একটি নির্জন প্রহর চাই পর্ব -০৬

#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৬.
#writer_Mousumi_Akter

মনের মাঝে একটা সুপ্ত প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছে সেটা হলো রোশান স্যার থাকতেও এ বাড়িতে তরী এতটা অত্যাচারিত কেনো?উনি তো তরীকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট করেন কাল রাতেই দেখলাম।তাহলে কাহিনী টা কি?কোনো তো ব্যাপার আছেই এ বাড়িতে।কিছু একটা যেটা আমি বুঝতে পারছিনা হঠাত করে।শ্বাশুড়ি তরীর কাছ থেকে আসার পর পর ই আমি রান্নাঘর থেকে আরেকটা বটি নিয়ে তরীর সাথে বসে পড়লাম।তরী আমাকে দেখেই ভীষণ অবাক হলো।সাথে সাথে বলল,

‘আরে ভাবি এ আপনি কি করছেন।উঠুন উঠুন আপনাকে মাছে হাত দিতে হবেনা।’

আমি তরির দিকে তাকালাম দেখলাম মেয়েটার মুখের অদল ভর্তি যন্ত্রণা।তরীর নিষেধ ভঙ্গ করে ছাইয়ের গাদায় হাত ঢুকিয়ে দিলাম।মাছ কুটতে কুটতে বললাম,
‘আচ্ছা তরী তুমি ঘুম থেকে কখন উঠেছো?’
‘আপনি আগে মাছ রেখে উঠুন,আপনার হাতে গন্ধ হবে।’
‘আর তোমার হবেনা?’
‘আমি আর আপনি কি এক।আপনি হলেন শিক্ষিত মেয়ে।’
‘তা তোমাকে শিক্ষিত হতে কে আটকেছিলো।’
‘সব ই কপাল ভাবি।’
‘স্টুডেন্ট কি খারাপ ছিলে?মানে আমার থেকেও খারাপ ছিলে।’
‘না সেসব কিছু নয়।’
খেয়াল করলাম তরীর হাতে গলায় পুরণো কিছু দাগ।দাগ গুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এসব দাগ কিসের?’
‘না কিছুনা ভাবি।’
‘তরী আমার কাছ থেকে তুমি কিছুই লুকোতে পারবেনা।এ বাড়িতে তোমার সাথে কিছুই স্বাভাবিক হচ্ছেনা।আমাকে তোমার বোন ভাবো তরী। আমি অন্য জা দের মতো তোমার সাথে কম্পিটিশন করব না কিছু নিয়ে।অন্য ফ্যামিলিতে যেমন হয় এ ফ্যামিলিতে তেমন হবেনা।আমি তোমার জা নই তোমার বোন হতে চাই।তোমার কষ্ট গুলো নিজের করে নিতে চাই।আমি এক মেয়ে তরী শ্বাশুড়ি তোমাকে ছোট করে যে আমাকে প্রশংসা করলো কি ভেবেছো আমি খুশি হয়েছি।না আমি খুশি না তাতে।’

