ডাহুক নদীর তীরে পর্ব -১৩+১৪

#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৩)
#হালিমা রহমান

আকলিমা খাতুন কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।রিনরিনে গলায় বলেনঃ” আমি আপনেরে কিছু জিগাইছি।”

_” হু,কি যেন জিগাইছিলা?”

_” এতো টাকা কই পাইছেন আপনে?”

_” এডি তথার টাকা।তথার কামের টাকা আমার কাছে দিছে।”

_” এতো টাকা! এতো ছোট একটা কাজের লেগা এতো টাকা দেয়?”

_” কি জানি! দিলো তো।”

_” কে দিছে?”

_” ডিরক্টর আখতার হোসেন।”

_” এডা ওই যে ওই ব্যাডা না,আপনেগো গ্রামে যে থাকে।গড়ের পুকুরের পাশে যে একটা বড় বাড়ি আছে।হেয়নি?”

_”হ।”

_” ওই ব্যাডার তো শুনছি অনেক দোষ। কিসব দুই নাম্বারি কাজ-কাম করে।হের লগে কাম করতাছে তথায়! কি কন এডি।মাইয়া তো যাওয়ার আগে হের নাম কয় নাই আমারে।কইলে আমি কহনো যাইতে দিতাম না।”—- শেষের দিকে আকলিমা খাতুনের গলা কেঁপে উঠে।মেয়ে তার কোন গর্তে পড়েছে আল্লাহ মালুম!

_” আরে লিমা, তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা করতাছো।আমগো তথার রাজ কপাল।ওয় অনেক ভালো জায়গায় পড়ছে।ডিরেক্টর স্যার ওরে ঠিক জায়গায় পৌঁছায় দিব।চিন্তা কইরো না।”

_” ঠিক জায়গা আবার কি,হ্যাঁ? ওই ডিরেক্টর দুই বছর আগে কি করছে,শুনেন নাই?গ্রাম থেকা দুইডা মাইয়ারে কামের কথা বইলা ঢাকায় আনছিল।পরে মাইয়াগোরে বিদেশে পাঠায় দিছে।মাইয়ার বাপ-মায় কি হেরে এই কামের অনুমতি দিছিলো?তবুও পাকনামি কইরা করছে। কত বড় হারামজাদা!”

_” চুপ কর, লিমা।যা বুঝো না, তা নিয়া কথা কইবা না।তুমি কি বুঝো এগুলির?মাইয়া মাইষের লগে কথা কওনই ভুল।দেও টাকাডি দেও।সবকিছু তে বাড়াবাড়ি।যত্তসব।পন্ডিত আইছে এক্কারে।সব জানে।”

ইকবাল মিয়া চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে টাকাগুলো আলমারিতে সংরক্ষণ করেন।আকলিমা খাতুনকে বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দেন।আর আকলিমা খাতুন? তিনি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকেন স্বামীর দিকে।এই ইকবাল মিয়াই এক বছর আগে আখতার হোসেনকে দেখতে পারতেন না।কত নিন্দা করতো এই লোকের।আখতার এটা করেছে, ওটা করেছে,সে একটা কুলাঙ্গার –এরকম আরো কত কি।আজ কি হলো? ইকবাল মিয়া কবে থেকে ডিরেক্টরের এতো ভক্ত হয়ে গেলেন? এতো বড় মেয়েকে এরকম খারাপ একটা লোকের সাথে কাজে পাঠাতে একটুও দ্বিধা করলেন না!হিসাব মেলাতে পারেন না আকলিমা খাতুন।তার মাতৃহৃদয়ের এককোনে দুর্ভাবনারা বাসা বাধে।মনের কোনে ভয় জমে। মেয়েটা ভালো থাকবে তো?ইকবাল মিয়াকে আর কোনো প্রশ্ন করেন না আকলিমা খাতুন।কেবল জ্বিভ নাড়িয়ে পরম দয়াময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন। ” আমার মাইয়াডারে সুস্থভাবে ঘরে ফিরায়া দেও আল্লাহ।আমার তথারে আমার বুকে ফিরায়া দেও।”

ঘর থেকে এলোমেলো পায়ে বেড়িয়ে যান আকলিমা খাতুন।তিনি এখন তথার ফোনে হাজারবার কল করবেন।তথার সাথে কথা না বলা অবধি তার ছটফটানি কমবে না।

এই ডিরেক্টরকে নিয়ে গ্রামে অনেক কথা প্রচলিত আছে।বলাবাহুল্য, সেগুলো মোটেও ভালো কথা নয়।একদম নিম্নবিত্ত ঘড় থেকে উঠে এসেছে আখতার হোসেন।বয়স হলেও কাজ করতো না সে।বিশ বছর বয়সে চুরির দায়ে গ্রামছাড়া হয়েছিল।তারপর বহুদিন আর দেখা পাওয়া যায়নি তার। বছর সাতেক আগে বহু বছর পর আখতার হোসেন যখন আবার গ্রামে ফিরলেন, তখন তার রমরমা অবস্থা।মাস তিনেকের মাঝেই পুরোনো ভিটায় নতুন করে বিশাল এক বাড়ি করলেন।গড়ের পুকুরে নতুন করে চকচকে ঘাট তৈরি করলেন।গ্রামবাসীর চক্ষু চড়কগাছ।চোরা আখতার এতোদিন কোথায় ছিল,কি করতো, সৎ কাজ নাকি অসৎ কাজ–এসব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে।এসব খবরে বেশ কয়েকদিন চায়ের দোকান সরগরম থাকতো। কেউ কেউ বলতো আখতার হোসেন শহরে যেয়ে ভালো কাজই করেছে।সৎ কাজ করেই এতো টাকা কামাই করেছে।এসব কথা শুনে আরেকদল মুখ ভেংচি দিলো।হুহ! সৎভাবে কেউ এতো তাড়াতাড়ি এতো টাকা কামাতে পারে।এসব অসৎ কাজের ফল নিশ্চয়ই। কতদিন এই দুই দলের মাঝে তর্কাতর্কি,কথা-কাটাকাটি চলেছে।চায়ের কাপে ঝড় উঠতো এসব আলোচনাকে ঘিরে।

