দ্বিতীয় বাসর পর্ব ২২+২৩

দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-২৩
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

অবশেষে ঝিরিঝিরি হাওয়ায় বৃষ্টি ঝরে পড়ল।আজকে আর শোবার ঘরে এসি ছাড়েনি মিতু।বাইরের বৃষ্টিটাও যেন পয়মন্ত হলো মিতুর কাছে। প্রকৃতির সুন্দর একটা মিষ্টি শীতল আমেজ আর মিতুর অনবরত দুষ্টুমী,চোখের ইশারা বন্ধনের কাছে ভালোবাসার নতুন আলাপন মনে হয়।মুখে কিছু না বল্লেও বন্ধন ঠিকই বুঝে নেয় ঐ চোখের ভাষা।
এমনিভাবে কখন দুজন দুজনাতে মিশে যায় কেউ যেন বুঝতেই পারে না।
বন্ধন প্রতিদিনকার মতো খুব ভোরেই নামাজ আদায় করে বের হয়ে যায়।পর্দাগুলি তখনও উড়ছে।মিতু সেই আমেজে আরাম করে কি শান্তিতেই না ঘুমুচ্ছে?
দিনের আলো ফুঁটে উঠছে।বন্ধন জানালা লাগিয়ে পর্দা ঠিক করে,মিতুর গায়ে চাঁদরটা ঠিক করে দেয়।
ঘর অন্ধকার করে ঘুমাতে ভালোবাসে মেয়েটা বন্ধন মনে মনে ভাবে।
মিতু অন্যসময় সজাগ হয়ে যায় যখনই ওর স্বামী ভোরে ওঠে।
কিন্তু আজ যেন চোখ মেলতেই পারছে না বেচারী!
বন্ধনের ভীষন ভালো লাগে তখন।
“থাক্ উঠা লাগবে না,ঘুমাও।’
বলে কপালে চুমু খেয়ে চলে যায়।
মিতু আজ বেলা করে ওঠে ফের।ঘড়ীতে দেখে সাড়ে নয়টা বেজে গেছে।বন্ধন নেই তার পাশে।মিতু হাত দিয়ে বিছানার পাশটা স্পর্শ করে,যেখানে বন্ধন ঘুমিয়ে থাকে।
মৃদু হাসে মিতু।গতকালকের দিনটা কত তারিখ ছিল,মনে রাখার চেষ্টা করে সে।
খবরের কাগজটা দেখে মিতু।বুয়া রুমে দিয়ে গেছে।
আজকে সেপ্টেম্বরের আট তারিখ।তার মানে গতকাল সাত তারিখ ছিল।
গোসলে ঢুকে যায় মিতু।অবশ্য ইচ্ছে ছিল আরও কিছুক্ষণ ঘুমাবে।
বেশ একটা সময় নিয়ে স্নান করতে মিতু ভীষন ভালোবাসে।বাবার বাসায় ঝরনার নীচে মাথা দিয়ে সে বহুবার গোসল করেছে।
স্বামীর বাড়ীতে তো বাথটাব আছে।বাথটাবে তেমন একটা ভালো লাগে না ওর।কেমন যেন একটু ভয় হয় ওর।
ও অনেক আগে শুনেছিল মিতুর বড়লোক এক বান্ধবী বাথটাবে হাত কেটে সুইসাইড করেছিল।তাছাড়া এসব তো অহরহই পত্রিকা,গল্প-উপন্যাসে পড়েছে মিতু।
সতেজ একটা গোসল শেষে ঘরে ফিরে মিতু।কিচেনে যাবার পর কাদের যেন গলার আওয়াজ পায় সে।
বুয়াকে জিজ্ঞেস করে,
“কে এসেছে? ‘
“ভাইগো জানি কোন চাচা হয়,দেশ থ্যাইকা আইসে আফামনি।আবার সাথে কইরা সুন্দর একখান মাইয়াও আইসে?’
“তাই নাকি?সুন্দর তাও দেখে ফেলসো?’
