তাসের ঘর পর্ব -০৪

#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-৪
এবার সেই বিশেষ মুহূর্ত যখন পাত্র পক্ষ তাদের হবু কনেকে রিং পড়াবে।এমন সময়
দুম করেই রূপ এসে তনুর পাশে বসে পড়ে।সবাই কিছু বুঝে উঠার আগেই।অন্তরের দাদীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে
-দেখোতো দীদামুণি,তনয়াকে আমার সাথে কেমন মানিয়েছে ?সতীন হিসেবে তনুকে পছন্দ হয়েছে তোমার?

রূপের এমন কথায় সবাই বেশ থতমত খেয়ে যায়।অন্তরের দাদী ম্লান হেসে উওর দেয়
-আমি তো সতীনের সংসার করতে পারবো না।তার চেয়ে বরং তনু আমার নাতবউই হোক।আর তুমি আমার বর।

কথাটা বলেই তিনি উঠে তনুর হাতে বালা পড়িয়ে দিতে আসেন
রূপ দিদীকে বাঁধা দেন।দীদার হাত থেকে বালা নিজের হাতে নেয়।
-এগুলো তনুর জন্য নয়।যত্ন করে রেখে দাও ভবিষ্যতের অন্য কারো জন্য
দীদা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে
-মানে
-মানে, আমার বউকে আমার সামনে বিয়ে দিতে চাইছো, তুমি তো দেখছি খুব হিংসুটে।সতীন বিদায় করার নতুন পন্থা নাকি এটা?

কথাটা বলেই রূপ তনুর হাতটা নিজের দুই হাতের মধ্যে মুষ্টি বদ্ধ করে নেই।
-এই বিয়ে হবে না দীদা।প্লিজ,

এবার পরিস্থিতি কেমন একটা হয়ে গিয়েছে।সবার একে অপরের মুখ তাকা তাকি করছে।কারও আর বুঝতে বাকি নেই রূপ চাইছে না বিয়েটা হোক।

আন্জুআড়া বানু এবার নড়েচড়ে বসেন।পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি বিয়ে সংক্রান্ত কার্যক্রম এখানেই বন্ধ করতে চান।

-আসলে তনুর পড়াশোনা তো শেষ হয় নি আগে শেষ হোক।তাই তনু এখন বিয়ে টিয়ে করতে চাইছে না।আর রূপও তো একটা পাগল সেসব না বলে শুধু শুধু পাগলামো করছে।স্পষ্ট বললেই তো হয় তনু এখন বিয়ে করবে না।আর ও তো তনুর হ্যা তে হ্যা মেলাবেই।অন্তর তুমি তো রূপকে চেনোও ও হয়তো মজা করছে।

আন্জুআড়া বানুর কথায় সবাই মলিন হাসি হাসে।রূপ এখনো তনুর হাত ধরে রেখেছে।
সবাই ব্যাপ্যারটা একটু সংকোচের সাথে মেনে নিলেও অন্তর বেশ বুঝতে পারছে,রূপ চাইছে না।অন্তর এতোদিন রূপের ওমন ব্যবহার ফরমালি নিলেও আজকের ঘটনাই সে নিশ্চিত রূপ তনুকে চায়।সে শুধু শুধু ওদের মাঝে আসাতে যাচ্ছিলো।
এখন অবশ্য তার লজ্জা লাগছে। বেশ লজ্জা লাগছে।
***

অন্তরের পরিবারকে দুপুরের খাবার খাইয়ে ভালোভাবে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরের বিছানায় এসে বসেন আন্জুআড়া বানু।সঙ্গে রূপের মা আর চাচী ও আছেন।
আন্জুআড়া বানু একটা পান সেজে অন্তরের মায়ে হাতে দিয়ে প্রশ্নকরে
-আচ্ছা ভাবি, তনুকে তোমার কেমন লাগে?
তিনি মৃদু হাসেন
-কেমন আবার লাগবে।ছোট থেকে তো তনুকে আমিই মানুষ করেছি আমার মতো করে।রূপ তো তোমার হাতে মানুষ।ছেলেটা সেই ছোট থেকেই তুমি ছাড়া কিছুই বুঝতো না।আমার তনুই তো আমার পায়ে পায়ে ঘুরতো।তুমি তো তনুকে দেখতেই পারতে ন…..

