#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ৭
🍂🍂🍂
~আপনি? আপনি এখানে?
নুরের প্রশ্নে অরণ্য হাসলো। গালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
কেনো আসতে পারি না?
শুভ্রতা এগিয়ে গিয়ে বললো,
এটা অবশ্যই আপনার মামার বাড়ি না? তবে কেনো আসবেন?
শুভ্রতার প্রশ্নে অরণ্য যেনো বোকা বনে গেলো। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। অরণ্যের বিপরীত চেয়ারে বসে বললো,
কি দরকার? ডেকেছেন কেনো?
শুভ্রতার প্রশ্নে অরণ্য নড়ে চড়ে বসলো। এতক্ষণে নুর ওরাও সবাই চেয়ার টেনে বসেছে। তিলোত্তমা রাজুকে কোল্ড ড্রিঙ্কস দিয়ে যেতে বলে নিজেও ওদের সাথে এসে বসলো। অরণ্য ওর পাশে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে বললো,
ও আহাদ
শুভ্রতা সাবলীল ভাবে বললো,
তো আমরা কি করবো?
শুভ্রতার এমন কথায় অরণ্যের পাশাপাশি এবার আহাদও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। নুর শুভ্রতাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,
হচ্ছেটা কি? এমন করছিস কেন?
শুভ্রতা “চ” শব্দ করে পুনরায় অরণ্যের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। অরণ্য অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
শ্রেয়াকে চেনো?
~কোন শ্রেয়া?
রিদিতার প্রশ্নে করুন চোখে তাকালো অরণ্য। এদের পরিচয় দিতে দিতেই না অর্ধেক দিন পার হয়ে যায় তা নিয়েই বেশ চিন্তিত সে। অরণ্য আহাদের দিকে তাকালো। শুভ্রতার উদ্দেশ্যে বললো,
তোমার সাথে একই স্কুলেই তো পড়তো। এই ভার্সিটিতেই তো পড়ে তোমাদের সাথে। তোমার ফ্রেন্ড।
শুভ্রতার ভ্রু কুঁচকে এলো। মাথা নুয়ে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ মাটির দিকে চেয়ে রইলো। রিদিতা বললো,
ওই যে সবসময় ক্লাসে চুপ করে বসে থাকে ওই মেয়েটার কথা বলছেন?
আহাদ এবারও অপ্রস্তুত ভাবে মাথা দুলালো। শুভ্রতা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
ও আমার বন্ধু নয়।
অরণ্য শুভ্রতার দিকে চেয়ে মিনিট দুয়েক চুপ থেকে বললো,
আহাদ শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ড।
উপমা সবে মাত্র কোল্ড ড্রিঙ্কস মুখে নিয়েছিল। অরণ্যের কথায় সে বিষম খেলো। মাত্রই মুখে নেওয়া কোল্ড ড্রিঙ্কস সব গিয়ে পড়লো রূপার গায়ে। রূপা ধমক দিতে গিয়েও চুপ করে গেল। কেননা আপাতত উপমার কাশতে কাশতে এমনিই শহীদ হওয়ার উপক্রম। উপমা কোনো মতে নিজেকে শান্ত করে অরণ্যের দিকে চেয়ে বললো,
কে কার বয়ফ্রেন্ড?
অরণ্য একটু নড়েচড়ে বসলো। এতগুলো মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলতে বেশ অসস্তি হচ্ছে। তারওপর এরা এভাবে প্রশ্ন করছে। অরণ্য গলার স্বর নামিয়ে বললো,
আহাদ শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ড।
উপমা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললো,
হ্যাহ! এই মাইয়া যেমনে চুপ থাকে ক্লাসে মনে হয় ভাজা মাছও উল্টায় খাইতে জানে না। এই মাইয়ার বয়ফ্রেন্ডও আছে? তাও এত সুন্দর?
শুভ্রতা বিরক্ত হয়ে বললো,
শ্রেয়াও মাশাহআল্লাহ কম সুন্দরী নয়। যাই হোক, অরণ্য ভাইয়া? ওর বয়ফ্রেন্ড এর কথা আমাদের বলার কারণ কি?
~আসলে… (অরণ্য)
~আসল নকল পরে। আগে বলুন তো!