“দেখুম না?আইসে তো তারা সেই কখন?ভাই যাইবো হেই সময়ে?ভাই নাস্তার টেবিলে পানি বাইড়া খাওয়ায় ভাইরে কয় কি ভাবিজান ওহনো উঠে নাই?’
মিতু আড়চোখে দেখার চেষ্টা করে কারা এসেছে।দূর থেকে নানুর রুমে অস্পষ্ট লাগছে।বিশ,বাইশ বছরের একটা মেয়ে তবে বেশ ফরসা বোঝা যাচ্ছে।
“বলেছে তো বলেছে?তাতে কি হয়েছে?’
“আফামনি বয়স তো কম হয় নাই,এসব মাইয়াগো কাম ঘরের ভিতরে গিট্টু লাগা।’
“হুম বুঝলাম কিন্তু গিটঠুটা কি?’
“হেইডাও বুঝলেন না? মানে প্যাঁচগোস সংসারে অশান্তি।’
“কে আবার অশান্তি লাগালো ভাবী?’
নীবিড়ের হঠাৎ উপস্থিতি।
সকালে উঠলেই তার ভাবীর হাতে নাস্তা চাই,সেটা না হলেও চা তো অবশ্যই লাগবে।সেটাই বলতে কিচেনে আসা নীবিড়ের।
বুয়াও অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
” ও কিছু না।কারা এসেছে নীবিড়?’
“গ্রাম থেকে আমাদের দুঃসম্পর্কের এক চাচাজান হয় চাচা, ফুপু আর চাচার মেয়ে রানু।’
“বেশ সুন্দরী মনে হচ্ছে মেয়েটিকে।’
মিতু ফ্রিজ থেকে মাছ,মুরগী নামাতে নামাতে বলে।
“তা কি করে বলবো ভাবী?আমি কি ভালো করে দেখেছি?উঠলামই তো কিছুক্ষণ হলো।তুমি এখনো দেখোনি তাদের? আর তাড়াতাড়ি নাস্তা দাও বাবাইকে স্কুলে দিয়াসতে হবে।’
নীবিড়কে মনে হলো খুব বিরক্ত।বাবাই ইদানীং তার ছোটচাচুর সাথে স্কুলে যেতে পছন্দ করে।আর বন্ধনও বলে দিয়েছে যতদিন এখানে আছে একমাত্র ভাতিজাকে একটু স্কুলে কষ্ট করে দিয়ে আসতে নিয়ে আসতে,ওর পড়াটা একটু দেখিয়ে দিতে,সময় কাটাতে ইত্যাদি।
জবাবে নীবিড় তখন বলে,
“এভাবে বলছেন কেন ভাই?দিয়ে আসবো নিয়ে আসবো এতে কষ্টের কি আছে?’
নীবিড়ের নাস্তা ঝটপট দিতে থাকে মিতু।বুয়াও সাহায্য করে।মিতুর তাড়াহুড়ো কখন মেহমানদের সাথে দেখা করবে।আজ আবার উঠেছে একটু দেরী করে এদিকে নীবিড় তো নাস্তা চেয়ে বসে আছে।
“মেহমানরা নাস্তা খেয়েছে বুয়া?’
“খাইসে তয় এরা ভাত খাওয়াইনা পাবলিক, রুটি, টোষ্ট হেরা এডি বুঝে না।তয় মাইয়া খান খাইসে।দেইখ্যা মনে হইল হে এডি পছন্দ করে।’
নীবিড় আর বাবাই এর নাস্তা দেয় মিতু।বাবাইকে স্কুলের জন্য নীবিড়কে বলে ওকে তৈরী করে দিতে।
মিতু এইবার তড়িঘড়ি করে মেহমানদের কাছে যায়।
বয়স্ক দুজন মানুষ ড্রইংরুমে টিভি দেখছেন আর নানুর সাথে গল্প করছেন।
মিতু তাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
“বাইচা থাকো মা…’
মিতুর বাড়ী কোথায়,চাকরী করে কিনা,বাবা কি করেন,ভাই বোন কতজন নানা প্রশ্ন করেন ইত্যাদি।তবে বেশীরভাগ প্রশ্ন বোরখা পরিহিতা ও পান চিঁবানো ফুপুই করছিলেন।আর বারবার মিতুর মুখটায় কি যেন দেখছিলেন।
“রানুর সাথে পরিচিত হইসে মা?’
