তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -০২-৫

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ২

আরমান আর না দাড়িয়ে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো বাসা থেকে কারণ ইমার ওপর দিয়ে এখন যেটা যাবে সেটা হয়তো ওর সয্য হবে না। ইমা দাঁড়িয়ে ছিলো পাথরের মতো। কিছু বুঝে উঠার আগেই ইমার ঘন চুলের এলোমেলো হাত খোঁপাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো ইমার মণি। ব্যাথায় ইমা আহ্ করে চিৎকার করে উঠলো। চুলের টান একদমই সয্য করতে পারে না ইমা। কিন্তু বারবার এই আঘাতটাই করা হয় তাকে।

ব্যাথা কাতর গলায় ইমা বললো, মণি ব্যাথা পাচ্ছি ছেড়ে দাও প্লিজ।

মণি হুংকার ছেড়ে বললো, আমার ছেলের খাওয়া নষ্ট করে এখন এইটুকুই সয্য হচ্ছে না তোর ?

ইমার খালাতো বোন কথা এতোক্ষণ চুপচাপ বসে খেয়ে যাচ্ছিলো। এতোকিছু দেখে আর চুপ থাকতে পারলো না। ইমার প্রতি তার মায়ের অত্যাচার দিনদিন বেড়েই চলেছে। চোখ বুজে সয্য করা ছাড়া তারও কিছু করার নেই। কারণ এই বাড়িতে সে নিজেও মূল্যহীন মানুষ। যেখানে তার মা নিজের মেয়েকে ভালোবাসতে পারে না সেখানে ইমাকে কী ভালোবাসবে ? সে তো বোনের মেয়েই।

কথা উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মা আপুকে মারছো কেনো ? আজকের পরোটা আপু নয় আমি বানিয়েছি।

কথার মা চমকে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়ে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না তাদের কারো সাথে। তাতে অবশ্য খুব একটা যায় আসে না তাদের কারো।

মেয়ের কথা শুনে অবাক হলেও পরে কর্কশ গলায় বললেন, তুই কিচেনে কেনো গিয়েছিলি ?

কথা বললো, আপুকে এক কাপ চা দিতে বলতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি আটা মাখতে পারছে না হাতের জন্য। গতকাল তো তুমি আর তোমার ছেলে মিলে হাতটা পুড়িয়ে দিয়েছো। তাই আমি বানিয়েছি পরোটা আর আপু বাকি কাজ করেছে।

এটা শুনে মণি যেনো আরো ক্ষেপে গেলো আর বললো, একেবারে রাজকার্য করে দিয়েছো আমার, একদিন পরোটা বানিয়ে। কিচেনে কে যেতে বলেছে তোকে ? আগুনে পোঁড়ে গায়ের রং আরো কালো হলে বিয়ে দিবো কীভাবে ? এমনিতেই কয়লার ড্রাম হয়ে জন্মেছিস আমার ছেলের কতো টাকা নষ্ট করতে হবে তোকে ঘাড় থেকে নামাতে কে জানে ?

কথা ধরা গলায় বললো, আমার বিয়ে নিয়ে তোমাদের না ভাবলেও চলবে।

কথা আর দাঁড়ালো না নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। হ্যাঁ এই গায়ের রঙের জন্য কথার নিজের পরিবারের সাথে আজ #তিক্ততার_সম্পর্ক।
কথার গায়ের রং শ্যামবর্ণের। টানাটানা চোখ, মাথা ভর্তি লম্বা চুলগুলো দেখে মনে হয় কার্লি করা, গালে টোল পরা হাসি যেটা খুব একটা দেখা যায় না। এই বাড়িতে ইমা আর নানুর সাথেই একটু কথা বলে সে। বাবা-মা ভাই সবার কাছেই যে একটা বোঝা কথা। ইমা এ বাড়িতে আসার আগে সম্পূর্ণ একা ছিলো সে।

কথা চলে যেতেই মণি ইমার চুল আরো শক্ত করে ধরে বললো, ও বললো রান্না করবে আর তুইও করতে দিলি ? যদি ওর হাত পোড়ে যেতো। এমনই কালো আবার হাত পোড়ে গেলে বিয়ে দিতাম কীভাবে হ্যাঁ ? কী চাইছিস যাতে আমার মেয়েটাকে বিয়ে দিতে না পারি ?

ইমা কাঁদতে কাঁদতে বললো, না মণি, আমি ওকে না করেছিলাম কিন্তু আমার কথা শুনেনি।

মণি দাঁতে দাঁত চেপে বললো, পোড়া হাতের জন্য রান্না করতে পারিসনি তাই না ? দাড়া এখনই সারিয়ে দিচ্ছি তোর হাত||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

এটা বলে ইমার হাতের ব্যান্ডেজ খুলতে লাগলো। ইমা বাঁধা দিয়ে বললো, কী করছো মণি ছেড়ে দাও।

মণি ওর কোনো কথা না শুনে ব্যান্ডেজ খুলে ফেললো আর বেড়িয়ে এলো লাল টকটকে ঘা। টেবিলের ওপর থেকে তরকারির বাটিটা নিয়ে ইমার হাতের ওপর ঢেলে দিলো। ইমার চিৎকারে পুরো বাড়িটা যেনো কেঁপে উঠলো। মণি ইমাকে ছেড়ে দিতেই ইমা দৌড়ে কিচেনে গিয়ে বেসিন ছেড়ে পানির নিচে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলো। বেশ কিছু সময় হাতটা পানিতে ভিজিয়ে রেখে দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো ইমা। কাঁদতে লাগলো নিশব্দে যে কান্না কেউ দেখতে পাবে না। হঠাৎ কাঁধে কেউ হাত রাখলে তার দিকে তাকালো।

নানু বলে জড়িয়ে ধরলো ইমা তাকে। বয়সের ভাড়ে গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। দুধে আলতা গায়ের রং, ঝুলে পড়েছে গালের চমড়া। তবু অদ্ভুত এক সুভ্রতা ছড়াচ্ছে যেনো। দেখেই বুঝা যায় অল্প বয়সে ভয়ংকর সুন্দরী ছিলেন।

নানু ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, বোনরে তুই চলে যা এখান থেকে।

ইমা কাঁদতে কাঁদতে বললো, কোথায় যাবো নানু ? আমার যে এই পৃথিবীতে যাওয়ার জায়গার বড্ড অভাব নানু বড্ড অভাব।

নানু ধরা গলায় বললো, এখানে থাকলে ছাহেরা (ইমার মণি)তোকে তিলেতিলে মেরে নিজের রাগ মিটাবে।

ইমা হেঁচকি তুলে বললো, মণির কিসের এতো রাগ আমার ওপর নানু ? আমি তো মণির সব কথা শুনি।

নানু বললো, ছাহেরার রাগ তোর ওপর না রে বোন তার রাগ তোর বাবা-মায়ের ওপর। যেটা তোকে কষ্ট দিয়ে মিটানোর চেষ্টা করছে।

ইমা অবাক হয়ে বললো, আমার বাবা-মায়ের ওপর কিসের রাগ মণির ?

নানু মলিন মুখে বললো, সেটা আমি তোকে বলতে পারবো না রে ইমা। তাই বলছি তুই এখান থেকে চলে যা।

ইমা আবার কেঁদে উঠে বললো, কোথায় যাবো বলো আর আমি চলে গেলে তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। আরমান ভাইয়া বলে দিয়েছে শুনোনি ? আমি এই বাড়ির বাইরে পা রাখলে তোমাকেও বের করে দিবে বাড়ি থেকে। আর আমি নাহয় কোনো রকমে নিজের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিবো তোমার প্রতিদিন যে মেডিসিন লাগে সেই খরচ আমি জোগাড় করতে পারবো না।

নানু বললো, আমাকে বের করে দিলে আমি নাহয় পথে পথে ঘুরবো তবু তুই চলে যা ইমা।

ইমা কেঁদে বললো, আমি পারবো না তোমাকে একা রেখে যেতে। আর এই পৃথিবী একটা একা মেয়ের জন্য কতটা কঠিন তুমি হয়তো জানো না নানু।

নানু রেগে বললেন, তাহলে কী এখানে এভাবে পঁচে মরবি তুই ?||লেখনীতে তাহমিনা তমা||

ইমা চোখের পানি মুছে বললো আমার ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে। কিন্তু আমি তোমাকে একা ফেলে যেতে পারবো না নানু।

কথাটা শেষ করে উঠে আসতে গেলে নানু বলে উঠলো, ইমা তুই আরমানের কথায় রাজি হয়ে যা।

এ কথায় ইমা চমকে তার নানুর দিকে তাকালো তারপর শান্ত গলায় বললো, নানু আরমান ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে না তার ইগো হার্ট হয়েছে আমি রিজেক্ট করায়। তাই আমার সাথে এসব করছে। আমিও দেখি উনি আর কত নিচে নামতে পারে।

ইমা উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। আরমানকে যেদিন ভার্সিটির সবার সামনে রিজেক্ট করেছিলো সেদিন থেকেই ইমার অভিশপ্ত দিনের শুরু। ভার্সিটিও তার এখন যাওয়া হয় না খুব একটা। কোনো সপ্তাহে দু-দিন আবার কোনো সপ্তাহে একদিনও না। শুধু পরিক্ষাটা দিতে পারে। ক্লাস ছাড়া, টিউশন পড়া ছাড়া টেনেটুনে পাশ করা ছাড়া ভালো রেজাল্ট করার ভাগ্য হয় না তার। পোড়া হাত নিয়ে এ সপ্তাহে ইচ্ছে করেই ভার্সিটি যাবে না ঠিক করেছে ইমা। কেউ দেখলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাকে।

