এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব -৪১+৪২

#এক_মুঠো_কাঁচের_চুরি
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রথমে’ই আমি তোমার থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।যাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসা যায়।তার শরীরে নিজ হাতে আঘাত করা,কতটা যন্ত্রনাদায়ক তা’ যদি তোমাকে এক বিন্দু দেখাতে পারতাম।তোমার হয়তো শরীরে আঘাত লেগেছে।কিন্তু আমি আমার কলিজা’তে আঘাত করেছি।তুমি আমার ক্ষতটা অনুভব করতে পারছো ইয়াদ।আমি জানি তুমি আমার ওপরে রাগ করে আছো।তাই খুব গোপনে ফাইয়াজের মাধ্যমে,
ইফাদ’কে দিয়ে চুড়ির ডালাটা তোমার হাতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।আমি জানি আমার চিঠিটা পড়ে,তোমার মুখ হাসি ফুটে উঠেছে।আমি আবারো তোমার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।আমি বাবার সামনে তোমাকে মারতে বাধ্য হয়েছি।তুমি তো’ জানোই আমি বাবা’কে কতটা ভয় পাই।বাবা আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিবে না।তিনি এক কথার মানুষ।আমাকে বলেছে।আমি যদি তার কথা মতো বিয়ে না করি।তাহলে উনি তোমার ক্ষতি করে দিবে।ভয়ে রাজি হয়ে যাই।কিন্তু সারারাত নিজের সাথে যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলাম।আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে-ও আমার কষ্ট হয়।আমি আর পারছি না ইয়াদ।তোমাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমাকে নিয়ে পালিয়ে চলো প্লিজ।আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।বাবা এমনিতে-ই আমাদের ভালো থাকতে দিবে না।আমরা কেউ সারাজীবন থাকতে আসি নাই।যতগুলো দিন বেঁচে আছি।আমি তোমার সাথে বাঁচতে চাই।তোমার বউ হতে চাই।তোমার বাচ্চার মা হতে চাই।তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন জানো,নিজের জন্য আজ স্বার্থপর হয়ে গিয়েছি।পরিবারের কথা ভাবছি না।তুমি যদি খারাপ হতে,বাবা যদি তোমার একটা খারাপ দিক দেখাতে পারতো।তাহলে মনকে বুঝ দিতে পারতাম।তুমি পুরোটাই ভালোবাসার মানুষ।তোমাকে শুধু ভালোবাসা যায়।আমি বড্ড লোভী জানো।এত ভালোবাসা রেখে অন্যের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না।আমাদের ছোট একটা সংসার হবে।যেখানে হাসি খুশি দিয়ে ভরা থাকবে।আজ রাত বারোটায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।জামাকাপড় সব গুছিয়ে নিয়েছি।তুমি আসলেই চলে যাব।তোমার অপেক্ষা থাকলাম(পুতুল)

তানহা চিঠি’টা পড়ে নিজের অজান্তে-ই দু’ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল।ইফাদ আর ফাইয়াজ কোথায় গিয়েছে।তা’ জানার জন্য এসেছিল তানহা।দু’জন’কে নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে,তাদের দিকে এগিয়ে আসলো।ফাইয়াজ হাঁটুর মাঝখানে নিজের মুখ গুঁজে রেখেছে।ইফাদ স্থির দৃষ্টিতে,ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে।কাগজ’টা পড়ে থাকতে দেখে তানহা কাগজ’টা তুলে নিজেই পড়তে শুরু করেছিল।তানহা-ও ফাইয়াজ আর ইফাদের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।কথা বলার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না।দু’জন ছেলে মানুষ তাই হয়তো কান্না করতে পারছে না।মেয়ে হলে,এখনই মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিত।ইফাদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।

–আরো একটা জিনিস দেখবে ফাইয়াজ?ইফাদের কথা শুনে ফাইয়াজ চোখ তুলে তাকালো।অশ্রুকণায় ভরে উঠেছে দু-চোখ।ইফাদ আবার রুমের মধ্যে গেল।একটা কাগজ নিয়ে এসে ফাইয়াজ হাতে দিল।ফাইয়াজ চোখ মুছে কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করল।

