের সামনে গাড়ি থামালো। আজ সারাদিনে দিয়াকে একটাবারও কল দেয়নি ও। কাজের চাপ তো ছিলই কিন্তু ইচ্ছা করেই কল দেয়নি। যদিও এটা করতে ওর ভিষন কষ্ট হয়েছে। কিন্তু এটাও একটা ট্রিক। এখন দিয়ার কারেন্ট সিচুয়েশন কি সেটাই দেখবে ও? যদি দিয়ার মধ্যে অভিমান দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে দিয়া ওর প্রতি কিছু ফিল করছে। এখন শুধু দিয়ার রিয়েকশন দেখার অপেক্ষা। ভেবেই ফোনটা হাতে নিল রিয়াদ। তারপর কল দিল দিয়ার নাম্বারে। রিয়াদের ধারণা ছিল দিয়া ফোনটা রিসিভ করবে না। কিন্তু একবার রিং হতেই কল রিসিভ করলো দিয়া। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
আপনি কোথায় আছেন দেখা করতে পারবেন?
হুম। নিচেই আছি তুমি এসো।
আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিল দিয়া। রিয়াদ অবাক হলো। এমন রিয়েকশন ও আশা করেনি। যাই হোক দিয়া নিজে থেকে ওর সাথে দেখা করতে চাইছে। এটা নিশ্চিত পজেটিভ দিক। দিয়ার অপেক্ষায় গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো ও। কিন্তু দিয়া এসে সোজা গাড়িতে উঠে ওকেও উঠতে বলল। রিয়াদ গাড়িতে উঠে বলল,
কোথায় যাবে বলো?
কোথাও না এখানেই বসবো। কিছু কথা আছে আপনার সাথে।
হ্যা বলো। আমি শুনছি।
দেখুন বড়াপু আমাকে নিয়ে শুধু শুধু টেনশন করে। সেখান থেকে আপনাকে বলে ফেলেছে আমার খেয়াল রাখতে। আপনার আমার জন্য কিছু করতে হবে না। আমি নিজে বড়াপুর সাথে এব্যাপারে কথা বলবো। বড়াপু কিছুই মনে করবে না।
দিয়ার কথায় উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো রিয়াদ। রিয়াদ কে এভাবে হাসতে দেখে ভ্রূ কুঁচকে দিয়া বলল,
হাসছেন কেন আপনি? আমি কি হাসির কথা বলেছি?
কোনো মতে হাঁসি থামিয়ে রিয়াদ বললো,
তোমার মনে হয় ভাবির কথায় আমি তোমার সাথে এভাবে বিহেভ করি?
নয়তো কি?
স্টুপিড মেয়ে, তোমার মাথায় আসলেই সমস্যা আছে। ভাবির কথায় আমি এখানে আসবো কেন?
ভদ্রতার খাতিরে।
আচ্ছা ধরে নিলাম ভদ্রতার খাতিরে। তাহলে আমি এক দুই দিন আসবো, তোমাকে একবার ফোন দিবো, জাস্ট ফরমালি খোঁজ খবর নিবো। কিন্তু আমি কি তা করেছি?
মানে?
মানেহ। আমার চোখের দিকে তাকাও দিয়া, বুঝতে পারবে।
বলেই দিয়ার মুখ নিজের দিকে ফেরালো রিয়াদ। দিয়ার ফর্সা নাক লাল হয়ে আছে, চোখমুখ ফুলে আছে। এতক্ষণ কেঁদেছে ও। কার জন্য? রিয়াদের জন্যই কি? মনে মনে একটু খুশি হলো রিয়াদ। তারপর দুহাতের আজলে মুখটা তুলে ধরে সোজা ওর চোখে চোখ রাখলো রিয়াদ। এবং বলল,
কি দেখতে পাচ্ছ দিয়া?
হুট করে কিছুই বলতে পারলো না দিয়া। কি বলবে কিছুই তো দেখছে না ও। শুধু সুন্দর দুটো চোখ ওর সামনে। যেই চোখে মায়া ভরা। গভীর মায়া। মে মায়ায় ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে ও।

রিয়াদ এখনো ফেরেনি?
