প্রেম পর্ব -০৯

প্রেম 💜 (Love has no limits)

#পর্ব : ০৯

স্পর্শিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে নাক ফুলিয়ে রাগে গজগজ করতে লাগলো।আরাধ্য আস্তে করে বললো,
– বেবি টা কি তোমার এখনি লাগবে?
আরাধ্যর দিকে ফিরে তাকালো স্পর্শিয়া। আরাধ্যর চোখেমুখে দুষ্টুমির হাসি। এতক্ষণ কি বলেছে সেদিকে কোন খেয়ালই ছিল না স্পর্শিয়ার। আরাধ্যর চেহারা দেখেই মনে পড়লো কি কি উলটা পালটা কথা বলে বসেছে ও এতক্ষণ। সাথে সাথে জিবে কামড় দিয়ে বসলো স্পর্শিয়া..।

কি বললো এতক্ষণ ও। আরাধ্য কি ভাববে! ছিঃ! স্পর্শিয়া আরাধ্যর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ওর এই মুহূর্তে নিচের পানিতে ঝাপ দিতে ইচ্ছে করছে। আরাধ্য কি পাগল নাকি ছাগল? স্পর্শিয়া না হয় ঝোকের মাথায় বলেই ফেলেছে বেবি নিয়ে এতকিছু, তাই বলে আরাধ্য এমন একটা কথা বলে ওকে লজ্জা দিতে পারলো! স্পর্শিয়া তো লজ্জায় আরাধ্যর দিকে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না। কি বলে ফেললো এগুলো তাই ভাবছে বারবার।

আরাধ্য বললো,
– বিবিজান, সন্ধ্যা হচ্ছে তো। আপনার লজ্জা পাওয়া শেষ হলে চলুন বাড়ি যাই।
স্পর্শিয়া খুব সাহস করে আরাধ্যর দিকে এক নজর তাকালো। এখনো ওর চোখেমুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। উফফফ! ছেলেটা এমন কেন? এভাবে লজ্জা দেওয়ার কোন মানে আছে। এভাবে তাকায় কেন!

.
.
.
.

প্রায় অর্ধেক রাস্তা শেষ। স্পর্শিয়া এখনো চুপ করে আছে। অন্য সময় হলে হয়তো টুকটাক কথা বলতো আরাধ্যর সাথে। কিন্তু ওর লজ্জায় আরাধ্যর দিকে তাকাতেই ইচ্ছে করছে না। জানালা দিয়ে বাহিরেই তাকিয়ে আছে ও।

আরাধ্য কাশি দিয়ে স্পর্শিয়ার এটেনশন সিক করার চেস্টা করলো । স্পর্শিয়া বুঝতে পারলো আরাধ্য হয়তো কিছু বলবে। আর যাই বলুক, বাচ্চার ব্যাপার নিয়ে কিছু না বললেই হলো।
স্পর্শিয়া বাহিরেই তাকিয়ে আছে। আরাধ্য বলল,
– এইটুকু কথায় এভাবে লজ্জা পাচ্ছ, তাহলে গত রাতে ফোনে কিস কি করে দিলে?
স্পর্শিয়া ভুত দেখার মতো ঘুরে তাকিয়ে রইল আরাধ্যর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নজর সরিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো। স্পর্শিয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল মুহুর্তেই। ঢোক গিলতে থাকলো। ঘাম জমেছে কপালে বিন্দু বিন্দু। আরাধ্য সারাদিন পর এই কথাটা জিজ্ঞেস করবে স্পর্শিয়া চিন্তাও করেনি । কি বলবে এখন ও? ভেবে পাচ্ছে না কিছু।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,
– আমি তো ভুত না। এভাবে ভয় পাচ্ছ কেন?
– কা…কা…কাল রাত। না.. আমি। না…. যখন কথা বলেছি।
আরাধ্য স্পর্শিয়ার হাত ধরলো।
– স্পর্শ। ভয় পাও কেন? আমাকে কিছু বলতে এত দ্বিধা তোমার? আমি জানি কাল রাতে ওই কাজটা তুমি করনি।

স্পর্শিয়া একবার শুধু আরাধ্যর দিকে তাকালো। তারপর কিউরিসিটি দমন করার জন্যই আরাধ্যকে জিজ্ঞেস করলো,
– ওইটা যে আমি ছিলাম না সেটা কি আপনাকে স্নিগ্ধা বলেছে?
– নাহ।
– তবে? আর তো কেও ছিল না সামনে। কে বলল?
– আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি। কারণ যেই মেয়ে ঠিক মতো কথাই বলে না আমার সাথে, সে কি আর আমাকে ফোনে কিস দিবে নাকি।
বলেই আরাধ্য হাহাহা করে হাসতে লাগলো। কিন্তু আরাধ্যর হাসি স্পর্শিয়ার ভালো লাগছে না। সত্যিই আরাধ্য এটা বুঝতে পারছে যে স্পর্শিয়া ওর সাথে ঠিক মতো কথা বলছে না? আরাধ্য কি কষ্ট পাচ্ছে? হ্যা, কষ্ট পাওয়ার ই তো কথা। নিজের ফিওন্সে নিজের সাথে ঠিক মতো কথা না বললে কষ্ট তো লাগবেই। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে স্পর্শিয়ার।