ডিরেক্টর আখতার হোসেন কিন্তু এসব কথায় বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলেন না।বাড়ি করার পর একপাল ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে ঘুরতে গেলেন।রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে আবার কিছুদিন পর ফিরে এলেন।যারা পূর্বে আখতার সাহেবের পক্ষে ছিল তারা মাথা নিচু করে ভুল স্বীকার করলো।না,আখতার সাহেবকে তারা যতটা ভালো-ভদ্র ভেবেছিল ততোটা সাধু-সন্যাসী সে নয়।এতো বছরে তার অনেক নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।অনৈতিক মানুষেরা আবার সৎপথে চলতে পারে নাকি?

***

বিকালের নরম আলোতে সবকিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।সবদিকে কেমন একটা শান্ত-স্নিগ্ধ ভাব।কোনো আওয়াজ নেই,হৈ-হুল্লোড় নেই,গাড়ি-ঘোড়ার অযাচিত শব্দ নেই,আশেপাশে দূষিত বায়ু নেই।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা আনমনে দেখে সোনালী।সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।শেষ বয়সে সে গ্রামে থাকবে।কোনো অজপাড়া এক গায়ে।যেখানে যানবাহনের শব্দে কান ঝালাপালা হবে না,দূষিত বায়ুর কারণে শ্বাসকষ্ট হবে না,ফরমালিনের খাবার খেয়ে পেট খারাপ হবে না।রিটায়ার্ড করার পরেই গ্রামে চলে আসবে।দো-চালা ঘর করবে একটা।ছোট্ট ঘরের সামনে একফালি উঠোন থাকবে।উঠোনে বুনবে লাল শাকের চারা,লাউশাক,কুমড়ো শাকের চারা।এককোনে একটা বাতাবি লেবুর গাছও থাকবে। ছোট একটা পুকুর করবে সোনালী।সেখানে শুধু তেলাপিয়া মাছ ছাড়বে।যখনই মাছ খেতে ইচ্ছে করবে,তখনই পুকুরের শেষ ঘাটে পিড়ি পেতে বসে বড়শি ফেলবে। সাধ মিটিয়ে পছন্দের মাছ ধরে ছোট লালশাক দিয়ে রাঁধবে। মাটিতে লেপ্টে বসে সস্তা স্টিলের প্লেটে গরম তরকারি দিয়ে গরম ভাত খাবে। আহ! ভাবতেই জ্বিভে পানি চলে আসে সোনালীর।হাত ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলায় সে।বিকাল চারটা বাজে।আজকে তারা ডাহুক নদীর তীরে ঘুরতে যাবে। এই নদীর পাড়ে নাকি শুটিং হবে।শুটিংয়ের কথা মনে করে হাসে সোনালী।শুটিং নয়,দুধ-ভাতের লোভ দেখিয়ে এ পর্যন্ত তাদেরকে টেনে আনা হয়েছে।
সোনালী ঘরের দিকে পা বাড়ায়।ওর তৈরি হতে দু-মিনিট সময় লাগেনি।অথচ সবার কতো সময় লাগছে। কতো কিছু মাখছে এরা মুখে? বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত খেতে যাবে নাকি?আশ্চর্য! বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আসে সোনালীর।তথাকে একপ্রস্থ কথা শোনাতে ঘরের দিকে যায়।

কুচকুচে কালো রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে তথা।সুতির শাড়িতে সোনালী রঙের আঁচল। নিচু করে একটা খোপা করে নেয় সে।চোখে মোটা করে কাজলের রেখা আঁকে।আসার পথে ব্যাগে করে দুই ডজন রেশমি চুড়ি এনেছিল।কালো রঙের ছয়টা চুড়ি হাতে গলায় তথা।সামনের চুলগুলো খানিক অগোছালো হয়েছিল।সেগুলোতে আরেকবার চিরুনি চালিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। সব ঠিক আছে।শুধু খোপায় একটা টকটকে লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া গুজতে পারলে ষোলকলা পূর্ণ হতো।নিচে নেমে একটা ফুল কুড়িয়ে খোপায় গোজার সিদ্ধান্ত নেয় সে।আয়নার দিকে চেয়ে সন্তুষ্টির হাসি হাসে তথা। দারুন লাগছে দেখতে।নদীর তীরে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাজটা একটু বেশিই হয়ে গেছে।কিন্তু,তাতে কি?তথা খুব সাজতে ভালোবাসে।মেয়েরা না সাজলে সাজবে কারা?এই কাজল,শাড়ি কারা ব্যবহার করবে?এসব তো মেয়েদের জন্য।

_” তথাপু করেছো কি তুমি?তোমায় যা লাগছে না।ইশ! ছেলে হলাম না কেন?আমি ছেলে হলে এক্ষুনি কাজি অফিসে নিয়ে জোর করে বিয়ে করতাম তোমায়।”

_” খুব বেশি সুন্দর লাগছে নাকি?”

