চিত্তদাহ লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা পর্ব ১৪

#চিত্তদাহ
লেখনীতে : শুভ্রতা আনজুম শিখা
পর্ব ১৪

🍂🍂🍂

বন্ধুমহল, প্রিয় মানুষ আর পরিবারের সাথে বেশ ভালোই সময় কাটছে নুরের। এই মুহূর্তে সে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের তালিকায় খুজে পাচ্ছে। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা, অরণ্যের যত্ন, ভালোবাসা আর পরিবারের সকলের ভালোবাসায় আজ তার জীবনটাও যেনো পূর্ণতা পেয়েছে। মাঝে মাঝে আনমনেই আবার নিজেকে প্রশ্ন করে সে “এই সুখ সইবে তো?”। তখনি তার মন যেনো প্রতিবাদী হয়ে বলে উঠে “সইবে না কেনো? অবশ্যই সইবে”। আজ ভার্সিটিতে ক্লাস নেই। বন্ধুমহলের সাথে আজ বাহিরে যাওয়াও হবে না। শুভ্রতাকে ডাকতেই জানালো সে নাকি ব্যস্ত। নুরের অভিমান হলো, মেয়েটা ইদানিং কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে। খুব একটা কথা বলে না, ভার্সিটিতেও ঠিকঠাক আসে না। কল দিলেই বলে “ব্যস্ত আছি, সময় হলে জানাবো”। নুরের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে “সময়টা কবে আসবে শুনি?”। শুভ্রতার উত্তরটাও তার জানা “খুব শীঘ্রই”।
~নুর! তোর চাচী আম্মা কল দিয়েছিলো। গলির মোড়ে আছে। রেডী হস নি এখনো?

ঘরে আসতেই মেয়েকে দেখে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলেন নিতা। মেয়েকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কলাপাতা রঙের শাড়ি, এক পাশে বেণী, কানে ঝুমকা, মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া, হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি। “শাড়িতে সব নারীকেই সুন্দর লাগে” কথাটা আপাতত একদম চিরন্তন সত্য বলে মনে হলো তার কাছে। তার মা যে তার সামনে দাড়িয়ে আছে সেদিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই নুরের। সে চিন্তায় মশগুল শুভ্রতার হটাৎ পরিবর্তন দেখে। মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙলো নুরের।

~মা শাহ্ আল্লাহ! তোকে খুব সুন্দর লাগছে নুর। এদিকে আয়।
নুর এগিয়ে যেতেই তিনি আয়াতুল কুরসী পড়ে মাথায় ফু দিলেন। নুর চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রইলো। মায়ের কাজে মুচকি হেসে মা কে জড়িয়ে ধরলো। নিতা নুরকে দ্রুত নিচে আসতে বলে যেতে নিলেই ফিরে নুরের কাছে এলেন।

~এই শাড়িটা কবে কিনলি?

নুর ঠোঁট কামড়ে মায়ের দিকে তাকালো। কি জবাব দিবে সে? অরণ্য দিয়েছে বলবে? যদি মা জিজ্ঞেস করে “অরণ্য কে?” তখন কি জবাব দিবে? অরণ্য তার প্রেমিক? নুরের বেশ আফসোস অনুভব হলো। সে কেনো শুভ্রতার মতো স্পষ্টভাষী আর ঠোঁটকাটা স্বভাবের হলো না? পরিণাম এর পরোয়া না করে ফট করে জবাব দেওয়াটা শুভ্রতার থেকে শেখা উচিত ছিল তার। তাহলে হয়তো এখন এত অস্বস্তি বোধ করতো না। ওর জায়গায় শুভ্রতা থাকলে হয়তো সাথে সাথে জবাব দিতো “অরণ্য, আমার বয়ফ্রেন্ড গিফট্ করেছে। সুন্দর না!”। নুরের জানতে ইচ্ছে হলো তখন মায়ের রিয়াকশনটা কেমন হতো? নিশ্চয়ই অনেক বেশি অবাক হতো? সকল ভাবনা এক পাশে রেখে নুর জবাব দিলো,
ওইদিন যে পার্সেল এলো দেখোনি? এই শাড়ি এইগুলোই তো এসেছিলো।
~তোর পছন্দ দেখি দিন দিন শুভ্রতার মতো ভালো হচ্ছে? যাক ভালো। মেয়েটার সাথে থেকে যদি কিছু খারাপ দিক পরিবর্তন হয় তোর।