৪.
এদিকে কথা রেডি হয়ে কলেজের জন্য বের হয়ে গেলো। কথা এবার ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ছে, পড়াশোনা ছাড়া বাকি কোনো দিকে তার নজর যায় না। পড়াশোনা শেষ করে পরিবারের সাথে #তিক্ততার_সম্পর্ক থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে চায় সে। বাবা-মা ভাই সবার থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চায়। এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তা পাড় হচ্ছিলো তখনই একটা গাড়ি সজোরে ব্রেক করলো তার সামনে। কথা ভ্রু কুঁচকে তাকালো গাড়ির দিকে। কানে হেডফোন লাগিয়ে ফুল স্প্রিডে গাড়ি চালাচ্ছিলো ইশান। ড্রাইভ করতে তার খুব ভালো লাগে কার রেস করে মাঝে মাঝে। কার রেসে সবসময় চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। সকালে ইয়াদ ওকে না নিয়ে যাওয়ায় মন খারাপ ছিলো তাই একটু বেশি স্প্রিডে চালাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা মেয়ে সামনে চলে এলে সজোরে ব্রেক করায় মাথাটা স্টিয়ারিং এ ধাক্কা খেলো। মাথা না কাটলেও বেশ ব্যাথা পেয়েছে তাই রাগী ফেস নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে মেয়েটার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ নেই বরং ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

ইশান গাড়ি থেকে নেমে রেগে বললো, দেখে রাস্তা পার হতে পারেন না ? এখনই এক্সিডেন্ট করলে তো রাস্তার লোকজন আমাকে গণধোলাই দিতো।

কথা ইশানকে দেখতে লাগলো। সিল্কি চুল বাতাসে উড়ছে, গায়ের রং সদ্য জন্মানো ইঁদুরের বাচ্চার মতো। একবার স্টোররুমে পুরোনো একটা বই খুঁজতে গিয়ে কথা দেখেছিলো সদ্য জন্মানো ইঁদুর ছানা। এর গায়ের রং তেমনই লাগছে কথার কাছে , এটা ভেবে আনমনে হাঁসলো কথা। ছেলেটা জোড়া ভ্রু কঁচকে তাকিয়ে আছে কথায় দিকে, ঠোঁটগুলি লাল রঙের, গায়ে ব্ল্যাক টিশার্ট আর ব্লু জিন্স প্যান্ট, টিশার্টের গলায় সানগ্লাস ঝুলিয়ে রেখেছে। কথা বড়সড় একটা ক্রাশ খেলো। কিন্তু পরক্ষণে নিজের অবস্থান মনে পরতেই নিজেকে সামলে নিলো। তার জন্য এসব চিন্তা করাও অন্যায়। ইশান উত্তর না পেয়ে কথাকে একবার দেখে নিলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। সাদা আর ব্লু কম্বিনেশনের কলেজ ড্রেস পরা, মাথায় সাদা হিজাব, কাঁধে ব্যাগ আর হাতে একটা মোটা গাইড দেখে স্কুলের মেয়ে মনে হচ্ছে। গায়ের রং কালো বলা চলে না তবে শ্যামবর্ণ। কিন্তু সাদা হিজাব পড়ায় কালোই লাগছে।

কথা নিজেকে সামলে খুব আস্তে বললো, সরি।

ইশান একটু অবাক হলো কারণ মেয়েটা এতো সহজে সরি বলে দিবে ভাবেনি। কারণ দোষ তার নিজেরও ছিলো এই রোডে যতটুকু গতিতে গাড়ি চালানোর নিয়ম তার প্রায় তিনগুণ বেশি গতিতে ইশান চালাচ্ছিলো। ইশান মনে মনে ভালো হয়তো তাকে দেখে ভয় পেয়ে সরি বলে দিয়েছে।

এটা ভেবে একটু ভাব নিয়ে বললো, এই পিচ্চি এরপর থেকে রোড ক্রস করার আগে ভালো করে দেখে নিবে কেমন ?

পিচ্চি শব্দটা শুনে কথার রাগ উঠে গেলো। সে এখন কলেজে পড়ে তাকে কেনো এখন কেউ পিচ্চি বলবে। রাগে কথার চিকন নাকটা ফুলে গেলো।||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||

কথা রেগে বললো, আপনি পিচ্চি কাকে বলছেন হ্যাঁ ? Now I am a college student.

কথার রাগ দেখে ইশান অবাক হলো। পিচ্চি মেয়ের আবার এতো রাগ। ইশান অবাক হয়ে বললো, আমি তো মনে করেছি তুমি স্কুলে পড়ো।

কথা কটমট করে তাকিয়ে আছে ইশানের দিকে। তা দেখে ইশান দুষ্টুমি করে বললো, আর কলেজে পড়লেই বড় হয়ে গেলা নাকি তুমি তো পিচ্চিই।

কথা বাড়তি কথা বলা পছন্দ করে না তাই ইশানের দিকে একটা কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে চলে গেলো সামনে থেকে। ইশানও মুচকি হেঁসে টিশার্টের গলা থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে দিলো আর শিষ বাজাতে বাজাতে গাড়িতে উঠে ভার্সিটির দিকে যেতে লাগলো।

৫.
ইয়ানা গাড়িতে বসেই ছেলেটাকে দেখিয়ে দিলো ইয়াদকে। গেইটের সামনে বাইকে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডা দিচ্ছে বললে ভুল হবে সেখান দিয়ে যাওয়া মেয়ের টিস করছে। এসব দেখে ইয়াদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রাগে।

ইয়াদ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বললো, তুই যা।

ইয়ানা অবাক হয়ে বললো, মানে ? তুমি কিছু বলবে না ওদের ?

ইয়াদ রেগে বললো, তোকে যেটা করতে বলছি সেটা কর না।

ইয়ানা একটু ভয় পেলো ইয়াদের রাগ দেখে। ইয়াদ ইয়ানার সামনে নিজের রাগ প্রকাশ হতে দেয় না। আজ একটু প্রকাশ পেলে ইয়ানা ভয় পেয়ে যায়। ইয়াদ বোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাই চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দুটো নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো ইয়াদ।

নরম গলায় বললো, তুই ভার্সিটির ভেতরে যা আমি দেখছি ওরা কী করে ?

ইয়ানা আর কথা না বাড়িয়ে ওকে বলে চলে গেলো গাড়ি থেকে নেমে। গেইটের সামনে যেতেই সবগুলো ছেলে শিষ বাজিয়ে উঠলো। ছেলেটার নাম জাহিদ দেখেই বুঝা যায় একটা বখাটে।

সে সবাইকে থামিয়ে বললো, হেই বেবি তুমি না গতকাল বললে আমি তোমাকে আর বিরক্ত করলে তোমার ভাইয়াকে বলে দিবে ? জানো আমি না একদম ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

এটা বলেই উচ্চস্বরে হেঁসে উঠলো সাথে থাকা সবগুলো যোগ দিলো। ইয়ানা হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে আগাতে চাইলে জাহিদ পথ আঁটকে দাঁড়ালো।

ইয়ানার দিকে ঝুঁকে বললো, হেই বেবি এতো তাড়া কিসের সবসময় ঐ আরমান মাহমুদের ক্লাস করার জন্য একদম উতলা হয়ে থাকো দেখি। চলো আজ আমি তোমাকে ক্লাস করাবো।

জাহিদের মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে আর তাতে ইয়ানার পেটের সব বেড়িয়ে আসার উপক্রম।

ইয়ানা কাঁপা গলায় বললো, আমার সামনে থেকে সরে যান বলছি নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আমার ক্লাসের লেট হচ্ছে।

ইয়ানা পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গেলে জাহিদ খপ করে ইয়ানার হাত ধরে ফেলে। এতোক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে ইয়াদ নিজের রাগ কন্ট্রোল করে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ানার হাত ধরায় ইয়াদের মাথায় যেনো থপ করে আগুন জ্বলে উঠলো আর কন্ট্রোল করা সম্ভব না তার পক্ষে। ইয়াদ গিয়ে জাহিদের হাতটা এতো শক্ত করে ধরলো যে জাহিদ ব্যাথায় আহ্ করে উঠলো আর ইয়ানার হাত ছেড়ে দিলো।

জাহিদ রেগে বললো, কোন শালার রে এতোবড় সাহস জাহিদের হাত ধরে।

জাহিদ ঘুরে তাকিয়ে দেখে একহাত পকেটে রেখে অন্যহাত দিয়ে জাহিদের হাত ধরে রেখেছে ইয়াদ। ইয়ানা পাশে তাকিয়ে নিজের ভাইয়াকে দেখে মুখে হাঁসি ফোটে উঠলো। কিন্তু ইয়াদের লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

ইয়ানা কিছু বলবে তার আগেই ইয়াদ ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো, সোজা ক্লাসে যাবি একবারও পিছনে ফিরে তাকাবি না যা।

ইয়াদের মুখ দেখে ইয়ানার আর কিছু বলার সাহস হলো না সোজা হাটা শুরু করলো ক্লাসের দিকে। ইয়ানা যত আগাচ্ছে জিহাদের হাতে চাপের পরিমাণ ততো বাড়ছে। ইয়াদ তাকিয়ে আছে ইয়ানার যাওয়ার দিকে। সে চায় না তার বোন তার এই ভয়ংকর রুপ দেখুক। এদিকে জাহিদ একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর ব্যাথায় হাত মোচড়ামুচড়ি করছে। ইয়াদ তাকিয়ে দেখলো ইয়ানা তার চোখের আড়াল হয়ে গেছে। জাহিদ রেগে খোলা হাতটা দিয়ে ইয়াদকে মারতে গেলে ইয়াদ পকেটে থেকে হাত বের করে ধরে ফেললো।

জাহিদ বললো, এই কে রে তুই, জানিস আমার সাথে এসব করার ফল কী হবে ?

