প্রেম পর্ব -০৮

প্রেম ❤️💙(Love has no limits)

#পর্ব: ০৮

আরাধ্য চলে যেতেই স্নিগ্ধা স্পর্শিয়াকে ডেকে রুমে নিয়ে গেল। ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
– তোর আর আরাধ্যর মাঝে কি হয়েছে?
– কই? কিছু না তো।
– সত্যি করে বল। আরাধ্যকে তুই এতগুলো ফাকি মরিচ খাওয়ালি কেন?
স্পর্শিয়া আস্তে করে বলল,
– উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল তাই।
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বলল,
– কি করেছিল?
– না, মানে…আমি উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
স্নিগ্ধা চোখ গোলগোল করে বলল,
– তুই জড়িয়ে ধরেছিলি?
– ধুর!! বুঝাতে পারি না তোকে! আসলে উনি ভয় দেখিয়েছিল.. নাহ, আমি ভয় পেয়েছিলাম.. আরে, নাহ। ধুর! উনি ভয় দেখিয়েছিল, তাই আমি ভয় পেয়েছিলাম আর সেজন্য উনাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।
– তোর কথা বুঝি না আমি। ঠিক করে বল।
স্পর্শিয়া শুরু থেকে সব বলল স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা শুনে বেশ খুশিই হলো। তারপর রাগ দেখিয়ে স্পর্শিয়াকে বলল,
– দোষ তো তোর ই, আরাধ্য ভাইয়া না হয় একটু মজাই করেছে। জড়িয়ে ধরেছিস তো তুই-ই। তাই বলে তুই এমন করবি? সরি বলবি উনাকে।
– সরি বলেছি তো।
– তাহলে ওকে। শোন, যেহেতু এখন সায়ান তোর লাইফে নেই, সো ওর কথা কখনো ভুলেও আরাধ্য ভাইয়াকে বলতে যাস না। উনি তোকে আজ যা কিছু বলেছে তাতে বুঝাই যাচ্ছে উনি তোকে খুব ভালবাসে। কষ্ট দিস না উনাকে কিছু বলে। বুঝেছিস?
– হুম। কিন্তু.. উনি মনে হয় আমাকে আগে থেকে চেনে। উনার কথায় এমনি মনে হলো। আর আমার এমনিতেও কেন যেন মনে হয় কোথায় যেন দেখেছি উনাকে, কিন্তু মনে করতে পারছি না।
– আহা! এত কথা বলিস কেন! চিনে থাকলে চিনে।

স্পর্শিয়া তবুও চিন্তিত মুখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধা বললো,
– শোন তুই আরাধ্য ভাইয়াকে কল দে।
স্পর্শিয়া ভ্রু কুচকে বললো,
– উনাকে আমি কল দিতে যাব কেন?
– আমি দিতে বলেছি তাই দিবি। তোর বিহেভে এমনিতেই উনি অনেক কিছু ডাউট করেছে, আর কিছু ডাউট করুক আমি চাই না। এখন থেকে উনার সাথে রেগুলার কথা বলবি। এখনি কল দে।
বলেই স্পর্শিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্নিগ্ধা স্পর্শিয়ার ফোন নিয়ে আরাধ্যকে কল দিল।

আরাধ্য নিজের ফোনে স্পর্শিয়ার কল পেয়ে চমকে উঠল। বিশ্বাস ই করতে পারছিল না নিজের চোখকে। কিন্তু বুকটা হঠাৎই ভয়ে কেপে উঠলো। স্পর্শিয়া ওকে কল দিল যে! কিছু হলো না তো? সব কিছু ঠিক আছে তো?
ভয়ে ভয়ে কল পিক করে যখন আরাধ্য স্পর্শিয়ার গলার শান্তভাবে “হ্যালো” বলা শুনলো, তখন ওর টেনশন কমলো।
স্পর্শিয়ার হ্যালোর উত্তরে আরাধ্য বলল,
– এই মেয়ে তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
স্পর্শিয়া অবাক হয়ে বলল,
– কেন? আমি কি করলাম।
– এই যে, কল করলে।
– মানে?
– আহারে পিচ্চি মেয়ে! সব বুঝিয়ে বলতে হয়। তুমি তো আমাকে কল করার মানুষ না আমি জানি, তাই এত রাতে তোমার কল পেয়ে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কিছু হলো না কি তাই ভাবছিলাম।
– ও!
– শুধুই ও!! তারপর বলো কেন কল করেছিলে? আমাকে মিস করছিলে?

