দ্যি এল্ডরিচ সিটিজেনস, পর্ব:৩

#দ্যা_এলেমেন্টাল (১)
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
৩য় পর্ব

সেদিন বিকালে নিগাম পরিবারের সকলেই মায়রার সম্পর্কে কিছু একটা ধারণা করতে পারে। তবে এটা নিয়ে তাদের কোন প্রকার ক্ষোভ বা প্রতিক্রিয়া ছিল না। কারণ মায়রা তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তার উপহার স্বরূপ। তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই মায়রাকে আপন করে নিয়েছে।
কিন্তু মায়রাকে খুবই সাবধানে রাখার জন্য তারা নিজেদের মাঝেই সিদ্ধান্ত নেয় এবং সতর্কতা অবলম্বন করে। মায়রার সবকিছু বুঝে উঠতে বেশি একটা সময় লাগে না। মাত্র কয়েকদিনেই সে অনেকটা স্বাভাবিক মানুষের মতো ব্যবহার করে এবং অন্যান্য সব দিক দিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেয়। কিছুদিন পর, রিহান এবং নিশি কথামতো মায়রাকে নিয়ে সেই জংগলেই যায়। মায়রাকে তার বন্ধুদের সাথে সাক্ষাত করানোর জন্য।
মায়রা খুব হাসিখুশিভাবে গাড়ি থেকে নামে। কিন্তু সেই হাসি তার মুখে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সামনের দিকে তাকাতেই মায়রার চেহারায় স্পষ্ট এক রাশ কালো মেঘের ভেলা দেখা যায়। মায়রা তার বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই হাত ছেড়ে দিয়ে সে দৌঁড়ে জংগলের ভেতর প্রবেশ করে।
জংগলটাতে আগুন লেগে সম্পূর্ণ জংগল পুড়ে ছাই হয়ে আছে। সেই জংগলের ছাইয়ের মাঝে পরে আছে হাজারো পশুপাখির পুড়ে যাওয়া মৃত লাশ।
মায়রা এসব দেখে ধপাস করে বসে পরে জংগলের মধ্যে। জোড়ে চিৎকার সে কান্না করে দেয়। মেয়ের এমন আকাশ কাঁপানো চিৎকারে রিহান এবং নিশি মন খারাপের সাথে কিছুটা ভয়ও পেয়ে যায়। মায়রার চিৎকারে সেখানে কয়েকটা ঝলসে যাওয়া প্রাণী এসে উপস্থিত হয়, যাদের চোখ ভিজে আছে অশ্রুতে।
একটা হরিণ এসে মায়রার গালে গাল ঘেষে কান্না করতে থাকে। মায়রা সেই হরিণকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমাকে ক্ষমা করে দিস, আমি এখান থেকে চলে না গেলে হয়তো এমনটা হতো না। আমার জন্য এতোগুলো বন্ধুদের জীবন চলে গিয়েছে।”

মায়রা যখন হরিণটার ক্ষত স্থানে হাত বুলিয়ে দেয়, তখন ক্ষত স্থানটা সেরে গিয়ে সেখানে নতুন চামড়া উঠে ক্ষত স্থান ভরাট হয়ে যায়। এভাবে প্রতিটা পশুপাখির ক্ষত স্থান ঠিক করে দেয় মায়রা।
নিশি মায়রার সামনের মাটির দিকে তাকাতেই কিছুটা অবাক হয়ে যায়। সে রিহানকে ডেকে বলে,

” রিহান, দেখো, সবুজ ঘাস। মায়রার চোখের পানি যেখানে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানেই সবুজ ঘাসের সৃষ্টি হচ্ছে।”

নিশির কথায় রিহানও সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

“এতে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মেয়ে মায়রা সাধারণ কেউ নয়, তা আমরা জানি।”
“আমার মনে হয় না, মায়রা এখান থেকে আর যেতে চাইবে।”
“দেখি, কি হয়।”
“বাবা, একটা ট্রাকের ব্যবস্থা করতে পারবে? আর আমাদের বাড়ির পেছনের অংশে ছোট এবং উন্মুক্ত চিড়িয়াখানার ব্যবস্থা করতে পারবে?” মায়রা কান্নারত কন্ঠে তার বাবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে।
“তা দিয়ে তুমি কি করবে মামণি?” আদুরে গলায় রিহানের প্রশ্ন।
“আমার বাকি বন্ধুদের আমি আমার সাথে রাখতে চাই, বাবা। দয়া করে না করো না,” মায়রার অনুরোধ আদেশের মতো মনে হয়।
“আচ্ছা, ঠিকাছে, তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি রাস্তার কাছে গিয়ে ফোন দিয়ে ট্রাক আনার ব্যবস্থা করছি। কেমন?” রিহান কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে।
“আচ্ছা,বাবা।”