বয়স্ক চাচাজান জিজ্ঞেস করেন।
“জ্বী না এখনো হই নি।কই ও?’
নানু বল্ল “আমার ঘরে ঢুকসিল কয় নানু আপনের ঘরটা গুছায় দেই।’
“ঠিক আছে আমি যাচ্ছি ও ঘরে।’
মিতু ঢোকে এবার নানুর রুমে।যা ভাবছিল বিশ, বাইশ বছরের তরুনী রানু,উজ্জ্বল ফরসা ও বেশ সুন্দরী।মিতুকে দেখে দৌড়ে এসে পায়ে সালাম করতে নেয়।
“আরে কি করছো আমাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা লাগবে না?’
“ভাবিজান ভালা আসেন?’
“হ্যা আলহামদুলিল্লাহ্‌। তুমি?’
“আমিও…. ‘মিতুর দিকে এইবার চোখ বড় বড় করে তাকায় রানু।
“ভাবীজানের মুখে এগুলান কি হইসে……?’
মিতুর যা সন্দেহ হচ্ছিল গতকাল তো বন্ধনের সাথে সারাদিন সময় কাটিয়েছিল।
কিন্তু মুখে,গলায় যে আবার দাগ হয়েছে সেটাতো মিতু ভুলেই গেছে।(চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-২৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা

মিতুর বিয়ে হয় মে মাসের দশ তারিখে।আর বাসর হয়েছে কিনা গতকাল অর্থাৎ সাতই সেপ্টেম্বর।যদিও এর আগে বন্ধন তাকে সোহাগের এ চিহ্নগুলি দিয়েছে তাও প্রায় দশদিন আগে।তবে সেটা বাসর বা ফুলশয্যা কোনটাই ছিল না।
গতরাত এমনকি দিন থেকেই হয়েছে মিতুর জীবনের প্রথম বাসর বা ফুলশয্যা।যদিও ফুল ছিল না।তবে বন্ধন কিন্তু তাকে বেলী ফুল কিনে দিয়েছিল,ক্যাফেতে খাওয়ার সময়।
আর খুব আফসোস করেছে হোটেলটায় তারাহুরো বা হঠাৎ করে এসেছে না হলে বন্ধন বলে দিলেই নাকি ফুলের ব্যবস্থাও হয়ে যেতো।
মিতু অবশ্য তাতেই খুশি।
“আরে লাগবে না কি যে বলেন এখন ফুল দিয়ে কি হবে?বিয়ে তো কবেই হয়ে গেছে?’
বন্ধন বলেছে,
” তুমি ফুল ভালোবাসো না মিতু?’
“তা কেন বাসবো না?’
“হুম তা ঠিক?আমার বউটাই তো একটা সুগন্ধী ফুল! তবে হ্যা পরেরবার পুশিয়ে দিব।অনেক ফুলের ভেতর তোমাকে নতুন করে সাজাবো আর প্রাণ ভরে সুবাস নিবো আমার বাসরের সবচাইতে আবেদনময়ী সুন্দর ফুলের….’
বন্ধনের আবেগী কথায়,ভালোবাসায়, সোহাগে সব কিছুতেই যেন জাদু আছে।
ঘুমের ভেতর একাকীত্বে,বিশেষ করে বন্ধন যখন অফিস চলে যায় , তখন আরোবেশী মিতুর কানে বাজে বন্ধনের এসব জাদুমাখা কথা!
আর ভাবে
“লোকটা কি পাগল?
কিন্তু এভাবে বল্লে তো যে কেউই পাগল হয়ে যাবে?এভাবে ভালোবাসলে,আদর করলে….’