স্পর্শিয়া এবার নিজ থেকেই কথা বাড়ানোর জন্য বললো,
– আচ্ছা, একটা কথা বলুন। আমি কি আপনাকে চিনি? মানে.. আমার মনে হয়েছে আমি আপনাকে কোথাও দেখেছি । কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারছি না।
আরাধ্য হেসে দিল।
– আমি জানতাম তুমি আমাকে চিনতে পারনি। তুমি আমাকে একবার না, বরং বেশ কয়েকবার ই দেখেছ।
স্পর্শিয়া ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
– বেশ কয়েকবার দেখেছি! কোথায়?
– তোমার কলেজের সামনে, লেক সাইডে যেখানে আড্ডা দিতে সেখানে, তোমার নানু বাড়িতে, অনেক জায়গাতেই দেখেছি আমি তোমাকে। কিন্তু তুমি আমাকে ৩/৪ বারের বেশি হয়তো দেখনি।
স্পর্শিয়া অবাক হয়ে বলল,
– এত জায়গায় কি করে দেখলেন? কেন যেতেন? গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যেতেন নাকি?
আরাধ্য হেসে দিল কথা শুনে।
– নাহ, গার্লফ্রেন্ড না। আমি তো তোমাকে দেখতেই যেতাম।
স্পর্শিয়া চোখ গোলগোল করে বলল,
– আমাকে দেখতে মানে!!
– গল্প শুনবে?
– না গল্প শুনবো না। আগে বলুন আমাকে দেখতে যেতেন মানে?
– এটাই তো গল্প। আমার ভালোবাসার গল্প।

স্পর্শিয়ার চোখেমুখে কৌতুহলের ছাপ স্পষ্ট। আরাধ্য স্পর্শিয়াকে ওয়েট না করিয়ে বলা শুরু করলো,

– তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম তোমার নানুবাড়ির গ্রাম মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। এটা ৭ মাস আগের কথা । তখন আমি রিসেন্টলি দেশে ফিরেছিলাম। আমি আর রোহান দেশে ফেরায় সব বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করেছিল ঘুরতে যাবে। বিক্রমপুরে আমার ফ্রেন্ড জিহানের গ্রামের বাড়ি। শীতকাল ছিল বলে সবাই ঠিক করে সেখানেই যাবে। সেখানে যাওয়ার তৃতীয় দিনে আমরা সবাই পেয়ারা বাগান ঘুরতে যাই। আমি হাটতে হাটতে দল থেকে সরে গিয়ে বাগানের একটু ভেতরে যেতেই প্রথম দেখি তোমাকে। তুমি কালো রং এর একটা জামা পড়া ছিলে, ওড়না টা কোমরে বাধা ছিল, একটা পেয়ারা গাছের ডালে উঠে বসেছিল। মজার ব্যপার হচ্ছে প্রথমে ভুত ভেবেছিলাম। কারণ, শুনেছি গ্রামে নাকি ভুত থাকে । যেভাবে গাছের ডালে পা ছড়িয়ে বসেছিলে ভুত ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথাই আসেনি। কিন্তু একটু ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম এটা তো ভুত না একটা পরী। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে স্নিগ্ধা, রিতিকা, সোহান, আরও কার কার নাম ধরে যেন ডাকছিলে। বুঝতে পারলাম হয়তো গাছে উঠে ফেসে গেছ, নামতে পারছ না বলে ডাকছিলে সবাইকে। তোমাকে দেখে কেমন যেন ফিল হচ্ছিল আমার যা অন্য মেয়েদের দেখে ফিল হতো না। কয়েক সেকেন্ড ওয়েট করলাম। দেখলাম কেওই আসছে না। আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে তোমাকে নামানোর জন্য। কিন্তু আমার কপাল এতই খারাপ যে ওই মুহূর্তেই সোহান চলে আসে। আর ও তোমাকে গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। আমি তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। সোহানকে আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড মনে করেছিলাম। একটা গ্রামের মেয়েকে দেখে এমন ফিল হবে আমি তা চিন্তাও করিনি।
স্পর্শিয়া চেঁচিয়ে বললো,
– কোন দিক থেকে গ্রামের মেয়ে আমি? আর সোহান আমার বয়ফ্রেন্ড? কি বলেন!!
– আরে বাবা! রাগ করছ কেন? আমি তো তখন তোমাকে গ্রামের মেয়ে ই ভেবেছিলাম। তোমার ওই সময়ের ড্রেস আপ, গাছে উঠে ঝুলে থাকা দেখে এমনই মনে হয়েছিল, তাই বলেছি। আর সোহান তোমাকে এসে গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল তাই ভেবেছিলাম ও তোমার বয়ফ্রেন্ড।
– গাছ থেকে কেও নামিয়ে নিলেই বয়ফ্রেন্ড হয়ে যায়?
– তা বলছি না তো। রাগ করো কেন সোনামণি?
– হুহ!
আরাধ্য আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগলো। স্পর্শিয়াও কিছু বলছে না। কিন্তু বাকী ঘটনা শুনতে ওর খুব ইচ্ছে করছে। কোন কিছু অর্ধেক শুনে ও আবার কৌতুহল কিছুতেই দমিয়ে রাখতে পারে না। সব শুনে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওর আবার কিছুই ভালো লাগে না। এখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে কেন যে আরাধ্যকে এসব বলতে গেল..!!!!

