তুই হৃদহরণী পর্ব ৩

#তুই_হৃদহরণী
#Sabriha_Sadi (সাদিয়া)
পর্ব : ৩

বোরকা পরিহিতার কাছ থেকে চর খেয়ে আহরার হা করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে ফেটে যাচ্ছে আহরার। জীবনে প্রথম তার গায়ে কেউ হাত তুলল। যেখানে তার শিক্ষকরাও তাকে মারতে পারে নি সেখানে এত সিম্পল একটা কথায় তার গায়ে হাত উঠল? তাও আবার এক মেয়ের কাছ থেকে প্রথম মার খেলো? আহরার আর চিন্তা করতে পারছে না। ভেতরের হিংস্র পুরুষত্ব টা জেগে উঠছে। আশেপাশে অনেক মানুষ জমে গিয়েছে। আহরার ভালো করে তাকিয়ে এত এত মানুষ কে দেখে রাগে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ভিড় ঠেলে সে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল। জ্যাম না থাকায় হাইস্পিডে গাড়ি টান দিল। মনে মনে বলতে লাগল,
“মেয়ে তুই আমার গায়ে হাত তুলেছিল? আহরার কে চর দিয়েছিস তুই? তোকে আমি দেখে নিব। এই প্রথম কোনো মেয়ে আমার হৃদরে ঢুকেছে। আমায় হৃদয় ছুরি করেছিস তুই। আমার থেকে তোর রেহায় নেই দেখে নিস। #তুই_হৃদহরণী আমার।”
এগুলি আওড়াতে আওড়াতে প্রচন্ড বেগে গাড়ি চালাতে শুরু করল সে।

ফিরাত কখন থেকে আহরার কে কল দিয়ে যাচ্ছে। আর একটু পরই ইন্টার্ভিউ শুরু হবে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। ফোন সুইচঅফ। ফিরাতের রাগ লাগছে আহরারের উপর। রাতে এত করে বলার পরেও এমন করল। ফিরাত ধরেই নিয়েই আহরার কোনো মেয়ের কাছে চলে গিয়ছে। ফিরাত সময় নষ্ট না করে ইন্টার্ভিউ শুরু করে দিল।

আহরার ড্রাইভ করতে করতে রাগে এত ড্রিংক করেছে এখন চোখ খুলতেও তেমন পারছে না। গাড়ির গতি আগের থেকে একটু কমিয়ে এনেছে। চোখ ঝাপসা লাগছে তার। হঠাৎ এক গাড়ির সামনাসামনি হয়ে পরে। শরীরে সমস্ত শক্তি দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেও একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়।
লোকজন জমা হয়। পুলিশ কে কল দেওয়া হয়। একটু বাদে পুলিশ আসে। দেখে খুব ভালো করে চিনে অফিসার। তাড়াতাড়ি করে ফিরাত কে কল দেয়। সবেমাত্র ইন্টার্ভিউ শেষ করে সে নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়িয়েছে। ফোন রিসিভ করে অফিসারের মুখে এ কথা শুনে তাড়াতাড়ি দৌড় লাগায়।

ফিরাত দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর খুব ভালো করে দেখছে আহরার কে। তেমন কিছুই হয়নি সামান্য একটু কপালের দিকে লেগেছে।
“চিন্তা নেই ফিরাত ভয়ের কিছু নেই।”
“আহরারের তেমন কিছু হয়নি তো আঙ্কেল?”
“না ফিরাত একটু পরেই জ্ঞান ফিরবে চিন্তা করো না।”
“ওকে আঙ্কেল চলুন।”
“হুম তবে একটু খেয়াল রেখো ওর।”
“অবশ্যই আঙ্কেল।”

ফিরাত সোফায় বসেই ল্যাপটপে কাজ করছিল। আহরারের শব্দে তার দিকে এগিয়ে গেল। আহরার উঠে বসল। মাথা ঝিমাতে শুরু করেছে।
“আস্তে।”
“কি হয়েছে? মাথা এমন করছে কেন?”
“এক্সিডেন্ট করে বলছিস কি হয়েছে?”
“….
“বেশি কিছু হলে কি হতো?”
আহরার ফিরাত কে ঠেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
“আরে কোথায় যাচ্ছিস?”
“সর আমায় যেতে দে।”
“কোথায় যাবি তুই?”
“ওই মেয়ে টার কাছে।”
“দেখ আহরার…”
আহরার রাগে ফিরাতের কলার চেঁপে ধরল। চেঁচিয়ে বলল,
“তুই জানিস? ও আমার গালে চর দিয়েছে। এই প্রথম, এই প্রথম কেউ আহরারের গায়ে হাত তুলেছে।”
ফিরাত অবাক হয়ে শুনল। কি বলছে এ?