নুর চোখ পিট পিট করে মায়ের যাওয়া দেখলো। সে বেশ দ্বিধায় পড়লো। বান্ধবীর প্রশংসায় খুশি হবে নাকি মায়ের থেকে সেকেন্ড হ্যান্ড অপমান লাভ হওয়ায় দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে ঘুরবে? আজকাল দুঃখী ভাব নিয়ে ঘুরলেই মানুষ ভাবে ব্রেক আপ হয়েছে। কান্না করতে কিংবা মন খারাপ দেখলেই আন্দাজে বলে উঠে “ওর নির্ঘাত ব্রেক আপ হয়েছে”। আরে বাবা! মানুষ শুধুমাত্র কি ব্রেক আপ হলেই মন খারাপ করে? পারিবারিক অনেক কারণই তো আছে যার কারণে মানুষের মন খারাপ হয়, কষ্ট পায়। অনেক সময় বন্ধুত্বে বিচ্ছেদের কারণেও কষ্ট পায়। এখনকার জমানায় মন খারাপ দেখলেই “ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গেছে” ট্যাগ দিয়ে মানুষ ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়ায়। অদ্ভুত! নুরের এই ট্যাগ পাওয়ার কোনো ইচ্ছে হলো না তাই সে শুভ্রতার প্রশংসায় খুশি হওয়ার আইডিয়াটাকেই বেস্ট মনে করলো।
__________________________________

রাত ১.২৫ মিনিট। নুর ফোন হাতে নিয়ে ভাবছে এতো রাতে কল দিবে নাকি দিবে না। অরণ্য যদি ঘুমিয়ে থাকে? নুরের চিন্তার মাঝেই অরণ্যের কল এলো। নুর হকচকিয়ে তাকালো ফোনের দিকে। দ্রুত রিসিভ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। দুজনেই নিশ্চুপ। একজনের মুখেও কথা নেই। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
কেমন আছো?
~আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি?
~আলহামদুলিল্লাহ্। রাতে খেয়েছো?
~হ্যাঁ। আপনি খেয়েছেন?
~না।
~কেনো? রাতের কয়টা বাজে খেয়াল আছে?
অরণ্য চুপ রইলো দীর্ঘ সময়। জবাব দিলো না। টানা কয়েক মিনিট ফোনের ওপর প্রান্তে থাকা প্রেয়সীর নিশ্বাসের শব্দ শুনলো চোখ বন্ধ করে। নুর বেশ কয়েকবার ডাকার পর নিজেও চুপ করে বসে রইলো। তারপর নিজেই মৌনতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো,
শুভির সাথে কথা হয়েছিল আপনার?

ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন এলো,
কেনো?

নুর উদাসীন চোখে আকাশের দিকে তাকালো। বললো,
আজ তো বন্ধ ছিল এমনিও। তাছাড়া তিনদিন যাবৎ মেয়েটা ভার্সিটিতে আসছে না। কল দিলে ধরে না। শুধু একটা মেসেজ দিয়েছিল “ব্যস্ত আছি” বলে। বাড়ি গিয়েছিলাম দারোয়ান কাকা বললো “বাড়িতে কেউ নেই”। ওর নানি বাড়ি গেলেও রেনু আপাকে বাসায় রেখে যায়। এবার নাকি রেনু আপাও বাড়ি নেই। কি হয়েছে আল্লাহ মালুম।
~আচ্ছা নুর? শুভ্রতা কি কখনো তোমাকে মিথ্যা বলেছে? কিংবা কখনো কোনো কথা লুকিয়েছে?
নুরের নিঃসংকোচ জবাব,
~না
~তুমি এত সিওর কি করে?
~শুভি অনেক ব্যাপারই আমাদের সাথে শেয়ার করে না। যদি কোনো ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি সে সত্যিটাই বলবে। যদি না বলতে চায় তবে সোজাসুজি জানিয়ে দেয় সে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয়। ওকে আমি কখনো মিথ্যা বলতে দেখিনি।