_” তা আবার বলতে।তোমায় ঠিক রাতের আকাশের এক টুকরো চাঁদের মতো লাগছে।উজ্জ্বল সুন্দর চাঁদ।আসো আসো একটু থু থু ছিটিয়ে দেই।তাহলে কারো নজর লাগবে না।”

চওড়া হাসি দেয় তথা।প্রশংসায় কে না খুশি হয়?

_” আর চাপাবাজি করতে হবে না।চলো নিচে যাই।সবাই বোধহয় তৈরি হয়ে নিচে অপেক্ষা করছে।”

_” হাহ! সত্যি কথার ভাত নাই আজকাল।আমি মোটেও চাপা মারছি না।”

_” আচ্ছা মানলাম।এখন নিচে যাই চল।”

নিচে শুধু শাফিন, খোকন ও দুটো মেয়েকে চোখে পড়লো সোনালীর।মেয়ে দুটোকে চিনে না সে।দুজনের মাঝে একজন তথার দিকে একবার চাইলো মাত্র।তারপর আবার ফোনে ডুব দিলো।কিন্তু আরেকটা মেয়ে এগিয়ে এলো তথার দিকে।মিষ্টি হেসে বললঃ” আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে,আপু।”

_” ধন্যবাদ।”– মৃদু হেসে উত্তর দেয় তথা।

_” আপনার নামটা কি জানতে পারি?”

_” আমি তথা।তুমি?”

_” মালিহা খানম।আপনিই কি নায়িকা?”

_” না।আমি সহকারী চরিত্র।তুমি কোন চরিত্রে আছো?”

_” কাজের মেয়ে”—মন খারাপ করে মাথা নিচু করে ফেলে মেয়েটা।বরাদ্দ চরিত্র নিয়ে সে মোটেও খুশি নয়।

_” মন খারাপ করো না আপু। তুমি তো তাও পুরো নাটকে ঝাড়া-মোছা করবে।আর আমি কি করব, জানো? বোবার মতো মাঝে মাঝে নায়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।আমি নায়কের বোবা ভাগনীর চরিত্রে আছি। সারা নাটকে আমার কোকিল কন্ঠ শুনবে না কেউ।দর্শকদেরকে আমার সমধুর কন্ঠ শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে এরা।হুহ!”

সোনালীর কথায় হেসে উঠে তথা।তা দেখে গর্জে উঠে সোনালী।

_” খবরদার তথা আপু,হাসবে না।নিজে ভালো চরিত্র পেয়েছ বলে আমার দূর্ভাগ্যে হাসতে হবে কেন?”

তথা নাটকীয় ভঙ্গিতে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখে।ইশারায় বলেঃ” আচ্ছা,আর কথা বলব না।”

_” আচ্ছা মালিহা আপু,আপনি এখানে চান্স পেয়েছেন কিভাবে?মানে কার মাধ্যমে এ পর্যন্ত এসেছেন?”

_” আমি আমার………

ওদের কথার মাঝে আর দাঁড়ায় না তথা।সোনালী ভীষণ কৌতূহলী।মেয়েটা সেকেন্ডের মাঝে ভাব জমাতেও পারে।কোনো জড়তা কাজ করে না ওর মাঝে।তথা কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে যায়।নিচে অনেক ফুল পড়ে আছে।বেশিরভাগ নেতানো।খোপায় দেওয়ার মতো উপযুক্ত ফুল খুঁজে পায় না তথা।

_” আপনি কি কিছু খুঁজছেন,মিস তথা?”

শাফিনের কন্ঠে পাশ ফিরে তাকায় তথা।সে এতোক্ষণ অশ্বত্থ গাছের নিচে বেঞ্চিতে বসা ছিল।

_” হ্যাঁ, আমি একটা সুন্দর ফুল খুঁজছি।”

_” আমি কি সাহায্য করতে পারি?”

প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা করে না শাফিন।গাছ থেকে সুন্দর একটা ফুল পেড়ে দেয়।তথার হাতে দিয়ে বলেঃ” এটা খোপায় দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগবে আপনাকে।”

অপ্রস্তুত হাসি হাসে তথা।শাফিনকে সে দেখতে পারে না।তাই কথা বলতে একটু জড়তা কাজ করে ভিতরে।তবে শীঘ্রই তা কাটিয়ে উঠে তথা।হুটহাট অকারণে কাউকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

_” মিস তথা,আপনাকে কিছু বলার ছিল।”

_” জ্বি,বলুন।”

_” আসলে প্রথম দেখার কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি।হয়তো আপনিও পারেননি।সেদিন একটু বেশিই বাজে ইঙ্গিত করেছিলাম। ক্ষমা করবেন প্লিজ।আমি আমার আচরণের জন্য লজ্জিত।আমার এরকম করা মোটেও ঠিক হয়নি।আমার ঘরেও মা-বোন আছে।তারাও এরকম আচরণের স্বীকার হতে পারতো।আমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগতো না।আমি খুবই লজ্জিত।”

_” আপনি যে বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।যান ক্ষমা করে দিলাম আপনাকে।”

_” সত্যি?”

_” হ্যাঁ, সত্যি।”

তথার কথার বিপরীতে চওড়া হাসি দেয় শাফিন।আশেপাশে একনজর দেখে নিচু স্বরে বলেঃ” বাঁচালেন।সুন্দরী মেয়েরা রাগ করে থাকলে আমার মোটেও ভালো লাগে না।নিজেকে নরাধম মনে হয়।”

_” তাই নাকি?”