কথাটা বলতে গিয়ে তিনি থেমে যান আড় চোখে তাকান আন্জুআড়া বানুর দিকে।বেশ থতমত খেয়ে যায়
-আসলে আমি ওমন ভাবে বলতে চাই নি!!
-নাহ ঠিকই তো বলেছো।তনুকে আমি ভালোবাসি না।
রূপের চাচী এবার নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠেন
-সে যাই হোক।রূপের সাথে তনুর বিয়ে হলে মন্দ হয় না।দুজনই আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে।আর তনুকেও পরের বাড়ি যেতে হবে না
শেফালী বেগম ও তাতে সহমত প্রকাশ করেন

আন্জুআরা বানু শেফালী বেগমকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন
-না সেটা সম্ভব না।সে রূপ যাই বলুক। তনু ওর যোগ্য নয়।
রূপের চাচী বলে উঠেন
-রূপ যে বললো ও তনুকে বিয়ে করেছে।
এবার আন্জুআড়া বানুর চোখ মুখ লাল হয়ে যায়
-এতো দিন আমার রূপকে দেখছো এইটুকু বুঝে না ছেলে কোনটা মজা করে বলছে আর কোনটা সত্যি সত্যি বলছে?
রূপ হয়তো তনুকে পছন্দ করে কিন্তু আমাকে না জানিয়ে বিয়ে অসম্ভব।।

শেফালী বেগমের মুখটা মলিন হয়ে যায়।তিনি আজ অব্দি বুঝে উঠতে পারলেন না তার ননদকে।তার যে তনুর উপর কিসের এতো রাগ তিনি বুঝতে পারেন না।
তবে তিনিও মনে মনে চান রূপ আর তনুর বিয়েটা হোক!!

***
সন্ধায় রূপ ছাদে বসে স্মোক করছিলো।অতিরিক্ত টেনশন থেকে মুক্তির পথ।তনু কোথা থেকে এসে রূপকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
রূপ সিগারেটটা ফেলে দেয়।
-আমার এখন তোমায় চুমু খেতে মন চাইছে তবে খাবো না।
রূপ তনুকে ছাড়িয়ে নেয়।চোখে মুখে চিন্তার ছাপ।
তনু একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়
-কি হয়েছে?কি এতো ভাবছো?
-মামনীকে সবটা বললে কেমন রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারছি না!
-মা বোধয় খুব রাগ করবে!
-কষ্ট পাবে।মামনী কিছু খুব কষ্ট পাবে।
– হু
-কি হু?
-কিছু না
-হুট করে বিয়ে করাটা বোধয়…
রূপ থেমে গিয়ে আড় চোখে তনুর দিকে তাকায়।।
-আফসোস হচ্ছে তো?আফসোস করে লাভ নেই ….
-কেন?
-কেন আবার।তোমাকে বিয়েটা তো করেই নিয়েছি।এখন ভাবছি দুই চার টা বাচ্চা কাচ্চ নিয়ে নেবো।তাতে তোমার আফসোস দুই গুন তিন গুন হয়ে যাবে।তারপর একে বারে বাচ্চা কাচ্চা সহ মায়ের কাছে গিয়ে বলে দেবো। আমরা চুপি চুপি বিয়ে করে নিয়েছি বাচ্চাও নিয়ে ফেলেছি।

এবার রূপ আর তনু দুজনই হেসে দেয়।
তাদের হাসি থেমে যায় কারো পায়ের শব্দে।কেউ যেন উপরে আসছে।
রূপ আর তনু দুজনই একটু দূরত্ব নিয়ে দাড়ায়।

আন্জুআড়া বানু এসেছে।তিনি এসে তনুকে নিচে যেতে বলেন।রূপের সাথে একা কথা বলবেন।তনু যেতে চায় না।সেও শুনতে চায় মা কি বলবে।তবে তিনি তনুকে একটা ধমক দিয়ে নিচে পাঠিয় দেয়।
তনু মাকে একটা ভেংচি কেটে নিচে চলে যায়।
রূপের তনুকে দেখে ভিষন হাসি পেলেও আন্জুআড়া বানুর সিরিয়াস মুখ দেখে আর হাসে না।
তিনি রূপকে ছোট্ট করে প্রশ্ন করেন
-কেন করলি এমন?
-কেমন?
-অন্তরের পরিবারের সামনে যা করলি।তাতে কি আমার মুখ ছোট হলো না?
-সত্যিই তো বললাম
-কোনটা সত্যিই
-আমি তনুকে ভালোবাসি!এটাই সত্যিই।
এবার আন্জুআড়া বানুর বুকটা ধক করে উঠে।
রূপ স্বভাবত খুবই চাপা।তার আবেগ অনুভূতি সে খুব কম প্রকাশ করে।
ঐ তো কিছু মানুষ হয় না যাদের বুক ফাটে তবুও মুখ ফুটেনা।রূপ ঠিক তেমন ধাচের মানুষ।