স্পর্শিয়া প্রশ্ন শুনে চুপ হয়ে গেল। চিন্তা করতে লাগলো কি বলবে। স্নিগ্ধাকে খোচাচ্ছে স্পর্শিয়াকে, কি উত্তর দিবে তা বলে দেওয়ার জন্য। হঠাৎ স্নিগ্ধার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি চলে এল। স্নিগ্ধা স্পর্শিয়ার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল। ফোনের মাউথ টা স্নিগ্ধা নিজের মুখের সামনে নিয়ে জোরে একটা কিস দিয়ে দিল। কিস দিয়ে ফোনটা স্পর্শিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েই স্নিগ্ধা রুম থেকে দিল এক দৌড়। স্পর্শিয়া ফোন হাতে নিয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে আরাধ্য ফোনের মধ্যে কিস পেয়ে হতভম্ভ হয়ে গেল। কি হল এটা বুঝতে পারলো না। স্পর্শিয়া ওকে কিস দিল ফোনে! হাজার জল্পনাকল্পনা করে ফেললো আরাধ্য মুহূর্তের মধ্যেই। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আরাধ্য হ্যালো বলল, কিন্তু ওপাশ থেকে কোন সাড়া নেই। আবারো হ্যালো বললো কিন্তু কেও কথা বলছে না। একটু পর কট করে কলটা কেটে গেল। বুঝতে পারলো স্পর্শিয়া হয়তো লজ্জা পেয়েছে।
আর এদিকে আরাধ্যর হ্যালো হ্যালো শুনে স্পর্শিয়ার মুখ দিয়ে ভয়ে কোন কথাই বের হচ্ছিল না। তাই ও কল কেটে দিয়েছে।

খাটের উপর থুমম ধরে বসে রইল স্পর্শিয়া। হাত ঘামছে ওর। ভয় লাগছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। স্নিগ্ধা এটা কি করলো, ওকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অনেকক্ষণ পর স্নিগ্ধা এল দরজার সামনে। স্পর্শিয়া যেই ওকে মারতে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধা বললো,
– তোকে আমার দোহাই কিছু করবি না।
রাগে গজগজ করতে করতে স্পর্শিয়া বলল,
– তুই এমন করলি কেন? ওই ব্যাটা এখন কি ভাববে?
– কি আর ভাববে.. ভাববে তার বাচ্চা বউটাও কত রোমান্টিক।
– তোর খবর আছে।
– আহা! এমন করিস কেন? একটু মজাই তো করেছি আমার দুলাভাইয়ের সাথে। আমি তো তাকে আমার দুলাভাই মেনে নিয়েছি, এবার তুই যত জলদি আরাধ্য ভাইয়াকে নিজের উড বি হ্যাজবেন্ড মেনে নিস, ততই তোর জন্য ভালো।
– ভালো নাকি কালো বুঝাচ্ছি তোকে!
বলেই স্পর্শিয়া স্নিগ্ধার পিছনে দিল দৌড়।

… … … … …

আজ অনেকদিন পর কলেজে যাচ্ছে স্পর্শিয়া। এ্যাঙ্গেজমেন্টের পর প্রথম কলেজে যাওয়া। কতদিন পর আবার সব বান্ধবীরা একসাথে মজা করবে ভাবতেই ওর খুব খুশি খুশি লাগছে।

কলেজে গিয়ে ক্লাস তো করলই না উলটো আরও সব বান্ধবীরা মিলে গাছের আম চুড়ি করে দৌড়ানি খেল দাড়োয়ানের। সব ফাজলামি শেষ করে কলেজ টাইম শেষ যখন হলো, তখন সব বান্ধবীরা মিলে হৈ চৈ করতে করতে বের হচ্ছিল গেট দিয়ে। হঠাৎ স্পর্শিয়া দেখে গেটের সামনে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আরাধ্য দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে ডার্ক মেরুন আর ব্ল্যাক কম্বিনেশনের টি শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট, কেডস, আর চোখে সানগ্লাস। মুহূর্তের মধ্যে কালকে রাতে করা স্নিগ্ধার কুকির্তী মনে পড়ে যায় স্পর্শিয়ার। ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। হাত কাপতে থাকে। শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এই মুহূর্তে ওর ইচ্ছে করছে মাটি টা দু ভাগ হয়ে যাক, আর ও মাটির ভেতরে চলে যাক। আরাধ্য ওর দিকে এগিয়ে আসছে, আর ওর বুকের ধুকপুক বেড়েই চলছে। এতই জোড়ে বিট করছে যে স্পর্শিয়ার মনে হচ্ছে বাইরে থেকে ওর হার্টবিট যে কেও শুনতে পাবে।

