নোনাজলের শহর পর্ব ১০

নোনাজলের শহর
লেখিকা: হৃদিতা আহমেদ

পর্ব-১০

“আদিব প্লিজ চোখ বন্ধ করিস না তাকা আমার দিকে, প্লিজ তাকা।” স্টেচার ধরে হাসপাতালের হলে দৌড়াতে দৌড়াতে বলছে মিমন।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,আদিবের আকুতি দেখে নিজেরই কান্না পাচ্ছে মিমনের।অনেক বুঝিয়ে বললেও আদিব তার কোনো কথা মানতে নারাজ। রাগারাগি করে রুপার বাসার উদ্দেশ্যে মিমনকে ফেলেই বাইক নিয়ে চলে যায়।কিছুদূর যেতেই ট্রাকের সাথে ভয়ানক ভাবে দূর্ঘটনা ঘটে।অফ হোয়াইট কালারের টিশার্ট টা রক্তে চুপেচুপে হয়ে গেছে।মিমনের মরে যেতে ইচ্ছা করছে, একদিকে আদিব অন্যদিকে মুমু।

ও.টি. এর সামনে দেয়াল ঘেষে ফ্লোরে বসে আছে মিমন, সারা শার্টে আদিবের রক্ত লেগে আছে। বাবাকে ফোন করেছিল, সবাই আসছে।সৃজা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে মিমনের সামনে হাটু গেড়ে বসে, সৃজাকে সামনে পেয়েই জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মিমন। “সৃজা আদিবের কিছু হলে আমি মুমুকে কি জবাব দিব?আমার মুমু!!সৃজা আমার মুমু…মুমুকে পাচ্ছিনা… সৃজা মুমুকে কোথায় পাবো?” সৃজা মিমনকে অনেক বোঝালেও মিমনকে থামাতে পারছেনা। “আদিবের এই অবস্থায় তুমি পাগলামি করলে মুমুকে কে খুজবে মিমন, প্লিজ শান্ত হও।”এই কথায় মিমন কান্না থামিয়ে দ্রুত চোখ মুছে নেয়, আদিবের ফোন বের করে রুপাকে ফোন দেয়।রুপাকে সবকিছু জানাই, সেও সকল ফ্রেন্ডের থেকে খবর নিয়ে কিছুই জানাতে পারেনি।

রাত ১২:০০ মিনিট
আদিবকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে, মাথায় লাগায় এখনো জ্ঞান ফেরেনি তবে ভয়ের কিছু নাই বলে জানিয়েছেন ডক্টর। মুমুর কোনো খবর এখনো পায়নি মিমন। থানায় জি ডি করেছেন বাবা,কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টার আগে কিছু করবে না তারা।সৃজা আর মিমন বসে আছে আদিবের পাশে।

মুমু ভয়ে কাঁদছে, ভীষণ পানি তেষ্টা পেয়েছে তার। কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পারছে না। হাতটা পিছনে বাধা,চোখেও কিছু দেখতে পাচ্ছে না, মুখটাও বাধা কাউকে ডাকতেও পারছে না। সকালে বাসে উঠার আধাঘন্টা পরে হালকা ঘুমিয়ে গেছিল, তারপর তার কিছুই মনে নাই।নানা ধরনের বাজে চিন্তায় ভীষণ ভয় পাচ্ছে, অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে মুমুর কান্নার গতি আরো বেড়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে কেউ তার সামনে এসে বসেছে। বসা অবস্থায় ভয়ে কুঁকড়ে পিছনে সরতে গেলেই সেই কেউটা তাকে কাছে নিয়ে আসে, কোনো পুরুষ পারফিউম এর কড়া গন্ধ নাকে আসছে। লোকটা তার গালে স্লাইড করতেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুমু।

একটা পুরুষ কন্ঠ বলে উঠে,”কাঁদে না জান, তুমি কাঁদলে আরো কিউট লাগে তখন আমার অন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে।”(মুমুর হাত ও মুখের বাধন খুলতে খুলতে) হাত ছাড়া পেয়েই মুমু লোকটা কে ধাক্কা দিয়ে চোখের বাধন খুলতে গেলেই লোকটা তার দুই হাত পিছনে ধরে কাছে নিয়ে আসে। লোকটা ভীষণ জোরে মুমুর গলায় কামড়ে দিয়ে বলল,”কোনো চালাকি না জান” মুমু ব্যাথায় ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।”পি..প্লিজ ছে..ছেড়ে দিন আ..মাকে” কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না মুমু। “কেনো আদিবের কাছে যাবে, আজ এমন হাল করবো কোনো দিন ওর কাছে যাবে না,আর গেলেও আদিবকে শেষ করে দিবো আমি ”

মাথার অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ মেলে তাকাতে পারছে না আদিব, অনেক কষ্টে চোখের পাতা দুটো আলাদা করে। সাদা সিলিং দেখে পাশ ফিরে তাকায়, মুগ্ধ তার পাশে চুপ করে বসে আছে।অন্য পাশে আম্মু কাদছেন আর কাকি তাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। দরজার সামনে মিমন তার বাবার সাথে কথা বলছে।আদিবকে চোখ মেলতে দেখেই মুগ্ধ সবাইকে ডাকে।সবাই কাছে আসলেই আদিব মিমনের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “মুমু” মিমনের নীরবতা দেখে আদিব নিজেই উঠতে গেলে মিমন দ্রুত বলে উঠে, “মুমু ঠিক আছে।” আদিব ঠোঁটে কষ্টের হাসি ফুটিয়ে তোলে, সে তো জানে তার এই অবস্থায় মুমু একমুহূর্ত তার থেকে দূরে থাকবে না।