স্পর্শিয়া একবার আড়চোখে আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে নিল ওর চেহারার হাবভাব বুঝার জন্য।
আরাধ্য সাথে সাথেই বলল,
– স্পর্শ, আমি তোমারই। চাইলে ভালো মতোই তাকাতে পার আমার দিকে। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাতে হবে না।

স্পর্শিয়া সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। এই ছেলে কেমন! সামনের দিকে তাকিয়েও কি করে বুঝলো যে আড়চোখে দেখছে স্পর্শিয়া ওকে। লজ্জা দিতে কোন ছাড় দেয় না এই ছেলে। আরাধ্য গাড়ি থামিয়ে দিল। গাড়ি কেন থামালো সেটা বুঝার জন্য আরাধ্যর দিকে তাকাতেই স্পর্শিয়া দেখলো বাড়ি চলে এসেছে ওরা। স্পর্শিয়া খুব অবাক হল। আচ্ছা, আরাধ্যর সাথে কথা বলতে থাকলে সময়ের যেন কোন হুদিস থাকে না এমন লাগে কেন ওর কাছে? মনে হচ্ছে কত জলদি বাড়ি চলে এসেছে।

আরাধ্য গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ডোর খুলে দিল স্পর্শিয়াকে বের হওয়ার জন্য। স্পর্শিয়া গাড়ি থেকে নামলে আরাধ্য বললো,
– তুমি তাহলে যাও। এখন তো যেতে পারবে।
– আপনি যাবেন না?
– না।
– কেন?
– বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়িতে প্রতিদিন গেলে কেমন যেন দেখায়।
– সবাই তো আপনাকে খুব পছন্দ করে। তবে কেমন দেখাবে কেন?
– বেশি বেশি শ্বশুর বাড়ি গেলে কদর কমে যায়। বুঝলে ময়না?
– না, কমে না। চলুন।
– ঘটনা কি বলো তো।
– কিসের ঘটনা?
– তুমি আমাকে বাসায় নেওয়ার জন্য এত ইনসিস্ট করছো যে। মার্ডার টার্ডার করবে না কি আমার?
– উফফফ! আমাকে এত খারাপ মনে হয় আপনার?
– তবে?
– আসলে… আমি বাকি ঘটনাটুকু শুনতে চাচ্ছি।
– আচ্ছা পিচ্চি। এই তবে ঘটনা! আমিও তো বলি আমার প্রতি এত ভালোবাসা কি করে এল যে বাসায় নিতে চাচ্ছে।
– উহু। আমি মোটেও পিচ্চি না।
– ওকে, তবে বুড়ি।
– কিহ!
– তুমিই তো বললে তুমি পিচ্চি না। তবে তুমি বুড়ি।
– হুহ। এখন আপনি তাহলে বাকী গল্পটুকু না শুনানোর জন্য এমন করছেন তাই না?
– আরে না। এ কথা বলছো কেন? আমার বিবিজান কিছু বলেছে তা কি আমি ফেলতে পারি? চলো ভেতরে যাই।

স্পর্শিয়া আরাধ্য ভেতরে ঢুকতেই সব কাজিনরা এসে ঘিরে ধরলো আরাধ্যকে। স্পর্শিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কোথায় ও আরাধ্যকে নিয়ে এসেছিল বাকি কাহিনী শুনবে বলে আর ওরা ঢুকতে না ঢুকতেই যেভাবে ঘিরে ধরেছে , মনে হচ্ছে না আরাধ্যকে সহজে ছাড়বে ওরা। কেমন পাগল ছাগল পোলাপান, বোনের জামাইকে বোনের থেকেই দূরে সরিয়ে রাখছে।