ইয়াদ রেগে জাহিদের দু’হাত একসাথে মোচড় দিলো আর জাহিদ জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলে ইয়াদ জাহিদের গায়ের শার্টটা টান দিয়ে খুলে ওর মুখে পেঁচিয়ে দিলো যাতে চিৎকার করতে না পারে। ইয়াদের মার দেখে জাহিদের বন্ধুদের ভয়ে অবস্থা খারাপ।

ইয়াদ রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আমি কে সেটা জানতে চাস ? একটু আগে যে মেয়েটার হাত ধরার সাহস করেছিলি সেই মেয়ের ভাই। নাম জানিস ঐ মেয়ের ? ইয়ানা হামিদ এই আবরার হামিদ ইয়াদের একমাত্র দুর্বলতা। এই ইয়াদের কলিজার টুকরা ইয়ানা হামিদ। যাকে ছাড়া আর পৃথিবীর কারো জীবনের এক বিন্দু মূল্য নেই আবরার হামিদ ইয়াদের কাছে।

ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে জাহিদের আত্মা কেঁপে উঠলো ভয়ে। ভয়ংকর দেখতে লাগছে ইয়াদকে।

ইয়াদ জাহিদের কানের কাছে গিয়ে ধীর গলায় বললো, আমি তোর কলিজাটা বের করে দেখতে চাই। কতবড় কলিজা নিয়ে তুই আবরার হামিদ ইয়াদের বোনের হাত ধরেছিস।

জাহিদ ভয়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। মুখও বেঁধে দিয়েছে ইয়াদ তাই কিছু বলতেও পারছে না। জাহিদের বন্ধুরা ভয়ে অনেক আগেই পালিয়ে গেছে। মুহুর্তের মধ্যে কয়েকটা কালো গাড়ি এসে থামলো ইয়াদের সামনে আর জাহিদকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেলো। ইয়াদ বাকা হাসি দিয়ে নিজের ড্রেসটা একটু ঝেড়ে গাড়িতে উঠে গেলো।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৩

ইয়াদ সোজা নিজের অফিসে চলে গেলো। ইয়ানা ক্লাসের সামনে এসে দেখে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ভয়ে একটা ঢোঁক গিলে নিলো ইয়ানা। আজকের প্রথম ক্লাসটাই আরমান স্যারের। আরমান মাহমুদ এই ভার্সিটিতে পড়াশোনা শেষ করে এখানেই টিচার হিসাবে জয়েন করেছে। আগে অনার্স পর্যন্ত ক্লাস নিতো কিন্তু নিজের যোগ্যতার জন্য এখন মাস্টার্সের ক্লাসও নেয়। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রং, বড়বড় ভাসা চোখ, মাথার চুলগুলো হালকা কোঁকড়ানো, পিংক কালার ঠোঁট, আর সবচেয়ে নজরকাড়া তার গালের টোল পড়া হাঁসি আর সে সুঠাম দেহের অধিকারী। ভার্সিটির সব মেয়ে তার জন্য পাগল কিন্তু সবাই জানে তার কাছে পাত্তা পাওয়া যাবে না, চার বছর আগে আনার্স ফাস্ট ইয়ারের ইমা নামের একটা মেয়েকে নবীন বরণ অনুষ্ঠানে সবার সামনে প্রপোজ করেছিলো আরমান স্যার। তখন স্যার হিসাবে কেবল জয়েন করেছিলেন তিনি। মেয়েটা স্যারকে রিজেক্ট করে কিন্তু পরে জানা যায় স্যারের বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলো স্যার। স্টুডেন্টকে প্রপোজ করতে পারবে না বলে তার বন্ধুরা বাজি ধরেছিলো। তবে এই ব্যাপারটা পুরো বছর সমালোচনায় ছিলো। এরপর আর এমন কোনো কিছু ঘটেনি যাতে বুঝা যাবে স্যার সত্যি মেয়েটাকে ভালোবাসে। ইয়ানা অবশ্য মেয়েটাকে দেখেনি। একদম শান্ত স্বভাবের মানুষ স্যার কিন্তু ঠান্ডা মাথায় থেকে নরমাল কথায় কীভাবে মানুষকে অপমান করা যায় সেটা হয়তো তার থেকে শেখা উচিত। ইয়ানা ভাবছে তাকে হয়তো আজ এতো স্টুডেন্টর সামনে অপমানিত হতে হবে।

ইয়ানা কাঁপা গলায় বললো, May i come in, sir ?

আরমান দরজার দিকে না তাকিয়ে বললো, Come and stand in front.

ইয়ানা অবাক হয়ে তাকালো। সে সামনে এসে কেনো দাঁড়াবে বুঝতে পারলো না। বেশি কথা না বলায় ভালো মনে করে ইয়ানা চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে সামনে দাঁড়ালো। ||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||

আরমান বইয়ের দিকে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রেখে বললো, ডিয়ার স্টুডেন্টস মিস ইয়ানাকে ভালো করে দেখে নিন। ইনি আমাদের দেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি ইয়াসির হামিদের মেয়ে এন্ড আবরার হামিদ ইয়াদের বোন। তাই ভার্সিটির নিয়মে উনি চলেন না বরং উনার নিয়মে ভার্সিটি চলে। যখন ইচ্ছে করবে তখন আসবে আর যখন ইচ্ছে চলে যাবে।

সবাই চুপচাপ বসে আরমানের কথা শুনছে। অন্য কোনো স্যার একথা বললে হয়তো এতোক্ষণ হাসির রোল পড়ে যেতো কিন্তু আরমানের ক্লাস বলে সবাই চুপ। কারণ সবাই জানে হাঁসলে আবার তাদের কোন অপমানের স্বীকার হতে হবে কে জানে। আর এদিকে অপমানে ইয়ানার চোখ টলমল করছে পানিতে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফ্লোরের দিকে।

আরমান আবার বললো, মিস ইয়ানা আপনার এই নিয়মটা অন্য টিচারদের ক্লাসে প্রয়োগ করবেন। আমার ক্লাস করতে হলে ভার্সিটির নিয়মেই ক্লাসে আসতে হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন মিস ইয়ানা হামিদ ?

ইয়ানা শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। তা দেখে আরমান বললো, এবারের মতো সুযোগ পেয়েছেন তবে টেক্সট টাইম এমন হলে আমার ক্লাসে আসতে পারবেন না। এবার নিঃশব্দে নিজের জায়গায় গিয়ে বসুন।

ইয়ানা আরমানের কথামতো নিঃশব্দে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। ইয়ানা সিটে বসলে তার বেস্টফ্রেন্ড নিধি তাকে সান্ত্বনা দেয় পিঠে হাত রেখে। ইয়ানা কখনো বাবা কিংবা ভাইয়ের পাওয়ার ভার্সিটিতে দেখায় না। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ার জন্য সব টিচার অতন্ত্য স্নেহ করে তাকে। কিন্তু আরমানের কাছে ভালো কিংবা খারাপ কোনো স্টুডেন্টের আলাদা জায়গা নেই। তার কাছে সবাই একই ব্যবহার পায়। যে একদিনও আরমানের কোনো কোশ্চেনের আনসার দিতে না পারে, সে যেমন অপমানের স্বীকার হয় আর যে প্রতিদিন তার সব কোশ্চেনের আনসার দিতে পারে কিন্তু একদিন কোনো কারণে দিতে না পারলে সেই একই অপমানের স্বীকার হয়। ইয়ানা চেনে আরমানকে তাই তার কথায় মন খারাপ না করে চোখ মুছে ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।

৬.
ইয়াদ অফিসে গিয়ে নিজের কেবিনে চলে গেলো আর পিছুপিছু গিয়ে উপস্থিত হলো তার পি.এ রনিত সরকার ছিপছিপে গড়নের একটা ছেলে। ছেলেটা হিন্দু তবে খুবই শান্ত স্বভাবের। সেটা না হলে হয়তো ইয়াদের কাছে এতোদিন টিকতে পারতো না। ইয়াদ যদি বিনা কারণে রেগে রনিতের মাথায় একটা বারিও দেয় সে নিজের আঘাতের কথা চিন্তা না করে বলবে স্যার আপনার লাগেনি তো। ইয়াদ তাই খুবই স্নেহ করে রনিতকে হয়তো ততটা ইশানকেও করে না |লেখনীতে তাহমিনা তমা|

ইয়াদকে রেগে থাকতে দেখে রনিত ভয়ে ভয়ে বললো, স্যার কফি আনবো আপনার জন্য ?