_” হ্যাঁ। আরে সেদিন আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিল।গার্লফ্রেন্ডের সাথে একচোট ঝগড়া করে ডিরেক্টরের অফিসে গিয়েছিলাম। তাই না চাইতেও খারাপ আচরণ করে ফেলেছি।বুঝতেই পারছেন আমার দোষ ছিল না সেদিন।সব দোষ আমার দজ্জাল প্রেমিকার।”

তথা শাফিনের দিকে তাকিয়ে মুখ বাকায়।

_” আপনারা ছেলেরা শুধু মেয়েদের উপর দোষ চাপাতে পারলেই বেঁচে যান।খারাপ ব্যবহার করলেন আপনি আর দোষ হলো ওই বেচারির?”

_” হ্যাঁ জানি জানি।আপনি মেয়ে তাই আরেকটা মেয়ের কোল টানবেন।তারচেয়ে চলুন পুকুরের দিক থেকে একটু ঘুরে আসি।ওদিকের পরিবেশটা আমার খুব ভালো লাগে।”

_” চলুন।ওদিকটা আমারো খুব পছন্দ। ”

শাফিনের সাথে হাঁটা ধরে তথা।বিকেলের নরম আলো গায়ে মাখতে চায় সে।আজকে খুব ভালো লাগছে তথার।তবে তথা ও শাফিনের একসাথে পথ চলার দৃশ্য ভালো লাগলো না ইউসুফের।সে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির দরজার সামনে।সানগ্লাসের ঢেকে আছে তার রক্তচক্ষু। তাই,কুঁচকানো কপালের নিচে একজোড়া চোখ তথা ও শাফিনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল তা কেউ বুঝতে পারলো না।

***

_ ” ছোট্ট মেয়ে,এটাই সেই প্রাচীন ডাহুক নদী।এটা বাংলাদেশ -ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী।এই নদীতে সারাবছর পানি থাকে।এখানে বর্ষায় বন্যা হয় না আবার নদীর পাড় ভাঙেও না।এর দৈর্ঘ্য…..

_” ধুর ব্যাঙ।আপনাকে একটা ছবি তুলে দিতে বলেছি।এতো লেকচার কে শুনতে চেয়েছে?”

_” আমার কাছে ছবি তুলতে হলে লেকচার শুনতেই হবে।”

_” দিন আমার মোবাইল দিন।আপনার ছবি তোলা লাগবে না।”

মুখ ঝামটা দিয়ে মামুনের হাত থেকে নিজের মোবাইল কেড়ে নেয় সোনালী।অন্যদিকে চলে যায়।মামুন সেদিকে অপলক চেয়ে থাকে।মেয়েটার কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে চায় সে।কিন্তু সোনালী যেন পিছুই ছাড়ছে না।এই যে এদিকে পা দেওয়ার সাথে সাথেই মামুনের দিকে ছুটে এসে তার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিল।মিষ্টি হেসে বললঃ” একটা ছবি তুলে দিন তো।আমি ডানপাশে হেলে দাঁড়াব,আপনি বামপাশ থেকে ছবি তুলবেন।ঠিকাছে?”

হাহ! মেয়েটা কি বুঝতে পারছে না মামুন তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে।যেচে কোনো ভয়ংকরীর ফাঁদে পা দিতে চায় না মামুন।

_” হ্যালো তথা,কই আছোস মা?”

_” নদীর পাড়ে ঘুরতে এসেছি কাকি।জানো জায়গাটা খুব সুন্দর।”

_” এইসব বাদ দে।তুই এক্ষনি ঢাকা চইলা আয়।এক্ষন মানে এক্ষন।”

তথা অবাক হয়ে যায়।এটা আবার কি কথা!

_” কাকি,কাজ শেষ না হওয়া অবধি বাড়ি ফিরতে পারব না আমি।”

_” আমার ভালো লাগতাছে না মা।আয়া পড় না।”

_” তুমি বুঝতে চাইছো না কেন কাকি,আমি ওদের সাথে চুক্তিবদ্ধ। টাকা নিয়েছি আমি।কাজ তো করতেই হবে।”—খানিক বিরক্ত হয় তথা।এক কথা কতবার বলতে ভালো লাগে।

_” আসবি না তুই?”

_” কাজ শেষে আসব।”

_” আসা লাগব না তোর।আল্লাহ তোরে আমার সংসারে আর ফিরায়া না আনুক।আমার কথা না শুনলে আমার সংসারেও আর ঢুকবি না।”

খট করে লাইন কেটে দেন আকলিমা খাতুন।তথা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কাকি কি সুন্দর করে সম্পর্কের মাঝে সীমারেখা টেনে দিল! চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তথা ওই সংসারে কেবল বহিরাগত।অনেকদিন পরে নিজের মনেই প্রশ্ন করে তথা।আচ্ছা, আপন মা হলে এমন কথা বলতে পারতো?সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন দোয়া করতে পারতো?কে জানে! তথা তো আর মা দেখেনি।

নদীর তীরের শীতল বাতাসে তথার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।জলজ বাতাস ছুঁয়ে দেয় তথার ঘাড়,গলা, মুখ,ঠোঁট, নাক,সবকিছু।তথার মনটা ভালো নেই।নদীর পাড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকে সে।আশেপাশে সবাই ছবি তুলছে,কথা বলছে, আনন্দ করছে।তথার চোখ বেয়ে একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে।অতি সন্তর্পণে তা মুছে নেয় সে।

_” মিস তথা,এদিকে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?ওদিকে চলুন।সবাই কত আনন্দ করছে আর আপনি….

