আয়ান ভাইয়া আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ভাবতেই খুব লজ্জা লাগছে এই অবস্থায় ভাইয়ার সামনে পরতে হবে। গায়ে হলুদের সাজেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরি। গালে হাতে এখনো হলুদ লেগে আছে। আয়ান ভাইয়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে আসার কথা ছিল অনেক আগেই কিন্তু ভাইয়া আসতে পারে নি কোনো এক কাজে আটকে যাওয়ার ফলে। তাই এখন যাচ্ছিল আমাদের বাড়িতে। আয়ান ভাইয়ার ডাকে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে হাজার প্রশ্ন যা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। ভাইয়া বলে উঠলো
—কোথায় যাচ্ছিস এত রাতে আর এই অবস্থায়
আমি কি বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবুও কিছু তো বলতেই হবে।
—ভাইয়া আসলে আমার এক ফ্রেন্ড এসেছে। অনেক দেরি হয়ে যাওয়াতে আমি একটু এগিয়ে নিয়ে আসছি।
—তুই বাড়ির ভেতর যা আমি নিয়ে আসছি।
—না ভাইয়া আমিই যাচ্ছি তুমি বরং ভেতরে যাও রিয়ান ভাইয়া সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছে।
—আচ্ছা ঠিক আছে তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় বাইরে প্রচুর ঠান্ডা পরছে কিন্তু।
—আচ্ছা।
আয়ান ভাইয়া আমাকে সেখানে রেখেই বাড়ির ভেতর চলে গেলো। আমি প্রাণ-পণে ছুটতে থাকি। এত রাতে কোনো গাড়ি তো দূরের কথা একটা রিকশাও পাওয়া যাবে না। হাতে থাকা ফোনটা দিয়ে বারবার একটা নাম্বারে কল দিচ্ছি কিন্তু বারবার নট রিচেবল আসছে। কিছুটা দূরে যেতেই একটা রিকশা পেয়ে যাই। আর এক মূহুর্ত দেরি না করেই রিকশাতে উঠে যাই আর রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে যেতে লাগলাম।
________
আয়ান বাড়িতে ঢুকতেই রিয়ান খুব রাগ দেখায়। আজ তার একমাত্র বোনের গায়ে হলুদ ছিল আর তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুই ছিল না। তাই রিয়ান আয়ানকে দেখা সত্ত্বেও না দেখার ভান ধরে নিজের কাজ করছিল। আয়ান নিজেই রিয়ানের কাছে গিয়ে বলে
— সত্যি অনেক কাজ ছিল না হলে তোর বোনের গায়ে হলুদে আমি না এসে থাকি বল
—হয়েছে বুঝেছি আর বলতে হবে না।
—দেখিস কাল সকাল থেকে আমি বাড়ি থেকে নড়বই না।
—আচ্ছা, এখন কিছু খেয়ে নে। কিছুই তো খাওয়া হয়নি বোধহয়
—হ্যা প্রচন্ড খিদে পেয়েছে
—শিলা আয়ানের জন্য খাবার টেবিলে খাবার দে
শিলা টেবিলে খাবার বেরে দিল আর বলল
—আয়ান ভাইয়ার সাথে তুমিও খেয়ে নাও, আমি দুইজনের খাবার দিয়েছি
—আমার খিদে নেই। আয়ান তুই শুরু কর
—একি তুই এখনো না খেয়ে আছিস আয় আমার সাথে খেয়ে নিবি।
তারপর দুই বন্ধু একসাথে খেয়ে নেয়। আর শিলাও খুব খুশি হয়ে যায় রিয়ান খেয়ে নেওয়াতে। সে তো ভেবেছিল বোনের দুঃখে আজ না খেয়েই থাকত। খাবার শেষ করে তারা বসার ঘরে বসে কথা বলছিল তখন আয়ান বলল,
—কিরে রিয়ান সে এখনো এলো না কেন? অনেক্ক্ষণ তো হল গেছে ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসতে এতক্ষণ লাগে নাকি?
