এবং তুমি, পর্ব:১০+১১

গল্পের নাম— #এবং_তুমি
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব–১০

সেদিনের পর থেকে ইশান স্যারকে ইগনোর করা যেনো আমার প্রথম ও প্রধান ডিউটি হয়ে গিয়েছে। সে যতক্ষণ ঘরে থাকবে ততক্ষণ রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকি। তিনবেলা খাবার সময় ও রান্নাঘরে থাকি। তার সামনে পড়ার মতো কোনো স্কোপ ই রাখি নি। শুধুমাত্র রাতে ঘুমাতে গেলেই ও আমাকে দেখতে পায়। কিন্তু আমি তখন গভীর ঘুমে বিভর। বলতে গেলে কোনোরকম কথাবার্তা ই হয় না। আমার ইগনোরেন্স আদৌ ইশান বুঝতে পারছে কি না তা আমার জানা নেই। হয়তো পারছে। সে অনেকবার আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। প্রতি সকালে নানা বাহানায় আমাকে ডেকেছে। আমি যাই নি। না শুনার ভান করে ছিলাম। আমার কেনো মনে হচ্ছিলো বাড়ীর বাকিদের চোখেও বিষয়গুলো পড়ছে।
এর মধ্যে খুব বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলাম। সেদিন দাদিমা ফোন দিয়ে বললেন,

—কি গো নাতবউ, তুমি নাকি নাতির প্রেমে ডুবে মধু খাচ্ছো?

আমি রসিকতার সহিত বললাম,
— আমার এত খারাপ দিন আসে নি আপনার বাঁদরমুখো নাতির প্রেমে পড়বো।

—ওহো,তাই নাকি? তাহলে আমার নাতির শার্ট টার্ট পরে কে হাটাহাটি করে? ভূত টুত হবে হয়তো, তাই না? কি বলো

—যান। কি সব বলেন আপনি?

— ইশশ, সেতি দেখি লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছে।

দাদী খিল খিল করে হাসলেন। আমি তখন এত লজ্জা পেলাম যে মুখ দিয়ে কথাই বের হলো না। দাদী জানালেন, মেঝ ভাবীর বাদর দুটো আমাকে ইশানের কাপড় পরতে দেখেছে। আর তারাই এ কথা উনাকে বলেছে। আমার খুব রাগ উঠলো। এত দুষ্টু কেনো এ দুটো? না জানি আর কাকে কাকে বলেছে? ভয় পেয়ে দুটো ডেকে আনলাম। অবশেষে তাদেরকে দশ টাকা করে বিশ টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করালাম। বাপরে বাপ কি ভাব ওদের, দশটাকা মানছিলোই না। বিশ টাকা করে দিতে হবে। কত কষ্টে যে মানাতে পেরেছিলাম সেটা আমিই জানি। করুণ এই কাহিনী কাউকে বলাও যাচ্ছিলো না। দুঃখে কান্না পাচ্ছিলো।

আজ সকালে দারুণ কান্ড ঘটেছে। শাশুড়িমা আমাকে আর ইশানকে সাথে বসিয়ে নাস্তা খেতে বসেছেন। খাবার টেবিলে তিনি প্রথম যে কথাটি বললেন তা হলো,

—ইশান, তোমার সাথে খুবই জরুরী কথা আছে আমার। তোমাকে তো আজকাল পাওয়া ই যায় না।

— মা, আসলে অফিসে খুব কাজের চাপ। নতুন বিয়ের প্রজেক্ট এসেছে। এবার পঞ্চাশ লক্ষ টাকার প্রজেক্ট। অলরেডি চেক দিয়েও দিয়েছেন। সেজন্যই এত বেশি চাপ।

—সে কি, বলিস কি? এত টাকা! লোকটা নিশ্চই বড়লোক হবে।

— হু।

—একদিন নিয়ে আসিস। এত বড় কাজ দিয়েছে ডাকে তো দাওয়াত করানোই যায়। কি বলিস?