_” আমার ভালো লাগছে না শাফিন।আমি এখানেই ঠিক আছি।”

তথার ভারী কন্ঠ কানে বাজে শাফিনের।সে খানিকক্ষণ চিন্তা করে তথার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।মেয়েটার চোখ-মুখ পরখ করে বলেঃ” আপনি কাঁদছেন, তথা।”

_” মোটেও না”—পুরোপুরি অস্বীকার করে তথা।

_” মিথ্যা বলবেন না প্লিজ।আপনি চাইলে আপনার সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”

বলবে না চিন্তা করেও বলেই ফেলে তথা।সে কথা চেপে রাখতে পারে না।শাফিনের দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলেঃ” আমার পরিবার চাইছে না আমি এখানে থাকি।আমার কাকি একটু আগেও ফোন করে ঢাকা চলে যেতে বলল। খুব জোর করছে কাকি।আমি বুঝতে পারছি না কি করব।”

শাফিন সোজা হয়ে দাঁড়ায়।মুহূর্তেই তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়। সে গলা শক্ত করে বলেঃ” আপনার কাকি ভুল কিছু বলছে না।ঢাকায় চলে যাওয়া উচিত আপনার।আমিও বলছি চলে যান।পারলে আজকেই ঢাকা চলে যান।সেখানেই আপনি নিরাপদ থাকবেন,এখানে নয়।”
#ডাহুক_নদীর_তীরে (পর্ব-১৪)
#হালিমা রহমান

_” আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, শাফিন।এখানে আমি নিরাপদ নয় কেন?”

_” দেখুন আমার মতে,এখন সময়টা খারাপ।বাইরের জগত অবাধে চষে বেরানোর মতো দিনকাল এখন আর নেই।মেয়েরা তাদের ঘরেই নিরাপদ।তাছাড়া,আপনার কাকি যখন এতো করে বলছে তখন চলেই যান।বড়দের কথা ফেলতে নেই।”

শাফিনের কথায় কিছুই বলে না তথা।একমনে একদিকে চেয়ে থাকে।নদীর ঠান্ডা বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে দেয়।শাফিন আধুনিক যুগের ছেলে হলেও এ যুগের ছেলেদের মতো চিন্তা করতে পারে না বোধহয়। তার চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গী সবটাই অন্যরকম।মেয়েদের বাইরে চলা-ফেরা, ঘোরাঘুরি এসব যে সে খুব বেশি একটা পছন্দ করে না তা তার কথা শুনলেই বুঝা যায়।
কয়েক মিনিটের মাথায় তথাকে আবার একা রেখে অন্যদিকে চলে যায় শাফিন।বিষয়টা স্বস্তি দেয় তথাকে।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না এখন।প্রত্যেকটা মানুষের ভিতরেই আলাদা একটা সত্তা থাকে।মাঝে মাঝে তাদেরকেও সময় দিতে হয়।হৈ-চৈ থেকে দূরে থেকে সেই গুপ্ত সত্তার সাথে চুপিচুপি বোঝাপড়া করতে হয়।এখন তাই করবে তথা।শান্ত নদীর তীরে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যাবে একাকিত্বের অন্তরালে।

টিমের একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া বেধে গেল সোনালীর।একদম উত্তাল ঝগড়া।নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল সে।ঘুরতে এসে শ-খানেক ছবি না তুলতে পারলে ভালো লাগে? এদিক-ওদিক ঘুরে ছবি তুলছিল সোনালী।ফোনের দিকে নজর দিতে যেয়ে ভুল করে আরেকটা মেয়ের পা মাড়িয়ে দিল।সেকেন্ডের মাঝেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সোনালী।ফোনটাকে জিন্সের পকেটে রাখে তাড়াতাড়ি করে।মাথা নিচু করে বলেঃ” সরি, সরি আমি একদম দেখতে পাইনি।”

_” দেখতে পাইনি বললেই হলো।চোখ আছে কেন হ্যাঁ? পা’টাকে ভর্তা করে দিল একদম।তোমার সরি ধুয়ে এখন আমি পানি খাব।”

বিশ্রি ব্যবহারে রীতিমতো অবাক হয়ে যায় সোনালী। এই মেয়ে কি সভ্য যুগের মানুষ? আশ্চর্য! সরি বলার পরেও এমন করার কি আছে?সোনালী কি আর ইচ্ছে করে করেছে?
সোনালীর পিছন থেকে আরেকটা মেয়ে দৌড়ে আসে।আহত মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলেঃ” কি হয়েছে চন্দ্রানী দিদি?ব্যথা পেয়েছ নাকি?”

_” আর বলিস না শুভ্রা।আকাশের দিকে চোখ রেখে হাঁটে সবাই।পায়ের হাড়গুলোকে একদম গুড়োগুড়ো করে ফেললো।”

স্পষ্ট খোঁচা।তবে সোনালী এবারেও কিছু বলল না।শত হলেও ভুলটা তারই।সোনালীর চুপ থাকাকে মেয়েদুটো দুর্বলতা ভাবলো হয়তো।শুভ্রা নামের মেয়েটা তেড়ে গেল সোনালীর দিকে।দাঁতে দাঁত চেপে বললঃ” দেখে চলতে পারো না?এখন যদি দিদির পায়ের কিছু হয় তবে ও এখানে কাজ করবে কিভাবে?”