— তুই কার কথা বলছিস
—কেন কথা, আমি যখন আসছিলাম কথার সাথে আমার বাইরে দেখা হয় কোথায় যায় জিজ্ঞেস করলে বলল তার কোন ফ্রেন্ড দেরি করে আসছে তাই একটু এগিয়ে যাচ্ছে তাকে আনার জন্য।
—কথার সব ফ্রেন্ডরাই গায়ে হলুদে উপস্থিত ছিল।
—তাহলে কথা আমাকে মিথ্যা বলল কেন
— কথা কিছু ভুল না করে ফেলে। আমাদের এখনি বের হতে হবে না হলে খুব দেরি হয়ে যাবে।
_________
রিকশা এসে থামে রেল স্টেশনের সামনে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে রেল স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকে কথা কাঙ্খিত ব্যক্তিটির জন্য। সে আসলেই ট্রেনে উঠে অনেক দূরে চলে যাবে। বারবার কল করেই যাচ্ছে কথা কিন্তু বারবার নট রিচেবেল বলছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পরতে থাকে। তার চোখের পানিতে মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা নামটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে। তবুও সে অনবরত কল করেই যাচ্ছে।
—সবকিছু তো ঠিক ছিল, তুমিই বলেছিলে আমি আর তুমি অনেক দূরে চলে যাব। তাহলে আজ কেন তুমি আমার সাথে নেই। তাহলে কি তোমার বলা সব কথা মিথ্যে ছিল! কিন্তু আমি যে বড্ড ভালোবাসি তোমাকে এখন কি করব বল, বাড়িতে ফিরে যাব নাকি আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব? আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি তুমি তো বলছিলে আমি যখনি ডাকব তুমি আসবে।
_________
অপরদিকে আয়ান আর কথার ভাই রিয়ান কথাকে সব জায়গায় খোঁজ করছে। রাতের ভেতর কথাকে খুঁজে বের করতে হবে কারণ ভোর হয়ে গেলেই মানুষ জানাজানি হবে তাদের পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে। কিন্তু কোথাও তারা কথাকে খুঁজে পায় না।
—রিয়ান শোন আমরা এখানে না খুঁজে রেল স্টেশন খুজলে কেমন হয়
—ওইখানে কথা যাবে কেন
—আমার মনে হয় কি কথা কাউকে পছন্দ করে না হলে এভাবে যাওয়ার কোনো কারণ তো দেখছি না
—তুই যা বলছিস তা যে আমি ভাবি নি তেমনটা না। আমারও এটাই মনে হয় কথা কাউকে পছন্দ করে। কিন্তু আমাদের কখনো বলেনি এই কথা
—আর তোদের পরিবার টাও এমন কেন? একটা ১৪ বছরের বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।
—আমাদের বাড়ির কোনো মেয়ে আজ অবদি ১৭ বছরের উপরে যায় নি তার আগেই বিয়ে দেওয়া হইছে। এটা আমাদের দাদার আমল থেকে হয়ে আসছে।
—বুঝলাম কিন্তু এভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি এটাতে একমত না। আজ যদি এটা না হত কথা এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কিছুসময় ভাবত কিন্তু এখন তার এসব ভাবার বয়স হয়নি তাই এমন একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।
— হুম তুই ঠিক বলছিস। কথা কে খুঁজে পাই তাহলে ওর ইচ্ছা না থাকলে এই বিয়েই হবে না।
—আচ্ছা এখন তাড়াতাড়ি চল কথা কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বের করা দরকার।
_________
প্রায় তিন ঘন্টার উপরে স্টেশনে বসে অপেক্ষা করছে কথা। এর মধ্যে ৪টা ট্রেন স্টেশন ত্যাগ করেছে। এখনো কাঙ্খিত মানুষটার আসার নাম নেই। চোখের পানিও পরা বন্ধ হয়ে গেছে। কথার এখন কি করা উচিত সে বুঝতেই পারছে না বাড়িতে ফিরে যাবে সে তারপর সবাইকে বলে দিবে সবকিছু। বাড়ির সবাই তাকে ভালোবাসে খুব তাই কথা সিদ্ধান্ত নিল বাড়িতে গিয়ে বলে দিবে। তারপর বাড়ির লোকেরাই তার পছন্দের মানুষের সাথে তার বিয়ে দিবে। কথা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় বাড়ির উদ্দেশ্যে কিন্তু আবার থেমে যায়।
—আরেকবার কল দিয়ে দেখি যদি এবার কল যায়। একবার কথা বললেই শান্তি লাগত।
কথা আরেকবার স্ক্রিনে থাকা প্রথম নাম্বারটিতে কল দেয় আর এবার সত্যি রিং পরতে থাকে। কথার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। কয়েকটা রিং পরার পর অপর পাশ থেকে কল রিসিভ হয়।