আরাধ্য সামনে এসে জিজ্ঞেস করল,
– কেমন আছ স্পর্শ?
স্পর্শিয়া কিছুক্ষন এমনভাবে আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে রইলো যেন ও বুঝতেই পারছে না আরাধ্য কাকে প্রশ্নটা করেছে।
তারপর আস্তে করে জবাব দিলো,
– ভালো আছি।
স্পর্শিয়া ভয়ে আরাধ্যকে কুশল বিনিময় কিছুই করতে পারলো না। গলায় যেন কথা দলা পেকে গিয়েছে এমন মনে হল ওর। স্পর্শিয়া ভাবতে লাগলো এই বুঝি আরাধ্য কিছু বলে ফেলবে কাল রাতের ব্যাপারে। কিন্তু আরাধ্য তেমন কিছুই বললো না। ও স্পর্শিয়ার বান্ধবীদের সাথে কথা বলতে লাগলো। আস্তে আস্তে স্পর্শিয়ার ভয় আর বুক ধুকপুকানি কমতে শুরু করলো।

স্পর্শিয়া আশেপাশে খেয়াল করে দেখল কলেজের যত মেয়েরাই এদিক দিয়ে যাচ্ছে সবাই আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে। কেও কেও ওকে দেখে একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করে কিছু বলছে। কিছু কিছু ছেলেরাও আরাধ্যকে দেখছে। স্পর্শিয়ার রাগ হলো। ওর ফিওন্সে, আর অন্য মেয়েরা এভাবে দেখছে! ওর ইচ্ছে করছে সব মেয়েদের হাতে একটা করে জোড়ে কামড় বসিয়ে দিতে, আর আরাধ্যর গলায় একটা সাইনবোর্ড টানিয়ে দিতে “স্পর্শিয়া’স প্রপার্টি “।

হঠাৎ স্পর্শিয়ার মনে হলো এগুলো ও কি ভাবছে! তাও আরাধ্যকে নিয়ে! যাকে ও ভালবাসে না, যাকে ও বিয়ে করতে চায় না। ভাবনায় পড়ে গেল স্পর্শিয়া। কেন এমন চিন্তা এল আরাধ্যকে নিয়ে ওর?
স্পর্শিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন রিমি বলে উঠলো,
– তুই জিজুকে টাইম দে। আমরা আসি।
স্পর্শিয়া হতভম্ব হয়ে বললো,
– কেন? তোরা যাবি কেন?
– তুই কোন ধ্যানে আছিস বল তো? এতক্ষন তো আমরা এটা নিয়েই ডিসকাস করছিলাম যে আজকে তোদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হবো না। জিজু মুখে মুখে থাকতে বললেও মনে মনে যে একাই সময় কাটাতে চাচ্ছে তোর সাথে তা এমনিতেই বুঝতে পারছি। আর তুই এতক্ষন কিছুই শুনলি না!

আরাধ্য বললো,
-বউ তো আমাকে কতদিনে বিয়ে করবে সেই টেনশনে উদাসীন। কিন্তু শালিকারা থাকলে মজাই হতো।
– আজকে বউ এর সাথেই মজা কর ভাইয়া, পরে করো শালিকাদের সাথে।

সবাই চলে গেল।

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞেস করল,
– তোমার কি খারাপ লাগছে?
– না তো..
– অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে।
– না, তেমন কিছু না।
– তুমি কি এখন বাড়ি যাবে?
স্পর্শিয়া মুখ তুলে আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছে।
– স্পর্শ, তোমার যদি খারাপ লাগে বলো। বাড়ি দিয়ে আসি তোমাকে।
স্পর্শিয়া নিজের চিন্তাতেই নিজে অন্যমনস্ক হয়ে ছিল। কিন্তু ছেলেটা ওর সাথে সময় কাটানোর জন্য এসেছে, আবার ও নিজেও চাচ্ছে সম্পর্কটাকে মেনে নিতে, তাই ও বললো,
– তেমন কিছু না। এখন বাসায় না গেলেও চলবে। আর আপনি এত দূর থেকে এসেছেন তাও আমার জন্য..
– হ্যা, শুধুই তোমার জন্য।
বলেই আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে মিস্টি একটা হাসি বিনিময় করলো। বলল,
– বল কোথায় যাবে?
– আপনার যেখানে ইচ্ছা।
– আমার তো ইচ্ছে করে বউ করে বাসায় নিয়ে যেতে।