— হু।

— হু হু কি করছিস? তোর কাজের চাপ বেড়েছে যখন তোর বউকে নে।

ইশান খাবার বন্ধ করে দিলেন। থমথমে মুখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। শাশুড়িমা বললেন,

—এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? তুই কি আমাকে ওল্ড মাদার-ইন-লো, ভেবেছিস যে বিয়ে হয়েছে দেখে বউদের কাজ করতে দেওয়া যাবে না? তাদের ঘরের কাজ করতে হবে। শুন এমন ভেবে থাকলে মাথা থেকে ঝেড়ে দূরে ফেলে দে। আমি নিউ জেনেরেশনের শাশুড়ি, আমার বড় দুই বউ এর একটা মাস্টার্স পাস, একটা অনার্স। সেখানে ছোট ছেলের বউ শুধু ম্যাট্রিক পাস এমন তো হবে না। তোর বউকে বল, সে যদি পড়ালেখা করে অনার্স পাস না করে তাহলে তাকে আমার ঘরের বউ মানা হবে না। আর তার নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেকেই চালাতে হবে।

— ও নিজেরে খরচ কীভাবে চালাবে?

—-কেনো? আগে কীভাবে চালাতো?

—আগে তো আমার অফিসে চাকরী করতো। কিন্তু এখন,,

—এখন তখন কিছুই না। সে আবার তোর ওখানেই কাজ করে পড়ালেখা চালাবে। সাথে সংসার। ক্ষতি কি?

—কিন্তু মা ও একসাথে সব পারবে? অফিস টা নাহয় বাদ দিয়ে দিক। তাছাড়া আমি নতুন কর্মচারীর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিয়েছি।

ইশানের মা পানির গ্লাস টা টেবিলে রেখে দিলেন। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,

—তুই জানিস তোর বাবা যখন আমাকে ম্যাট্রিক পাস করিয়েছে। তখন মোশারফ(বড় ছেলে) চার বছরের ছিলো আর সোহাগ( মেঝো ছেলে) সাত মাসের। তোর এই মা তখন সংসার পড়ালেখা বাচ্চা সব এক হাতে সামলিয়েছে। তাহলে সে কেনো পারবে না?

— কিন্তু মা…

—-কোনো কিন্তু ফিন্তু নেই। আমি মানুষের কথা শুনতে পারবো না যে আমার ছোট বউ ইন্টারও পাস করে নি। আমার প্রেস্টিজ ফেস্টিজ ফুশ হয়ে যাবে। তাছাড়া তুই বলার কে? এই যে নতুন বউ গোমটা সরাও। শুধু ঘোমটা দিলেই কাজ হয় না। আজকাল মেয়েদের সব কিছু জানতে হয়। আমাকে দেখেও তো কিছু শিখতে পারো তাই না? দেখো এ বয়সেও কত সুন্দর ফিটফাট ফিগারের। সেখানে যদি তুমি আমার থেকে বেটার না হতে পারো তাহলে তো আমার ছেলের বউ হওয়ার যোগ্যতা ই নেই।

আমি চুপ রইলাম। অথচ আমার তখন চেচিয়ে বলা উচিত ছিলো যে হ্যা আমি কাজ করতে চাই,পড়ালেখা করতে চাই। শাশুড়ি মা বললেন,

— আমি যা বলে দিয়েছি। এটাই ফাইনাল। তোর বউকে বলবি আজ থেকে কাজে যায়, আর কাল থেকে যেনো কলেজে যায়। নাহলে যেনো আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আমি ভীষণ খুশি হলাম। খুশিতে মনে হচ্ছিলো ডানা মেলে উড়ছিলাম। ইচ্ছা করলো শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। কিন্তু হলো না, তিনি রাগে গজগজ করতে চলে গেলেন। তার রাগ টা আমার উপর ছিলো। পড়ালেেখার প্রতি আগ্রহ নেই দেখে। অথচ তখন আমি খুশিতে কথাই বলতে পারছিলাম না। ইশান সকাল সকাল চলে গিয়েছেন। আমার ডিউটি সবসময় ২ টা থেকে শুরু হতো। কারণ নয়টা থেকে ১ টা পর্যন্ত কলেজ করতাম। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ১ টা ৩০ এ রেডি হয়ে শাশুড়িমার রুমে গেলাম। বেশ খানিক সময় পর ইতস্ত গলায় বললাম,

— মাদার-ইন-লো আমি কি যাবো?

