চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ১০

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ১০

🍂🍂🍂

গাড়ি চলছে তার আপন গতিতে। নুরের খুব ইচ্ছা হলো জানালার কাঁচটা নামিয়ে দিতে কিন্তু বাবার ভয়ে তা আর করা হলো না। আবারো কানে হেডফোন গুজে সিটে গা এলিয়ে বসলো। অজানা কারণেই আজ শুভ্রতার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। ইচ্ছা করছে শুভ্রতাকে কল করে তার সাথে কথা বলার। কিন্তু সে এমন করলো না। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রেখে বসে রইলো কিছুক্ষণ। ফেসবুকে ঢুকে সার্চলিস্টে তিনজন মানুষের আইডি স্ক্রিনে ভেসে উঠলে নুর এক ধ্যানে দ্বিতীয় আইডিটার দিকে চেয়ে রইলো। পরক্ষনেই সর্ব প্রথমে থাকা শুভ্রতার প্রোফাইলে ক্লিক করলো। অ্যাড থাকলেও তাদের কথা হয় না বছর খানেক। কিন্তু প্রায়ই শুভ্রতার প্রোফাইলে এসে ঘুরঘুর করে সে। শুভ্রতার নতুন পোস্টটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো সে,

“আমার বিদায় বেলায় আকাশটা হোক মেঘাচ্ছন্ন। চারদিকে গুমোট পরিবেশ, থেমে থেমেই বৃষ্টি পড়ুক ঝমঝমিয়ে। প্রিয় মানুষগুলো ছুটে আসুক আমার বাড়িতে। বৃষ্টির ফোঁটা আমার কাফনে পড়তেই বিচলিত হয়ে আমাকে ঢাকার চেষ্টা করুক স্বজনেরা। কেউ কেউ ছুটে আসবে দীর্ঘ সময়ের মনোমালিন্য ভুলে। তীব্র আফসোসে তখন বুক ভার হয়ে আসবে, মনের মাঝে দলা পাকাবে হাজারো না বলা কথা। পাশাপাশি বসে আর কখনো আলাপ করা হবে না নিজ নিজ মনে জমিয়ে রাখা সকল অভিযোগ নিয়ে। তীব্র আফসোসে তার মনটাও কেঁদে উঠুক। আমার উঠানে লাগানো ফুল গাছটাও ঝড়ো বাতাসে ফুল ঝরিয়ে আমাকে বিদায় জানাক। আগরবাতি আর ফুলের ঘ্রাণে তৈরি হোক অতি বিষন্ন এক পরিবেশ। প্রিয় বান্ধবীটার গাল গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণাগুলো বৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে যাক অতি সন্তপর্নে। প্রতিবারের মতো হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে না দেওয়ায় কাছের মানুষটাও একটু অভিমান করুক। সারাজীবন সাথে না থাকতে পারার আক্ষেপ নিয়ে আমিও বলে উঠি “ভালো থেকো প্রিয়, নিজের যত্ন নিও”।
~শুভ্রতা”

পোস্টটা পড়তেই নুরের বুকটা কেমন ধক করে উঠলো। কেউ যেনো তার হৃদপিন্ডটাকে খামচে ধরে রেখেছে। নুরের মনে হলো সে শ্বাস নিতে পারছে না। দ্রুত জানালার কাঁচ নামিয়ে জানালার বাহিরে মুখ বের করে বসলো নুর। চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগলো। চোখের কোণে জলের অস্তিত্ব বুঝতে পারলো সে। অতি সন্তপর্নে তা মুছেও নিলো। বাবা দেখলে যদি কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে তবে কি জবাব দিবে সে? নুর পোস্ট এর সময়টা দেখলো। ১ দিন আগে পোস্ট করেছে। নুর পোস্টটা আবারো পড়লো, বারবার পড়লো। সরব ই মনে এলো অরণ্য ওরা কি শুভ্রতার এই পোস্টটাও দেখেনি? দ্রুত রিয়েক্ট লিস্ট চেক করে দেখলো অনেক মানুষ রিয়েক্ট দিলেও আজও শুভ্রতার পোস্টে অরন্য, তিলোত্তমা ওদের কোনো রেসপন্স নেই। তবে কি তাদের সাথে শুভ্রতার সম্পর্ক শেষ? নুরের মন চাইলো সে এখনি শুভ্রতাকে মেসেজ দিবে। কিন্তু কি বলবে? সময়ের বিবর্তনে সম্পর্কে এতটাই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে যে এখন “কেমন আছিস” টেক্সট করতেও হাত কাপছে! বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও নুর পারলো না মেসেজ করতে। অবশেষে হাল ছেড়ে সিটে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। ডুব দিলো আবারো সেই অতীতে…