স্পর্শিয়া চুপ করে রইলো। আরাধ্য জানে স্পর্শিয়া ওর এই কথার কোন উত্তর দিবে না। কারন ওকে নিয়ে স্পর্শিয়ার মনে যে কোন ফিলিংস নেই সেটা ও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তাতে ওর আফসোস নেই। কারণ, আরাধ্যর টেনশন ছিল স্পর্শিয়া অন্য কাওকে ভালোবাসে কি না, কারও সাথে রিলেশন আছে কি না। যেহেতু স্পর্শিয়া গতকাল বলেছে যে ওর কোন রিলেশন নেই, তাই আরাধ্য অনেকটাই রিলিফ, আর আরাধ্যর বিশ্বাস একদিন না একদিন ওর স্পর্শ ওকে ভালবাসবেই।
আরাধ্য বললো,
– হাতিরঝিল চলি? যেহেতু বিকেল হয়ে এসেছে এখন ভালো লাগবে।
– হুম, যাওয়া যায়।
– তার আগে কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিছু খেয়ে নেই চলো।
.
.
.
.
.

আরাধ্য আর স্পর্শিয়া দুজন দুজনের মুখোমুখি বসে আছে। আরাধ্যর খুব করে ইচ্ছে করছিল স্পর্শিয়ার পাশে বসতে। কিন্তু সাহস হয় নি। স্পর্শিয়া মুখে ইচ্ছেমত খাবার পুরে দিয়ে খাচ্ছে। আরাধ্য নিজের খাওয়া রেখে তাকিয়ে তাকিয়ে স্পর্শিয়ার খাওয়া দেখছে।
স্পর্শিয়া অন্য সব মেয়েদের মতো ঢং করে খাচ্ছে না, বরং ওর খাবার খাওয়া দেখে বুঝাই যাচ্ছে বেশ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে ও। ব্যাপারটা খুব ভালো লাগছে আরাধ্যর কাছে। স্পর্শিয়ার এই ছোট ছোট বিষয়গুলিই আরাধ্যকে আরও ঘায়েল করে ফেলছে। স্পর্শিয়া যে ওর ফিওন্সের সামনে বসে খাবার খাচ্ছে সেদিকে যেন ওর কোন খেয়ালই নেই। স্পর্শিয়া খাওয়া শেষ করে আরাধ্যর দিকে তাকাতেই দেখলো আরাধ্য ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। স্পর্শিয়া লজ্জা পেয়ে গেল। নিজে নিজেই ভাবতে লাগলো ও কত গাধা! ফিওন্সের সামনে কিভাবে খাবার খাচ্ছে! নিজেকে নিজে কয়েকটা বকাও দিল ফেললো মনে মনে।

আরাধ্য হতাশ হয়ে বললো,
– এটা কি হলো?
স্পর্শিয়া চমকে উঠলো। এই বুঝি খাবার খাওয়া নিয়ে আরাধ্য ওকে লজ্জা দিবে এখনি। ভয়ে ভয়ে বললো,
– কি হয়েছে?
– এইটুকু কোন খাবার হল? কি খেলে তুমি? কত সুন্দর করে খাচ্ছিলে আর আমি দেখছিলাম। এত অল্প খাবার খাও বলেই তো মুরগির বাচ্চার মতো শরীর তোমার। আরেকটু খাও না, আমি দেখি একটু।
স্পর্শিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
– খাবার খাওয়া আবার দেখার লাগে? নিজে খেলে পেট ভরে, অন্যের খাওয়া দেখলে তো আর নিজের পেট ভরবে না।
– তোমারটা দেখলে আমার পেট না ভরলেও মন ভরবে।
স্পর্শিয়া কোন উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো,
ছেলেটা চিজও একটা! এই ছেলে এত পটানো টাইপ কথা বার্তা আমার সাথে বলে, তবে কি অন্য কারও সাথে বলতো না?