শাশুড়িমা আমার দিকে ঘুরলেন। ঘুরেই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমি চমকে গেলাম। কি হলো কি হলো? আমি আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলেছি?

— সর্বনাশ! এসব কি পরে বাহিরে যাচ্ছো? আর মুখের এ অবস্থা কেনো? চুলের কি হয়েছে? এই তোমাকে কি বিয়ের সময় মেক আপ টেক আপ দেওয়া হয় নি? আমি নিজে এত ব্রান্ডেড কসমেটিক্স কিনে দিয়েছিলাম। সেগুলার কি হয়েছে? এই মেয়ে কি হলো কথা বলো না কেনো?

আসলে হয়েছে কি, আমি কি পরবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই সুতির শাড়ী আর কোনোরকম পেচিয়ে খোপা করে নিয়েছিলাম। বিয়ে হয়েছে এখন তো শাড়ী ই পরতে হবে তাই না। শাশুড়িমা এসব দেখেই রেগে গেলেন। আমাকে নানান কথা শুনিয়ে মিস সুইটিকে ফোন দিলেন। মিস সুইটি হলেন পার্লারের মহিলা। আমার শাশুড়ির খাস মেক আর্টিস্ট। শাশুড়ির সাজগোজ এর পেছনে এ মহিলার লম্বাচওড়া হাত রয়েছে। তিনি ই এসব শিখিয়েছেন। কিন্তু আমার শশুড় এ মহিলাকে একদম সহ্য করতে পারেন না। তিনি বলেন তার সিধাসাদা বউকে নাকি এই কুটনি মহিলা নষ্ট করেছেন। এসব আবার তিনি আড়ালেই বলেছিলেন। শাশুড়ির সামনে আবার খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিলেন মিস সুইটিকে। অথচ আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, বুঝেছো বউ এই মহিলা কোনদিন মরবে সে দিনের অপেক্ষায় আছি। কত ভালো ভালো মানুষ মরে যায় আর এদিকে দেখো এর মরার কোনো খবর ই নেই। ।আমার তখন এত হাসি পাচ্ছিলো। বসে বসে শুধু উনাদের কান্ড ই দেখেছিলাম।

.

— আয়না দেখো এবার! দেখো তখন কেমন লাগছিলো আর এখন কেমন লাগছে।

আমি আয়নার দিকে তাকালাম। পরপর দুবার চোখ বন্ধ করে চোখ খুললাম। আমি কি সত্যি এত সুন্দর? এ আমার ভ্রম নয় তো? নিশ্চই স্বপ্ন দেখছি। শাশুড়ি মা বললেন,

— শুনো মেয়ে, আমার ছেলের বউ হয়ে থাকতে হলে তোমাকে আমার মতো হতে হবে। এসব গাইয়া,ক্ষ্যাত সেজে থাকলে চলবে না। তুমি দেখো না, বড়বউ আর মেঝোবউ রোজ আমার সাথে রুপচর্চা করে। কাল থেকে তুমিও করবে। কাল নয় বরং আজ থেকেই করবে। মনে থাকবে তো?