নুরের কণ্ঠ কর্ণপাত হতেই মাথা নুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো অরণ্য। মেয়েটার কণ্ঠ তার হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়। অসম্ভব ভালোলাগা কাজ করে তার মনে। আহাদ অরণ্যের অবস্থা দেখে হতাশার শ্বাস ফেললো। বন্ধু ওর প্রেমকে বাঁচাতে এসে নিজের প্রেয়সীর চক্করে পড়ে লজ্জা রাঙা হয়ে বসে আছে। আহাদ বললো,
আসলে আপু! শ্রেয়ার বাবা ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি। ওর বাবা মা ওকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে।
~আমরা কি করতে পারি এতে? আমি যতটুকু জানি আমাদের মধ্যে কেউ কাজী না। (শুভ্রতা)
~আপনি তো বড্ড বেশি কথা বলেন। কাজীর কাজ কাজী করবে। আপনার দায়িত্ব অন্য একটা।
বলতে বলতেই শুভ্রতার পাশের চেয়ারে গা এলিয়ে বসলো চন্দ্র। শুভ্রতা তার দিকে তাকালে সে ভ্রু নাচালো। শুভ্রতা কপাল কুঁচকে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতেই চন্দ্র নিঃশব্দে হাসলো। অরণ্য সস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
ভাগ্যিস এলি। এতো দেরি করলি কেনো?
চন্দ্র শুভ্রতার হাত থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস কেড়ে নিয়ে তাতে এক চুমুক দিয়ে বললো,
টানা তিনটা অপারেশন করতে হয়েছে আজ। আমি টায়ার্ড। সোজা বাসায় যেতাম। আহাদের জন্য আসতে হলো।
শুভ্রতা চেঁচিয়ে বললো,
ওটা আমার কোল্ড ড্রিঙ্কস।
চন্দ্র আরেক চুমুক দিয়ে বললো,
এখন এটা আমার।
~আমি ওটায় মুখ লাগিয়ে খেয়েছি। আপনি ওটায় মুখ লাগাচ্ছেন কেনো? দিন আমাকে। তিলো? ওনার জন্য অন্যটা অর্ডার কর।
তিলোত্তমাকে বাধা দিয়ে চন্দ্র হাতে থাকা বোতলটি ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
বোতলেই তো মুখ লাগিয়েছি। আপনার ঠোটে তো আর লাগাইনি। এতো রেগে যাচ্ছেন কেনো?
চন্দ্রর কথায় একরাশ অসস্তি নিয়ে চুপ করে বসে রইলো শুভ্রতা। বিড়বিড় করে বললো,
ঠোঁটকাটা বাঁদর! লাজলজ্জা কিছুই নেই। সবার সামনে কি বললো এটা! ছি!
শুভ্রতার পাশে চন্দ্র বসায় তার কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো সে। মাথা নিচু করে সকলের অগোচরেই মৃদু হাসলো চন্দ্র। সোজা হয়ে বসে বললো,
শ্রেয়া আর আহাদ পালিয়ে বিয়ে করবে, বন্ধু হিসেবে আমাদের উচিত সাহায্য করা।
~তো আপনারা করান গিয়ে। আমাদের বলছেন কেনো? (রিদিতা)
~ভাবছি শ্রেয়াকে নিয়ে এসে ওর জায়গায় বিয়ের পিঁড়িতে আপনাকে রেখে আসবো। (চন্দ্র)
~কিহ! (রিদিতা)
~শ্রেয়ার মা বাবা শুভ্রতাকে ছোট থেকেই চিনে। আর তাদের কাছে শুভ্রতা অত্যাধিক ভদ্র স্বভাবের মেয়ে। আর তাদের প্রিয় পাত্রীও সে ই। (আহাদ)
শুভ্রতা কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো। রূপা বললো,
দুনিয়ায় আর কারো মা বাকি আছে যে কিনা তোকে পছন্দ করে না?