–আমার পুতুল,সত্যিই তুমি একটা পুতুল।ইচ্ছে করে তোমাকে রুমের মধ্যে সাজিয়ে রেখে প্রাণ ভয়ে দেখি।তোমাকে সারাজীবন দেখলে-ও ভরবে না আমার দু’নয়ন।তুমি আমাকে মেরেছো।আমি তাতে কিছু মনে করি নাই।আমি ভালো করেই জানি আমার পুতুল সোনা,তার বাবা’কে কতটা ভয় পায়।আমাকে আঘাত করে,সে আমার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছ।এটা আমি জানি।যাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে কল্পনা করতে গিয়ে,আমার দম বন্ধ আসে।তাকে অন্য কারো পাশে কিভাবে সহ্য করবো।আমি অর্থের কাছে হেরে গেলাম পুতুল।তোমার বাবা তোমাকে নিলামে তুলেছে।শুধু টাকার অভাবে কিনতে পারলাম না।আমাকে তুমি মাফ করে দিও।আমি বেঁচে থাকতে কখনো তোমাকে অন্যের পাশে দেখতে পারবো না।তুমি স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থেকো।আমি না হয় ওপারে ভালো থাকবো।এই রংয়ের দুনিয়ায় তোমাকে ছাড়া চাওয়া’র কিছুই ছিল না।তোমাকে চাওয়ার ছিল,তোমাকে পেলাম না।চুড়ি গুলো নিজে কামাই করে তোমাকে কিনে দিয়ে ছিলাম।বলে ছিলাম কখনো চুড়ি গুলো ফিরিয়ে দিও না।একটা বেকার ছেলে জানে,টাকা কামানো কতটা কষ্টকর।তুমি আমাকে কথা দিয়ে-ও কথা রাখলে না।চুড়ি গুলো আমাকে ফিরিয়ে দিলে।আমি খুব আঘাত পেয়েছি।তুমি ঠিকি বলো আমি খুব দুর্বল মনের মানুষ,তা না হলে সামান্য বিষয় নিয়ে এতটা কষ্ট পাই।তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে জানো পুতুল।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি আর পারছি না পুতুল।তুমি আমাকে মাফ করে দিও।বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে সুখী হও।পারলে এই অধমকে ভুলে যেও।(ইয়াদ)

–সব হয়েছে বাবার জন্য আমি বাবাকে কোনোদিন ক্ষমা করবো না।দু’টি ফুল এভাবে ঝড়ে গেল।কি দোষ ছিল দু’জনের,সব অনিয়মের দেওয়াল ভেঙে দু’জন’কে এক করে দিলে,কি এমন ক্ষতি হতো।তাদের সুন্দর একটা সংসার হতো।দিন শেষ একজন আরেকজনের বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে পারতো।মানসিক শান্তির চেয়ে বড় শান্তি পৃথিবীর কোথাও নেই।ইয়াদ ভাইয়া আপুর চিঠিটা খুলেই দেখে নাই।চিঠিটা খুলে দেখলে কি এমন ক্ষতি হতো।দু’জন একসাথে থাকতে পারতো।আমি বাবাকে কিছুতেই ক্ষমা করবো না।আমি আবার বাহিরে চলে যাব।আর কখনো বাংলাদেশে আসবো না।বাবাকে দেখলে আমার রাগ হবে।রাগের মাথায় কিছু একটা করে বসবো।আমি আজকেই চলে যাব।বলেই ফাইয়াজ হন্তদন্ত হয়ে ইফাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল।

পুরো বাড়ি একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।একটু ভুলের জন্য দু’টো প্রাণ চলে গেল।ইফাদের আফসোস হচ্ছে,কেনো সে,তার ভাইয়া’কে বলল না।ভাইয়া কাগজের লেখা গুলো পড়।ইফাদ যদি জানতো পুতুল আপু,ইয়াদের সাথে পালানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে।নিজের জীবন দিয়ে হলে-ও,পুতুল আপুকে,তার ভাইয়ের কাছে নিয়ে আসতো।কেনো তার ভাইয়ার কথা শুনে চুড়ি গুলো রেখে ভাইয়ের রুমে থেকে বেড়িয়ে আসলো।ইফাদের চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।বিচ্ছেদের যন্ত্রনা এতটা কঠিন কেনো?চৈতালি কেমন শান্ত চোখ তাকিয়ে আছে ভাইয়ের দিকে,রোকেয়া বেগমের শরীর খারাপ লাগছে।তানহা ইফাদে’র কাছে এগিয়ে গেল।ইফাদের কাঁধে হাত রাখতে-ই ইফাদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।তানহা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।তানহা কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না।ইফাদ’কে নিজের সাথে মিলিয়ে রাখলো।