তরী মাছ কোটা রেখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।ওর চোখ ভর্তি পানি।মেয়েটা বোধহয় এক্ষণি খুব জোরে কেঁদে দিবে।ওর প্রবল কাঁন্না পাচ্ছে।এই কাঁন্না খুব কাছের কারো কাছেই করা যায়।তরীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘কি হলো তরী কিছু বলো।’
‘যার স্বামি ঠিক তার দুনিয়া ঠিক ভাবি।এক চাঁদ সুখ দিলে হাজার তারা কিছু করতে পারেনা।যার জন্য এ বাড়িতে আছি সেই যদি দেখতে না পারে বাকিরা আর কি করবে?’
‘ওশানের সাথে কি নিয়ে ঝামেলা তোমার?’
‘ছোঁয়া।’
‘ছোঁয়া? ‘
‘হ্যাঁ! আমার জীবনের সব হাসি-আনন্দ কেড়ে নেওয়ার পেছনে একমাত্র ছোঁয়ার হাত রয়েছে।ওই একটা মেয়ে জীবন টা তছনছ করে দিয়েছে আমার।’
‘কি করেছে ছোঁয়া।’
‘ওশান ছোঁয়ার সাথে রিলেশন করে।ছোঁয়া নাকি সব জেনে শুনেই ওশান কে ভালবাসে।একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে অন্য মেয়ের সংসার ভাঙতে পারে।আমি জীবনে একবার হলেও ছোঁয়ার সাথে দেখা করব।জিজ্ঞেস করব অন্যর স্বামি কেড়ে নিয়ে কেমন লাগছে। দুনিয়াতে কি আর ছেলে পায় নি সে।সে তো ভীষণ সুন্দরী দেখতে।তাহলেও কেনো আমার সংসার টা এভাবে ভাঙছে।’
‘তোমার বাড়িতে জানাওনি। ‘
‘কাকে জানাবো।বাবা-মা দুজন ই মারা গিয়েছে।নিজের একটা ভাই ও নেই।আরো তিনটা বোন আছে।তাদের ও পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়।চাচারা যেমন তেমন পেয়ে বিয়ে দিয়েছে।আমি একটু দেখতে শুনতে ভালো।তাই ওশান আমাকে দেখে পা’গ-ল হয়ে যায়।ওর মা-বাবা কেউ রাজি ছিলো না।একাই বিয়ে করে এনেছিলো।’
‘তুমি সিওর ছোঁয়া সব জানে?’
‘জানে?’
‘তুমি কিভাবে জানলে ছোঁয়ার ব্যাপারে।’
‘ওর ফোনের ওয়াল পেপারে ছবি আছে।তাছাড়া আমার পাশে সুয়ে অব্ধি কথা বলে।’
‘আর শ্বাশুড়ি।’
‘শ্বাশুড়ির ইচ্ছা ছোঁয়ার সাথে ওশানের বিয়ে দেওয়ার।তাহলে অনেক কিছু পাবে।বড়লোকের মেয়ে।’
‘অনেক কিছু পাওয়ার লোভে ওশানের আবার বিয়ে দিবে।এত লোভী উনি।’
‘ হ্যাঁ,আমার তো পরিবার বলে কিচ্ছুই নেই।তারা কিছু দিতে পারলে হয়ত উনি কদর করত।’
‘এই দাগ গুলো কিসের বললে না।’
‘এমন অসংখ্য দাগ আছে শরীরে ভাবি।’
‘ওশান এত অত্যাচার করে।’
‘শুধু ওশান নয়।ওর মা ও।ওর মা আমাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না।আমাকে বিয়ে করে ওষান কোনো সম্পত্তি পায়নি এইজন্য।’
‘কি কি করেন উনি তোমার সাথে।’
‘আমাকে অত্যাচার করে তাড়াতে জিওল মাছের কাটা পর্যন্ত শরীরে ফুটিয়েছে।আমার শ্বাশুড়ি আমার গায়ে যতবার হাত তুলেছে ওশান ও অতবার হাত তোলেনি।উনি চাই আমি যে কোনো ভাবে যেনো এ বাড়ি থেকে চলে যায়।কাজ করি তাতে কষ্ট নেই কিন্তু অত্যাচার গুলো মেনে নিতে কষ্ট হয় খুব।কত না খেয়ে থেকেছি।একবার গরম তেল ও আমার পায়ের উপর ফেলেছেন।ওনার ইচ্ছা ওশান কে যৌতুক দিয়ে আবার বিয়ে করাবেন।শুনেছি তোমাদের দু’বোনের নামে শহরে বাড়ি আছে।তাছাড়া অনেক ফার্নিচার ও পাঠাবে,টিভি,ফ্রিজ সহ।তোমাকে যে গহনা দিয়েছে দেখবে চেয়ে নিয়ে যাবে।’
‘রোশান স্যার এসব জানেন?’
‘কিছুই জানেন না।কিভাবে জানবেন। বাড়ির বাইরে থেকে লেখাপড়া শেষ করেছেন।জব হয়েছে কলেজের ওখানে থাকেন।রোশান ভাইয়ার কাছে তার মা ফেরেশতা।শুধু জানেন ওশান আর আমার ঝামেলা।আমার লেখাপড়া অফ করে দিয়ে বলেছে আমি নাকি লেখাপড়া করতে চাইনি।এসব ব্যাপারে রোশান ভাইয়া বা বাইরে কাউকে কিছু বললে আমাকে ছেলে সহ বাড়ি থেকে বের করে দিবে।অপেক্ষায় আছি ছেলে বড় হলে যদি মায়ের কষ্ট বোঝে।’

তরীর কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো আমার।এক অজানা ব্যাথায় বুক চিন চিন করে জ্বলছে আমার।ছোঁয়ার কি হবে তাহলে।ছোঁয়ার জীবন টা ওশান এভাবে শেষ করে দিলো।ছোঁয়া এসব জানতে পারে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা।সে ওশান কে নিজের থেকেও বেশী ভালবাসে।

ছোঁয়া আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।আমি ছোঁয়া,তন্ময়,মৃন্ময় সেই ছোট বেলা থেকে এক সাথে বড় হয়েছি।ছোয়াকে মিথ্যা বলে ওশান এভাবে ঠকালো।আর তরী মেয়েটার জীবনে এত কষ্ট।ওশান এক সাথে দুটো মেয়েকে ঠকাচ্ছে।ওশান কে আমি উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।