আরাধ্য সাথে সাথেই বলে উঠলো,
– কি ভাবছো? এমন কথা বার্তা অন্য মেয়েদের সাথে বলতাম নাকি সে চিন্তাই তো আসছে মাথায়, তাই না?

স্পর্শিয়া চোখ গোলগোল করে বলল,
– না, না। এমন কিছু না।
আর মনে মনে ভাবতে লাগলো ছেলেটা মাইন্ড রিডার নাকি!

আরাধ্য হেসে দিল। স্পর্শিয়া খেয়াল করলো আরাধ্যর হাসিটা খুব সুন্দর। ঠিক সায়ানের হাসির মতোই সুন্দর। ওদের দুজনের হাসিতে এতো মিল! ওর কাছে এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো সায়ান ওর সামনে বসে হাসছে। ছেলেদের হাসি সাধারণত সুন্দর হয় না। অনেকের হাসি আবার খুব বিচ্ছিরি দেখায়। কিন্তু ওর সামনে বসে থাকা ছেলেটার হাসি সত্যিই খুব সুন্দর। স্পর্শিয়া কি যেন ভেবে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের কোণায় একটু পানিও জমলো হয়তো।
.
.
.
.

হাতিরঝিলের পরিবেশ টা সুন্দর লাগছে। আশেপাশে মানুষ খুবই কম। এ সময় মানুষ এত কম হওয়ার কথা না, তবুও কম। আকাশে হালকা মেঘ জমে আছে। রোদ না থাকাতেই পরিবেশটা বেশ উপভোগ করা যাচ্ছে। আরাধ্য ব্রিজের রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্পর্শিয়া ওর পাশেই দাঁড়ানো। আরাধ্য আশেপাশের মানুষদের দেখছে। বেশিরভাগই কাপল। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। কেও কেও হাসছে, কেও একসাথে প্রকৃতি দেখছে, কেও বাদাম খাচ্ছে, কেও হাত ধরে হাটছে। কষ্ট হচ্ছে আরাধ্যর এসব দেখতে। ওর খুব ইচ্ছে করছে স্পর্শিয়া ওর কাধে একটু মাথা রাখুক। কিন্তু রাখবে না ও জানে। স্পর্শিয়া এখনো সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারছে না কেন আরাধ্য বুঝতে পারছে না। ও তো ভেবেছিল এ্যাঙ্গেজমেন্টের পর পরই চুটিয়ে প্রেম করা শুরু করবে । কিন্তু স্পর্শিয়ার হাবভাব এ মনে হচ্ছে নিজেদের ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়ে ফেলার পরেও প্রেম করতে পারবে না ওরা।

স্পর্শিয়া কিছু একটা বলার জন্য আরাধ্যর দিকে তাকাতেই দেখল আরাধ্য ওর দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। স্পর্শিয়া ইতস্তত ফিল করল। ওর মনে হল তাকিয়েই যেন ভুল করে ফেললো। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আবার পানির উপর চোখ রাখল। আরাধ্য শব্দ করেই হেসে দিল।
– হাসলেন কেন?
– এত লজ্জা পাও তুমি?
– কোথায় লজ্জা পাই?
– এই যে, কিছু বলার জন্য আমার দিকে তাকিয়েছিলে, আর আমি তোমার দিকে তাকিয়ে আছি বলে লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলে।
– কই? কিছু বলার জন্য তাকাই নি তো। এমনি তাকিয়েছিলাম।
– ওরে বাবা! আমি এত লাকি? রিয়েলি? আমি এতই লাকি যে তুমি কোন কারন ছাড়া আমাকে দেখার জন্য আমার দিকে তাকিয়েছ।
– কখন বললাম আপনাকে দেখার জন্য তাকিয়েছি?
– মাত্রই তো বললে।
– আপনাকে দেখার জন্য তো তাকাই নি। এমনি তাকিয়েছি।
– এমনি তাকিয়েছ মানেই তো আমাকে দেখার জন্য তাকিয়েছ।
– উফফফফফ! আপনি না…
– এত ভালো তর্ক করো, ল-ইয়ার হয়ে যাও।
– আমার হওয়ার লাগবে না। আপনিই হয়ে যান হুহ!
ওদের কথার মাঝখানেই স্পর্শিয়ার ড্রেস ধরে কেও টানতে লাগলো। স্পর্শিয়া পিছনে তাকিয়ে দেখলে তিন /চার বছরের ফুটফুটে একটা বাচ্চা মেয়ে ওর ড্রেস ধরে টানছে।
আরাধ্য অবাক হয়ে বললো,
– বাচ্চাটা কে?
– আমি চিনিনা। কিন্তু ওই যে দেখুন একটু দূরে একজন মহিলা আর লোক ঝালমুড়ি খাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, একটু আগে বেবিটাকে আমি উনাদের সাথেই দেখেছিলাম।
– তাহলে হয়তো তাদেরই বেবি। তাদের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে বেবিটা হয়তো হেটে হেটে এখানে চলে এসেছে। চলো দিয়ে আসি।
ততোক্ষনে স্পর্শিয়া বেবিটাকে কোলে তুলে নিয়েছে।
স্পর্শিয়া বলল,
– একটু রাখি বেবিটাকে প্লিজ?
– ওর আব্বু আম্মু টেনশন করবে।
– যখন খুজবে তখন গিয়ে দিয়ে আসবো।
– হ্যা, তোমার মতো পিচ্চির কথা শুনে আমি ছেলেধরার খাতায় নাম লিখাই।
স্পর্শিয়া মন খারাপ করে রইলো, আর আরাধ্য বেবিটাকে স্পর্শিয়ার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বেবিটার আব্বু আম্মুর কাছে চলে গেল। স্পর্শিয়া দূর থেকে দেখতে লাগলো আরাধ্য বাচ্চাটার আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলছে। বুঝাই যাচ্ছে তারা খুব কৃতজ্ঞতার সাথে আরাধ্যকে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