ইয়াদের মাথা থেকে কিছুতেই ইয়ানার ভীত ফেসটা যাচ্ছে না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেটা আর সাথে ছেলেগুলোর বাজে কথা কানে বাজছে। ইয়ানাকে খুব ভালোবাসে ইয়াদ বলা যায় ইয়ানা ইয়াদের প্রাণভোমরা। বোনটা ছাড়া আপন আছেই বা কে তার ? যারা আছে সবাই মুখোশধারী তাদের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে আছে ঘৃণিত চেহারা। তাই একমাত্র বোনের কষ্টে তার হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হয় যায়।

ইয়াদ থমথমে গলায় বললো, রনিত আজকের রুটিন কী ?

রনিত নিজের হাতের ডায়েরিটা খুলে দেখে বললো, স্যার আজকে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত পরপর তিনটা মিটিং আছে। প্রথমেই আছে খান গ্রুপ অব কোম্পানির সাথে আর তারপর মির্জা গ্রুব অব কোম্পানি আর শেষে একটা কোরিয়ান কোম্পানির সাথে মিটিং।

ইয়াদ বললো, এর মধ্যে কোনো মিটিং ক্যানন্সেল করা যাবে ?

রনিত বললো, নো স্যার প্রত্যেকটা মিটিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কোম্পানির জন্য। তবে মাঝে আধঘন্টার লান্স ব্রেক আছে।

এটা শুনে ইয়াদ বাকা হাঁসলো তারপর রনিতকে বললো মিটিংয়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট হয়েছে কিনা দেখে নিতে। রনিত ইয়াদের কথামতো চলে গেলো মিটিং রুমের দিকে। কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হলো মিটিং। পরপর দুইটা মিটিং শেষ করে বের হয়ে ইয়াদ।

ইয়াদের পেছন পেছন রনিত বের হয়ে বললো, স্যার পরের মিটিংটা একটা ফাইভ স্টার হোটেলে।

ইয়াদ অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে পা বাড়িয়ে বললো, ফাইলগুলো সাথে নিয়ে অফিসের গাড়ি দিয়ে চলে যেও আর লোকেশন আমাকে টেক্সট করে দিও ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবো।

রনিত বললো, স্যার এখন কোথায় যাচ্ছেন ? এখন তো আপনার লান্সের সময়।

রনিতের কথা শুনে রাগি চোখে তার দিকে তাকালে রনিত মাথা নিচু করে ফেলে আর বলে, সরি স্যার।

ইয়াদ রাগি গলায় বললো, আমার কাজে কারো ইন্টারফেয়ার আমি পছন্দ করি না সেটা বারবার ভুলে যাও কেনো রনিত ? আমার কাজের কইফত চাওয়ার অধিকার আমি কাউকে দেয়নি আর কখনো দিবোও না। আর কখনো এই ভুলটা করো না ফল ভালো হবে না। যেটুকু করতে বলেছি শুধু সেটুকুই করবে।

রনিত মাথা নাড়িয়ে বললো, ওকে স্যার।

ইয়াদ গোটাগোটা পা ফেলে বের হয়ে গেলো অফিস থেকে। রনিত যেনো এতোক্ষণে ভালো করে শ্বাস নিতে পারছে। যতক্ষণ ইয়াদ সামনে থাকে শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হয়। এই অফিসে চার ভাগের এক ভাগ মেয়ে আর বাকি সব ছেলে। মেয়ে যারা আছে ইয়াদের সামনে যাওয়ার অনুমতি নেই। মেয়েগুলো ইয়াদকে দূর থেকে দেখে শুধু আফসোস করে এমন একটা ছেলেকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয় না তাদের। ইয়াদ ফুল স্প্রিডে গাড়ি চালিয়ে ফার্মহাউসের একটা গোডাউনে হাজির হলো। সেখানে হাতপা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে জাহিদ আর তার সাথেই তার সেই বন্ধুরা। ইয়াদ তা দেখে বাঁকা হেঁসে একটা চেয়ার টেনে তাদের সামনে বসলো। আশেপাশে গান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদের গার্ডগুলো। প্রত্যেকটা গার্ড বডি- বিল্ডার আর ক্যারাটে জানা সাথে শার্প শুটার প্রত্যেকে। ইয়াদ নিজেই তাদের তৈরি করেছে একজন ক্যারাটে মাস্টারের সাহায্যে। ইয়াদ নিজে ক্যারাটেতে অভিজ্ঞত এন্ড শার্প শুটার। ইয়াদের কথায় কেউ ওদের গায়ে হাত তুলেনি শুধু তুলে এনে বেঁধে রেখেছে। ইয়াদ ওদের দিকে তাকাতেই তখনকার সব আবার চোখে ভাসতে লাগলো আর রাগে কাঁপালের রগ ফোটে উঠলো। যতক্ষণ না ওদের উচিত শাস্তি দিচ্ছে ইয়াদের শান্তি হবে না।

ইয়াদ তার মেইন গার্ড জাম্বীর দিকে তাকিয়ে বললো, গরম লোহা নিয়ে এসো জাম্বী।

জাম্বী আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছিলো ইয়াদ বলতেই ইয়াদের সামনে এনে রাখলো। ইয়াদ হাতে গ্লাভস পড়ে লোহাটা হাতে নিয়ে জাহিদের হাতে চেঁপে ধরলো। জাহিদ চিৎকার করতে পারছে না শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

ইয়াদ পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে জাহিদের ছটফট দেখে। দাঁত কিটমিট করে ইয়াদ বললো, আমার বোনের নরম হাতের স্পর্শের পর এমন গরম স্পর্শ কেমন লাগছে মিস্টার জাহিদ তালুকদার ?

জাহিদ শুধু ছটফট করছে। লোহাটা একসময় জাহিদের হাতটা ভেদ করে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে গেলো।

ইয়াদ জাম্বীকে বললো, মুখটা খুলে দাও জাম্বী।

ইয়াদের কথামতো জাম্বী মুখটা খুলে দিতেই জাহিদ গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো।

ইয়াদ চিৎকার শুনে এক কানে হাত দিয়ে একচোখ বন্ধ করে বললো, কানের বারোটা বাজাবি নাকি ?

ইয়াদ জাম্বীর দিকে তাকিয়ে বললো, এই জাম্বী দেখতো এর জিহ্বা বড্ড আওয়াজ করে। খুব রোমান্টিক কথাও বের হয়। আজ থেকে যেনো একটা শব্দও বের না হয়।

ইয়াদের কথার মানে বুঝতে পেরে জাম্বী জাহিদের দিকে এগিয়ে গেলে জাহিদ বলে, অনেক বড় ভুল করছো আবরার হামিদ ইয়াদ এর ফল খুব ভয়ংকর হবে।||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||

ইয়াদ রেগে বললো, আমার বোনের দিকে সামান্য বাজে নজর দেওয়ার জন্য তোদের এই অবস্থা করেছি এবার বুঝে নে আমি কতটা ভয়ংকর। আবরার হামিদ ইয়াদের থেকে ভয়ংকর একমাত্র আল্লাহর সৃষ্টি ছাড়া মানুষের সৃষ্টি আর কিছু হতে পারে না। জাম্বী তোমাকে কী বললাম দাঁড়িয়ে আছো কেনো যাও ? আজকের পর এই রাস্কেল আর ওর বন্ধুরা যাতে কোনো মেয়ের দিকে তাকানো, ওহ্ সরি সরি যে মেয়ের দিকে ইচ্ছে তাকাক। শুধু আমার বোনের দিকে যেনো তাকানো অবস্থায় না থাকে।

ইয়াদের কথায় জাম্বী জাহিদের হাতদুটো ভেঙে হুড়িয়ে দিলো। এমনভাবে ভেঙেছে পৃথিবীর কোনো ডাক্তারের পক্ষে ভালো করা সম্ভব নয়। জাহিদের বাকি বন্ধুদেরও একই অবস্থা করছে বাকি গার্ডগুলো। প্রথমে হাত ভেঙে, জিহ্বা কেটে নিয়ে শেষে চোখের মধ্যে এসিড ঢেলে দেওয়া হয় তাতে চোখদুটো ঝলছে যায়। ইয়াদ পায়ের ওপর পা তোলে চেয়ারে বসে দেখছে আর বাঁকা হাসছে। ওদের চিৎকার ইয়াদের মনের আগুন নেভাতে পানির মতো কাজ করছে। সবশেষে জাহিদ আর তার বন্ধুদের একটা ভয়ংকর ড্রাগস দিয়ে দেয় যেটা নিলে মানুষের মেন্টাল কন্ডিশন এতো খারাপ হয় তাতে আশেপাশের মানুষের ক্ষতি করে তারা। এটা দিয়ে ইয়াদ সবাইকে মনে করাবে ড্রাগস নিয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে একে অপরের এমন দশা করেছে। কাউকে কিছু বলার মতো অবস্থা ওদের নেই তাই ইয়াদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও পারবে না। ইয়াদ এখানকার কাজ শেষ করে হোটেলে চলে গেলো মিটিংয়ের জন্য। একদম ঠিক টাইমে পৌঁছালো এক মিনিট এদিক ওদিক হয়নি তার।

৭.
ইমারে আমার ঔষধ শেষ হয়ে গেছে একটু এনে দিবি রে ?

