ঝরাপাতার দিনগুলি পর্ব ৬

#ঝরা পাতার দিনগুলো
#পান্না হাবিব

পর্ব-৬

ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছাড়ার আগেই আমি ঘুম। ঘুম ভাঙার পরে জানালা দিয়ে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে কোথায় জানি। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৬.২০ বাজে। এতক্ষণ শান্তিতে ঘুমিয়েছি!!কি ব্যাপার!! আজকে ফয়সাল বিরক্ত করছে না কেন। ওর জন্যে কখনোও শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম না, না বাসে, না ট্রেনে। পাশের সিটে তাকাতেই বুকটা ধক করে উঠলো। ফয়সালের সাথে আমার আর পাশাপাশি সিটে বসে যাওয়া হবে না বুঝতে পেরে চোখ আবার বন্ধ করলাম। ঠিক করলাম এবার ঘুম না আসলেও আর চোখ খুলবো না। ধরে নেব আমার পাশের সিটে ফয়সাল বসে আছে।

সারা রাস্তা একটা কথাও কেউ কারো সাথে বলিনি। রাত ৯.৩০টায় চিটাগং স্টেশনে এসে পৌছালাম। ট্রেন থামতেই সাব্বির নিজের ব্যাকপ্যাক টা কাধে নিয়ে নেমে গেলো!! খুব কস্টে লাগেজ টা উপরের তাক থেকে নামিয়ে ট্রেন থেকে নেমে দেখি সে আশে পাশেও নেই। দূরে হনহন করে হেটে চলে যাচ্ছে!!! আস্তেধীরে হেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
টিকেট চাইতেই বললাম যে টিকেট নেই।
“স্যার এই মেয়ে টিকেট কাটে নাই”, টিকেট দেখতে চাওয়া স্টাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসার কে বললো।
-দেখে তো ভদ্রঘরের মেয়েই মনে হয়। তো টিকেট কাটো নাই কেনো? অফিসার এগিয়ে এসে জিগ্যেস করলো।
-বাবা মা থাকতে ভদ্রমেয়ে ছিলাম স্যার। এখন তো নাই।তাই অভদ্র হয়ে গিয়েছি।সরি স্যার।
১০০০ টাকা জরিমানা দিতে দিতে দেখলাম সাব্বির এগিয়ে আসছে এইদিকে।
-এক্সকিউজমি স্যার, আসলে ইনি আমার সাথেরই। আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ। একসাথেই এসেছি। এইযে আমাদের টিকেট।
অফিসার ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো এই ছেলে তোমার সাথের?
-না উনি আমার সাথের না। এই নিন টাকা। এটা বলে ১০০০ টাকা দিয়ে খুব দ্রুত হেটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রাগে দুঃখে চোখে পানি চলে আসছে বারবার।
পিছন থেকে খপ করে কেউ আমার হাত ধরলো অনেক জোড়ে। না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারলাম সেটা কে হতে পারে।
হাত ধরে টানতে টানতে স্টেশনের বাইরে নিয়ে এসে একবার আমার দিকে রক্তগরম চোখে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দিলো।
মেইনরোডে এসে সাব্বির সিএনজি ঠিক করতে করতে আমি সুন্দর মতো লোকাল বাসে উঠে পরলাম। রাত তখন ১০টা। বাসে আমি একা একটা মেয়ে আর প্রায় ১৫ জনের মতো পুরুষ যাত্রী। ভয় হওয়ার বদলে রাগে চোখে বার বার পানি চলে আসতেছে।

ভার্সিটির মেইন গেটের সামনে নেমে গেলাম। রাস্তা পার হয়ে মেইনগেট দিয়ে যেই ঢুকতে যাবো পিছন থেকে কেউ একজন হাত টান দিয়ে ধরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই গালে খুব জোড়ে থাপ্পড় খেলাম!! বোকার মতো গালে হাত দিয়ে ধরে সাব্বির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
-থাপ্পড় দিলে একসাথে দুই গালে দিতে হয়।এক গালে খেলে জামাই মরে যায়।
বলার সাথে সাথেই ঠাস!!
শান্ত গলায় বললাম আরো দেয়ার বাকি আছে? দিলে তারাতাড়ি দাও,গেটের দাড়োয়ান দেখছে।
-তোর প্রেম কাহিনি তো এই ভার্সিটির ইটের কনাও জানে। আজকে না হয় থাপ্পড় খায়ছিস সেটাও জানলো।
-এতোই যখন জ্বলে তাহলে বিয়ে করেছ কেন?
-দয়া করছি তোকে দয়া!! গিয়েছিলি না তোর নাগরের কাছে? এই দয়াটুকুও তো করে নাই।
-অনেক দয়া দেখাইছ। থাক আর দেখাইতে হবে না। মুক্তি দিয়ে দিব।
-আরে তুই কি আমাকে মুক্তি দিবি। সবার সামনে তোকে আমি ডিভোর্স দিবো।
– আচ্ছা দিও। বলেই হলের দিকে হাটা ধরলাম।
আমার প্রতি এতো রাগের কারণ বুঝতে পারলাম না।
আর আমি যে ফয়সালের বাসায় গিয়েছিলাম সেটা ও কিভাবে জানতে পারলো !!!