🍂 অতীত 🍂

~কিরে বাল! ওরা আসছে না কেনো এখনও?
উপমার কথায় রিদিতা বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। এই নিয়ে পনেরোবার হলো সে এই প্রশ্ন করেছে। নুর আঙুল উচিয়ে দেখিয়ে বললো,
ওই তো আসছে।
নুর, রিদিতা, উপমা আর রুপা সেদিকে তাকালো। তিলোত্তমার হাতটা বাম হাতে শক্ত করে ধরে শুভ্রতা ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হয়ে ওদের কাছেই আসছে। নুর দ্রুত মুহুর্তটা ক্যামেরা বন্দী করলো। উদ্দেশ্য শুভ্রতার জন্মদিনে অনেকগুলো ক্যান্ডিড ছবি একত্রে করে একটা অ্যালবাম গিফট্ করা। শুভ্রতারা ওদের কাছে আসতেই রিদিতা বললো,
এতো দেরি লাগলো কেনো? কোথায় ছিলি?
~তোর জন্য মোটা, টাকলা, ভুঁড়ি ওয়ালা বিসিএস ক্যাডার ছেলে খুঁজতে গিয়েছিলাম। অনেক দিন হলো বিয়ের দাওয়াত টাওয়াত পাই না। শ্রেয়ার টা পেয়েছিলাম কিন্তু দাওয়াত আর খাওয়া হলো না। তাই ঠিক করেছি তোকেই জোর করে বিয়ে দিবো। (শুভ্রতা)
~তোর মাথায় যতসব উল্টা পাল্টা চিন্তা ভাবনা ঘুরে কেনো!
রিদিতার কথায় শুভ্রতা ফিচেল হেসে বললো,
কারণ আমার বান্ধবী সবকটা পাগল। আর আমার দশা হয়েছে “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে” টাইপ।
~আমরা পাগল? তুই আমাদের পাগল বললি! (নুর)
~যেভাবে চিৎকার দিলি তাতে যে কেউ বলে দিবে তুই সার্টিফাইড পাগল।
নুর গাল ফুলাতেই শুভ্রতা আবার বললো,
শুন না! অনেক দিন কোনো টুরে যাই না।
~তো? আমি কি করবো? (নুর)
~তুই তো সার্টিফাইড পাগল। তোকে পাবনা ভর্তি করানোর চক্করে একটু ঘুরা হবে। চল তোকে পাবনা নিয়ে যাই।
শুভ্রতার কথায় নুর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। শুভ্রতাকে মারতে নিতেই শুভ্রতা তিলোত্তমার পেছনে গিয়ে লুকালো। চোখে কৃত্রিম ভয় ফুটিয়ে বললো,
দৌড়ানি দিবি না খবরদার! শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারি না। দৌড়াতে গিয়ে যদি উষ্টা খেয়ে শাড়ি খুলে পড়ে যায় তখন কি এক সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার হবে জানিস তুই!
___________________________________