ফাইয়াজ বাসায় এসে সোজা মায়ের কাছে গেল।কোনো কথা না বলে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।ছেলের করুন অবস্থা দেখে,রাহেলা চৌধুরী অস্থির হয়ে উঠলো।স্নেহের হাত মাথায় রেখে বলল।

–আমার বাবুইয়ের কি হয়েছে।

–আমার পুতুল আপুকে এনে দাও আম্মু।আমার আপুর কথা খুব মনে পড়ে।আপুর কথা মনে হলে,খুব কষ্ট হয়।একটা নজর দেখতে ইচ্ছে করে।ছেলের কথায় রাহেলা চৌধুরী চুপসে যান।দু-চোখে অশ্রুকণা গুলো এসে হানা দেয়।বোনের কথা মনে হলেই ছেলে এমন পাগলামি করে।একটু পরে ফাইয়াজ উঠে চলে গেল।চোখ দু’টো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।

তানহা সবাই’কে বুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিল।ইফাদ’কে বুঝিয়ে রুমে নিয়ে আসলো।

–একদিন সবাই’কে চলে যেতে হবে।কেউ সারাজীবন থাকতে আসে নাই।তুমি কষ্ট পেও না।নামাজ পড়ে ভাইয়ার জন্য দোয়া করো।

ইফাদ কোনো উওর দিল না।চুপচাপ বিছানায় শুইয়ে পড়ল।

ঘড়ির কাটায় রাত দু’টো বাজে,আবির চুপ করে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো।ঘন্টা খানিক পরে একটা ছোট বাসার সামনে এসে পৌঁছালো।বাসার মধ্যে প্রবেশ করতে-ই চেয়ারে কাউকে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।আবির’কে দেখে আগন্তুক বলল।

–তুমি চলে এসেছো?

–জ্বী এতরাত করে আসাটা উচিৎ হয় নাই।আপনি ভালো করেই জানেন,আমি নিজের বাসায় থাকি না।আমার বউয়ের বাসায় থাকি।

–ছেলে মানুষ হয়ে বউয়ের বাসায় থাকো লজ্জা করে না।

–আমার মনে হয়,আমি এখানে কাজে এসেছি।আপনার জ্ঞান শুনতে আসি নাই।

–আবির তুমি ভুলে যাচ্ছো,আমি কে?আমি চাইলে নিমিষেই তোমাকে শেষ করে দিতে পারি।আবির ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল।

–সে,আপনি যা ইচ্ছে খুশি করে নিতে পারেন।আমার কোনো ক্ষতি হবে না।সব ক্ষতি কিন্তু আপনার-ই হবে।আবিরের কথা শুনে আগন্তুক দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে,হয়তো নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা করছে।

–কালকে ইফাদ’কে তুলে,এখানে নিয়ে আসবে।মারতে মারতে আধমরা করে ফেলবে।তারপরে তানহা’কে ফোন দিবে।ভালোই ভালোই যদি সাইন না করে,স্বামীর সাথে বউকে-ও লাশ বানিয়ে দিবে।যে,করেই হোক চৌধুরীর ছেলের সাথে,আমার মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে।এর জন্য আমার অনেক টাকা আর ক্ষমতা লাগবে।

–আপনি ঐ’ আশাই করুন।চৌধুরীর ছেলে ইফাদের বোন’কে ভালোবাসে,আপনার মেয়েকে কোনোদিন বিয়ে করবে না।

–সেটা তুমি আমার হাতে ছেড়ে দাও।কালকে সময় মতো কাজ করতে পারবে।নাকি আমি অন্য ব্যবস্থা করবো।

–অন্য ব্যবস্থা করলে ভালোই হয়।আমাকে কষ্ট করতে হবে না।আগন্তুক আবিরে’র দিকে ক্রোধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আবির আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।আবির’কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আগন্তুক চলে যায়।আবির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউকে একটা ফোন দিল।ফোনের ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনে,আবিরের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
#এক_মুঠো_কাঁচের_চুরি
#পর্ব_৪২(বোনাস পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