খাবার টেবিলে বসে সবার উদ্দেশ্যে বললেন আজিজ সাহেব। কাজের চাপে সারাদিনের খাবারটা পরিবারের সাথে না খেতে পারলেও রাতের খাবার উনি সবাইকে সাথে নিয়ে খান। কিন্তু কাজের কারণে প্রায়ই রিয়াদ দেরি করে ফেরে বিধায় সেদিন গুলো রিয়াদ কে ছাড়াই সবার খেতে হয়। এ কারণে রিয়াদের কাজটা বিশেষ পছন্দ না ওনার। উনি চেয়েছিলেন বড় ছেলের মত ছোটটিও পড়ালেখা শেষ করে তার বিজনেসের দেখা শোনা করবেন। কিন্তু ছোট ছেলেটা বরাবরই জেদি ঠিক তার মতো। বড়টার মতো বাধ্য না। তাই ছোট ছেলের জেদের কাছে হেরে তাকে তার মন মতো পেশায় যেতে দিয়েছেন তিনি। ভেবেছেন যতদিন ইচ্ছা করুক শখ মিটে গেলে বিজনেসে বসিয়ে দেবেন। তবে কাজের ক্ষেত্রে যতই ছাড় দিক বিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছাতেই দেবেন। যেমনটা দিয়েছেন বড়দুটি সন্তান কে। কারো ক্ষেত্রেই ভুল হয়নি তার। জামাই মাশাআল্লাহ সোনার টুকরা। আর নতুন বৌমাকেও বেশ ভেবে চিন্তে বেছে এনেছেন। বড় ছেলের মুখ দেখেই তিনি বলে দিতে পারেন ছেলে সুখি। রিয়াদের জন্য ও মেয়ে তার দেখাই আছে। তার বন্ধুর মেয়ে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। পরিক্ষা হলেই রিয়াদের বউ করে নিয়ে আসবেন এটাই তার পরিকল্পনা। বন্ধুর সাথে এব্যাপারে কথা হয়ে গেছে তার। কিন্তু পরিবারের কাউকে এ বিষয়ে বলা হয়নি। ভেবেছিলেন আজ খাবার টেবিলে বলবেন। কিন্তু রিয়াদের উপস্থিতিতে তিনি কথাটা বলতে চান। তাই রিয়াদ কে না দেখে উপরের প্রশ্নটি করলেন তিনি। উত্তরে ইমি বলল,
ভাইয়াকে ফোন দিয়েছিলাম। আজকে নাকি পেশেন্টের খুব চাপ। তার উপর ফাহিম ভাই ফিরেছে হসপিটাল থেকে সোজা ওখানেই যাবে। আজ আর ফিরবে না।
উত্তরে সন্তুষ্ট না হলেও বিশেষ কিছু বললেন না তিনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
তোমার বোনের ব্যাপারে রিয়াদ কে বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে না আমার। কাজের চাপে ওর সাথে আলাদা করে যে একটু কথা বলবো সেটাও হয়ে উঠেছে না।
সমস্যা নেই বাবা। রিয়াদ পুরো বিষয়টা জানে।
কে বললো ওকে তুমি?
না আসলে সেদিন আমাদের বাড়িতে দিয়া একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই বাবাই ওকে সব বলতে বললো।
ভালোই করেছো। তা তোমাদের যাবার প্রস্তুতি কেমন?
ভালো বাবা।
বাড়িতে বলেছো?
হুম মায়ের সাথে কথা হয়েছে।
ভালো। রাজিব সোমবার তোমাদের ফ্লাইট কয়টায়?
রাত দশটায়।
রাতের ফ্লাইট ই ভালো। সকাল সকাল পৌঁছুতে পারবে।
তোমাদের ছাড়তে যাবে কে?
রিয়াদ যাবে বলেছে।
ও বাড়ি থেকে কেউ আসবেনা?
বাবারা আসতে চেয়েছিল। আমিই মানা করেছি। বলেছি যাওয়ার আগে ওবাড়ি হয়েই যাবো। এয়ারপোর্টে যেতেই তো হিয়াদের বাড়ি।
সেটাই ভালো।
কথা বেশিদূর এগোলেন না আজিজ সাহেব। এখন তিনি ছোট ছেলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছেন। তার জেদি ছেলের অন্য কোথাও কোনো পছন্দ না থাকলেও এই মেয়েকে বিয়ে করতে যে রাজি হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তবুও এ বিষয়ে কোনো জেদকে তিনি প্রশ্রয় দেবেন না তিনি। তার বন্ধুর মেয়ের সাথেই বিয়ে হবে রিয়াদের। এট এনি কসট্। আফটার অল তার কথার ও যথেষ্ট মূল্য আছে। আর সন্তানের প্রতি এটুকু জোর খাটানোর অধিকার ও।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here