সন্ধ্যার নাশতা রেডি করছিলো ইমা নানুর কথা শুনে পেছনে ফিরে তাকালো। হাতে টাকা আর খালি মেডিসিনের পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ইমা আবার কাজ করতে করতে বললো, নানু আমি কাজ করছি কীভাবে যাবো এখন ? আজকে তো আরমান ভাইয়া আগেই এসেছেন তাকে বলো।

নানু কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে বললো, বলেছিলাম সে টাকা দিয়ে বললো তার কাজ আছে কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিতে। সে নাকি একটু পর বের হবে আর রাতে আসবে আর আমার ঔষধ খেতে হবে সন্ধ্যায়।

ইমা বললো, বাড়ির দারোয়ানকে বলো।

ইমার মণি ড্রয়িংরুম থেকে শুনতে পেয়ে বললো, দারোয়ান চলে গেলে তুই গিয়ে বাড়ি পাহারা দিবি নাকি। বাড়িতে আর কেউ নেই কাজ শেষ করে তুই গিয়ে নিয়ে আয়।

ইমা আর কথা বাড়ালো না তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে টাকা আর খালি মেডিসিনের পাতা নিয়ে বের হয়ে গেলো। পাশেই দোকান তাই আর বোরখা পড়লো না বাসায় পড়া থ্রিপিস পরেই ওড়নাটা ভালো করে বেঁধে বের হয়ে গেলো।

মিটিং চারটায় শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হতে বিকেল গড়িয়ে গেলো। রনিত অফিসের গাড়ি দিয়েই চলে গেলো আর ইয়াদ নিজের গাড়ি নিয়ে আবার অফিসের দিকে রওনা হলো। মুখে চরম বিরক্তির ছাপ নিয়ে ড্রাইভ করছে।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৪

বাসা থেকে বের হতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো ইমার। হাতের ব্যাথায় রাতে জ্বর হয়েছিলো আবার সকালে তরকারি ফেলায় জ্বালা আর ব্যাথা দুটোই বেড়েছে। হয়তো আবার জ্বর আসবে। আরমান সকালে না খেয়ে যাওয়ায় সারাদিনে খাবার দেওয়া হয়নি ইমাকে। এখন আর শরীরটা চলছে না। কপাল খারাপ হলে যা হয় তাই হলো বাসার পাশের ফার্মেসিটা বন্ধ।

ইমা বিড়বিড় করে বলে উঠলো, এটাকেও আজই বন্ধ রাখতে হলো ? এখন কতদূর যেতে হবে আমাকে আবার আর বোরখা না পড়ায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। বাসায় গিয়ে আবার বোরখা পরে আসার শক্তি নেই শরীরে। এভাবেই যেতে হবে।

নিজের মনে বকবক করে অন্য ফার্মেসির দিকে পা বাড়ালো। পরের ফার্মেসিটা মেইন রোড দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ওদিকে মানুষের আনাগোনা কম গাড়ির যাতায়াত বেশী। বাধ্য হয়ে সেখানেই যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো ইমা। এদিকে সন্ধ্যাও নেমে আসছে।

গাড়ির চাকায় একটা লাথি মেরে ইয়াদ বললো, এটাকে এখনই খারাপ হতে হলো ?

অফিসে যাওয়ার সময় তার মনে পরে নতুন প্রজেক্ট শুরু করার আগে জায়গাটা আর একবার দেখে নেওয়া বেটার হবে। তাই জমিটা দেখতে এসেছিলো। হঠাৎ গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেলো মাঝ রাস্তায় এসে। ইয়াদ গাড়ি সবই ঠিক করতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে একদমই ইচ্ছে করছে না চাকা চেঞ্জ করতে। লান্স করা হয়নি এখন বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। ফোন দিয়ে অন্যগাড়ি পাঠাতে বলে গাড়িতে হেলান দিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যটা দেখছে। ইয়াদের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক খুবই ভালো। তার মনের কথা শোনার একমাত্র সঙ্গী এই প্রকৃতি। এই প্রকৃতি তাকে ভয়ংকর হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। প্রকৃতি যেমন সুন্দর আর শান্ত মাঝে মাঝে আবার তেমনই ভয়ংকর আর বিধ্বংসী। ইয়াদ প্রকৃতির ভালো দিকটা নেয়নি খারাপ দিকটা নিজের মাঝে ধারণ করেছে আর সেটা তাকে করতে বাধ্য করেছে জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটা। ইয়াদ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে একটু দূরে বেশ কয়েকটা দোকানপাট দেখা যাচ্ছে হয়তো মেকানিক পেয়ে যাবে কিন্তু ইয়াদের সেটাও করতে ইচ্ছে করছে না। গাড়ি আসার অপেক্ষা করলে সেই সময়টুকু পড়ন্ত বিকেলের সাথে কাটানো যাবে। সেটা ভেবেই দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদ।

কীরে ইমা তুই এখানে তাও আবার এভাবে ?

ইমা চমকে উঠে পাশে তাকালেই এলাকার বখাটে ছেলে শামীমকে দেখতে পেলো। সবসময় ইমার দিকে কেমন যেনো নজরে তাকিয়ে থাকে তার সাথে দেখা হলেই কিন্তু আরমানের ভয়ে কিছু বলতে পারে না। তবে আজ ইমা মনে হয় ভালোই ফেঁসে গেছে। ইমা কিছু না বলে তাড়াতাড়ি মেডিসিনগুলো নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ফার্মেসি থেকে বের হয়ে রাস্তায় একটু দূরে আসতেই ইমার পথ আটকে দাঁড়ালো শামীম। এদিকে খুব একটা মানুষজন নেই।

ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, শামীম পথ ছাড় আমার, ভালো হবে না বলে দিলাম।

শামীম বিশ্রি হেঁসে বললো, আজকে তো আর তোর ঐ আরমান ভাই নেই আশেপাশে তাহলে কীভাবে বাঁচবি তুই ?

ইমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলো শামীম। কলাপাতা রঙের একটা সুতি কাপড়ের থ্রিপিস ইমার গায়ে। অনেকটা পুরনো হয়ে গেছে তবু পড়ন্ত বিকেলের আলোতে বেশ লাগছে ইমাকে।

ইমা একটু সাহস নিয়ে বললো, আমার পথ ছাড় শামীম নাহলে চিৎকার করবো আমি।

শামীম খপ করে ইমার হাত ধরে বললো, তুই বুঝিস না কেনো ইমা আমি তোকে ভালোবাসি। তোকে খারাপ নজরে দেখি না বরং বিয়ে করে ঘরের বউ করতে চাই। তুই শুধু বিয়ে করে নে আমি সব খারাপ কাজ ছেড়ে দিবো।

ইমা রেগে বললো, শামীম আমার হাত ছাড় বলছি নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।

শামীম বললো, দেখ ইমা আমি তোকে অনেক সুখে রাখবো তোর মণির অত্যাচার তোকে আর সয্য করতে হবে না।

ইমা জোর করে হাত ছাড়িয়ে রেগে শামীমের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। এতে শামীম রেগে গেলো।

খপ করে ইমার ওড়নার ওপর দিয়ে চুলের মুঠি ধরে বললো, আজই তোকে বিয়ে করবো আমি তারপর তোর এই তেজ ভেঙে গুড়িয়ে দিবো।

ইমার কলিজা কেঁপে উঠলো ভয়ে এমনিতেই তো #তিক্ততার_সম্পর্ক ইমার জীবন বিষিয়ে রেখেছে। এখন আরো একটা #তিক্ততার_সম্পর্ক তার চাই না। বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছে সে। একদিন এক রাজপুত্র এসে তার জীবনের সব কষ্ট মুছে বুকে আগলে নেবে। সেটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে না। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে আর অন্ধকার গ্রাস করতে শুরু করেছে চারপাশ। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা দূরে একটা ফাঁকা গাড়ি ছাড়া কাউকে দেখতে পেলো না ইমা। কী করবে বুঝতে পারছে না তবে শামীম যে তাকে আজ সহজে ছাড়বে না সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। শামীম ইমার চুল ধরে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলে ইমা চিৎকার করতে থাকে। এমনই হালকা পাতলা শরীর ইমার তারওপর অসুস্থ আর এই শক্তি নিয়ে সে শক্তপোক্ত দেহের শামীমের সাথে পেরে উঠবে কী করে।

ইমা চিৎকার করে বললো, কেউ আছো,,,? বাঁচাও আমাকে,,, শামীম ছেড়ে দে বলছি আমাকে।

গাড়ির দরজার সাথে হেলান দিয়ে পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো ইয়াদ। হঠাৎ কোনো মেয়ের আওয়াজে ঘোর কাটে তার। ইয়াদ গাড়ির উল্টো দিকে ছিলো তাই ইমা বা শমীম দূর থেকে বুঝতে পারেনি। ইয়াদ ইমার চিৎকার শুনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেলো একটা ছেলে একটা মেয়ের চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা দেখে ইয়াদের ভ্রু কুঁচকে গেলো। এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবার থেমে গেলো। সে কিছুতেই একটা মেয়েকে হেল্প করতে পারে না। পিছিয়ে আসার আগেই ইমা দেখতে পেলো ইয়াদকে। চেহারা বুঝা যাচ্ছে না এতোটা দূরে আছে তারা।

ইমা চিৎকার করে বললো, প্লিজ হেল্প মি।

শামীম রেগে বললো, তোর কোনো নাগর এখানে তোকে বাঁচাতে আসবে না।

ইয়াদ বিড়বিড় করে বললো, এই রাস্কেলগুলো সব আজই আমার সামনে পড়তে হলো। সকালে এতো গুলোকে শিক্ষা দিলাম আবার আরেকটা। তবে ইয়ানা ছাড়া সারা পৃথিবীর সব মেয়েদের যা ইচ্ছে তাই হয়ে যাক তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

ইয়াদ আবার নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে ইমার চিৎকার বাড়তে লাগলো। ইমার চিৎকার একসময় বিরক্ত লাগতে লাগলো ইয়াদের কাছে তাই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না এগিয়ে গেলো সেদিকে। শমীম এতোক্ষণে ইমাকে টেনে হিঁচড়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। ইয়াদ দ্রুত হেঁটে শামীমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

গম্ভীর বিরক্ত গলায় বললো, This girl does not want to go with you, but why are you insisting ?