প্রতিদিনে’র মতো আজকে-ও চৈতালি আর ইফাদ অফিসে’র উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল।কাল রাত থেকে সবার মনটা বিষাদে ভরে আছে।সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে আছে।যে,বাড়িটা’কে প্রতিদিন দেখলে মনে হতো’ বাড়িটা-ও কথা বলছে,আজ সেই বাড়িতে থাকতে তানহার গা ছমছম করছে।মনের মধ্যে ভয় জেঁকে বসেছে।মনটা কেমন কু গাইছে।শরীরের মধ্যে অশান্তি বোধ করতে তানহা।মনে হচ্ছে,আজকে কিছু একটা হবে।নিজের মনের ভুল ভেবে,নিজের কাজে মন দিল।

চৌরাস্তার কাছে অপেক্ষা করছে কয়েকজন।হয়তো কারো আসার অপেক্ষায়।সাদা গাড়ির সাথে চারজন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এক বার ফোনের দিকে দেখছে,আরেকবার হাতের ঘড়ির দিকে দেখছে।

–স্যার তো’ আমাদের বলেছিল।এই রাস্তা দিয়েই আসে।অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না।

–ঐ দেখ তোরা উনি আসছেন।

–শোন পাবলিকের সামনে কোনো ধরনের ভুল করবি না।সুন্দর করে গাড়িতে তুলে নিবি।

–উনাকে কাছে ডেকে নিয়ে আসতে হবে।ইফাদ মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে অফিসের দিকে যাচ্ছিলো।তখনই পেছনে থেকে কেউ বলে উঠল।ভাই শুনছেন।ইফাদ পেছনে ঘুরে বলল।

–ভাই আমাকে বলছেন।

–জ্বী ভাই আপনাকে বলছি।আমরা এই শহরে নতুন।একটু সাহায্য করবেন ভাই।এই ঠিকানা কোথায় একটু বলতে পারবেন।

ইফাদ লোকগুলোর দিকে এগিয়ে আসলো।একটা লোক ইফাদের দিকে কাগজ এগিয়ে দিল।ইফাদ কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো।কাগজটি সম্পূর্ণ ফাঁকা।ইফাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

–স্যরি ভাই আমি আপনাকে ভুল কাগজ দিয়েছি।এটা আমাকে দেন।আমি আসল কাগজটা আপনাকে দিচ্ছি।ইফাদ বিরক্ত হয়ে চলে যেতে লাগলে,পেছনে থেকে কেউ ইফাদের মুখে রুমাল চেপে ধরলো।সেকেন্ডের মধ্যে ইফাদ সেন্সলেস হয়ে গেল।এর পরে আর ইফাদের কিছু মনে নেই।

ফাইয়াজ মলিন মুখ করে অফিসে প্রবেশ করল।চৈতালি ফাইয়াজে’র দিকে তাকিয়ে আছে।আজকে ফাইয়াজে’র জন্য বড্ড মায়া হচ্ছে চৈতালি’র।ইচ্ছে হলো ফাইয়াজে’র সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতে,
মনের ইচ্ছে মনেই রেখে দিয়ে,কাজে মন দিল।একটু পরে অভি এসে চৈতালি’কে বলল।

–চৈতালি ফাইয়াজ তোমাকে ডাকছে।বলেই অভি চলে গেল।চৈতালি উঠে ফাইয়াজে’র কেবিনে’র দিকে গেল।ফাইয়াজে’র থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।

–স্যার আমাকে ডেকে ছিলেন।

চৈতালি কথায় মাথা নিচু করেই শান্ত ভাবে উত্তর দিল।”আমাকে বিয়ে করবে চৈতালি”?ফাইয়াজে’র শান্ত কণ্ঠে বলা কথা গুলো চৈতালির হৃদয় স্পর্শ করে গেল।পুরো শরীরে লোম দাঁড়িয়ে উঠেছে।ভেতরে অদ্ভুত একটা ভয় কাজ করছে।আচ্ছা ফাইয়াজ মাথা নিচু করে আছে কেনো?চৈতালি’র দিকে তাকাচ্ছে না কেনো?কোনোভাবে নিজের কষ্ট গুলো আড়াল করার চেষ্টা করছে।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।