_” আমি সত্যিই দেখতে পাইনি।ভুল করে হয়ে গেছে।”

_” ম্যানার্সলেস।অবশ্য তোমারই বা দোষ কি।সব দোষ ডিরেক্টরগুলোর।কোয়ালিটি,ম্যানার্স,এক্সপেরিয়েন্স—এসব না দেখেই কাজে নিয়ে নেয়।যত্তসব।বস্তি-টস্তি দিয়ে মিডিয়াটাকে ভরে ফেললো একদম।”

এতো রীতিমতো গালাগালি! পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায় সোনালীর।মেয়েটা আবার খুব রাগী কিনা।রাগ সমসময় তার নাকের ডগায় থাকে।শুভ্রার দিকে তেড়ে যায় সে।গলা উঁচিয়ে বলেঃ” ওই সমস্যা কি হ্যাঁ? সরি বলেছি গায়ে লাগে না? এখন কি পায়ে ধরতে হবে?”
সোনালীর গলার আওয়াজে আশেপাশের সবাই অবাক হয়ে যায়।নিজেদের কাজ রেখে ওদের দিকে ছুটে আসে।তা দেখে শুভ্রা যেন আরো সাহস পায়।সেও গলা চড়িয়ে বলেঃ” তুমি পাড়া দিবে কেন?দেখে হাঁটতে পারো না?”

_” আমি কি ইচ্ছে করে দিয়েছি নাকি।তাছাড়া, যার পায়ে পা দিয়েছি,সে তো কিছু বলছে না।তোমার এতো সমস্যা হচ্ছে কেন?তুমি কি ওর চামচা?”

আরো রেগে যায় শুভ্রা।সোনালীর দিকে দু’পা এগিয়ে যেয়ে তার গালের কাছে হাত নিয়ে যায়।ডানহাত উঠিয়ে চোখ বড় বড় করে বলেঃ” এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব।তোকে বলতে হবে,আমি…….

আর কথা বলতে পারে না শুভ্রা।সোনালী তার ডানহাত পিছনে মুচড়ে বামহাতে গলা টিপে ধরে।শুভ্রাকে খানিকটা শূন্যে তুলে বলেঃ” আই উইল কিল ইউ বিচ।তোর হাত যদি আজকে না ভেঙেছি,তবে আমার নামও সোনালী না।”

অসহ্য যন্ত্রণায় গোঙাতে শুরু করে শুভ্রা।মুখ দিয়ে অদ্ভূত শব্দ করে। এক হাত দিয়েই সোনালীর শক্ত হাতের মুঠি থেকে গলা ছাড়াতে চেষ্টা করে।মুহূর্তেই চারপাশে হুলস্থূল কান্ড বেধে যায়।মেয়েগুলো অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।চন্দ্রানী নামের মেয়েটা পায়ের ব্যাথা ভুলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।ডিরেক্টর আখতার হোসেন চিৎকার করে সোনালীকে গালাগালি করেন।মামুন ভীরের মাঝে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সোনালীর দিকে। এইটুকু মেয়ের শরীরে এতো শক্তি!
কোথা থেকে দৌড়ে এলো শাফিন।এক ঝটকায় শুভ্রার গলা থেকে সোনালীর হাত ছাড়িয়ে নেয়।শাফিন তার বলিষ্ঠ হাতদুটো দিয়ে সোনালীর দু-হাতের কনুই চেপে ধরে।শক্ত কন্ঠে বলেঃ” সমস্যা কি আপনার?ভদ্রতা -সভ্যতা ভুলে গেছেন?”

_” ছাড়ুন শাফিন।ওকে আজ মেরে তবে দম নেব।”

শাফিন ছাড়ে না।বরং আরো শক্ত করে সোনালীর হাত চেপে ধরে।কাঠকাঠ গলায় বলেঃ” ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে নিজের নাম ভুলিয়ে দেব,বেয়াদব।অসভ্যতার একটা সীমা থাকা উচিত।আপনি জানেন কি করতে বসেছিলেন মাত্র?মেয়েটা মরে যেতে পারতো।”

হুট করেই শান্ত হয়ে যায় সোনালী।মাটির দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে। বড় এক দম নেয়।ঘোলা চোখে আশেপাশে দেখে। সবাই ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।কেউ কেউ নিজেদের মাঝে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে।ডিরেক্টরের চেহারাটা পুরো লাল হয়ে আছে।খুব রেগে গেছেন বোধহয়।শুভ্রা মাটিতে বসে অনবরত কাশছে। মেয়েটার গলায় সোনালীর আঙুলের দাগ বসে গেছে। চন্দ্রানী শুভ্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কাঁদছে।আবার কিছুক্ষণ পর পর সোনালীর দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বলছেঃ” আই ওয়ান্ট জাস্টিস। আমার বোনকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।আমি থানায় অভিযোগ করব,আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব।”
আড়চোখে একবার মামুন ও ইউসুফের দিকেও তাকায় সোনালী।মামুনের চোখে-মুখে এখনো বিস্ময়ের রেশ লেগে আছে।সে অবাক চোখে চেয়ে আছে সোনালীর দিকে।ইউসুফের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে সোনালী।ইউসুফ তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।হাতদুটো বুকের উপর ভাঁজ করা।সারা মুখে চিন্তার ছাপ।ইউসুফের চেহারা দেখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করে সোনালীর।এই পরিস্থিতিতে এরকম একটা ঘটনা ঘটানো মোটেও উচিত হয়নি।এখন ইউসুফের মনে সন্দেহ না জাগলেই হয়।

_” মিস সোনালী,শুভ্রাকে সরি বলুন।এখন সরি বলুন।”

শাফিনের কথায় আবারো রাগ উঠে যায় সোনালীর। আবার সরি! এই সরিকে কেন্দ্র করেই তো এতো কাহিনি, এতো ঝামেলা।সোনালী বেশ গোয়ারের মতো প্রশ্ন করেঃ” ও আমার সরি মানবে কেন?এরা সরি-টরি বোঝে না।”

_” এই ফাজিল মেয়েটাকে এক্ষুণি বের করে দেও,শাফিন।আমার টিমে এরকম বেয়াদবের কোনো দরকার নেই।”

ডিরেক্টরের কথার বিপরীতে তার দিকে কঠিন চোখে তাকায় ইউসুফ।মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় বলেঃ” একদম চুপ।”

_” কি হলো আপনি এখনো চুপ করে আছেন কেন?আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না?বাংলা বুঝেন না আপনি?”

চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে সোনালী।চারদিকে নিরবতা। সবাই যেন সোনালীর হার মানার অপেক্ষায় আছে। সোনালী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিনমিনে গলায় বলেঃ ” সরি,আর এরকম হবে না।আসলে আমার উগ্র মেজাজ।রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না।আমার আচরণের জন্য আমি লজ্জিত।”

কিছুই বলে না শুভ্রা।চন্দ্রানীর বুকে মাথা দিয়ে বোনের শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে।সে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে।চোখের পাতা টেনে খুলতে পারছে না। শাফিন সোনালীর দিকে একবার তাকিয়ে শুভ্রার কাছে যায়।হাঁটুর উপর ভর দিয়ে শুভ্রার মুখোমুখি বসে।নরম গলায় বলেঃ” দেখুন,খুব বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটে গেছে এখানে।দোষ আপনারও ছিল,সোনালীরও ছিল।দুইজনে মিটমাট করে নিন প্লিজ।আমরা কাজের জন্য এসেছি এখানে।রাত পেরোলেই একে অন্যের মুখ দেখতে হবে।শুধুশুধু নিজেদের মাঝে ঝামেলা করে লাভ আছে?আশা করছি এই বিশ্রি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আর কিছুই হবে না।এ ঘটনাকে এখানেই মাটি দিয়ে দিন।”

শাফিনের কথায় কাজ হলো।সত্যিই সত্যি চন্দ্রানী ও শুভ্রা শান্ত হয়ে গেল একদম।ডিরেক্টরের পিএ খোকন তাদেরকে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাড়ির পথ ধরলো।সোনালীও বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল।কিন্তু তাকে আটকে দিল মামুন।চন্দ্রানী ও শুভ্রার সাথে একা বাড়িতে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।আবার যদি উনিশ -বিশ হয়ে যায়।যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল আবার।শাফিন একদিকে চলে গেল,ডিরেক্টর পুনমের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো,অন্যান্যরা এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করা শুরু করলো,মামুনের সাথে রাগ করে সোনালীও একদিকে চলে গেল।কেবল ইউসুফ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো একজায়গায়। সে কিছু একটা ভাবছে।একটু দূরেই মামুনকে দেখতে পেয়ে তাকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকে ইউসুফ।মামুন কাছে আসলে তাকে নিয়ে একটু দূরে চলে যায় সে।

_” মামুন, খবর পেয়েছো?”

_” কিসের খবর,স্যার?”

_” আমরা এখানে কি কি করছি,তার সব খবরাখবর গোয়েন্দা বিভাগের কাছে যাচ্ছে।”

_” তাই নাকি,স্যার! কিন্তু কিভাবে?”

_” বিভিন্ন ভাবেই নিউজ লিক হতে পারে।হতে পারে এখানে গুপ্তচর আছে অথবা স্বয়ং গোয়েন্দা পুলিশ আছে।আবার এমনও হতে পারে,আমাদের টিমের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে।আমাদের কাজের কথা পুলিশকে বলছে।”

_” পুলিশ যদি এখানে কাজের কথা জেনেই থাকে, তবে হাত গুটিয়ে বসে আছে যে?ওদের তো ডিরেক্ট অ্যাকশন নেওয়ার কথা।”

_” সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না।গোয়েন্দা বিভাগ আসলে কি করতে চাইছে।ওদের পরিকল্পনা এখনো ধরতে পারছি না।”

_” স্যার,তাহলে কি করবেন এখন?অতি শীঘ্রই দেশ ছাড়া উচিত আপনার।এখনো কি মাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকবেন?”

_” উঁহু। বিশ দিনের মাথায় ভারত থেকে সীমান্ত পথে অস্ত্র আসবে।ওগুলো নেপালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেই দেশ ছাড়ব।”

_” এবারেও রিভলভার? ”

_” হুম।মডেল পি-২৯।”

_” তথা ম্যাম?”—দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তথার দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করে মামুন।

_” তোমার ম্যামকে নিয়েই যাব।”

_” করাচীতে যাবেন স্যার?”

_” না,লাহোরে।গত বছর দুইদিন বাড়িতে হানা দিয়েছিল পুলিশ।এবারেও করাচীতে গেলে আবারো ছুটে আসবে।আমি চাই না তোমার ম্যাম কখনো এসব জানতে পারুক।তথা কখনোই এসব মেনে নিতে পারবে না।আমার সারা পৃথিবী একদিকে আর তোমার ম্যাম একদিকে।আমি চাই না কাজের মাঝে তথা চলে আসুক অথবা তথা আর আমার মাঝে আমার কাজ বাধা হয়ে দাঁড়াক।দু-জায়গায় ব্যালেন্স করে চলতে চাইছি।”

_” যদি ম্যাম না যায়?”

_ ” ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত টেনে আনতে পারলে, পাকিস্তান পর্যন্তও টেনে নিয়ে যেতে পারব।যেতে না চাইলে প্রয়োজনে অজ্ঞান করে নিয়ে যাব।”

ইউসুফ কিছুক্ষণ একমনে চেয়ে থাকে তথার দিকে।বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে।খোপার ফুলটা নেতিয়ে গেছে।মুহূর্তের মাঝেই এক সুন্দর সিদ্ধান্ত নেয় ইউসুফ। বিয়ের পর গাদা গাদা শাড়ি কিনে দেবে তথাকে।বাড়ির সামনে ফুলের বাগান করবে।তথা যখনই খোপা করবে তখনই তার খোপায় সতেজ ফুল গুজে দেবে সে।কখনো একটা ফুল আবার কখনো একগুচ্ছ ফুল।তথা নিশ্চয়ই তখন দারুন খুশি হবে।
তথার দিক থেকে চোখ ফুরিয়ে আবার মামুনের দিকে তাকায় ইউসুফ।আদেশের সুরে বলেঃ” সোনালীর উপর নজর রাখবে মামুন।মেয়েটা ভীষণ স্মার্ট। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো না ও।”

_” ওকে স্যার।”

_” ওহ আর একটা কথা।আমি দেশ ছাড়ার পরেরদিনই মেয়েগুলোকে পাচারের ব্যবস্থা করবে।কলকাতার ব্রোথেল ম্যানেজারের সাথে কথা হয়েছে আমার।ওদিকে সব ঠিকঠাক করা।আমাদের দিকের কাজ বাকি শুধু।এখন থেকেই কাজ গুছিয়ে নেও।এবার দেরি করা যাবে না।গোয়েন্দা বিভাগ হাত ধুয়ে পিছনে পড়েছে।কি থেকে কি হয় বলা যায় না।”

আদেশ দেওয়ার পর আর দাঁড়ায় না ইউসুফ।লম্বা লম্বা পা চালিয়ে জায়গা ছাড়ে।কথার শেষে মামুনের দিকে একবার তাকায় না পর্যন্ত। তবে মামুনের দিকে তাকালে আজ অবাক হয়ে যেত সে।কারণ বহুদিনের বিশ্বাসী মামুনের মুখের রঙ উবে গেছে ইউসুফের কথা শুনে। মামুনের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে। সে ঘোলা চোখে একবার সোনালীর দিকে তাকায়।বড়জোর দশ পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা।গোমড়ামুখে নদীর পানির দিকে চেয়ে আছে।মামুনের অস্থিরতা বাড়ে।সোনালী ও ব্রোথেল— দুটো শব্দকে কিছুতেই একসাথে মিলাতে পারে না সে।

***

_” মিস সোনালী,আপনি খুনোখুনি করতে গেছেন ওখানে?মিনিমাম কমন সেন্স নেই আপনার?”

ডিপার্টমেন্ট হেডের ঝাঝালো গলার আওয়াজে সোনালীর কানে তালা লাগার জোগাড়।কান থেকে ফোন সরিয়ে বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল কানে ঢুকায় সে।কানের ভিতরে আঙুল দিয়ে কিছুক্ষণ খুচিয়ে নেয়।

_” সোনালী আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?”

_” জ্বি,স্যার।”

_” সমস্যা কি আপনার বলুন তো।আরেক মেম্বারের কাছ থেকে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন শুনতে হয়? আপনি না টিম লিডার?”

_” সরি স্যার।তখন রাগ উঠে গিয়েছিল খুব।”

_” আপনার রাগের উপর ভর করে পৃথিবী চলে না মিস সোনালী।আপনারা তো খুব আনন্দেই আছেন সেখানে। আর এদিকে আহমেদ ইউসুফ তার কাজ চালিয়েই যাচ্ছে।গত মাসের মাঝামাঝিতেও বিপুল পরিমান ড্রাগ ও হেকলার এন্ড কক এমপি-৫ মডেলের রিভলবার পাচার করেছে।আর নারী পাচারের কথা নাহয় নাই বললাম।ব্রোথেলগুলোতে মেয়েরা পৌঁছে যাওয়ার পর আমরা খবর পাই। বুঝতে পারছেন কিছু?এরকম চলতে থাকলে ওকে থামানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।যেভাবেই হোক আহমেদ ইউসুফকে এবার ধরতেই হবে।আর কোনো সমস্যা বা অভিযোগের কথা শুনতে চাই না আমি।ঠিকাছে?”

_” জ্বি স্যার।”

_” গুড।সাবধানে থাকবেন। গুড বায়।”

_” গুড বায়, স্যার।”

খট করে লাইন কেটে দেন ডিপার্টমেন্ট হেড।হাফ ছাড়ে সোনালী।মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় পুরো।কিছু একটা হলেই উপরতলায় খবর পাঠিয়ে দিতে হয়?বেয়াদপ কোথাকার। অফিসার মনিরুজ্জামানের উদ্দেশ্যেও গুটিকয়েক গালি দেয় সোনালী।কি না কি শুনেছে, অমনি রাতদুপুরে বকাবকি করতে ফোন করেছে।যত্তসব।তিক্ত মেজাজে রাতের অন্ধকারে বাড়ির পিছনে পা বাড়ায় সোনালী।বাড়ির পিছনের জঙ্গলে তন্ন তন্ন করে খুঁজবে আজ।দেখাই যাক কিছু পাওয়া যায় কিনা।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here