আমি মাথা নাড়ালাম। ভীষণ লজ্জা লাগছে। আবার কেমন অজানা ভয় ও হচ্ছে। ভয়,সংকোচ,লজ্জা নানারকম মিশ্র অনুভূতি নিয়ে বের হলাম। পথে নানারকম কল্পনা-ঝল্পনা করে নিলাম। কিন্তু তখন সব অনুভূতি ঠুস হয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো যখন সেখানে যেয়ে দেখলাম মাধবি আপা ইশান স্যারের হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছেন। দুজনে মুখোমুখি চেয়ারে বসে ছিলেন। স্যারের হাত ছিলো টেবিলের উপর। আপা সেই হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছেন। আমার বুক মুচড়ে উঠলো। শরীর অটোমেটিক কাঁপতে লাগলো।

#চলবে….

গল্পের নাম— #এবং_তুমি❤️
লেখিকা— #সোনালী_আহমেদ
পর্ব– ১১ (বোনাস)

আমি খুব সাবধানে সরে গেলাম। ইশান স্যার আর মাধবি আপা কারোর নজরে এলাম না। ধীর পায়ে বাহিরে চলে গেলাম। এক প দু পা এগিয়ে যেয়ে দেখলাম সজীব ভাই আর রিফাত ভাই আসছেন। দুজনের হাতে কাপড়ের ব্যাগ। নিশ্চই প্যান্ডেল সাজোনোর জন্য। তারা দুজন নিজেদের গল্পে মত্ত হয়ে আছেন। আমি স্বাভাবিক কন্ঠে ডাক দিলাম,

— রিফাত ভাই।

দুজনেই আমার দিকে তাকালো। চমকানো অদ্ভুত দৃষ্টি। তারা নিশ্চই আমাকে আশা করে নি। আশা করার কথা ও নয়। দুজনে একসাথে বললেন,

— আরে প্রভাতি…

— তুমি এখানে?

আমি বললাম,— চলে এসেছি। কেমন আছো তোমরা? বাকিরা কই?

সজীব ভাই কথা বললেন না। তিনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। রিফাত ভাই হেসে বললেন,

— এইতো আলহামদুলিল্লাহ। মেয়েরা সবগুলো একসাথে ফুসকা না টুসকা খেতে গেছে। আপনি কেমন আছেন?

— আমাকে আপনি বলার কারণ কি?

রিফাত ভাই ইতোস্ত কন্ঠে বললেন,

— তখন তো আমাদের সহকর্মী ছিলেন। এখন তো ভাইয়ের বউ। তাই….

— রিফাত ভাই, আরেকবার যদি আপনি ডাকেন তাহলে আমি সিরিয়াস কিছু করে বসবো। আমি সেই আগের প্রভাতি আর আপনাদের সহকর্মী। বুঝেছেন? এখন থেকে নো আপনি টাপনি। ঠিক আছে?

রিফাত ভাই ঘাড় হেলালেন। সজীব ভাই কথা বলছেন না। তিনি অন্যদিকে ফিরে আছেন। এ কারণটা অবশ্য আমার কাছে স্পষ্ট। কেননা তিনি আমাকে পছন্দ করতেন।তার ভাষ্যমতে ভীষণ রকম ভালোবাসতেন। এ বিষয় টি সবার জানা। কারণ তিনি আমাকে সরাসরি প্রপোজ করে ছিলেন। সবাই আমাকে কত ফোর্স করলো হ্যা বলতে, কিন্তু আমি বলি নি। প্রেম-ভালোবাসা আমার জন্য নয়। আমি ছিলাম এসবের ঘোর-বিরোধী। এই মুহূর্তে খুব আফসোস হচ্ছে আমার সেই বিষয়গুলোর প্রতি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

— রিফাত ভাই, আমাকে, স্যারকে তো চিনেন ই। আমাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছে সেটাও নিশ্চই জানেন। তাই এত ফর্মালিটি দেখিয়ে প্লিজ লজ্জা দিবেন না। আমি আবার এখানে কাজ করতে এসেছি। সেই আগের মতো।