–আমার পরিবার যদি,আপনার সাথে আমাকে বিয়ে দেয়।তাহলে করবো।না দিলে করবো না।কারন যাকে ভালোবাসি না।তার সাথে আর যায় হোক সংসার করা যায় না।

চৈতালির মুখে ভালোবাসি না কথাটা ধারালো অস্ত্রের মতো ফাইয়াজে’র বুকে আঘাত করল।ফাইয়াজ মাথা নিচু রেখেই বলল।

–আমি জানি ইফাদ ভাইয়া কোনোদিন,তোমার সাথে আমার বিয়ে দিবে না।নিজের জীবন শেষ করার জন্য,আমি নিজেই যথেষ্ট।তারমানে তুমি আমাকে বিয়ে করবে না।

–না।

–আচ্ছা তাহলে তুমি তোমার কাজে যাও।তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।এবার তুমি আসতে পারো।চৈতালি কোনো উওর করল না।চুপচাপ রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।ফাইয়াজ এবার মুখ তুলে তাকালো।অশ্রুভেজা দু’নয়ন ব্যর্থ দৃষ্টিতে চৈতালি’র দিকে তাকিয়ে আছে।চৈতালি একবার পিছু ফিরে তাকালে,দেখতে পেত।একজোড়া আহত চোখ আকুল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

–আমি চাই না।আমার জন্য তোমার কোনো বিপদ হোক চৈতালি।পুতুল আপুর মতো আমি’ও ভালোবেসেছি।আপুর মতো একই ভুল করেছি।আপু তার ভালোবাসার মানুষ’কে বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছে।আমি কিন্তু আপুর মতো বোকা নই।তুমি তো’ আর আমাকে ভালোবাসো না।আমি তোমাকে একতরফা ভালোবেসেছি।তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে দেখতে,
পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমাকে এনে দিতাম।তুমি ভালো থেকো।আমি না হয় দূর থেকে-ই তোমাকে ভালোবাসবো।কালকে আমি চলে যাচ্ছি।দেশে থাকলে হয়তো পাগলের মতো বারবার ছুটে ছুটে তোমার কাছে চলে আসবো।এতে তোমার-ই ক্ষতি।ভালো থেকো।নিজের খেয়াল রেখো।এই বিরক্তিকর মানুষটা আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবে না।

ইফাদে’র জ্ঞান আসতে-ই সে নিজেকে অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করল।একটি চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে ইফাদ।মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে।গলাটা বড্ড শুকিয়ে আসছে।চারদিকে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।ইফাদ একবার ডেকে উঠল।একটু পরে পুরো জুড়ে আলো জ্বলে উঠল।ইফাদে’র সামনে মধ্যে বয়স্ক একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।ইফাদ আহত দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল।

–আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে কেনো?

–দেখো বাবা তোমাকে একটা কাজের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে।তুমি যদি আমার কথা গুলো ভালোভাবে পালন করো।তাহলে আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।যেমন সশরীরে নিয়ে এসেছি।ঠিক তেমনই সশরীরে রেখে আসবো।

–কে আপনি?আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এসেছেন?

–তুমি আগে শান্ত হও বাবা।কে কোথাস আছিস।ইফাদ’কে একটু পানি দিয়ে যা’।একজন গার্ড এসে,পানি দিয়ে গেল।

–পানিটা খেয়ে নাও।ঠান্ডা মাথায় আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলছি।ইফাদে’র গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।তাই লোকটি পানি মুখের সামনে ধরতেই খেয়ে ফেলল।

–আচ্ছা এখন কয়টা বাজে?বলল ইফাদ।

–সন্ধ্যার আজান দিয়েছে।একটু আগেই।

–বাসায় সবাই আমার জন্য অনেক চিন্তা করছে।সারাদিন তানহার খোঁজ নেওয়া হয় নাই।মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক অভিমান করে আছে।কিন্তু এরা কারা?আমাকে দিয়েই বা’ তাদের কাজ কি?ইফাদে’র ভাবনার মাঝেই লোকটি ইফাদে’র কাছে এসে বসলো।