নুরের কথা অরণ্য মন দিয়ে শুনলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
তবে বিশ্বাস রাখো সময় হলে সে নিজেই এসে বলবে। চিন্তা করো না। ঘুমাও এখন। আমি রাখছি। নিজের যত্ন নিও।
~আচ্ছা। আপনিও নিজের যত্ন নিবেন।
~হু

🍂🍂🍂

ভার্সিটির মাঠে গোল হয়ে বসে আছে নুর, তিলোত্তমা, উপমা, রিদিতা আর রুপা। তাদের চিন্তার বিষয় আজ চারদিন যাবৎ শুভ্রতা ভার্সিটি আসছে না। এমনকি বাড়ির কেউই কল ধরছে না। বাড়ির দারোয়ান চাচাকে কল করলে জানায় “তারা বাড়িতে নেই”।
~মেয়েটা গেলো কোথায়? এতদিন তো এভাবে গায়েব থাকার কথা না। (রিদিতা)
~নুর! আরেকবার কল দিয়ে দেখ না কল ধরে কি না। (তিলোত্তমা)

কল রিং হতেই সাথে সাথেই রিসিভ হয়ে ওপাশ থেকে ভেসে এলো শুভ্রতার আওয়াজ,
আসসালামু ওয়ালাইকুম।

নুর সহ সকলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ মনে হচ্ছিলো তাদের শ্বাস রোধ হয়ে আছে। বান্ধবী হারানো ভয়ে হাত পা কাপছিলো প্রত্যেকের। রিদিতা ফোনটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলতে লাগলো,
ইডিয়ট একটা! কোথায় ছিলি তুই? কল ধরছিলি না কেনো? ঠিক আছিস তুই? কিছু হয়নি তো তোর?

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। অন্য সময় হলে শুভ্রতা নির্ঘাত হাসতো। কিংবা ধমকে উঠে বলতো “এত কথা বলিস কি করে? শ্বাস নে”। কিন্তু শুভ্রতা চুপ রইলো। নুর তটস্থ হয়ে বললো,
কথা বলছিস না কেনো? মুখে কি তালা পড়েছে?

ওপাশ থেকে শুভ্রতার শীতল কণ্ঠ,
কি বলবি?
~কোথায় তুই? বাসায়? (তিলোত্তমা)
~না। বাড়ির বাহিরে আছি। (শুভ্রতা)
~আমরা দেখা করতে আসতাম। অনেকদিন হলো দেখা হচ্ছে না তোর সাথে। ফিরবি কবে? (উপমা)
~ঠিক জানা নেই। (শুভ্রতা)
~ফোন ধরছিলি না কেনো? (রুপা)
~ব্যস্ত ছিলাম। (শুভ্রতা)

সকলে চুপ করে রইলো। কল কাটলো না। শুভ্রতাও কান থেকে ফোন সরালো না। কল দিলে বিরক্ত হওয়া মেয়েটাও আজ বিরক্ত হলো না। শুভ্রতার গলার স্বরটা একটু অন্য রকম মনে হলো সকলের কাছে। মেয়েটার কি মন ভালো নেই? তিলোত্তমা প্রশ্ন করলো,
তুই কি তোর দাদী বা নানীর বাড়ি?

শুভ্রতা জবাব দিলো,
না।
~তাহলে? কোথায় তুই?
~আমি বাড়ি গেলে তোদের জানাবো।

কল কাটতেই সকলের মনেই চাপা অভিমান জমা হলো। মেয়েটার কি বান্ধবীদের প্রতি টান নেই নাকি? তারাই শুধু যেচে খোঁজ খবর নিচ্ছে।

🍂🍂🍂

কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই দরজা খুললো শুভ্রতা। ওদের দেখতেই শুভ্রতা আলতো হেসে ওদের বাড়িতে প্রবেশ করতে বললো। নুররা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বাড়িতে প্রবেশ করলো। স্বভাবসুলভ ভাবেই সোজা শুভ্রতার ঘরের দিকেই গেলো। ড্রয়িং রুমে বাকি সব মেহমান বসলেও ওরা গিয়ে শুভ্রতার ঘরের বেলকনিতে গিয়েই বসে। আজও তার ব্যতিক্রম করলো না। ঘরে গিয়ে বসতেই শুভ্রতা বললো,
তোরা বস আমি চা নিয়ে আসছি।
~তুই কেনো? রেনু আপা কোথায়? (রুপা)
~বাসায় নেই। (শুভ্রতা)
~কোথায় গেছে? (নুর)
~মায়ের সাথে। (শুভ্রতা)
~আনা লাগবে না কিছু।তুই আমাদের পাশে বস। কতদিন পর দেখা হলো আজ। (নুর)