রিহান প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে, এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। মায়রা এবং নিশি যেই স্থানটাতে আছে, সেই স্থানে মুটামুটি ঘাস জন্মেছে। যা সেখানে উপস্থিত তৃণভোজী প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। নিশির দিকে তাকিয়ে রহস্যজনক হাসি হেসে মায়রা আরো কয়েক কদম এগিয়ে যায়। নিজের চোখ বন্ধ করে নেয় সে। মায়রার শরীরের পরিবর্তন দেখে নিশি কিছুটা ভীত হয়।
মায়রার দেহ সবুজ বর্ণের আলোতে আলোকিত হতে থাকে। চুলগুলো সাপের চলনের মতো তরতর করে লম্বা হচ্ছে। চোখজোড়ার মণি তার রংধনুর সাত রঙে রেঙেছে। চোখের পলকে মায়রার দেহের সেই সবুজ আলো সূর্যালোকের মতো ছড়িয়ে যায় সমস্ত জঙ্গলটাতে। শীতল এক ছায়া বিরাজমান হয় সেই জঙ্গলে। মুহুর্তে আগুনে পুড়ে যাওয়া গাছ-গাছালি গুলো কেমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। সবুজ কচি পাতা, ঘাসে মুহুর্তে জঙ্গল পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয় নি এই জঙ্গলে। আগুন তো দূরের কথা, কয়েকবছর যাবত কোন মানুষের চলাচল নেই এমন মনে হচ্ছে। নিশি বেশ অবাক হয়ে যায়। শুকনা নদীটা পানিতে ভরে উঠে। দূর থেকেই পানির শব্দ শুনতে পায় নিশি, যা কিছুক্ষণ আগেও ছিল না। প্রকৃতির প্রাণ ফিরেছে দেখে অবশিষ্ট ও জীবিত পশুপাখিগুলো খুশিতে বিভিন্নরকম আওয়াজ করতে থাকে। মায়রা নিজের স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসে। সে নিজেও খুশি। অজান্তেই নিশি নিজেও মুচকি হাসে।

হাঁটতে হাঁটতে রিহান রাস্তার পাশে এসে ভয় পেয়ে যায়। রাস্তার অপর পাশের কিছুটা জায়গায় বিরাট এক ফাঁটলের সৃষ্টি হয়েছে।

“ভূমিকম্প তো হয় নি, তাহলে এখানে এতো বড় ফাঁটল কিভাবে হলো?” ভয় ও চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠে আপন মনকে প্রশ্ন করে রিহান।

রিহান নিজে নিজে কথাগুলো বলার সময় মায়রার চিৎকারের কথা মনে পড়ে। সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ে রিহান কোথাও ফোন দিয়ে ট্রাকের ব্যবস্থা করে। ট্রাক আসতেই কয়েকজন লোক নিয়ে রিহান মায়রা এবং নিশির কাছে ফিরে আসে।

“ব্যবস্থা করেছ, বাবা?” রিহানকে দেখা মাত্রই মায়রার প্রশ্ন।
রিহান জংগলের ভেতর তাকিয়ে বেশ অবাক হয়, তার সাথে আসা লোকগুলোও বেশ অবাক হয়।
বিস্মিত কন্ঠে উত্তর দিয়ে রিহান বলে,
“হ্যাঁ, মামণি, এরা তোমার পশুপাখি নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে।”
“কোন লোক লাগবে না, বাবা। এরা একাই আমার পেছন পেছন যাবে।”
“কিন্তু, জনাব, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া, এসব পশুপাখি এখান থেকে নেওয়া ঠিক হবে না। এতে কেস হতে পারে,” একজন লোক রিহানকে বলে উঠে।
“কিন্তু, আংকেল, আমি তো এদের চিকিৎসার জন্য এদেরকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের তথাকথিত প্রশাসন তখন কোথায় ছিল, যখন জংগলে আগুন লেগেছিল? যখন এসব পশুপাখি অনাহারে ঘুরছিল? চিকিৎসার অভাবে শরীরে ক্ষত নিয়ে ঘুরছিল? এখন যখন আমি এদের চিকিৎসা করতে চাচ্ছি, এদের দায়িত্ব নিতে চাচ্ছি, তখন আপনি প্রশাসনের কথা বলছেন?যদি গভীরে খোঁজ নেওয়া হয়, তবে দেখা যাবে, এসকল প্রশাসনের কিছু সদস্য অসদুপায়ে এরকম অনেক জংগল ধ্বংসের সাথে জড়িত। খনির জন্য, নয়তো বিভিন্ন রাসায়নিক কলকারখানার জন্য।”

মায়রার এমন রাগান্বিত জবাবে লোক দুটো সহ নিশি এবং রিহানও কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তবে মায়রার একটা কথাও অযৌক্তিক নয়। তাই কোন কথা না বাড়িয়ে লোক দুটো রাস্তা দেখিয়ে তাদের নিয়ে আসে।
মায়রার পেছন পেছন পশুপাখিগুলো খুবই শান্তভাবে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে যায়।

“এক এক করে এই ট্রাকে উঠে পর। ভয় পাস না, তোদেরকে আমি আমার সাথেই নিয়ে যাব।”