সারাদিন পরে ক্লান্ত হয়ে চৈতালি বাসায় ফিরলো।মনটা ভিষণ উদাসীন হয়ে আছে।তার কেনো জানি মনে হচ্ছে,ফাইয়াজ’কে ফিরিয়ে দেওয়াটা,ঠিক হয় নাই।ফাইয়াজ তো’ তাকে হালাল ভাবে প্রস্তাব দিয়েছে।চাইলে প্রেম করার প্রস্তাব দিতে পারতো।সমস্ত চিন্তা ভাবনা ঝেরে ফেলে বাসার কলিং বেলে চাপ দিল।তানহা এসে দরজা খুলে দিল।আশেপাশে তাকিয়ে ইফাদ’কে দেখতে না পেয়ে বলল।

–তোমার ভাইয়া কই?

–আমি তো’ বলতে পারবো না ভাইয়া কই।

–প্রতিদিন তো’ একসাথে-ই আসো।

–যেদিন দেখা হয়।সেদিন একসাথে আসি।হয়তো কাজের জন্য আঁটকে পড়েছে।কাজ শেষ হলেই চলে আসবে।

–ওহ্ তাই হবে হয়তো,আজকে সারাদিন আমাকে ফোন-ও দেয় নাই।আমি দিয়ে ছিলাম।কিন্তু উনার ফোন বন্ধ পেয়েছি।

–আচ্ছা বউয়ের বুঝি অভিমান হয়েছে।আজকে ভাইয়া বাসায় আসলে,খবর করে দিও।

–চৈতালি আমার ভালো লাগছে না।হঠাৎ কোনো কারন ছাড়াই খুব খারাপ লাগছে।

–মাঝে মাঝে এমন হয় ভাবি।তুমি চিন্তা করো না ভাবি।ভাইয়া ঠিক বাসায় চলে আসবে।বলেই নিজের রুমে চলে গেল।

আগন্তুকে’র কথা শুনে,ইফাদ রেগে আগন্তুকে’র দিকে তাকালো।কঠিন কণ্ঠে বলল।

–অসম্ভব!আমাকে আপনার পাগল মনে হয়।আপনি আমাকে যেভাবে বলবেন।আমি সবকিছু শুনবো।আমি বেঁচে থাকতে কখনো এটা হতে দিব না।আমি যদি মরে-ও যাই।তাহলে তানহার কারো পায়ের নিচে পড়তে হবে না।নিজেরটা নিজেই খেতে পারবে।আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।ইফাদ মৃত্যুর ভয় করে না।

–এতক্ষণ তোকে অনেক ভালো করে বুঝিয়েছি।তুই ভালো কথা শোনার মানুষ-ই না।এই কে কোথায় আছিস।যতক্ষণ না রাজি হচ্ছে,মারতে থাকবি।বলেই আগন্তুক চলে গেল।দু’জন লোক এসে ইফাদ’কে মারতে শুরু করল।টানা দু’ঘন্টা ইফাদে’র শরীরে আঘাত করা হয়েছে।দাঁতের ওপরে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করেছে।অতিরিক্ত মারার ফলে ইফাদ আবার সেন্সলেস হয়ে গেল।

ঘড়ির কাটায় রাত দু’টো ছুঁই ছুঁই।ইফাদ এখনো বাসায় ফিরে নাই।সবাই রাত জেগে ইফাদে’র জন্য অপেক্ষা করছে।তানহা’র পুরো শরীর ভয়ে জমে এসেছে।বুকের মাঝখানে অসম্ভব ব্যথা অনুভব করছে।খুব শক্ত হয়ে বসে আছে।চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

–আম্মা আপনি অসুস্থ মানুষ এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকবেন।আপনি রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।চৈতালি তোমার কাল অফিস আছে।তুমি’ও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

–আমার ইফাদ কোনোদিন এমন করে না।আমার ছেলে ঠিক আছে তো’।আমার খুব চিন্তা হচ্ছে,চৈতালি আরেকবার তানভীর’কে ফোন দিয়ে দেখতো ফোন ধরে কি না?

–বুঝতে পারছি না।তানভীর ভাই কেনো ফোন তুলছে না।বলতে বলতে আবার ফোন দিল।সাথে সাথে তানভীর ফোন রিসিভ করল।

–হ্যালো তানভীর ভাই।আমি চৈতালি বলছিলাম।আজকে ভাইয়া বাসায় ফিরে নাই।আপনি কিছু জানেন?