“ইয়ার কি হয়েছে? শান্ত হো তুই।”
“….
“আয় এদিকে আয় বস এখানে।”
ফিরাত আহরার কে টেনে বিছানায় নিয়ে গেল। আহরার বিচলিত হয়ে বিছানায় বসল।
“কি হয়েছে আমায় বল।”
“….
“আহরার।”
“হৃদহরণী।”
“কি?”
আহরার সব টা জানাল ফিরাত কে।
“ফিরাত এই প্রথম আমার এমন লেগেছিল। খুব চিনাও লেগেছিল। ও আমার হৃদর নিয়েছে ফিরাত।”
“…..
“আমি তো ওকে ছাড়ব না। ওকে বেড শেয়ার করার কথা বলেছি বলে ও এমন করেছে? ওকে আমি….”
“দেখ আহরার সবাই এক না। তোর উচিৎ হয়নি এভাবে বলা।”
“….
“এতই যখন ফিল করেছিস তো বেড শেয়ারের কথা বললি কেন? এটা ছাড়া কিছুই আসে না তোর মাথায়?”
“….
“খেয়ে একটা ঘুম দে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রাতে আহরার সুইমিংপুলে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে ড্রিংকের গ্লাস। মেয়ে টার কথা ভাবছে। চোখ গুলি বারবার মনে শিহরন তুলছে। অস্থির হয়ে গিয়েছে। চরটার কথা মনে হলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। ভাবল, মেয়ে টা কে খুঁজে বের করবে কি করে? নাম ঠিকানা ছবি কিছুই নেই। এটা ভেবেই অস্থির হয়ে পরেছে সে। সারারাত তার আর ঘুম হয়নি।

সকালে ফ্রেশ হয়েই ওই রাস্তায় চলে যায়। অর্ধেক দিন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করলেও বোরকা পরিহিতার দেখে মিলল না। আশাহত হয়ে ফিরে এলো আহরার। কিছু তেই শান্তি মিলছে না। সব কিছুতেই অস্থিরতা কাজ করছে। বিকেলে এসে ঘন্টা খানেক শাওয়ার নিয়ে আসলেও তার শরীর গরমই লাগছে। মেজাজ টা খিটখিট করছে। কয়েক টা ড্রিংকের গ্লাস ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ইতিমধ্যে। সারাক্ষণ শুধু বোরকা পরিহিতার ঝলমল করা চোখ গুলি ভেসে আসছে চোখের সামনে আর চর টার কথা মনে পরছে। আহরার বিচলিত হয়ে পরেছে। যেন কেউ তার ভেতরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে তাই শুধু ছটফট করছে। আহরারের মনে হচ্ছে হৃদহরণীর কাছে দুনিয়ার সব মেয়ে তুচ্ছ। এই প্রথম হয়তো একদিন কোনো মেয়ের সংস্পর্শ ছাড়া কাটিয়েছে আহরার। কারো কথা মনে হচ্ছে না আহরারের। কোনো মেয়ে কে চাইছে না। কোনো মেয়ের কথা মনেও হচ্ছে না। না ইসার ফিগারের কথা আর না আইলা বুবসের কথা। চিন্তা ভাবনা সব টা জুরেই সেই বোরকা পরিহিতা, তার চোখ আর সাহসিকার সাথে দেওয়া সেই চর টা। সেটার কথা ভেবেই আহরার চোখ বন্ধ করে নিল। গতি তে নিশ্বাস ছাড়তে লাগল। ফোন বাজতেই ফিরে তাকায় সে।

স্কিনে আইলার নাম্বার দেখে আহরারের মেজাজ দিগুন বিগড়ে গেল। খিটখিট তো লাগছেই মন চাইছে ওখানেই গিয়ে ওকে মেরে চলে আসুক। রাগে কল কেটে দিল আহরার।

আবার কল বেজে উঠল। আইলাই কল দিয়েছে। আহরার কল ধরল,
“কি হয়েছে তোর?”
“ডার্লিং আজ আসো নি তুমি?”
“তুই তো দেখেছিস আমি আসি নি। কল করে জিজ্ঞেস করতে হয় কেন তোর? ফোন রাখ।”
“কি হয়েছে তোমার?”
“তোকে ভালো লাগছে না ফোন টা রাখ।”
“তুমি এমন করছো কেন?”
“মরে যেতে যাস?”
আইলা আতকে উঠল।
“বাঁচতে চাইলে আর কল দিবি না আমায়। মনে থাকে যেন।”
আহরার কল কেটে দিয়ে ফুসফুস করতে লাগছে। কিছুই ভালো লাগছে না। নির্ঘুম তার আরেকটা রাত কাটল।

সকালে ফিরাত এসে আহরার কে টেনে ঘুম থেকে উঠাল।
“কিরে? উঠ।”
“দেখ সকালে চোখ লেগেছে ১ ঘন্টা হয়েছে মাত্র। তুই যা তো মেজাজ খারাপ করিস না।”
“আরে অফিসে ইম্পরট্যান্ট একটা মিটিং আছে। তুই না থাকলে চলবে না।”
“….
“প্লিজ ইয়ার তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
“তুই যা আমি আসছি।”
“জানি আবারও কোথাও চলে যাবি।”
“বললাম তো আমি আসছি তুই যা।”
“শিওর আসছিস?”
“হুম।”
“ওকে আমি গেলাম।”