ভাগ্যিস কেউ নাই আশেপাশে। থাকলে এতোক্ষনে পুরো ভার্সিটি জানাজানি হয়ে যেতো। ফয়সালের গার্লফ্রেন্ড বলে কথা!!

আচ্ছা ফয়সাল এখন কই আছে? ওদের বাসায় গিয়ে তো মনে হয়নি যে ও আদৌ ঢাকায় আছে। তাহলে কি ভার্সিটিতে?
আল্লাহ!! এতো ছোট্ট একটা ক্যাম্পাস!! আমি ওর সামনে না গিয়ে থাকবো কিভাবে। তার উপর আবার একই ডিপার্টমেন্ট। দুনিয়ার সব চিন্তা মাথায় আসছে। উফ্।
আল্লাহ আল্লাহ করছি যেনো এই মুহুর্তে কারো সাথে দেখা না হয় আমার। আর টেনশন নিতে ভালো লাগছে না। আচ্ছা সবাই যখন জানবে যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে অন্য কারো সাথে তখন সবাই তো আমাকে খারাপ ভাববে। ফয়সাল টিচার হতে পারবে না দেখে আমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছি!!
আর ভাবতে পারছি না। এইসব কিছুর চিন্তায় একটু আগে যে ২গালে ২ চড় খাইছি সেটা ভুলেই গিয়েছি।

উফফ যেতেও হবে ছেলেদের হলের সামনে দিয়ে। ভার্সিটি এমন ভাবে বানাইছে কেন। ভিসি কে অকথ্য গালাগাল দিতে দিতে সামনে এগিয়ে গেলাম।
এমন চোরের মতো মনে হয় ভার্সিটিতে কোনদিন ঢুকবো চিন্তাও করিনি।

কত সপ্ন ছিল দুজনের!! ও টিচার হলে এই রাস্তা দিয়ে বিয়ের পর রাতের বেলা হাটতে বের হবো। আর আজ।

হলের কাছে এসে দৌড়ে হলে ঢুকলাম। নিচের গার্ডে থাকা আপা আমাকে দেখেই চওড়া একটা হাসি দিয়ে বললেন, “আফার শরীর ভালো নি? মিস্টি খাওয়াইতেন না আফা?”
উনার কথা শুনে মনে হলো কেয়ামত হয়না কেনো এখনো? সব তাহলে জানাজানি হয়েই গেলো!!
খাওয়াবো বলেই প্রায় দৌড়ে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।

রুমে ঢুকতেই ভার্সিটির একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড জেনি হাসি দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।

-তো মেহের ট্রিট কবে পাচ্ছি। আমি তো স্পেশাল ২টা ট্রিট পাবো। একটা তুই দিবি আর একটা ভাইয়া দিবে।
– আমি থতমত খেয়ে বললাম কিসের ট্রিট?
-ঢং ধরে লাভ নাই মেহের। ট্রিট হবে ট্রিট।
-আচ্ছা ঠিক আছে।
-আরে এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো? বাসার সবার কি অবস্থা? আংকেলের কথা তো শুনলাম। দেখ মন খারাপ করিস না। খারাপ কিছুর সাথে তো ভালো কিছুও পেলি।

জেনি কোনটাকে ভালো বলছে মাথায় ঢুকছে না কিছুই।
-যা ফ্রেশ হয়ে আয়। তুই আজকে আসবি বলবি না আগে? তাহলে তো রাতের খাবার এনে রাখতাম। ভাইয়ের সাথে তো সন্ধ্যায় দেখা হলো। ভাইয়াও দেখি কিছু বললো না।
-খাবো না কিছু। ভালো লাগছে না।
– সেটা পরে দেখা যাবে। মন খারাপ করিস না আংকেলের জন্য। যা গোসল করে আয়, ভালো লাগবে।
হুম বলে গোসল করতে চলে গেলাম। ও কি বলছে আগা মাথা কিছুই ধরতে পারছি না। কার সাথে দেখা হওয়ার কথা বলছে জেনি।
শাওয়ার ছেড়ে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে ভিজছি। ইশ এই পানি পরার সাথে যদি মাথার টেনশন গুলোও চলে যেতো!!

রুমে এসে দেখি হলের সব ফ্রেন্ডরা এসে বসে আছে। সবাই হাসি মুখে আমাকে কনগ্রাচুলেশনস জানাচ্ছে। কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।
একটা ফ্রেন্ড হঠাৎ বলে উঠলো, মেহের আর কিছুদিন পর মাসটা মাস্টার্স এ ভর্তি হতি, তাহলে তো একেবারে ভাইয়ার আন্ডারে করতে পারতি, তুই খাবার বানিয়ে নিয়ে যেতি। আহ কি প্রেম!! সবগুলো একসাথে হেসে উঠলো।
আমি কিছুই বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, কার আন্ডারে?
জেনি মুখ ভেংচিয়ে বললো, ন্যাকা সাজতেছে আরেকজন। আমাদের মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছে আর কি যে ফয়সাল ভাইয়া টিচার হয়ে গেছে আর কি।

আমি অস্ফুটস্বরে বলে উঠলাম ফয়সাল টিচার হয়ে গিয়েছে!!!!
খুশি হবো নাকি ওকে এতো কাছে এসেও না পাওয়ার জন্য কান্না করবো, কি এক্সপ্রেশন দিব!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here