–ইফাদ আজকে অফিসে-ও আসে নাই।আমি তো’ বলতে পারবো না।ইফাদ কোথায় গেছে।

–আচ্ছা ভাইয়া এটা জানার জন্যই,এতরাতে বিরক্ত করলাম।আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

–সমস্যা নেই বোন।সকাল হলে,আমি’ও খোঁজ নিয়ে দেখছি।বলেই কল কেটে দিল।

–উনি অফিসে যান নাই।তাহলে কোথায় গিয়েছে।উনার কোনো বিপদ হলো না তো’ আবার।

–ভাবি সকাল হতে দাও।রাতে ভাইয়া বাসায় না আসলে,আমরা পুলিশের সাহায্য নিব।তানহা’র ভেতরে ঝড় বইয়ে যাচ্ছে।অতিরিক্ত চিন্তার কারনে,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের কণা তৈরি হয়েছে।হাত-পা কেমন অবশ হয়ে আসছে।চৈতালি আর রোকেয়া বেগম অপেক্ষা করতে করতে ড্রয়িং রুমে-ই ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুম নেই তানহার চোখে,সারারাত ঘুমোয় নাই।দু-চোখ লাল হয়ে আছে।পুরো মুখ একদম ফুলে উঠেছে।বারবার দরজা’র কাছে গিয়ে দেখেছে,ভোর হবার সাথে সাথে কতবার বাহিরে গিয়ে,ঘুরে আসছে।তার কোনো হিসেব নেই।সাতটা বাজতেই চৈতালি’কে ডেকে তুলল।শেষরাতে ঘুমোনো’র ফলে রোকেয়া বেগম আর চৈতালি কেউ নামাজ পড়ে নাই।তানহা নামাজ পড়ে স্বামীর জন্য দোয়া করেছে।চৈতালি ঘুম ঘুম চোখে তানহা’র দিকে তাকালো।কাল রাতের কথা মনে হতেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো।

–ভাবি ভাইয়া বাসায় আসে নাই।

–না।

চৈতালি চিন্তা পড়ে গেল।এতকিছুর মধ্যে রিয়াদের কথা ভুলেই গিয়েছিল চৈতালি।রিয়াদের কথা মনে হতেই সাথে সাথে ফোন দিল।রিয়াদের বউ ফোন ধরে বলল।রিয়াদ অনেক সকালে জরুরি মিটিংয়ের জন্য বেড়িয়ে গিয়েছে।ফোনটা ভুলে বাসায় রেখে গিয়েছে।চৈতালি হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিল।

–চৈতালি উনি কোথায় চলে গেল।আমি কি কোনো ভুল করেছি।উনি আমাকে ছেড়ে চলে গেল।আমি ওনাকে এখনো বাচ্চার মুখ দেখাতে পারি নাই।সেজন্য উনি কি আমার ওপরে নারাজ।

–আমার ভাইয়া এমন মানুষ-ই না ভাবি।ভাইয়া তোমাকে নিজের থেকে-ও বেশি ভালোবাসে।তোমাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত থাকতে পারে না।আর একটা বাচ্চার জন্য তোমাকে ছেড়ে দিবে।আমার ভাইয়ার মন মানসিকতা এতটা নিচু না।তুমি অতিরিক্ত চিন্তা করার ফলে,তোমার মাথায় এসব উল্টা-পাল্টা চিন্তা আসছে।

–আমার খুব ভয় হচ্ছে,পুরো একটা দিন কেটে গেল।উনার কোনো খোঁজ পেলাম না।উনাকে ছাড়া নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়।খুব করে উনার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।

–চিন্তা করো না ভাবি।আর একটু সকাল হোক।ভাইয়া না আসলে আমরা থানায় যাব।

–আমার তো’ মন মানছে না চৈতালি।তানহা’র অবস্থা বুঝতে পেরে চৈতালি’র খুব খারাপ লাগছে।একদিকে ভাইয়ের চিন্তা,অন্য দিকে তানহা’র বিধস্ত চেহারা’র দিকে তাকিয়ে কলিজা কেঁপে উঠছে,কতটা ভালোবাসলে,একটা মেয়ে একটা ছেলের জন্য এমন পাগলামি করতে পারে।চৈতালির নিজের ভাইকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো।

চলবে…..
চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here