এমনই শামীম রেগে ছিলো তারপর ইয়াদের কথায় আরো রেগে আর বিরক্ত হয়ে গেলো কারণ সে ইয়াদের কথা বুঝতেই পারেনি আর তাই রেগে একহাতে ইয়াদের কলার চেপে ধরে বললো, এই ইংরেজিতে কী পটপট করেছিস, কে রে তুই ?

কলারে হাত রাখতেই ইয়াদের মাথায় আগুন ধরে গেলো৷ কতবড় সাহস এই রাস্তার ছেলের ইয়াদের কলারে হাত দেয়। যার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে মানুষ ভয় পায় তার কলারে হাত দেয়। ইয়াদ নিজের কলারের দিকে একবার রক্তলাল চোখে তাকিয়ে শামীমের নাক বরাবর ঘুষি বসিয়ে দেয়। শামীম ছিটকে দূরে চলে যায় আর নিচে বসে পড়ে আর ধাক্কা খেয়ে ইমা মাটিতে পরে যায়। ইমা হা করে তাকায় একবার ইয়াদের দিকে আবার শামীমের দিকে। এক ঘুষিতে শামীম নাক চেপে ধরে চিৎকার করছে। ইমা এবার ইয়াদের দিকে ভালো করে খেয়াল করলো। এই প্রথম এতো সুন্দর ছেলে দেখছে ইমা। আরমানও বেশ সুন্দর তবে ইয়াদের মতো নয়। রাগে নাকটা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে তাতে আরো সুন্দর লাগছে ইয়াদকে।

ইয়াদ নিজের কলার ঝাড়া দিয়ে একহাঁটু ভাজ করে শামীমের কলার ধরে উঁচু করে বললো, আবরার হামিদ ইয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে সবার হাঁটু কাপে আর তুই তার কলার ধরিস এতো সাহস ? এক পাঞ্চ খেয়ে উঠতে পারছিস না আর দিলে তোকে আর খোঁজে পাওয়া যাবে না।

ইমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। ইয়াদের নামটাই ইমার কানে গেছে বাকি কিছু শুনেনি সে। ইয়াদ ইমার দিকে বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকালো। ইয়াদ না চাইতেও ইমার চোখে চোখ আটকে গেলো তার আর কপালের কুঁচকানো ভাবটা একাই মিলিয়ে গেলো। ইমার গভীর কালো চোখের ঘন আর বড় বড় পাপড়িগুলো ভিজে গেছে কান্নার জন্য তবে এখন তার চোখে মুগ্ধতা আর বিস্ময় দেখতে পাচ্ছে ইয়াদ। ইমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে খুব করে চাইছে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে কিন্তু পেরে উঠছে না। গাড়ির হর্ণ শুনে ইয়াদের হুঁশ ফিরে। মুহুর্তে কপালটা আবার কুঁচকে যায়। রনিত গাড়ি থেকে নেমে ইয়াদকে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রসগোল্লার মতো চোখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বলার মতোও খুঁজে পাচ্ছে না।

রনিত ইয়াদের সামনে গিয়ে তেতলাতে তেতলাতে বললো, স,,,স্যার গ,,গাড়ি নিয়ে এসেছি।

ইয়াদ নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে চমকে উঠলো সে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো ? এটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না।

নিজেকে সামলে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বললো, দেখো মেয়েটার হেল্প লাগবে কিনা আর সামনেই মেকানিক পেয়ে যাবে হয়তো, গাড়ি ঠিক করে অফিসে চলে এসো।

ইয়াদ কথা শেষ করে গাড়িতে উঠে শাঁ করে সামনে গিয়ে চলে যায়। ইয়াদ চোখের আড়াল হতেই ইমার হুঁশ ফিরে। তাকিয়ে দেখে শামীম এখনো নাক চেঁপে ধরে বসে আছে আর তার হাত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রনিতের এতক্ষণে চোখ পরে শামীমের দিকে আর সবটা বুঝতে পারলো।

রনিত বিড়বিড় করে বলে, আজ তোর কপাল খারাপ রে ভাই স্যারের সামনে পড়ছিলি। তাও ভালো এটুকুতেই ছেড়ে দিছে।

ইমা একটু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে নিচে পড়ে যাওয়া মেডিসিন কুড়াতে শুরু করলো আর ভাবছে, আবরার হামিদ ইয়াদ নামটা কেমন চেনাচেনা লাগছে। তবে যেই হোক লোকটা আজ ঠিক সময়ে না আসলে কী হতো ভাবতেই আত্মা কেঁপে উঠে ইমার।

রনিত ইমার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, আপনার কোনো হেল্প লাগবে ম্যাম ?

ইমা সামনে তাকিয়ে রনিতকে দেখে বললো, বলার জন্য ধন্যবাদ কিন্তু আমার আর হেল্প লাগবে না।

ইমা নিজের পথে পা বাড়ালো আর রনিত শামীমের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনার তো মনে হয় হেল্প লাগবে তাই না ?

শামীম মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালে রনিত আবার বললো, মেয়েদের সাথে নোংরামি করার সময় মনে থাকে না ? তুই শালা এখানেই মর।

রনিত সামনে এগিয়ে গেলো গাড়ি ঠিক করার লোক খুঁজতে আর ইমা অনেকটা চলে গেছে বাসার দিকে পরে রইলো শামীম।

৮.
ইয়াদ নিজের ওপর চরম বিরক্ত এখন। সে কী করে একটা মেয়েকে হেল্প করতে গেলো ? এটা সে মানতে পারছে না আর বারবার মেয়েটার ভেজা চোখ ইয়াদের সামনে ভেসে উঠছে। অফিসে এসে কিছুতেই কাজে মন দিতে পারছে না। অফিস ছুটি হয়ে গেছে পাঁচটায় এখন সাতটা বাজে। ইয়াদ নতুন প্রজেক্টের কিছু কাজ করতে এসেছিলো যেটা বিকেলে মিটিংয়ে ড্রিলটা কনফার্ম হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। রনিতকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে গাড়ি নিয়ে ফোরার পর। ইয়াদ একসময় বিরক্ত হয়ে কাজ রেখে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো। ক্ষুধা পেয়েছে তাই একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়ে নিলো তারপর গাড়ি নিয়ে বের হলো। আজ বাসায় যাবে না ফার্মহাউসে থাকবে সেটা জানিয়ে দিলো ইয়ানাকে।

ফার্মহাউসে গেলে কেয়ারটেকার এসে বললো, স্যার আপনি কিছু খাবেন ?

ইয়াদ বললো, নাহ্ আমার জিনিসপত্র ছাঁদে রেখে এসো। আমাকে যেনো কেউ বিরক্ত না করে। আমার আর কিছু দরকার হলে ডেকে নিবো।

কেয়ারটেকার ঠিক আছে বলে চলে গেলো আর ইয়াদ রুমে এসে সব রেখে শুধু একটা টাউজার পরে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো। আজ ইয়াদ নিজের সাথে একটু সময় কাটাতে চায়। শাওয়ার শেষে ড্রেস চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট আর থ্রী কোয়াটার প্যান্ট পরে ছাদে চলে গেলো। গিয়ে দেখে তার কথা অনুয়ায়ী সব জিনিসপত্র ছাঁদে রেখে যাওয়া হয়েছে। ইয়াদ তুলিটা হাতে নিয়ে ক্যানভাসে রঙ তুলে দিলো। আজ পূর্ণিমা রাত গাছের আড়াল থেকে পূর্ণ চন্দ্র উঁকি দিচ্ছে। ইয়াদ সেটা রং তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। যখন ইয়াদ নিজের ওপর খুব বিরক্ত থাকে এখন প্রকৃতির কিছু ছবি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলে রঙ তুলির সাহায্যে আজও তাই করার চেষ্টা করছে কিন্তু ইয়াদ চাঁদের দিকে তাকিয়েও যেনো সেই মায়াবী ভেজা চোখ জোড়া দেখতে পাচ্ছে। অনেক সময় পর ইয়াদ খেয়াল করলো সে চাঁদের নয় বরং সেই ভেজা চোখজোড়া ফুটিয়ে তুলেছে তার ক্যানভাসে। এটা দেখে রাগে ইয়াদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো আর হাতের তুলিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

রেগে বললো, একটা মেয়ে কীভাবে আমাকে এতটা বিরক্ত করতে পারে, কীভাবে,,,,, ? How is this possible ? How,,,,,,,,?