শুভ্রতা রূপার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে জোরপূর্বক এক হাসি উপহার দেয়। নুর রূপার পক্ষ নিয়ে বলে,
ঠিকই বলেছে ও। সব বন্ধু-বান্ধবের মা ই দেখি তোকে বেশ পছন্দ করে আবার বিশ্বাসও করে।
শুভ্রতা থমথমে কণ্ঠে বললো,
প্রথমত, শ্রেয়া আমার বন্ধু না। দ্বিতীয়ত, সবার মা আমাকে কেনো বিশ্বাস করে আমার জানা নেই।
~এত কিউট চেহারা হলে যে কেউ গলে যাবে।
চন্দ্রকে বিড়বিড় করতে দেখে শুভ্রতা বললো,
কিছু বললেন?
~হ্যাঁ! না মানে কেনো নয়? শ্রেয়া আপনার বন্ধু নয় কেনো?
~বললেই তো সবাই বন্ধু হয়ে যায় না। এক সাথে পড়েছি আর ওকে চিনি তার মানে এই না যে ও আমার বন্ধু।
~কিন্তু শ্রেয়া যে বললো তোমরা ওর বন্ধু? (আহাদ)
শুভ্রতা জবাব দিলো না।
~ওর বিয়ে কখন? (তিলোত্তমা)
~৩ দিন পর। তোমাদের বাসায়ও তো কার্ড পাঠিয়েছে। জানো না? (অরণ্য)
নুর জিভ কামড় দিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললো,
মা বলেছিল হয়তো। আমার খেয়াল নেই।
~আচ্ছা! ওদের মা বাবাকে মানানো যায় না? এভাবে পালিয়ে বিয়া করা কি ঠিক হবে? কষ্ট পাবে না ওর মা বাবা? (তিলোত্তমা)
~অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার মা বাবা নেই বলে তারা বিয়ে দিতে নারাজ। শ্রেয়ার ভাইও আমাদের হেল্প করবে বলেছে। (আহাদ)
~ব্যাপারটা সুন্দর তো! (রিদিতা)
~তাই নাআআ?
নুরের কথায় লাজুক হাসলো রিদিতা। শুভ্রতা তিলোত্তমা আর নুরের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচাতেই ওরাও ভ্রু নাচালো। শুভ্রতা ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে চেয়ে থেকে জানালো,
এসবে আমি নেই সরি।
রূপা বললো,
একদম! আমিও নেই। বাঁশ খাওয়ানোর প্ল্যানিং যতসব।
~ওরা একে অপরকে খুব ভালোবাসে। (অরণ্য)
শুভ্রতা ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
এসব প্রেম করার আগে অবশ্যই মনে রাখা উচিত ছিলো। প্রেম করার সময় পরিবার কি মঙ্গল গ্রহে ঘুরতে যায়? বিয়ের ব্যাপার এলেই পরিবারের নামে আজাইরা প্যানপ্যানানি।
শুভ্রতার কথায় ওরা নির্বাক হয়ে গেলো। আহাদের করুন চাহনী শুভ্রতার দৃষ্টি গোচর হলো না। কিন্তু সে আপাতত এসবে জড়াতে চাইছে না। সে চাইলেও তার মন টানছে না এসবে। নুর বললো,
গিয়ে দেখি চল না।
~তোর ইচ্ছে হলে তুই যা। তোদের ধরুক আর না ধরুক মেয়ে ভাগলে সবার আগে ওর খান্দান আমাকেই চেপে ধরবে। যেহেতু আমাকে তার ছোট বেলার ফ্রেন্ড বলে রেখেছে। (শুভ্রতা)
একটু থেমে অরণ্যের দিকে চেয়ে আবার বললো,
আমার সাহায্য করতেও সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ওর সারা গুষ্টি মিলে যে বসে বসে ঘণ্টা কয়েক লেকচার দিবে তা আমার ভালো লাগবে না। এতো ঝামেলার থেকে ভালো বাড়িতে পড়ে ঘুমাই।
শুভ্রতা উঠে দাড়ালো। নুরদের উদ্দেশ্যে বললো,
তোদের যদি ইচ্ছে থাকে তবে অবশ্যই যা। আমি যাচ্ছি না বলে বসে থাকিস না।
নুর কিছু একটা বলতে চাইলেও শুভ্রতা তার অপেক্ষা করলো না। ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো।
শুভ্রতা যেতেই চন্দ্রও চেয়ার ছেড়ে দাড়ালো। নুরদের জিজ্ঞেস করলো ওরা সাহায্য করবে কি না। ওরা জানালো শুভ্রতা না গেলে ওরাও যাবে না। চন্দ্র বললো,
শুভ্রতা আসবে, আপনারাও রেডী থাকবেন। ৩ দিন পর বিকেল ৫ টায়। আমি ঠিকানা জানিয়ে দিবো।
____________________________________
~বাবাআআআ!!!!!
বাবাকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নুর। ব্যবসা বাণিজ্য সব ময়মনসিংহ কিন্তু নুরের ভার্সিটি ঢাকায় হওয়ায় এখন প্রায়ই তার যাতায়াত এখান থাকে ওখানে চলতেই থাকে। মা নুরের সাথেই থাকছে। আর নীরা আপাতত চাচার বাড়ীতে থাকছে। এতদিন পর বাবাকে দেখতেই নুর যেনো খুশিতে আটখানা হয়ে গেলো।
~কখন এসেছো? আমাকে বলোনি কেনো?
মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখে নুরুজ্জামান হাসলেন। এ এক প্রশান্তির হাসি। সন্তানকে হাসি খুশি দেখতে পৃথিবীর প্রায় সব মা বাবাই চায়। তিনিও ব্যতিক্রম নন। নুরুজ্জামান বিস্তর হেসে বললেন,
দুপুরে এসেছি। শুনলাম তুমি ভার্সিটিতে গেছো তাই আর ডিস্টার্ব করিনি।
নুর ঠোঁট বাকালো। সে মোটেও ব্যস্ত ছিলো না, সে তো ক্লাস শেষে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো। সে তার বাবাকে মিথ্যা বলতে চাইলো না। পৃথিবীর সবথেকে বিশ্বস্ত মানুষটির বুকেই মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলো।
~ব্যস্ত ছিলাম না বাবা। ক্লাস শেষে বান্ধবীদের নিয়ে ক্যাম্পাস এ বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
নুর না থেমেই আবারও বললো,
তুমি কল দিলে ভালো হতো। দেখতে ফাজিলগুলো তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে বাড়িতে এসে হাজির।
নুরুজ্জামান মেয়ের কথায় গা দুলিয়ে হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
তুই যেমন পাগলী তেমন তোর বান্ধবীগুলোও পাগলী স্বভাবের।
___________________________________
~চল না রে ভাই! (নুর)
শুভ্রতা এবার ধমকে উঠলো। সকাল থেকে এই এক কথা শুনতে শুনতে সে চরম বিরক্ত। ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
সমস্যা কি তোর? কতবার বলেছি আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই!
নুর মুখখানা মলিন করে তাকালো। শুভ্রতা কিছুটা রাগী হলেও খুব সহজে ধমক দেয় না। শুভ্রতার এমন ধমকে তার যেনো আত্মা দেহ ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিয়ে বসেছিল। তিলোত্তমা অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললো,
রেগে যাচ্ছিস কেনো? আমরা কেনো বলছি তা নিশ্চয় তোর অজানা নয়।
শুভ্রতা ফোঁস করে দম ছাড়লো। মাথা চেপে মিনিট দুয়েক এর মত বসে রইলো। মৃদু স্বরে বললো,
সরি ঝাড়বাতি!
নুর জবাব দিলো না। প্রচন্ড অভিমানে বাড়ি চলে এলো। বাড়ি বসে ঠিক করলো শুভ্রতাকে ছাড়াই যাবে তারা। নুরের কথামতো রিদিতা, রূপা আর উপমাও রাজি হলো। তিলোত্তমা যেতে না চাইলেও শুভ্রতা জোর করে বললো নুর ওরা গেলে যেনো সেও যায়। অবশেষে তিলোত্তমারও ওদের সাথে যেতে হলো।
~~~
চলবে~
(গল্প পড়ে অনেকেই রিয়েক্ট দেন না, কমেন্টসও করেন না। এতে আমি বুঝবো কি করে যে লেখাটা পাঠক/পাঠিকার ভালো লাগছে কিনা? অবশ্যই গঠনমূলক কমেন্টস করবেন। হ্যাপি রিডিং~)