—হ্যালো
—বিহান, আমি কথা বলছি।
—তুমি এতরাতে কল করেছ কেন আর এটাই বা কার নাম্বার? তোমাকে তো মোবাইল দেয়নি বাড়ি থেকে
—এটা ছোট চাচির মোবাইল। ওই শিলা আপুর আম্মুর আমি বাড়ি থেকে আসার সময় নিয়ে চলে এসেছি তোমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য।
—বাড়ি থেকে আসার সময় মানে! আর আজ তোমার গায়ে হলুদ ছিল আর কাল তোমার বিয়ে তাই না।
—আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমি আমাকে তাহলে আমি অন্য কাউকে কি করে বিয়ে করতে পারি? আর তুমিই বলছিলে যে এমন কিছু হলে আমাকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে নিবে
—আমি কি কাল বা আজ তোমাকে একবারের জন্যও বলছি যে বাড়ি ছেড়ে চলে আস আমার কাছে
—না
—তাহলে, কেন এলে বাড়ি ছেড়ে? এখন বাড়ি ফিরে যাও কাল তোমার বিয়ে কেউ জানলে খারাপ ভাববে তোমাকে।
—কাল আমার বিয়ে মানে তুমি আসবে না আমাকে নিতে
—মাথা খারাপ আমার যে তোমাকে নিতে আসব। আর আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব না। রাখছি।
কথা কে কিছু বলতে না দিয়েই বিহান কল কেটে দিল। কথা আবার কল করলে মোবাইল সুইসড অফ বলে কেটে যাচ্ছে। কথা সেখানেই নিচে বসে পরে। সে এখন করবে কি? এতবড় একটা ভুল কি করে করতে পারল সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঠিক সেই সময় রাত ৪টার সময় যেই ট্রেন আসার কথা সেটা এসে স্টেশনে থামে। কিছু যাত্রী নেমে যায় আর কয়েকজন যাত্রী ট্রেনে উঠে পরে। আজ রাতের জন্য এটাই শেষ ট্রেন তাই স্টেশন মাস্টার এসে কথাকে বলল
—কি হল মেয়ে তুমি কি যাবে না সেই কখন এসে বসে আছ কত ট্রেন গেল একটাতেও তো গেলে না। এটাই কিন্তু আজ রাতের জন্য শেষ ট্রেন আজ আর আসবে না। আবার কাল সকাল ৮টায়।
কথা কিছু না বলে চুপ করে স্টেশন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখনই কথা দেখতে পায় রিয়ান আরও কয়েকজন এদিকেই আসছে। সাথে আয়ানও আছে। তবে কথাকে এখনো কেউ খেয়াল করেনি। কথা তাদের দেখে কোনো কিছু না ভেবেই মাথায় কাপড় টেনে মোবাইলটা হাতে নিয়ে ট্রেনে উঠে যায়। খালি একটা কামরার ভেতর ঢুকে যায় কথা। আর এদিকে রিয়ান কথাকে স্টেশনের চারপাশে খুজতে থাকে আর বাকিরা ট্রেনের ভেতর। সেই সময় ট্রেন ছেড়ে দেয় তাই সবাই ট্রেন থেকে নেমে যায়। ট্রেন ছাড়ার পর কথা আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। একোন অজানা গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল কথা। সামনে আরও কত বিপদ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটা ভেবেও খুব চিন্তিত হচ্ছিল কথা। না জানি এই অজানা গন্তব্য তাকে সুখের মুখ দেখা পায় নাকি দুঃখের দেখা পায়। ট্রেন ছুটে চলছে আর কথা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কান্না করছিল। একসময় কথা জানালার কাছেই ঘুমিয়ে পরে।
________
রিয়ান একটা টেবিলে বসে বলছে
—কথাকে তো খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। এখন বাড়ি গিয়ে কি বলব আয়ান
—চিন্তা করিস না সব ঠিক হবে
—আর কি করে ঠিক হবে, আমার বোনটা সবার চাপে বিয়েতে রাজি হল। আর এখন বিয়ের আগের রাতেই পালিয়ে গেলো।
—কিছুই হবে না আমরা খুঁজে বের করব কথাকে। এখন বাড়িতে ফিরা দরকার
— হুম চল যাওয়া যাক।
_________
পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে কথা যে কামরায় ছিল সেখানে আরও লোকজন আসে। তাদের মধ্যে দুইজন মহিলা আর চারজন ছেলে আসে। একজন মহিলা কথাকে ডেকে তুলে। হঠাৎ ডেকে উঠায় কথা ঘাবড়ে যায় আর পরক্ষণেই মনে পরে সে ট্রেনে বসে আছে। তারপর কথা সরে যায় আর সবাই যে যার সিটে বসে পরে। কথাও ওই মহিলাদের সাথে বসে পরে। ট্রেন চলছে আপন গতিতে। সাথে ছুটে চলছে কথার জীবনও।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,
#উদ্দেশ্যহীন_কথা
Part_01
#Writer_Fatema_Khan