ইয়াদ রেগেমেগে সব ফেলে ঐ অবস্থায় গাড়ি নিয়ে বের হলো আর ফুল স্প্রিডে গাড়ি চালাতে লাগলো সে কোথায় যাচ্ছে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে আবরার হামিদ ইয়াদের ভাবনায় কোনো মেয়ে আসতে পারে না কখনো না।

এদিকে ইমা বাসায় এসে কাউকে কিছু বলেনি নরমাল ভাবে কাজ করছে। তবে মনে মনে সে ইয়াদ নামের লোকটার কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু সে তো ইমাকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া সুযোগও না দিয়ে চলে গেলো। ইমা না চাইতেও তার মনে একটা পজিটিভ জায়গা দখল করলো ইয়াদ যেটা হয়তো একদমই ঠিক হলো না। যখন ইয়াদের ভয়ংকর রুপ দেখবে তখন হয়তো নিজে নিজে ভেঙে গুড়িয়ে যাবে ইমা।

ইমা আমার কফি দিয়ে যা, আমার খাওয়া শেষ হয়ে গেছে রুমে যাচ্ছি। তুই কফিটা নিয়ে রুমে আয়।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০৫

আরমান ভাইয়ার গলা শুনে হুঁশ ফিরে আমার। সবাই ডিনার করছে আমি কিচেনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনই ভাইয়া কফি দিতে বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। ডাইনিং টেবিলে এখন শুধু মণি আর নানু বসে আছে। আঙ্কেল (খালু) গতকাল সকালে অফিসের কাজে তার বসের সাথে কোথাও গেছে শুনেছি আর কথা সবসময় নিজের রুমেই খায় তার খাবার। সবার খাওয়া শেষে বাড়ির কাজের মেয়ে টিয়ার সাথে আমি খেয়ে নিই। চুলা জ্বালিয়ে কফি বসিয়ে দিলাম। খাবার খেয়ে কফি খাওয়া এটা কেমন অভ্যাস বুঝি না আমি।

নিজের মনে বকবক করে কফি নিয়ে আরমানের রুমের দিকে পা বাড়ায় ইমা। সেদিকে একবার বাঁকা চোখে তাকায় ছাহেরা বেগম। মাথার চুলগুলো তার এমনই এমনই পাকেনি বয়স ভালোই হয়েছে তাই সবই বুঝে। তার ছেলে যে ইমাকে পছন্দ করে সেটাও বুঝে। কিন্তু সে তো কিছুতেই ইমাকে নিজের ছেলের বউ বানাবে না এসব ভেবে আবার নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সে।

ইমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ভাইয়া আসবো ?

আরমান গম্ভীর গলায় বললো, আয়।

ইমা রুমে এসে দেখে আরমান সোভায় বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। ইমা সোফার পাশে টি-টেবিলটাতে কফির মগ রেখে ঘুরতেই আরমান উঠে দাঁড়িয়ে ইমার হাত পিঠের সাথে মুচড়ে ধরলে ব্যাথায় ইমা আহ্ করে উঠে।

ইমা অস্থির গলায় বলে, ভাইয়া লাগছে আমার হাতটা ছাড়ুন।

আরমান তাকিয়ে দেখলো ইমার পুড়া হাতটা ধরেছে সে। হাতের ব্যান্ডেজটা অনেকটাই নোংরা হয়ে গেছে কাজ করার জন্য। ব্যান্ডেজ দেখে আরমান ইচ্ছে করে আরো জোরে চেপে ধরলো আর ইমা ব্যাথায় চিৎকার করে উঠলো।

আরমান শান্ত তবে রাগী গলায় বললো, তুই সন্ধ্যায় বাসার বাইরে গিয়েছিলি কার অনুমতি নিয়ে ?

ইমা দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সয্য করে বললো, নানুর মেডিসিন শেষ হয়ে গিয়েছিলো আপনাকে বলেছে কিন্তু আপনি এনে দেননি তাই আমি গিয়েছিলাম।

আরমান হাতটা আরো চেপে ধরলে ইমা ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে ফেলে আর আরমান বলে, আমি নানুকে টাকা দিয়ে বলেছিলাম কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিতে। বাড়িতে কাজের মেয়ে আছে, দারোয়ান আছে আর ড্রাইভারও আছে তুই কেনো গিয়েছিলি, কোনো বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে ?

ব্যাথায় ইমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো ভেজা গলায় বললো, মণি কাউকে না পাঠিয়ে আমাকেই যেতে বলেছিলো।

আরমান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, মণি যেতে বললো আর তুই চলে গেলি আর আমি যে বলেছি আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখবি না সেটা তোর মাথায় ঢুকেনি ?

ইমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমি কার কথা শুনবো। আপনার মা যখন ইচ্ছে বাইরে পাঠায় এটা সেটার জন্য আর বাইরে গেলে আপনি আমার ওপর তার ঝাল মেটান। আগে নিজের মায়ের সাথে বুঝাপড়া করে আসুন তারপর আমাকে বলতে আসবেন কিছু। কিন্তু কথাগুলো ইমার কন্ঠনালি অতিক্রম করে মুখ পর্যন্ত এলো না। কারণ ইমার খুব ভালো করে জানা আছে তার মুখ থেকে এই কথাগুলো বের হলে তার অনেক বড় মাশুল তাকে দিতে হবে। তাই চুপ করে ব্যাথা সয্য করতে লাগলো সে।

আরমান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, আর যদি আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখিস তার ফল খুব খারাপ হবে ইমা।

কথাটা শেষ করে আরমান ইমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। ইমা নিজের হাত সামনে এনে দেখতে লাগলো আর আরমান পুনরায় নিজের কাজ করতে লাগলো যেনো কিছুই হয়নি। ইমা ভেজা চোখে আরমানের দিকে৷ একবার তাকিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে আর নিজের রুমে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। ইমার চোখদুটো যেনো বেহায়া হয়ে গেছে একটু কিছু হলেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। চার বছর ধরেই তো এসব সয্য করছে এবার তো সয়ে যাওয়া উচিত।

মহারানী কী নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, কাজগুলো কী তবে আমাকে করতে হবে ?

একটু শান্তি মতো কান্না করার সুযোগও নেই ইমার।নিচ থেকে মণির চেঁচামেচি শুনে উঠে দাঁড়ালো আর চোখ মুছে নিয়ে নিচের দিকে পা বাড়ালো।

টিয়া তো আছে তোমাকে করতে হবে কেনো বুঝতে পারছি না। এই বাড়িতে টিয়া সার্ভেন্ট হয়ে এতটা কাজ করে না যতটা ইমা আপুকে করতে হয়ে। তার মূল্য কী এই বাড়িতে টিয়ার থেকেও কম মা ?

খাওয়া শেষে প্লেট নিচে রাখতে এসেছিলো কথা আর মায়ের চেঁচামেচি শুনে উত্তর না দিয়ে থাকতে পারলো না।

মেয়ের কথা শুনে ছাহেরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললো, মায়ের মুখে মুখে কথা বলা কোথায় থেকে শিখছিস তুই ? সব ঐ বাজে মেয়ের জন্য হচ্ছে। ঐ মেয়ের সাথে থেকে থেকে আমার মেয়েটা এমন বিগড়ে যাচ্ছে দিনদিন।

কথা শান্ত গলায় বললো, কারো থেকে কিছু শিখতে হয় না মা। তোমার কার্যকলাপ দেখে কাঠের পুতুলও কথা বলতে বাধ্য হবে।

কথাগুলো বলে কথা আর দাঁড়ালো না প্লেট রেখে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির কাছে আসতেই ইমাকে দেখতে পেলো। কাঁদার জন্য ইমার চোখদুটো লাল হয়ে গেছে। তা দেখে কথা শুধু একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে আগালো।

মনে মনে বললো, তোমার প্রত্যেক ফোটা চোখের পানির মূল্য একদিন হয়তো দিতে হবে এদেরকে। অভিশাপ হয়ে নেমে আসবে তা। এতিমের চোখের পানির হিসাব আল্লাহ একদিন ঠিক নিবে তুমি দেখে নিও আপু।

ইমা নিচে যেতেই মণি কতগুলো কথা শুনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। ইমা টিয়ার সাথে বাকি কাজ গুছিয়ে খাবার খেয়ে নিলো আর তারপর রুমে চলে এলো।

৯.
ইয়াদ ড্রাইভ করতে করতে অনেক দূরে চলে এসেছে। একটা গ্রামে বিশাল মাঠের সামনে গাড়ি থামালো ইয়াদ। মাঠটা অনেক বড় আর মাঠের একপাশে রাস্তা অন্যপাশে বিশাল একটা নদী। ইয়াদ মাঠের শেষপ্রান্তে নদী তীরে বালুর ওপর বসে পড়লো। পূর্নিমার চাঁদের আলোতে চারপাশ আলোকিত আর নদীর পানিগুলো জ্বলজ্বল করেছে। ইয়াদ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিলো তার কানে লাগছে ঝিঝি পোকার ডাক। ইয়াদ মাঝে মাঝেই এখানে আসে নিজেকে শান্ত করতে। জায়গাটা তার ভীষণ প্রিয়। ফোনটা বেজে উঠলে ইয়াদ পকেট থেকে বের করে দেখে ইয়ানা।

হ্যাঁ বল ইয়ানা।

ইয়ানা ব্যস্ত হয়ে বললো, তোমার কী হয়েছে বলো তো ভাইয়া ?