কিন্তু প্রথমদিন বন্ধনের আদরে যতখানি দাগ ছিল,আজ তো ওত থাকার কথা না।
মিতু এবার নানুর ড্রেসিং টেবিলে ভালো করে তাকায় নিজের দিকে।
“আসলেই তো…বোঝা যাচ্ছে এখন…পাঁচমাস পরে যে বাবু কি শুরু করলেন?’
হাত দিয়ে সড়ানোর চেষ্টা করতে চায় মিতু।গলার দাগ গুলি আরো বেশী বোঝা যাচ্ছে।
“ফুপুও তাহলে এসব দেখছিলেন ভ্রুকুটি করে….’শংসয় মিতুর।
মিতু এবার শাড়ীর আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতে চায়।কি যে বিপদে পড়ে যায় সে এই অবস্থায়?
রানু ফের বলে ওঠে,
“ভাবী ওতো শরমায়েন না,আমি আপনের ননদ।ননদের সামনে শরমের কী?এসব আমরা বুঝি গো ভাবী…’
রানু বেশ চটকদার কথাও জানে।মিতু খেয়াল করলো ওর কথায় আঞ্চলিকতা থাকলেও শুদ্ধ ভাষাতেই সে কথা বলার চেষ্টা করছে।
“ভাবী তো দেখতে অনেক সুন্দর?মাশাআল্লাহ!ভারতীয় নায়িকাদের মতো?’
“তাই নাকি?তুমি ভারতীয় নায়িকাও চিনো?’
মিতুর বিস্ময়।
“হো ভাবী আমাদের ঝিনাইদহে সব আসে।ডিশ,নেট সব মোটামুটি দেখা যায়।’
বন্ধনদের দেশ তো খুলনা বলেই জানে মিতু।দুঃসম্পর্কের চাচার বাসা বোধহয় ঝিনাইদহ?ভাবে মিতু।
“ও আচ্ছা।কিন্তু ভারতীয় নায়িকা কেন বলছো?বাংলাদেশী নায়িকা বুঝি সুন্দর না?’
“না না সুন্দর তো?নায়িকা মৌসুমী আফা তো ওহনো কত সুন্দর!মোটকা হইলেও ভালো লাগে….ভাবীরে তো ওইরকমই দেখা যায়।’
মিতু অবশ্য এর আগেও শুনেছে এ কথা।একটু সাজলে,তার গালের দুপাশ আর ভালো স্বাস্থ্যের জন্যেও অনেকবার শুনেছে সে।নীবিড় তো প্রথম দেখেই বলেছিল,
“পুরাই নায়িকা মৌসুমী….. ‘
মিতু হেসে বল্ল,”মৌসুমী তোমার আপা?’
রানু ফিক করে হেসে দেয়।
মিতু অবশ্য মনে মনে বলতে থাকে,
“আমি মৌসুমী হলে তুমি তাহলে শাবনূর?যে চটাং চটাং কথা তোমার?’
” যেভাবে শাবনূর মুখ ভেংচিয়ে সুন্দর অভিনয় করে দেখায়,কেমন একটা ঢঙ নিয়ে কথা বলে এ মেয়েটাও দেখছি তাই…..?’ভাবে মিতু।
“ঘর গোছানো শেষ হয় নি?’
যদিও নানুর ঘর তেমন অগোছালো হয় না।মিতু বেশীরভাগ বিছানাটা গুছিয়ে দেয়,কাপড় বা শাড়ী থাকলে সযতনে ভাজ করে ।
বুয়া ঘর ঝাড় দিতে এসেও গোছায় ফার্নিচার গুলি মুছে দেয়।
তবে নানু নাকি তার আলনার কাপড় গুলি দিয়েছে তাকে ভাঁজ করে দিতে।
বুয়া অবশ্য বলছিল নানু নাকি রানুকে অনেক পছন্দ করে।নানুর শখের পুরনো দিনের কাঠের আলমারীও নাকি তাকে দিয়ে গোছাবে।
“বুড়ীর মনে যে কী আছে কেডা জানে?’মিতুকে বলছিল বুয়া তখন।
মিতুও মনে মনে জানার চেষ্টা করে…..।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here