সকলকে অবাক করে দিয়ে, মায়রার কথা মতো এক এক করে পশুপাখিরা ট্রাকে উঠে নিজেদের জায়গা করে নেয়। একটিমাত্র খরগোশের জন্য জায়গার অভাব হয়। ট্রাকটা ছোট হওয়ার জন্যই এমন হয়। মায়রা খরগোশটাকে কোলে নিয়ে বলে,

“চলো বাবা, বাসায় যাওয়া যাক। ”
” আচ্ছা, চলো।”

রিহান, নিশি এবং মায়রা গাড়িতে উঠে বসে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। মায়রাদের গাড়ি আগে এবং ট্রাকটা পেছনে তাদের অনুসরণ করে চলতে থাকে।
নিগাম বাড়ির পেছনের কিছুটা অংশ সবুজ ঘাসে ভরপুর এবং ফাঁকা। সেখানে আবার বাঁশ দিয়ে বেড়া দেওয়া। এই অংশটা মায়রার কক্ষের পাশে হওয়াতে, সে ভালো মতোই জানে কোথায় কি আছে।
বাড়ি ফেরার পথে রিহান আরো কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসে। পশুপাখিগুলোকে বাড়ির পেছনের অংশে রাখা হলে, রিহান সকল ভাড়া পরিশোধ করে দেয়।
মায়রা নিজ হাতে সকল পশুপাখির খাবার ও পানি সরবরাহ করতে থাকে। এতো জংলী পশুপাখি হুট করে বাড়ি নিয়ে আসার কারণে রিহানের বাবা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তিনি রিহানকে বলে,

“রিহান, এসব পশুপাখিকে বাড়িতে কেন এনেছিস? এদের মধ্যে তো কিছু হিংস্রও আছে। মায়রা দাদুভাইকে একা এদের মাঝে কেন রেখেছিস। দাদুভাইকে যদি আঘাত করে?”
“বাবা, তোমার মনে হয় এরা মায়রাকে আঘাত করবে? একটু ভালোমতো সবটা আগে শুনে নাও, তারপর মায়রাকে দেখো এবং চিন্তা করে বলো। ”
” কি শুনব?”

রিহান তার বাবাকে সব ঘটনাই খুলে বলে। সবটা শুনার পর রিহানের বাবার মুখে হাসি ফুটে উঠে, এবং বলে উঠে,

“আমার দাদুভাই মায়রা, সে কোন সাধারণ কন্যা নয়, সে প্রকৃতি কন্যা। ”
রিহানের বাবা খুব আহ্লাদী সুরে কথাটা বলে উঠে।

সেদিন মায়রার পশুপাখি বন্ধুদের সাথে নিগাম পরিবারের বাকি সদস্যরাও মিশে যায়। যেন তারাও অই বোবা প্রাণীদের বন্ধু হয়ে যায়।

রাতে,

মায়রা ঘুমিয়ে গেলে নিশি এবং রিহান তার বাবার কক্ষে প্রবেশ করে।

” বাবা, ডেকে ছিলে?” রিহান দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ, ভেতরে আয়।দাদুভাই ঘুমিয়েছে?” রিহানের বাবা জিজ্ঞাসা করে।
“হ্যাঁ, ঘুমিয়েছে। ভাবছি, কালকে মায়রাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। কিন্তু বয়সের তুলনায় যতটা ম্যাচুর, কোন শ্রেণীতে দিব সেটাই বুঝতে পারছি না,” রিহান চিন্তিত হয়ে জানায়।
” সেটা শিক্ষকরাই ঠিক করবেন, চিন্তা করিস না। তবে, আজকে বোবা প্রানীগুলোর সেবা করে সত্যিই খুব ভালো লাগল, ” রিহানের মা খুশি হয়ে বললেন।
—” হ্যাঁ, মা। মায়রা আজকে আমাদের এটা শিখিয়ে দিল, এসকল জীবজন্তু গুলো আমাদের মানে মানুষদের বিভিন্ন অপকর্মের কারণেই মানুষকে আঘাত করে। এমনি কিন্তু আঘাত করে না। পশুপাখিও ভালোটা বুঝতে পারে। হোক সেটা হিংস্র বাঘ বা ছোট খরগোশ,” নিশি তাল মিলিয়ে বলল।
” লোক দুটোকে জবাব দেওয়াতে মায়রা কিন্তু এটাও বুঝিয়েছে, হিংস্র পশুপাখি নয় বরং মানুষই সবথেকে হিংস্র,” রিহান হেসে বলল।
” সত্যি, আমি ধন্য এবং নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি, মায়রাকে নিজের মেয়ে হিসেবে পেয়ে,” নিশির চোখের কোণায় পানি জমে।
“কালকে থেকে আমাদের মায়রা স্কুল জীবন শুরু করবে। নিশি, রিহান, যা তোরা গিয়ে ঘুমিয়ে পর, কালকে মায়রাকে স্কুলে ভর্তি করবি তো,” রিহানের বাবা তাড়া দিয়ে বললেন।
“হ্যাঁ, বাবা। যাচ্ছি, শুভ রাত্রি। ”

নিশি আর রিহান নিজেদের কক্ষে এসে ঘুমিয়ে যায়।

চলবে,,,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here