গল্পটা_আমারই পর্ব : ৫

#গল্পটা_আমারই

পর্ব : ৫
(সুরমা)

কেটে গেলো আরো বেশ কিছুদিন। ভেবেছিলাম অর্ণব আমাকে প্রপোজ করবে। কিন্তু না। সে করলো না। অর্ণবের সাথে এখন আমার প্রতিদিন দেখা হয়। কথা হয়। রাত জেগে দুজন ফোনে কথা বলি। দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আপন করে পেতে চাই। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারছি না। না আমি বলছি না অর্ণব।

না বলার কথার মাঝেও সুখ আছে। আছে না বলা ভালোবাসার সৌরভ। কথা বলতে বলতে কখনযে আমার রাত কেটে যায় ঠের পাই না। অর্ণবের অনেক কাজও আমি করে দেই। ভালো লাগে ওর জন্য কিছু করতে পেরে।

আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি অর্ণবকে মিস করি। ওর ভালোবাসাটাকে আমি ফিল করি। ওর সাথে আমি জড়িয়ে গেছিলাম। চাইলেও ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না আমার পক্ষে।

এতদিনে অর্ণবের সাথে আমার খুব ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছিল। ওর ভাল লাগা, খারাপ লাগা গুলো শেয়ার করতো। ওর নিজের পরিবারের কথা বলতো। ওর মায়ের কথা বলতো। ওর পরিবার বলতে শুধু ওর মা। ওর বাবা অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। অর্ণব তার মাকে খুব ভালোবাসে। মা’ই তার পৃথিবী।

অর্ণব নিজে টিউশনি করে নিজের খরচ চালায়। তার মাকেও হেল্প করে। তার মা গ্রামে থাকে। অর্ণব ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর ঢাকা চলে আসে। ওর মাকেও নিয়ে আসতো। তবে ঢাকা শহরে ঠিকে থাকা সহজ কথা নয়। অনেক টাকার ব্যাপার। অর্ণবের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। তবে সে একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছেলে হিসাবে একশোর মধ্যে একজন। ওর চলা ফেরা, কথা বলা, মাইন্ড সব কিছু আলাদা।

অর্ণবের আচরণে আমি আমার জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখেছিলাম। কিন্তু কেন আমাকে মুখ ফোটে বলতো না সেই কারণটা খুঁজে পেতাম না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, অর্ণব নিজের থেকে কখনও বলবে না “আমি তোমাকে ভালবাসি মীরা।”

তাই নিজেই কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেদিন ছিল ২৩ তারিখ। অর্ণবের বার্থ ডে। সেদিন আমি তন্বী আপুকে নিয়ে প্ল্যান করি। অর্ণব লোক দেখানো জিনিস পছন্দ করে না। যেমন, জন্মদিনে কেক কাটা। সাজানো এসব।

বাট কিছু নর্মাল জিনিসে অর্ণব অনেক খুশি হয়। তাই তন্বী আপুকে বলেছিলাম সে যেন অর্ণবকে নিয়ে মিরপুর নেভারল্যান্ড রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসে।

অর্ণবকে নিয়ে বসার মতো এর চেয়ে ভালো প্লেস আর পেলাম না। একদিন সন্ধ্যার দিকে অর্ণবের সাথে কার্জনহলের কাছে দেখা হলো আমার। অর্ণব টিউশন থেকে আসছিল। তাই ভাবলাম দুজন একটু বসে আড্ডা দেই। অর্ণবকে বললাম, চলুন আপনার কোনো কাজ না থাকলে কার্জন হলে বসি। অর্ণব কাজ নেই। তবে কার্জনে যাবো না।

অর্ণব নাকি আগে কখনও কার্জন হলে গিয়ে বসে নি। তার কার্জন হল পছন্দ না। তাই আমি একমতো তাকে জোর করেই নিয়ে গেলাম। বেচারা প্রথমে না করলেও আমার জন্য গিয়েছিল।

আমি আর অর্ণব মাঠের এক পাশে বসলাম। দুজন মুখোমুখি। সন্ধ্যা তখন নেমে এসেছিল। আকাশে তারা ভর্তি। আকাশের আলোয় চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার কিছুটা চলে গিয়েছিল।

বেশ রোমাঞ্চকর মোমেন্ট। চারপাশ হালকা আলোয় আলোকিত। ঠাণ্ডা বাতাস। আমার বেশ ভালো লাগছিল। তাও আবার প্রিয় মানুষটা পাশে বসে আছে। ভাল না লাগার কারণ নেই।