শুভ্রতা শুনলো না। চুপ চাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর একটা নাস্তা ভর্তি ট্রে এনে টেবিলে রাখলো। বিছানার পাশ থেকে একটা বালিশ কোলে নিয়ে আরাম করে বসলো। নুর শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
এতো দিন হলো ভার্সিটিতে যাচ্ছিস না কেনো?
~ব্যস্ত (শুভ্রতা)
~কি নিয়ে? (নুর)
~কৈফিয়ত দিতে চাইছি না আমি। (শুভ্রতা)

নুরের মেজাজ বিগড়ে গেলো। চেঁচিয়ে বললো,
কি নয় ব্যস্ত আছিস বলতে কি সমস্যা? লাস্ট যেদিন দেখা হয়েছিলো বলেছিলি আংকেল আন্টির বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে তাদেরকে সারপ্রাইজ দিবি। তাই এক দিন আসবি না। একদিন থেকে ছয়দিন হয়ে গেলো। তোর কোনো হুদিস নেই। হয়েছেটা কি?

শুভ্রতা তখনও চুপ। সম্পূর্ণ মনোযোগ কফি খাওয়াতে। এই মুহূর্তে যে তার সাথে কেউ উচু গলায় কথা বলছে তাতেও তার কোনোরুপ হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। কফি শেষ করে মগটা আগের জায়গায় রেখে মুচকি হেসে বললো,
আমার মনে হয় না যে মা এর আগে এমন সারপ্রাইজ পেয়েছে। সারপ্রাইজটা মায়ের একদম মন ছুঁয়ে গেছে জানিস। আমার মায়ের এমন রিয়েকশন আমি এর আগে কখনোই দেখিনি। আমি তো এখনও ওই দিনটার কথা ভুলতে পারছি না।

~আংকেল আন্টি খুব খুশি হয়েছে। তাই না? (উপমা)
~একদম ভাবনার বাহিরে ছিলো। বাই দ্যা ওয়ে, আজ দেখা করার জন্য বাড়িতে হামলে পড়লি কেনো? যদি বাড়িতে না থাকতাম?
~দারোয়ান চাচার থেকে খবর নিয়ে তবেই এসেছি। আর হ্যা আমি আর ঝাড়বাতি এক সপ্তাহ ভার্সিটি যাবো না। ভাবলাম যাওয়ার আগে তোর সাথে দেখা করে যাই।

উপমার কথায় ভ্রু কুচকালো তিলোত্তমা। জানতে চাইলো,
কেনো যাবি না?
~উমান ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি আর উপ কাল গ্রামে যাবো। (নুর)
~উহুম! উহুম! আমিও যাবো না। দাদী অসুস্থ। আজ রাতেই বগুড়ায় যাবো সবাই। কবে আসবো ঠিক নেই। (রিদিতা)

তিলোত্তমা শুভ্রতাকে প্রশ্ন করলো,
তুই ভার্সিটিতে যাবি না?
~আমি একটু পর মায়ের কাছে যাবো। ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না।

তিলোত্তমা হতাশ হলো। উদাসীন কণ্ঠে শুধালো,
আমি আর রুপ গিয়ে কি করবো তাহলে। আমিও যাচ্ছি না। তোরা যেদিন যাবি জানিয়ে দিস।
__________________________________

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে আসতেই রিকশা থামিয়ে নেমে পড়লো তিলোত্তমা।
~কিরে নামলি কেনো? চল। (নুর)
~তোরা যা। আমার একটু কাজ আছে। কাজ মিটিয়ে তারপর বাড়ি যাবো। (তিলোত্তমা)
~কি কাজ? (নুর)
~পরে জানাবো। (তিলোত্তমা)
~আমি আসবো সাথে? (রুপা)
~প্রয়োজন নেই। (তিলোত্তমা)

নুররা রিকশা নিয়ে যেতেই তিলোত্তমাও পা বাড়ালো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
~~~
চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here