ইয়াদ বললো, আমার আবার কী হবে ?

ইয়ানা আগের ভঙ্গিতে বললো, তোমার যেদিন মন খারাপ বা নিজের ওপর যেদিন বিরক্ত থাকো সেদিনই ফার্মহাউসে যাও। আজ কী হয়েছে বলো ?

ইয়াদ বললো, কিছু হয়নি আমি একটু পরই বাসায় ফিরছি এমনই এসেছিলাম।

ইয়ানা খুশি হয়ে বললো, ওকে তাড়াতাড়ি আসো আমি তোমার জন্য ওয়েট করছি।

ইয়াদ বললো, আরে তুই ঘুমিয়ে পর আমার লেট হবে হয়তো।

না না তুমি আসলেই ঘুমাতে যাবো আমি।

ইয়াদ আর কিছু বললো না কারণ ইয়ানা শুনবে না সেটা ইয়াদ জানে। আরো কিছু সময় সেখানে বসে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এদিকে ছাঁদে পরে রইলো ইয়াদের করা পেইন্টিংটা চাঁদের আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে সেটা। বাসায় এসে দেখে ইয়ানা ডিনার না করে ইয়াদের জন্য ওয়েট করছে। ইয়াদ তাই খিদে না পেলেও বোনের সাথে খেতে বসলো আর কোথা থেকে ইশান এসে ইয়াদের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো।

ইশান খাবার নিতে নিতে বললো, ভাইয়া আমিও তো তোমার জন্য ওয়েট করছিলাম আমাকে রেখেই খেতে শুরু করে দিলা ?

ইয়াদ ইশানের দিকে একবার তাকিয়ে খাবার মুখে দিলো আর ইয়ানা হেঁসে বললো, আমি তো কেবল তোকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।

ইশান হেঁসে বললো, লাভ ইউ আপু এন্ড ভাইয়া।

ইয়াদ আবার তাকালো ইশানের দিকে। ছেলেটাকে ইয়াদ এতো ইগনোর করে তবু গায়ে মাখে না আবার চলে আসে ভাইয়া বলতে বলতে। ইয়াদের একেক সময় ইচ্ছে করে ইশানকে কাছে টেনে নিতে কিন্তু তখনই মনে পড়ে যায় ওর শরীরে বইছে একটা খুনির রক্ত যাকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি হবে না ইয়াদের। এতোবছর ধরে যাদের খোঁজে আসছে একবার তাদের পেয়ে গেলে এই মুখোশধারী মানুষগুলোর মুখোশ সবার সামনে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে ইয়াদ।

খাওয়ার মাঝে ইশান বলে উঠলো, আপু জানিস আজকে একটা অদ্ভুত মেয়ে দেখেছি আমি।

ইশান আর ইয়ানা মাত্র দুই বছরের ছোটবড় তাই ইশান ইয়ানার সাথে তুই করেই বলে। কিন্তু ইয়াদকে দুজনেই তুমি সম্মোধন করে। কিন্তু ইশানের দুঃখ ইয়াদ ইয়ানাকে তুই বললেও তাকে তুমি বলেই সম্মোধন করে। এতে ইশানের মনে হয় ইয়াদ তাকে আপন মনে করে না তাই তুমি বলে। যদিও তার ভাবনাটা একশো ভাগ সত্যি।

ইশানের কথায় ইয়ানা ভ্রু কুঁচকে বললো, অদ্ভুত মেয়ে মানে ?

ইশান হেঁসে বললো, মেয়েটাকে দেখে আমার মনে হয়েছে স্কুলে পড়ে তবে সে নাকি পড়ে কলেজে আবার তার কথার গম্ভীরতা দেখে মনে হয়েছে কলেজে পড়ে না বরং কলেজের কোনো গম্ভীর টাইপ টিচার।

ইশান কথাটা শেষ করেই জোরে হেঁসে উঠলো সাথে ইয়ানাও। ইশান আবার বললো, কী জানিস তো, তোকে না বরং ঐ মেয়েটাকে মানায় ভাইয়ার বোন হিসাবে।

এটা শুনে ইয়াদ ইশানের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আর তা দেখে ইশানের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করে দেয়।

ইয়ানা পরিস্থিতি সামলাতে বলে উঠে, ইশান আগে তো তাও বড় মেয়েদের সাথে ফ্লাট করতি। এখন কী তুই স্কুল কলেজের বাচ্চা মেয়েদের সাথেও ফ্লাট করা শুরু করেছিস নাকি ?

ইশান ইয়ানার কথা শুনে ইয়াদের দিকে তাকায় ভয়ে ভয়ে আর ভাবে, ভাইয়ার সামনে এটা বলার কী প্রয়োজন ছিলো আপুর ? এই আপুটাও না মানুষ বুঝে কথা বলে না।

ইয়ানা বললো, কী রে চুপ করে গেলি যে ?

ইয়াদ খাবার খাচ্ছে না শুধু নাড়াচাড়া করছে। ইয়াদের কেনো যেনো এখান থেকে উঠে যেতে ইচ্ছে করছে না। নিজের গম্ভীরতার জন্য কখনো এভাবে আড্ডা দিতে পারে না ওদের সাথে আর ইশানের ব্যাপারটা তো আলাদাই। তাই বসে বসে ওদের কথা শুনছে।

ইশান দ্রুত বলে উঠলো, আরে না না এমন কিছু না। সকালে আমি অনেক স্প্রিডে কার ড্রাইভ করছিলাম মেয়েটা হঠাৎ সামনে এসে পড়ে। আর অবাক করা ব্যাপার কী আপু জানিস ?

ইয়ানা ভ্রু কুচকে বললো, কী ?

ইশান বললো, একটুখানির জন্য এতোবড় এক্সিডেন্ট থেকে বেঁচে গেছে তবু একটু ভয় নেই ঐ মেয়ের চোখে মুখে। আমি গিয়ে কিছু কথা বলতেই গম্ভীর গলায় বলে উঠে সরি আমি তো অবাক। যেখানে মেয়েরা সম্পূর্ণ নিজের ভুল থাকতেও সরি বলে না সেখানে এতো সহজে সরি বলে দিলো যেখানে দোষ আমারও ছিলো।

ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, তোর বর্ণনা শুনে ঐ পিচ্চিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে আমার।

ইশান হেঁসে উঠে বললো, পিচ্চি বলো না আপু এতোকিছু বললাম রাগলো না যেই পিচ্চি বলেছি ওমনি রেগে বলে আপনি পিচ্চি কাকে বলছেন হ্যাঁ ? Now I am a college student.

এ কথা শুনে ইয়ানা শব্দ করে হেঁসে উঠলো আর ইশান মুখটা পেচার মতো করে তাকালো ইয়ানার দিকে বেচারা।

হাসতে হাসতে ইয়ানা বললো, শেষ পর্যন্ত বাচ্চা মেয়ের কাছে ঝাড়ি খেয়ে এসেছেন আমাদের ভার্সিটির ক্রাশবয় ইশান হামিদ। এটা তোর ওপর ক্রাশ খাওয়া মেয়েদের জানাতে পারলে সেই মজা হতো রে ইশান।

ইশান বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। হঠাৎ কী ভেবে খুশি হয়ে বললো, মেয়েটা দেখতে কালো তবে তার মুখে আল্লাহ যেনো একটা মায়াজাল সৃষ্টি করে রেখেছে। যে তাকাবে সেই মায়াজালে আটকে যাবে।

ইয়ানা ঈশানের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো, তুই কী আঁটকে গেছিস নাকি সেই মায়াজালে ?

ইয়ানার কথা শুনে চমকে উঠলো ইশান তার মনে পড়লো আনমনে কী বলে ফেলেছে সে। ইয়াদ এতোসময় চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলো। ইশানের মায়াজাল শব্দটা শুনে ইয়াদের চোখের সামনে ইমার মায়াবী চোখ জোড়া ভেসে উঠলো।

মনে মনে বললো, তবে কী ঐ মেয়ের চোখেও মায়াজাল সৃষ্টি করে রেখেছে আল্লাহ তাআ’লা।

ইয়াদ হঠাৎ করে বলে উঠলো, আমার খাওয়া শেষ আমি রুমে যাচ্ছি। আর ইয়ানা অনেক রাত হয়ে গেছে আড্ডা না দিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যা।

আর কথা হলো না ডাইনিং টেবিলে। ইয়াদের পিছু পিছু ইশানও চলে গেলো। ইয়াদ নিজের রুমে গিয়ে থম মেরে বসে আছে।

ভাইয়া আসবো ?

ইয়াদ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে ইয়ানা। ওকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বলে, হ্যাঁ আয়, কিছু বলবি ?

ইয়ানা ভেতরে এসে বলে, হ্যাঁ একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।

ইয়াদ ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে, কী কথা ?

ইয়ানা বলে, সকালের ঐ ঘটনার পর জাহিদ বা ওর বন্ধুদের আর দেখিনি। তুমি কিছু করোনি তো ওদেরকে ভাইয়া ?

ইয়াদ চমকে উঠলো ইয়ানার প্রশ্ন শুনে। ইয়ানা কোনোভাবে সব জেনে যায়নি তো ? ইয়ানা ওকে ভুল বুঝে ওর থেকে দূরে সরে গেলে ইয়াদ সম্পূর্ণ একা হয়ে যাবে।

চলবে,,,,
চলবে,,,,,
চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here