আমরা কথা বলছি। এমন সময় অর্ণব বলে,,
-মীরা চলো আমরা এবার উঠি। অর্ণবের কথায় আমি বেশ অবাক হলাম। বসলামেই তো ১৫-২০ মিনিট হলো না। আরেকটু বসলে ক্ষতি কি? আমি একটু আহ্লাদী হয়ে বললাম,,,,
-আরেকটু বসি। ভালই তো লাগছে। কিন্তু ততক্ষণে অর্ণব উঠে দাঁড়িয়ে গেছিল। আমিও অর্ণবকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,,,
-উঠলেন কেন? আরেকটু থাকি এখানে। ভালো লাগছে আপনার সাথে এই সন্ধ্যাটা। কিন্তু কি অদ্ভুত। অর্ণবের মুখ তখন ঘন অন্ধকারে চেয়ে গেছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না তার কারণ। অর্ণব বললো,,,,

– অন্য কোথাও বসি। এখানে না। কথাটা বলেই অর্ণব হাঁটতে লাগলো। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই আমার চোখ দুটো আটকে গেলো। আমি একটু ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম আমাদের পেছনেই একটা কাপল বসে আছে।

একজন আরেকজনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে লিপকিস করছে। সাথে সাথেই আমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। ওদের দেখেই বুঝা যাচ্ছিল ওরা কতটা উত্তেজিত ছিল। এরকম একটা পাবলিক প্লেসে?

মানুষ কি করে এতটা নোংরা হতে পারে। দুজন দুজনাতে বিভোর ছিল। অন্য দিকে তাদের খেয়াল নেই। ছেলেটা মেয়েটার শরীরে টাস করছিল। এসব দেখে আমার নিজের উপরেই রাগ লাগছিল।

লজ্জায় ঘৃণায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম অর্ণব প্রায় গেইটের সামনে চলে গেছে। আমি আমার চারপাশে তাকিয়ে দেখি এমন আরো কয়েকটা কাপল বসে আছে। কি সব বিশ্রী, জেনা কাজে লিপ্ত ওরা।

আমিও বের হয়ে এসেছিলাম। অর্ণবের পেছন পেছন ডিএমসি পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে আসলাম। ওর সাথে কথা বলার সাহস পেলাম না। ওও আমার সাথে একটাও কথা বলে নি। ডিএমসির সামনে এসে অর্ণব একটা চায়ের দোকানে দাঁড়ালো। আমি মাথা নিচু করে ওর পিছনে দাঁড়ালাম।

অর্ণব দুটো রং চা অর্ডার করলো। আমি নম্র সরে আস্তে করে অর্ণবকে বললাম,,,,
– আই য়্যাম সরি অর্ণব। আমি বুঝতে পারিনি। আমার অনুসূচনা হচ্ছিল। কিছু করিনি তবুও নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। অর্ণবও নর্মালি বলেছিল,,,,

– ইটস ওকে। তখন থেকে অর্ণবের সাথে এভাবে বসা হয়নি। এসব জায়গায় বসার কথা বলবো এটুকুও সাহসও আমার হলো না। তাই আজকে এই জায়গায় প্ল্যান করলাম। এখানে এরকম লুচু কাপল পাওয়া যায় না। আসলে কার্জনে অনেক রকম মানুষ আসে। বেশির ভাগেই এক কোয়ালিটির। আর কিছু কিছু ছেলে মেয়ের কাছে তো প্রেম মানেই ওসব নোংরা কাজ। এখানেও জোড়া কবুতর আছে। প্লেইসটা মুগ্ধকর। তবে নোংরামি এখানে কম। সবার সামনে বসে কিস করা, শরীরে টাস করা এসব নাই।

আজকে আমি প্ল্যান করেই এসেছি। অর্ণবকে প্রপোজ করবো। এমন ভাবে প্রপোজ করবো যাতে অর্ণব আমাকে ফিরিয়ে দিতে না পারে। এতদিন অর্ণবের সাথে থেকে আমি ওর নাড়ি নক্ষত্র কিছুটা হলেও জেনেছি। আজ সেগুলো কাজে লাগাবো।

নেভারল্যান্ডা আমার বিশেষভাবে পছন্দ হওয়ার কারণ, এখানে আমরা খেতে খেতে নদী দেখতে পারবো। নদীর পাশে এই রেস্টুরেন্টটা বেশ সুন্দর। খাবারও ভালো। প্রাকৃতিক ছোঁয়া আছে এখানে। অর্ণবের ভালো লাগবে এখানে বসে। ওর জন্যই সব।

চারপাশে সবুজে ঘেরা। গাছপালা ভরপুর। শীতল স্নিগ্ধ বাতাস। শব্দও কম। এক কথায় রেস্টুরেন্টা বেশ।