আহরার রেডি হয়ে অফিসে গেল। নিজের কেবিনে মনে হয় অনেক দিন পর আসল। টেবিলে কত গুলি ফাইল দেখলে তাতে পাত্তা দিল না। ঠোঁট উল্টে মুখ ঘুরাল। ফিরাত এসে বলল,
“এই ফাইল গুলি দেখ।”
“কিসের?”
“পরশুদিন যে কজন আমাদের অফিসে জয়েন্ট হয়েছে তাদের ফাইল।”
“দরকার নেই।”
“আছে একবার দেখে নে।”
আহরার দাঁড়িয়ে থেকে কয়েক টা ফাইল নামমাত্র দেখল।
“হয়েছে?”
“আর তো একটাই বাকি আছে আহরার দেখে নে।”
আহরার বিরক্ত প্রকাশ করল। চেয়ারের পিছনে সুন্দর কাঁচের দেওয়াল আছে। তার সব টা কেবিনই কাঁচ দিয়ে ঘেরা। এতে রুম থেকে সবাই কে দেখা গেলেও বাহির থেকে কিছুই দেখা যায় না। উঠে ফাইল হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল সেখানে। ফাইল টা উল্টাল। প্রথমেই নাম টার দিকে তার চোখ গেল। মেয়ের নাম দেখে ছবির দিকে তাকাল। আহরার যেন বিস্মিত হয়ে জমে গিয়েছে। ওদিকে সুরেলা এক কন্ঠে ভেসে আসল।
“আসব স্যার?”
ফিরাত উত্তর দিল “ইয়েস।”
আহরার ঘুরে তাকায়। এখন বোধ হয় সে পাথর হয়েই যাবে। চোখ তার চড়ক গাছ। আহরার মাথা নেড়ে তাকায় আবারো। সুরেলা কন্ঠীর দিকে তাকিয়ে আবার ফাইলের দিকে তাকায়। অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠে,
“তুরফা।”
সেদিনের সেই বোরকা পরিহিতা নিজের নাম শুনে সামনে তাকাল। উঁকি দিয়ে ফিরাতের পেছনে সেদিনের অসভ্য লোক টা কে দেখতে পেল। তুরফা শুধু স্থির দাঁড়িয়ে ছিল।

ফিরাত একবার আহরারের দিকে তাকায় আবার বোরকা পরা তুরফার দিকে তাকায়। আহরার অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে এবার ফাইল টা টেবিলে রাখল। এগিয়ে এসে বলল,
“মিস হৃদহরণী তো আপনার নাম তুরফা?”
তুরফা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সামনের মানুষটার দিকে। এই লোক টা কেই তো চর দিয়েছিল সেদিন। এ এখানে কেন? তুরফার রাগ ভয় ঘৃণা একসাথে মিশে শরবত হয়ে যাচ্ছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেও ভেতর কাঁপছে।

ফিরাত বলল,
“আহরার এই পরশুদিন আমাদের অফিস…”
“আমায় চর মেরেছিল।”
ফিরাত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভালো করে আহরারের দিকে তাকাল। কি বলল আহরার? মেয়ের সাথে কি করবে সে কিছুই বুঝতে পারল না ফিরাত। মেয়েটার জন্যে মায়া লাগছে তার। আহরারের রাগ সম্পর্কে ফিরাত ভালো জানে। কিন্তু…
“মিস তুরফা আপনি আমায় চর দিয়েছিলেন কাল মনে আছে? আপনার সাথে আমি জাস্ট বেড শেয়ারের কথা বলেছিলাম।”
রাগে ঘৃণায় তুরফা চোখ বন্ধ করে নিল। ইচ্ছে হচ্ছে এই লোক টা কেই মেরে ফেলতে।
“ভুলে যান নি নিশ্চয়।”
“….
“ফিরাত তুই যা। পরে ডাকছি তোকে।”
“আহরার শুন..”
“ফিরাত তুই যা।”
“প্লিজ ইয়ার ওর সাথে…”
“তুই যা ফিরাত। তোকে যেতে বললাম তুই যা।”
“….
“যাওয়ার আগে দরজা লক করে দিয়ে যা।”
ফিরাত চুপ করে চলে গেল। এ কথায় তুরফা ভয় পেল ভীষণ। লোকটার দাপট দেখে এতক্ষণে সে বুঝে গিয়েছে উনি সাধারন কেউ নন। হয়তো কোম্পানির মালিক। এত বড় ভুল করে ফেলল সে? তুরফার এখন মারাত্মক ভয় লাগছে।

আহরার তুরফার দিকে এগিয়ে আস্তে ধীরেধীরে। তুরফা খুব ভয় পেয়ে পিছিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ভেতরটা এত কাঁপছে কিছুরই শক্তি পাচ্ছে না। আহরার চোখ মুখ শক্ত করে দৃষ্টি স্থির রেখে তুরফার দিয়ে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। ঠোঁটে ঠোঁট চেঁপে এগিয়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,
“মিস হৃদহরণী”

চলবে….
(চাইলে শেয়ার দিতে পারেন কিন্তু কোনো মতে কপি করবেন না।)

Sabriha Sadi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here