স্পর্শিয়া মুখ ঘুরিয়ে ব্রিজের রেলিং ধরে পানির দিকে তাকিয়ে আছে । ছলছল করে পানি বইছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। ছোট বাচ্চা ওর খুবই পছন্দের। আর এই বাচ্চাটা তো যেভাবে ওর কোলে ছিল ইচ্ছেই করছিল না বাচ্চাটাকে ছাড়তে । আরাধ্য এমন কেন। বেবিটা আরেকটু থাকলে কি এমন হতো? মানুষ নাকি ছেলেধরা ভাবতো। কত ঢং!

পেছন থেকে আরাধ্য ডাক দিল। পিছনে ঘুরেই স্পর্শিয়া শকড। ওর সবগুলো দাত বের করে খুশি হয়ে বললো,
– আপনি বেবিটাকে নিয়ে এসেছেন!
-হ্যা, তোমার জন্য।
স্পর্শিয়া হাত বাড়াতেই বেবিটা ওর কোলে চলে আসলো সাথে সাথে, যেন বহুদিনের পরিচিত ওরা। আরাধ্য স্পর্শিয়াকে দেখছে। স্পর্শিয়া বেবিটার নাকের সাথে নাক ঘসছে, ঠোটে গালে চুমু খাচ্ছে। স্পর্শিয়া আদর দিচ্ছে, আর বাচ্চাটা খুব খুশি মনেই তা নিচ্ছে। বাচ্চাটা আর স্পর্শিয়ার মধ্যে এতই মিল যে স্পর্শিয়ার পড়নে কলেজ ড্রেসটা না থেকে একটা শাড়ি থাকলে যে কেও ভাবতো এটা ওর ই বেবি। দুজনেই যেন পুতুল। আরাধ্য ভাবছে ওদেরও একদিন এমন একটা বেবি হবে। তখনো স্পর্শিয়া এমনই করবে। আরাধ্য হাসছে আর স্পর্শিয়াকে দেখছে। হঠাৎ স্পর্শিয়া বলল,
– চলুন না একটা সেলফি তুলি।

আরাধ্য খুশি হয়ে গেল। স্পর্শিয়া নিজ থেকে বলছে সেলফি তোলার কথা।
আরাধ্য সেলফি তুললো বেশ কয়েকটা। স্পর্শিয়ার সাথে বেবিটার বেশ কয়েকটা সিংগেল ছবিও তুললো। ছবি তুলে যেন আরাধ্য নিজেই বোকা বনে গেল। এত সুন্দর হয়েছে সেলফিগুলো। মনে হচ্ছে ফ্যামিলি পিক। ওরা দুজন হাজবেন্ড ওয়াইফ, আর এটা ওদের বেবি। আরাধ্য ঠোটে একটা হাসি ঝুলিয়ে ছবি দেখতে লাগলো।