আমি অনেক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি। প্রায় এক ঘণ্টা। তন্বী আপু বা অর্ণব কারো কোনো খবর নেই। একা একা অপেক্ষা যে কতো কষ্টের সেটা আমি বুঝতেছি। তবে মনে মনে ভয়ও পাচ্ছি। শরীর শীতল হয়ে গেছিল। রীতিমত হাত পা কাঁপছে আমার।

মনে মনে দোয়া পড়ছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি। অর্ণব যেন আমাকে একসেপ্ট করে। নাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি পাইচারি করছি এমন সময় দেখি অর্ণব, তন্বী আপু আর তহিদ ভাইয়া।

তহিদ ভাইয়াকে দেখেতো আমি অবাক। তহিদ ভাইয়ার আসার কথা ছিল না। নিশ্চয় তন্বী আপু জোর করে নিয়ে এসেছে। তবে তন্বী আপু আগেই তহিদ ভাইয়াকে আমার আর অর্ণবের কথা বলেছিল।

তবুও আমার লজ্জা লাগছিল। ইশরে, তহিদ ভাইয়া কি মনে করে। ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। দেন তারা আমার কাছে চলে এসেছিল। তহিদ ভাইয়া আমাকে দেখে বললো,,,
-শালিকা, কেমন আছো।
-জ্বি ভাইয়া আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
-আমি সব সময় ভালো থাকি। তহিদ ভাইয়া হাসলো। বেশ রসিক মানুষ তিনি। সব সময় হেসে হেসে কথা বলবে। তহিদ ভাইয়াকে পার্সনালি আমার খুব ভালো লাগে।

তন্বী আপুও খুব ভালো। দুজন ভালো মানুষ কি সুন্দর করে একটা বাসা তৈরি করতে নেমেছে। আমিও অর্ণবকে নিয়ে এভাবে সুখে থাকতে চাই। তহিদ ভাইয়ার অনেক টাকা। অর্ণবের এতো টাকা নেই। কিন্তু সুন্দর, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একটা মন আছে। যা সবার থাকে না।

অর্ণব জানতো না আমি এখানে থাকবো। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,,,,
-তুমি এখানে? কখন এলে?? আমি দুহাত দিয়ে শাড়ির আঁচল মুচড়াচ্ছিলাম। তন্বী আপুর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললাম,,,,
-এক ঘণ্টা আগে।
-আমাকে তো বলনি তুমিও আসবে।
-ই,য়ে মানে। তন্বী আপু আমাকে বলতে না দিয়ে নিজে বললো,,,,
-আমি বলতে মানা করেছিলাম।
-কিন্তু কেন?
-তোকে সারপ্রাইজ দিবো তাই। অর্ণব একবার আমাকে ভালো করে দেখে বললো,,,
-সত্যি আমি সারপ্রাইজড। তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে শাড়িতে। ঠিক যেন অপ্সরী।
-থ্যাংকইউ।

আমরা একটা টেবিল বুক করলাম। একদম নদীর কিনারায় টেবিলটা। খুব সুন্দর প্লেসটা। আমি আর তন্বী আপু এক পাশে। ওরা দুজন অপর পাশে। অর্ণব আমার মুখোমুখি। অর্ণব আমাকে খুব করে দেখছিল। এত তীক্ষ্ণভাবে আগে কখনও তাকায়নি। অর্ণবের নেশা ভরা চোখে আমি নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। আমি মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। আজকে অর্ণবকে অচেনা লাগছে।

বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর তন্বী আপু আমাকে বললো,,,
-মীরা, তুই না অর্ণবকে কি বলবি? বলে ফেল এখন। অর্ণব অবাক হয়ে বললো,,,,
-মীরা আমাকে কি বলবে?
-আমি কি করে জানবো। সেটাতো মীরাই জানে। আমার বুক কাঁপছিল। আমারও ভয় করছিল। কথার মাঝেও জড়তা চলে আসছিল। তন্বী আপু এবং তহিদ ভাইয়া বললো,,,,
-মীরা বলো। এখন না বললে আর বলতে পারবে না। অর্ণব কোনো কথা বলছিল না। শুধু অবাক চোখে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে একটা লাল বড় গোলাপ ফুল বের করে অর্ণবের সামনে দিয়ে সাহস করে বলেই ফেললাম,,,,,
-” আমাকে আপনার মায়ের সেবা করার দায়িত্বটা দিবেন প্লীজ?? আমি আপনার মাকে নিজের মায়ের মতো করে যত্ন করবো।”

আমার কথা শোনে অর্ণবের চেহারার রং বদলে গিয়েছিল। অর্ণবের চোখ দুটো কেমন জানি হয়ে গেছিল। আমি তখন নিজের বোধ শক্তিটা হারিয়ে ফেলেছিলাম। অর্ণবের চোখের ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না কি বলে এই চোখ। তবে মনে হচ্ছিল আমি বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছি।

চলবে——–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here