রিফাত ভাই ভীষণ অবাক হয়ে বললেন,
— কি বলো, তুমি আবার কাজ করবে? কিন্তু তোমাকে সেজেগুজে আসতে দেখে তো আমি মনে করলাম ভাইয়ের সাথে বোধহয় ঘুরতে যাবে।

— না। আমি কাজ করতেই এসেছি। আসলে স্যারের মা আমাকে জোর করে এভাবেই পাঠিয়েছেন। তিনি চান আমি যেনো কাজ করি। পড়ালেখা করি।

— খুব ভালো। তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। কত যে গেলাম-আসলাম। অনেক আদর করেন। উনি মনে হয় খুব শৌখিন।

— হ্যা। আচ্ছা সব কথা কি দাড়িয়েই বলবো নাকি? চলুন আমরাও যেয়ে ফুসকার দোকানে তাদের সাথে আড্ডা দেই।

রিফাত ভাই অবাক হয়ে বললেন,

—তুমি আবার ফুসকা খাও নাকি? তুমি তো এসব করো টরো না।

আমি মৃদু হাসলাম। সজীব ভাই এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। আমি বললাম,

—সজীব ভাই,আমার সাথে কথা বলবেন না? রাগ করেছেন নাকি?

—আ আরে ন্ না। রাগ করবো কেনো? তোমরা কথা বলছো,আমি শুনছি। বলার মতো কিছুই পাচ্ছি না। তাই চুপ। তাছাড়া তুমি তো বেশ কথাবার্তা বলো না,চুপচাপ থাকো। তাই ভাবলাম,,,

—নো ভাবাভাবি। চলুন চলুন, আমরাও ফুসকা খেতে যাবো।

সজীব ভাই স্বাভাবিকভাবে আসলেন। তিনি অবশ্য স্বাভাবিক ই থাকেন। আমি না করে দেওয়ার পরেও কি সুন্দর বন্ধুর মতো থেকেছিলেন। আমার সামনে এসে মাথা নিচু করে বলেছিলেন, ‘ শুনো প্রভা, তুমি যদি এত লজ্জা আর অস্বস্তি পাও তাহলে আমি ঠিকঠাক কাজ করতে পারবো না। প্লিজ ওটা ভুলে যাও। আমার উচিত ছিলো তোমার সাথে ডিসকাস করা। আই রিগ্রেট ফর দ্যাট। আমরা পূর্বের মতো নরমাল বিহেভ করবো ওকে? প্লিজ তুমি একটু নরমাল হও।’ আমি নরমাল হওয়ার চেষ্টা করলাম। একটা সময় এসে বিষয় টা আমার কাছে খুব সাধারণ মনে হলো। আমি ঠিক আগের মতো উনার সাথে স্বাভাবিক কথা বলছিলাম। উনি মিষ্টি হেসে আমাকে বলেছিলেন,থ্যাংকস। বাকি সবাই অবশ্য আমার উপর রাগ করেছিলো। আমি সেসব পাত্তা দেই নি।

অফিস থেকে উল্টো পথে প্রায় দশ মিনিটের পথেই ফুসকা স্টল। আমরা সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখলাম সবাই হৈ-হুল্লুড় করছে। একেকজন খাচ্ছে কম হাসছে বেশি। আমাকে দেখে কি খুশি তাদের। আমিও হেসে যোগ দিলাম। সবাই খুব অবাক ছিলো। ঘন্টা খানেক আড্ডা দিয়ে আমি বেরিয়ে গেলাম। ওদের কেউই আমার হাসিখুশি মুখের পেছনের গুড়িয়ে যাওয়া মুখ দেখলো না। সবাই ভীষণ খুশি দেখেছে আমায়। তাদের থেকে জানলাম, ইশান স্যার নাকি আজ নিজে ওদের ছুটি দিয়েছে ফুসকার জন্য। আর ছেলেদেরও কাপড় কিনতে তিনিই পাঠিয়ে ছিলেন। আমি এভাবে বলছি কারণ আমার মন বলছে তিনি নিশ্চই ইচ্ছা করেই ওদের কাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মাধবি আপার সাথে কিসের কথা বলছেন উনি? আপার সাথে কি আগে থেকেই যোগাযোগ ছিলো? এর আগেও কি আপা এসেছে?
আমার কি উনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলার দরকার? কথা বললেই কি হবে? উনি নিশ্চই বলবেন আপা ক্ষমা চাইতে এসেছে। আমাকে তো উনার পছন্দ নয়। নিশ্চই ছেড়ে দিতে চাইবেন। আপা কি আবার ফিরে এসেছে? ইশান কি ক্ষমা করে দিবেন? আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেলো। উল্টাপাল্টা চিন্তা ভরে উঠলো। আমার ভুল হয়েছে। বড় ভুল হয়েছে। আমার উচিত ছিলো সরাসরি উনাদের সামনে যেয়ে দাড়ানো। তখন দেখা যেতো কি বলে?