স্পর্শিয়া বেবিটাকে নাম জিজ্ঞেস করছে কিন্তু বেবিটা বলতে পারছে না। যা বলছে তা বুঝা যাচ্ছে না।
আরাধ্য বলল,
– ওর নাম সিনাদা।
– আপনি কি করে জানলেন?
– তুমি নাম জানতে চাইবে আমি জানতাম, তাই আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর আম্মুর কাছে।
এর মধ্যেই বাচ্চাটার আব্বু আম্মু চলে এল। তাদের সাথে কথা হলো ওদের কিছুক্ষণ। বাচ্চাটার আম্মু বাচ্চাটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই চলে গেল ওর আম্মুর কোলে। তারা চলে গেল বাচ্চাটাকে নিয়ে।

স্পর্শিয়ার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আরাধ্য খুব ভাল করেই বুঝতে পারলো যে স্পর্শিয়ার মন খারাপ হয়ে গেছে । ও নিজেই বলল,
– স্পর্শ।
– হুম।
– মন খারাপ বেবিটার জন্য?
– হুম।
– এমন একটা বেবি চাই তোমার?
– হুম।
– তাহলে চলো, দেড়ি না করে বাসায় জানিয়ে দেই। শুভ কাজটা সেরেই ফেলি।
এবার স্পর্শিয়া চোখ তুলে উপরে তাকালো। আরাধ্যর কথাটা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। যখন আরাধ্যর কথার অর্থ ও ধরতে পারলো তখন মুখ ঘুড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। স্পর্শিয়া নিজেও জানে না ওর হাসি কেন আসছে। আবার লজ্জাও লাগছে আরাধ্যর কথা শুনে।

আরাধ্য আবারো ডাকলো,
– স্পর্শ?
– বলুন।
– আমার না খুব শখ।
– কিসের শখ?
– একটা মেয়ে বাবুর শখ। আমার একটা মেয়ে বাবু হবে। সারাদিন আমার সাথে থাকবে। আমরা বাবা মেয়ে মিলে অনেক মজা করব। মেয়ে যখন স্কুলে পড়বে প্রতিদিন স্কুলে দিয়ে আসবো। ও যখন একটু বড় হবে তখন ও বন্ধুদের সাথে ঘুড়তে যেতে চাইলে আমি বাধা দেওয়ার জায়গায় আরও হেল্প করবো।কেও আমার মেয়েকে একটা বকা দিলে আমি ওকে আরও দশটা বকা শিখিয়ে দিব দিয়ে আসার জন্য। আমার মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হলে আমি ওর উপর রাগ করার বদলে ওর কাছে উলটো ট্রিট চাইবো। আমার মেয়ে কখনো…
এবার স্পর্শিয়া রেগে গেল খুব। চেঁচিয়ে বলল,
– ওয়েট! ওয়েট! হোয়াট ডিড ইউ সে? মেয়ের বয়ফ্রেন্ড হলে ট্রিট চাইবেন? এ কেমন বাপরে বাবা! এমন কখনো দেখেছেন নিজের মেয়ের রিলেশনের ট্রিট চায়? আবার নাকি বকাও শিখাবে নিজের মেয়েকে। নাউজুবিল্লাহ! বলে কি!
– আরে আমার মেয়ে, আমি করতেই পারি এমন।
– ওহ? মেয়েটা আপনার একার? আমার কিছুনা তাই না? আমি ৯ মাস পেটে ধরবো, কষ্ট করবো, আমার কিছু না, আর মেয়ে আপনার হয়ে গেল হুম?? মেয়ে আপনার একার না মেয়ে আমারও। বুঝলেন? আমার পারমিশন ছাড়া আমার মেয়েকে বকা শিখানো যাবে না, ট্রিট চাওয়া যাবে না। নয়তো তখনি আপনাকে গুল্লি করে উড়িয়ে ফেলবো।

স্পর্শিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগলো।আরাধ্য আস্তে করে বললো,
– বেবি টা কি তোমার এখনি লাগবে?
আরাধ্যর দিকে ফিরে তাকালো স্পর্শিয়া। আরাধ্যর চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি। এতক্ষণ কি বলেছে সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না স্পর্শিয়ার। আরাধ্যর চেহারা দেখেই মনে পড়লো কি কি উলটা পালটা কথা বলে বসেছে ও এতক্ষণ। সাথে সাথে জিবে কামড় দিয়ে বসলো স্পর্শিয়া..।

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here