তরী মাছ কেটেই যাচ্ছে।এত গুড়ো মাছ একা একা কিভাবে কুটবে।এভাবেই তরীকে নির্যাতন করে এরা।
তরীকে বললাম,

‘তরী এই বাইন মাছের কাটা কেটোনা,জিওল মাছের মাথা কেটে মাছের মাঝে মিশিয়ে দাও।সো কলড শ্বাশুড়ি মাকে দেখোনা কি করি।’
‘কি করবেন ভাবি।’
‘আজ থেকে আমি যা করব, তুমি চুপচাপ দেখে যাও।’
আগের কোটা মাছের মধ্য কতগুলো জিওলের কাটা সহ মাথা কেটে রেখে দিলাম।আর বাকি মাছ গুলো গুছিয়ে বাড়ির পেছনের গর্তে ফেলে দিলাম।তরী মাছ ফেলে দিতে দেখে বলল,
‘আল্লাহ ভাবি আপনি এটা কি করলেন।’
‘তরী চুপচাপ জিওল মাছ গুলো কাটো।’

সমস্ত গুড়ো মাছ গুলো ফেলে দিয়ে বাকি জিওল মাছে হাত দিলাম।এর ই মাঝে আমার হাত কেটে গেলো।তরী তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ভাবি আম্মা আমাকে আস্ত রাখবেনা।এইজন্য আপনাকে নিষেধ করেছিলাম।’
‘চুপ করো তরী।এ মারাত্মক কিছুই না।রান্নাঘরের কোনা থেকে পুরণো কাপড় একটু ছিড়ে আনোতো।’
তরী দ্রুত গিয়ে পুরণো কাপড় ছিড়ে নিয়ে এলো।আমার হাত বেঁধে দিতে দিতে বলল,
‘আর মাছের কাছে আসতে হবেনা ভাবি।’
আমি অবশিষ্ট কাপড় নিয়ে তরীর একটা আঙুল বাঁধতে লাগলাম।
তরী বলল,
‘ভাবি আমার হাত তো কাটেনি।’
‘চুপ করো এই মুহুর্তে কেটেছে।
উনার আদুরে ছেলের সামনে বলব আমাদের হাত কেটে গিয়েছে মাছ গুলো ধুয়ে দিন তো আম্মা।দেখব কিভাবে না ধুয়ে পারে।তোমাকে জিওলের কাটা ফুটানো।শোনো তরী আমি অত ভালো মেয়ে না বুঝলে।”
‘এসব করতে গিয়ে ঝামেলা হবে ভাবি।’
‘আমি নিজেই তো ঝামেলা।চলো শ্বাশুমার কাছে যায়।’
বাড়ির বাইরে এক্সট্রা গোসলখানা সহ ওয়াশরুম আছে।আমার ও একটু ওয়াশ রুম যাওয়ার দরকার।তরীকে বললাম ভেতরে কে আছে তরী।
ভাবি এইটায় দাদা ছাড়া আর কেউ যায়না।
ওয়েট দাদার সাথে একটু মজা করি দাঁড়াও।

ওয়াশ রুমের দরজায় টোকা মেরে বললাম,

‘ আচ্ছা ওয়াশরুমে কে?আমি সেই এক ঘন্টা ধরে ওয়েট করছি।ভেতরে কি ঘুমিয়ে পড়া হয়েছে।বালিশ -কাথা এগিয়ে দিবো।বছরের তা কি একবারে করছেন বুইড়া।বছরে কি একদিন বাথরুমে যাওয়া হয় না।এত বিশ্রি গন্ধ কেনো?আমি কিন্তু খুঁতখুতে স্বভাবের মেয়ে।ভাল করে যেনো পানি ঢালা হয়।বাইরে থেকে তাই আমি দূর্গন্ধে টিকতে পারছি না।না জানি ভেতরে কি অবস্থা। মানুষ টয়লেটে গেলে এত বিশ্রি দূর্গন্ধ কিভাবে ছড়াতে পারে।এই এলাকা আজ বায়ুদূষণে পরিণত হবে।’

তরী আর আমি দুজনেই মুখ চেপে হাসছি।এরই দরজা খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো।আর ভেতর থেকে যে বেরিয়ে এলো তা দেখে আরেকবার ভড়কে গেলাম।রোশান স্যার যে কি যা তা ভাবে তাকাতে তাকাতে বেরোলেন আমার দিকে তাকিয়ে।অদ্ভুত সে চাহনি।

চলবে?..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here