“আমার ফোন টা দে” মিমন ঝটপট ফোন দেয় আদিবকে। মেজো ভাই আদনান NSI অফিসার সেই এখন ভরসা,কিন্তু মেজো ভাইয়ার ফোন অফ।কোনো ভাবেই ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না, কান্না পাচ্ছে তার, দিশেহারা হয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎই বাবার কথা মনে পড়ে, হ্যা বাবা পারবে।কোনো কিছু না ভেবেই হন্তদন্ত হয়ে বাবার নাম্বার খুঁজে কল দেয় আদিব।

কনফারেন্স রুমে বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং করছেন রওনক হাসান, হঠাৎই পি এস ফোনটা সামনে দেয়।স্ক্রিনে ‘বাবাই’ নামটা দেখে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিগত সাত বছর যাবত যোগাযোগ তো দূরে থাক তার ফোনও কোনো দিন রিসিভ করেনি তার ছোট ছেলে। ‘এক্সকিউজ মি’ বলেই ফট করে বের হয়ে যান কনফারেন্স রুম থেকে। ফোন রিসিভ করতেই আদিব অস্থির ভাবে কেদে বলল, “বাবা,আমার মুমু…।”

রাত ৯:২৭ মিনিট
নামকরা হসপিটালের সবথেকে এক্সপেন্সিভ কেবিনে রাখা হয়েছে মুমুকে।সারা গায়ে কামড়ের দাগ,ঠোঁটের কোণে কেটে গেছে,গালে থাপ্পড়ের দাগ হয়ে আছে।হাতে
স্যালাইন সেট করা,নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে আছে মুমু।একটু আগেই পুলিশ একটা পুরাতন গোডাউন থেকে উদ্ধার করেছে।কিন্তু অন্য কাউকে পায়নি।রওনক সাহেব মুমুর দিকে তাকিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর এর সাথে কথা বলছিলেন।

মিমন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে কেবিনে টাতে ঢুকে যায়, পিছনে বাবা-মাও আছেন।সৃজা আর কাকি আদিবের সাথে আসছে।মুমুর বেডের কাছে এসেই ধুপ করে হাটু গেড়ে বসে পড়ে মিমন,ঝরঝর করে পানি পড়ছে চোখ থেকে।মুমুর গালে হাত দিতেও ভয় পাচ্ছে, হঠাৎ বাবার গলা শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে মা সেন্সলেস হয়ে গেছে। সৃজা আর কাকিও দ্রুত এসে মাকে ধরে।

আদিব একদৃষ্টিতে মুমুর দিকে তাকিয়ে আছে, তার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে কিন্তু কোথায়? মাথায় নাকি বুকে? ঠিক বুঝতে পারছে না,চোখ টা ঝাপসা হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। “বাবাই” বলেই রওনক সাহেব দ্রুত ধরে নেয় ছেলেকে।মিমনও দৌড়ে আসে,হুম আদিবও অবচেতন হয়ে গেছে।

মাথায় আঘাত ও অতিরিক্ত প্রেসারে জ্ঞান হারিয়েছে আদিব।ডক্টর ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে,রেস্ট দরকার। আদিবের বাবা সব সামলাচ্ছেন।মুমুর মায়ের জ্ঞান ফিরেছে,মুমুর বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।জার্নি করে এসে দুইদিন যাবত হসপিটালে থাকায় সবাই ক্লান্ত। সৃজা অনেক বুঝিয়ে মিমনের মা-বাবা কাকি ও মুগ্ধকে সাথে নিয়ে যায়।আনিয়া এসেছে আদিবের সাথে থাকার জন্য।

আনিয়া এসে থেকে মুমুকে দেখছে, এই ছোট বাচ্চা মেয়ে টাকে তার এই রগচটা ভাইটা বিয়ে করেছে ভাবা যায়।মুমু ও আদিবকে একই কেবিনে রাখা হয়েছে।ক্লান্ত হয়ে মুমুর মাথার কাছেই বসে ঘুমিয়ে গেছে মিমন।মেয়েটা ধুর মেয়ে হবে কেন ভাবির ভাইটা খুব ভালোবাসে মনে হয়, কি সুন্দর বোনের হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে।এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মুমুর চিৎকার শুনে লাফিয়ে উঠে আনিয়া, ততক্ষণে মিমনও উঠে গেছে।

মুমু কুঁকড়ে বসে হাত দিয়ে দুই পা জাপটে ধরে চোখ বন্ধ করে কাদছে আর চিৎকার করছে।মিমন দ্রুত বোনকে জড়িয়ে ধরে “মুমুমনি তাকা,ভয় নেই ভাইয়া আছিতো দেখ, কাঁদিস না ভাইয়ার দিকে তাকা।”(বলেই কেঁদে ফেলে) মুমু হাত পা ছুড়ে কাছে আসতে দিচ্ছে না জোরে জোরে কাঁদছে,মিমন না পেড়ে শক্ত করে জাপটে ধরে বুকের মাঝে। স্যালাইনের নলে রক্ত দেখে আনিয়া নার্স নিয়ে আসে।ততক্ষণে মুমু শান্ত হয়ে মিমনের বুকে আবার ঘুমিয়ে গেছে।নার্স এসে স্যালাইন ঠিক করে মুমুকে বিছানায় শুয়িয়ে দিতে বললেও মিমন কোনো ভাবেই বোনকে ছাড়বে না।নার্স আর আনিয়া অনেক বুঝিয়ে বলার পরে মুমুকে শুয়িয়ে দিলেও মুমুর হাত ধরে বসে থাকে মিমন।

চলবে
একটু ব্যস্ত তাই ছোট করে দিলাম🙂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here