রূপ যে কখনো এভাবে তনুকে ভালোবাসার কথা বলবে তা তিনি কল্পনাতেও ভাবেন নি।
তিনি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে রূপের মাথায় হাত রাখে একটু আদর করে দেয় রূপ কে।
-আমি চাইনা তনুর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠুক।আমি সত্যিই চাই না।
-আমি তনুকে বিয়ে করেছি মামনী।
রূপের এমন কথাতেও তিনি কোনো রিয়াক্ট করেন না। বেশ শান্ত গলায় রূপকে বলে
-আমি জানি তুমি এমন কিছু করবে না।তোমাকে আমি জানি,চিনি,বুঝি।তনুকে নিয়ে অনেক কমপ্লিকেশন আছে।তুমি ওর সাথে ভালো থাকবে না রূপ।
-মামনী প্লিজ।
-তোমার বাবাও কখনো চাননি তনুর সাথে তোমার বিয়ে হোক।তনুর রক্তে দোষ আছে।সে তোমার যোগ্য নয়।কোনো ভাবেই নয়। তোমার বাবাকে দেওয়া কথা আমাকে রাখতে হবে।তোমার বাবাকে কথা দিয়েছিলাম…. আমি মরার পরও শান্তি পাবো না।এমন কিছু করোনা বাবা!!

রূপ আর কিছু বলতে পারছে না।তিনিও আর কিছু বলেন না নিচে চলে আসেন।

তনু আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।সে এতোক্ষণ লুকিয়ে ছিলো দেওয়ালের আড়ালে…..তনু ছুটে এসে রূপকে জড়িয়ে ধরে।
-এক্ষুণি হাসপাতালে যাবো চলো
-কেন?হাসপাতালে কেন?শরীর খারাপ লাগছে?
-আরে না।রক্ত পরিক্ষা করতে,তাতে বুঝা যাবে আমার রক্তে কোনো ইনফেকশন আছে কি না,যেটা তোমার কাছে পার হতে পারে!!
-ধ্যাত
-চলো না,মা তো এই ভয়েই তোমাকে আমার থেকে দূরে দূরে….
-তনয়া আমায় বিশ্বাস করিস?
-উহু
-করিস না?
-হু করি তো।
-একটা কথা মনে রাখবি,এই পৃথিবীর সবথেকে খারাপ পরিস্থিতি ও যদি কখনো তোর জীবনে আসে সেই পরিস্থিতিতেও আমি তোর সাথে আছি।কখনো ভেঙ্গে পরবি না!!
-তুমি কতো বদলে গেছো।
-কিহ্
-এই যে কতো ভালোবাসছো আমায়।আগে বাসতে না!
-(…)
-একবার বলো ভালোবাসি।
রূপ চুপ করে আছে।
-বলবে না?
-(…)
-বেশ বলতে হবে না

এরই মাঝে তনুর ডাক পরে।শেফালী বেগম ডাকছে নিচে তনু ছুটতে ছুটতে নিচে চলে যায়…
আর কিছু বলে না

রূপ ছাদের রেলিং ধরে দাড়িয়ে ভাবতে থাকে মামনীর বলা কথাগুলো।
মামনী যে কথাগুলো প্রথমবার বলছে এমনটা নয় এর আগেও বলেছে।আন্জুআড়া বানু যখনই তনুর প্রতি রূপের দূর্বলতা অনুভব করতো তখনই তাকে বাঁধা দিতো বার বার করে বাঁধা দিতো।
কিন্তু প্রত্যেক বাঁধা যেন তনুর প্রতি রূপের আবেগ অনুভূতিগুলোকে আরো তীব্র করে তোলে।ঐ যে হিউম্যান সাইকোলজি।
মানুষ নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আরো বেশি করে আকর্ষন অনুভব করতে থাকে।রূপও তার ব্যতিক্রম নয়।

তনু নিচে এসে দেখেন শেফালী বেগম খাবার টেবিল গুছিয়ে রাখছে।তনু সেখানে এসে দাঁড়াতেই তিনি তনুরকে বলেন,আদা দিয়ে কড়া করে চা বানাতে।খুব করে মাথা ধরেছে।তনুর হাতে চা না খেলে এখন তার চলবেই না

তনু রান্না ঘরে যাওয়ার সময় চোখ পরে টেবিলের ঝুড়িতে থাকা জমজ কমলালেবুর দিকে।
তনু তার হাত থেকে নিয়ে নেয়
-এটাতো আমিই খাবো তাহলে আমার জমজ বাচ্চা হবে।আচ্ছা বাচ্চা হলে দুজনই আমার মতো হবে না কি রূপের মতো?
নিজে নিজে বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়।

এদিকে তিনি কিছু না বলে হাসতে থাকেন।
****
রূপ পকেট থেকে ফোন বার করে অন্তরকে ফোন দেয়…
দুইবার রিং হওয়ার পর অন্তর কল রিসিভ করে
রূপকে একনাগাড়ে কয়েকটা গালি দিয়ে নেয়।
তারপর শান্ত হয়ে প্রশ্ন করে এবার বল কি চাই তোর?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here