সেখান থেকে ফিরে আসার সময় আমার ফোন বাজলো। হাসপাতাল থেকে ফোন। সেই ডাক্তার মেম ফোন দিয়েছেন। ভদ্রমহিলার নাম শিলা। তিনি আমাকে আর্জেন্ট যেতে বললেন। আমার রিপোর্ট ব্যাপারে কথা বলবেন। আমি বাড়ীতে গেলাম না। যাওয়ার ইচ্ছাও ছিলো না। তাই সরাসরি সেখানে গেলাম। ডাক্তার শিলা এ নিয়ে পাঁচবার রিপোর্ট উল্টালেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই বসে আছি। তিনি নিশ্চই আশ্চর্যজনক কিছু দেখেছেন। আমার জানা নেই। এই মুহূর্তে জানার ইচ্ছাও হচ্ছে না।

শিলা ম্যামকে অধিক বিচলিত হতে দেখে আমি বললাম,

—ম্যাম সিরিয়াস কিছু?

উনার কপালে ভাজ পড়লো। তিনি রিপোর্ট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,

—রিপোর্ট টা দেখো। ডান পাশের এক্স-রে রিপোর্ট টা । কিছু দেখতে পাচ্ছো?

—হ্যা, এখানে গর্ত দেখাচ্ছে। পাশে ছোট ছোট বিন্দুও দেখা যাচ্ছে।

—এবার লেখাটা পড়ো।

আমি পড়লাম। ইংরেজীতে লেখা। যার অর্থ বোধগম্য হলো না। শিলা ম্যাম আমাকে আরো লেখা পড়ালেন। আমি সেটাও পড়লাম। কিন্তু কিছু বুঝি নি। আমাকে সেদিন তিনটা টেস্ট দিয়েছিলেন। এক্স-রে টা পরে এড করলেন। মিস শিলা বললেন,

—কিছু বুঝতে পেরেছো?

আমি মাথা নাড়ালাম। বিস্ফোরিত কন্ঠে বললাম,

—ম্যাম,আমি কি প্রেগন্যান্ট?

শিলা মেম গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টি বলছে এই মুহূর্তে আমার মজা করার ইচ্ছা নেই। তাহলে কি আমি মজার মতো কিছু বলেছি। হ্যা, মজা ই তো। মাত্র কয়েকদিন হলো বিয়ের। এর মধ্যে কীভাবে প্রেগন্যান্ট হবো? সত্যি আমার মাথা কাজ করছে না। বারবার ইশান স্যার আর আপুর বিষয়গুলো মনে পড়ছে।

—প্রভাতি। তুমি খুব ছোট। কথাবার্তা শুনে তা আরো স্পষ্ট বুঝলাম। তোমাকে বলেছিলাম তোমার হ্যাসবেন্ডের সাথে আসতে। কারণ এই মুহূর্তে তোমার গার্ডিয়েন প্রয়োজন। অথচ তুমি একা এসেছো। ডু ইউ হেভ এনি আইডিয়া তোমার কত বড় রোগ হয়েছে?

আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, — আপনি আমাকে বলুন। আমিই আমার অভিভাবক। আমার কেউ নেই।

ডাক্তার শিলা বললেন,

— এই যে রিপোর্ট। স্পষ্ট লেখা তোমার জরায়ুতে ইনফেকশন হয়েছিলো। আর সেটা এখন বড় ধরনের টিউমার ধারন করেছে। টিউমার বুঝেছো? টিউমার। লিসেন,তোমার কেস নরমাল নয়, খুবই কমপ্লিকেটেড। এর আগে কোনো ডাক্তার দেখাও নি ? এসব সমস্যা তো এখন নয় আরো পূর্বে থেকেই দেখা দিয়েছিলো। ইউ নিড অপারেশন। এন্ড ইউ নো হোয়াট, তোমার অপারেশন আমাদের হাসপাতালে করানো সম্ভব নয়। বিকজ এটা সাকলসেসফুল হওয়ার সম্ভাবনা ৩০% ও নেই। কিছু বুঝতে পারছো তুমি? আমি কি বলছি শুনছো?

আমি মাথা নাড়ালাম। শান্তস্বরে বললাম,

—আমি যদি অপারেশন না করি তাহলে কতদিন বাঁচবো? আই মিন এক্সাক্টলি আমার হাতে কতদিন রয়েছে।

শিলা ম্যাম দাড়িয়ে গেলেন। উত্তেজিত হয়ে বললেন,

—আর ইউ মেড? এত সিরিয়াস বিষয় নিয়ে এভাবে হেলাফেলা করে কথা বলছো। হাউ? দ্যাটস হোয়াই, আমি বলেছিলাম অভিভাবক নিয়ে আসতে। কেননা এসব নিউজ শুনলে পেশেন্ট এমন এবনরমাল হয়ে যায়। আমার উচিত ই হয় নি তোমার সাথে এসব বলার। এক্ষুণি তোমার হ্যাজবেন্ডকে কল দাও। তাকে বলো সে যেনো দ্রুত এখানে আসে।

— আমি ঠিক আছি। একদম নরমাল। আমার হ্যাজব্যান্ডকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। তিনি এই মুহূর্তে ব্যস্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। তাকে এখন ডিস্টার্ব করলে সে বিরক্ত হবে। ভীষণ বিরক্ত। আপনি বরং আমার বাবাকে ফোন দিন। বাবা আসবে। আমার বাবাকে ফোন দিন।

হুট করেই অস্থির হয়ে উঠলাম। নরমাল থাকতে পারছি না। কেনো পারছি না। জানি না। আমি কি মরে যাবো? মরে গেলেই ভালো। সবাই আদায় পেয়ে যাবে। কাউকে আমার বোঝা বইতে হবে না। আচ্ছা আমি মরে গেলে কি কেউ কাঁদবে? হাহ্ আমি একটা পাগল। কেউ কেনো কাঁন্না করবে? আমি নিশ্চই কারো কান্নার মতো মানুষ নয়।কে আমি? হু আই এম? হু হু..

#চলবে……

®সোনালী আহমেদ

[সকালে বোনাস পর্ব দেওয়া যাচ্ছিলো না। কেননা এ পর্ব একসাথেই দিতে হবে। নাহলে পাঠকরা কাহিনী বুঝতে পারবে না। তাই বড় করে দিতে হলো। সরি পাঠক। আরো একটা বিষয় এ গল্পে আমি নেগেটিভ চরিত্র রাখি নি। সুতরাং মাধবিও পজেটিভ চরিত্র। সামনে ক্লিয়ার করা হবে। আপনারা ধৈর্য্য ধরে পড়ুন। আচ্ছা শুনুন, রাতে আরো একটা পর্ব দিবো যদি আপনারা গঠনমূলক মন্তব্য করেন। ]

©ছবিয়াল-ফেসবুক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here