~তুই না পহেলা বৈশাখে আসবি বলছিলি? আবার তারিখ ঘুরালি কেনো?
শুভ্রতার পাশে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো নুর। শুভ্রতা তখনও রিদিতাদের ছবি তুলে দিতে ব্যস্ত। নুরের প্রশ্নে জবাব না দিয়ে রিদিতাকে ডেকে বললো,
ছবি ঠিকাছে কিনা দেখ।
রিদিতা জানালো দেখার প্রয়োজন নেই। বাড়ি গিয়ে একেবারে দেখবে। শুভ্রতা রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আবারো ছবি গুলো চেক করতে বলতেই রিদিতা এসে ফোনটা নিয়ে গেলো উপমা ওদের কাছে। রিদিতা যেতেই শুভ্রতা নুরের দিকে ঘুরে তাকালো। ~এবার বল। কি বলছিলি?
~পহেলা বৈশাখের বদলে আজকে আসার প্ল্যান করলি কেনো?
শুভ্রতা রিদিতাদের দিকে ইশারা করে বললো,
~বৈশাখের দিন এলে এভাবে ছবি তুলতে পারতাম আমরা? পা ফেলার জায়গা পেতি এই এলাকায়?
~আসলেই তো!
~আজকে আসার আরেকটা কারণ আছে।
নুর প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে তাকাতেই শুভ্রতা পেছনে তাকাতে ইশারা করলো। নুর বুঝলো না এই ইশারার মানে। বললো,
~কি?
শুভ্রতা নুরকে ধরে পেছনে ঘুরাতেই সে অবাক হলো। অবাকতার বশে কোথাও হার্ট এ্যাটাক করলেও হয়তো ব্যাপারটা অস্বাভাবিক হবে না। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
অরণ্য?
পেছন থেকে শুভ্রতা বললো,
অরণ্য ভাইয়াকে তো আমিই ডেকেছি কিন্তু এই ভরদুপুরে চন্দ্র কোথা থেকে উদয় হলো? নিশ্চিত আমাকে জ্বালাতে এসেছে!
~এই! এই! ওটা অরণ্য আর আহনাফ ভাইয়া না?
রিদিতার প্রশ্নে বিরক্তি নিয়ে তাকালো নুর। কতো মোহিত হয়ে তার ক্রাশকে দেখছিল সে। মাঝে এসে এই মেয়ে তার ঘোর ভেঙে দিলো! ব্যঙ্গ কণ্ঠে বললো,
কই না তো! ওটা তো টাকলা মুরাদ।
~হ্যাহ? আমিও তো অরণ্য ভাই আর আহনাফ ভাইকেই দেখছি। তুই টাকলা মুরাদ কে কই পেলি? (উপমা)
~আমিও তো তাই বলি। (রিদিতা)
নুর বিরক্ত হয়ে আর জবাব দিলো না। তিলোত্তমা উপমার মাথায় চাটি মেরে বললো,
তোদের অকারনেই শুভ্রতা গর্দভের নানি বলে না।
~হাই! কেমন আছো তোমরা?
অরণ্যের প্রশ্নে লাজুক হাসলো নুর। জবাব দিলো,
আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছে?
অরণ্য জবাব দিতে নিলেই শুভ্রতা চেঁচিয়ে বললো,
অরণ্য ভাইয়া! আমি আপনাকে ক্যামেরাম্যান হিসেবে আসতে বলছি। আপনি দেখি সাথে অ্যাসিস্ট্যান্টও নিয়ে আসছেন। তা আর কাউকে পাননি অ্যাসিস্ট্যান্ট বানানোর জন্য?
চন্দ্র ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
কে অ্যাসিস্ট্যান্ট? আমি?
শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে বললো,
জ্বি, আপনি।
~অ্যাসিস্ট্যান্ট একটা আনেনি বরং দুটো এনেছে।
তিলোত্তমার কথায় চন্দ্রের সাথে তর্ক থামিয়ে শুভ্রতা বললো,
দুই নাম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট আবার কে?
~ওই যে আসছে।
তিলোত্তমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে চেয়ে দেখলো মাহতাব আসছে। ওদের এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
কি হয়েছে? এভাবে চেয়ে আছো কেনো সবাই?
~তুই যে নতুন চাকরি শুরু করলি জানাসনি কেনো?
চন্দ্রের প্রশ্নে অবাক হলো মাহতাব। অবাক স্বরে বললো,
আমি আবার কি চাকরি শুরু করলাম ভাই?
~আমার দুই নাম্বার অ্যাসিস্ট্যান্ট এর চাকরি।
অরণ্যের কথায় দ্বিগুণ অবাক হয়ে তাকালো মাহতাব। সে আবার কবে অ্যাসিস্ট্যান্ট এর চাকরি নিলো? চোখ বড় বড় করে বলল,
~তুমি তো ডাক্তার, তার মানে ডাক্তার এর অ্যাসিস্ট্যান্ট? আমার তো রক্ত দেখলেই মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবো যাবো ভাব হয়ে যায়। আমি আবার ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট হবো? পাগলে পেলো নাকি তোমাকে? বাই দ্যা রাজপথ, আমি দ্বিতীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট হলে প্রথমজন কে?
চন্দ্র মাহতাবের কাধে হালকাভাবে দুটো চাপড় মেরে নিজেকে দেখিয়ে বললো,
এই যে আমি।
~তুমি না হার্ট সার্জন? আর অরণ্য ভাই নিউরোসার্জন। তুমি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হও কিভাবে? (মাহতাব)
~যেভাবে তুই হয়েছিস। (চন্দ্র)
~আমি আবার অ্যাসিস্ট্যান্ট হলাম কি করে? (মাহতাব)
~যেভাবে আমি হয়েছি।
মাহতাব এবার ধপাস করে ঘাসের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। মাথায় হাত দিয়ে বললো,
এ মেরেকো চাক্কার এনে লাগি হে রে…
মাহতাবের অবস্থা দেখে সকলে এক সাথে হেসে উঠলো। শুভ্রতা নুরকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
আজ তোর আর অরণ্য ভাই এর এক সাথে ছবি তুলে দেবো নে। তুই ফেসবুকে আপলোড দিয়ে ক্যাপশন দিস “মি এন্ড মাই ক্রাশ”। আমি লাভ রিয়েক্ট দিবো নে। আর সবাই কমেন্টস করবে।
নুর অবাক হয়ে তাকালো। এই মানুষটার সাথে তো কথা বলতে গেলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় সে। ছবি তুলতে গেলে যে বেহুঁশ হয়ে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। দেখা যাবে পর দিন খবরের পত্রিকায় হেডলাইন হলো “ক্রাশের সাথে কার্জন হলে ছবি তুলতে গিয়ে খুশিতে বেহুঁশ হয়ে গেলো এক সুন্দরী তরুণী”। তখন সে লজ্জায় মুখ দেখাবে কি করে? মন থেকেই যেনো জবাব এলো “মাস্ক পড়িস, সমস্যা নেই”।
~~~
চলবে~
(বানান ভুল হলে অবশ্যই জানাবেন। হ্যাপি রিডিং~)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here