মন খারাপ করে স্পর্শিয়া উপরে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে উপরের সিড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। এইদিকে দাড়ালে হল রুমের সব স্পষ্ট দেখা যায় নিচে কি হচ্ছে না হচ্ছে। নিচে আরাধ্যর আশেপাশে স্পর্শিয়ার দাদী, আম্মু, কাকীরা সবাই বসে হাহা হিহি করছে। বাচ্চারা বোর ফিল করে যে যে যার যার মতো কথা বলছে, খেলছে, আর স্নিগ্ধা, আলিয়া, সোহান, নাদিয়া, শিহাব অন্যদিকে চলে গেছে। স্পর্শিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। ওর কাজিনগুলা যেমন তেমন, কিন্তু একবার যেহেতু আরাধ্য কাকীদের পাল্লায় পড়েছে সহজে ছুটতে পারবে না।
আরাধ্য উপরে তাকাতেই স্পর্শিয়ার চোখে চোখ পড়লো। বুঝতে পারলো স্পর্শিয়ার মন খারাপ হয়ে গেছে সবাইকে আশেপাশে দেখে। কিন্তু বেচারা করবে তো করবে কি। শাশুড়িদের এভাবে রেখে তো ও চাইলেই আর নিজের বউ এর কাছে যেতে পারবে না।

হঠাৎ স্পর্শিয়ার ছোট কাকী দেখলো আরাধ্য উপরে তাকিয়ে আছে। ওর নজর অনুসরণ করে উপরে তাকাতেই দেখলো স্পর্শিয়া দাড়িয়ে আছে । কাকীকে উপরে তাকাতে দেখেই স্পর্শিয়া রুমে চলে গেল। কাকী বুঝলো দুজন হয়তো দুজনের সাথে নেই বলে মন খারাপ।

ছোট কাকী: আরাধ্য, তুমি আমাদের সাথে থেকে বোর হবে। বরং তুমি উপরে চলে যাও। স্পর্শিয়ার সাথে গল্প করো। বাচ্চারা এদিকে এলে আমি ওদের উপরে পাঠিয়ে দেব।
বড় কাকী : হ্যা, বাবা। যাও তুমি। স্পর্শিয়ার আব্বু, কাকারা বাড়িতে এলে তোমাকে ডাক দিব।
আরাধ্য বেশ কয়েকবার মানা করার অভিনয় করলো, আর তারপর বেশ খুশি মনেই উপরে গেল। যেতে যেতে ছোট কাকীকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদও জানালো মনে মনে।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার দরজা নক করতে গিয়েও করলো না। যা দেখলো তা দেখার পরে দরজা নক করতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। স্পর্শিয়া ওর খাটের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে আছে। মাথার নিচে একটা বালিশ। ও বালিশের ওপরে হাত রেখে সেই হাতের ওপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আরাধ্য ভাবতে লাগলো একটু আগেই তো সিড়ির সামনে ছিল, এত জলদি কি করে ঘুমালো।
ওর এইমাত্র শাওয়ার নেওয়া লম্বা ভেজা চুলগুলো ফ্লোরে টাচ করে পড়ে আছে। আরাধ্য পা টিপে টিপে রুমে ঢুকল যেন স্পর্শিয়ার ঘুম না ভাঙে। স্পর্শিয়ার খাটের সামনে গিয়ে হাটু ভাজ করে ফ্লোরে বসে পড়লো আরাধ্য। একনজরে দেখেই যাচ্ছে আরাধ্য স্পর্শিয়াকে। ইস! কি মিষ্টি মেয়েটা! আল্লাহ যেন নিজ হাতে বানিয়েছে মেয়েটাকে। পরীও হয়তো হার মানবে ওর কাছে। এই টানা টানা চোখগুলোরই প্রেমে পড়েছিল আরাধ্য। এই চোখ খোলা অবস্থায় যতটা সুন্দর, ঘুমন্ত অবস্থায়ও ঠিক ততোটাই সুন্দর লাগছে ওর কাছে। জানালা দিয়ে একটু জোড়ে বাতাস আসতেই স্পর্শিয়ার সামনের ছোট চুলগুলো ওর মুখের উপর পড়লো। আরাধ্য আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। নিজের অজান্তেই আলতো হাতের ছোয়া দিয়ে স্পর্শিয়ার চুল গুলো সরিয়ে দিল ওর মুখের ওপর থেকে। কারও হাতের ছোয়া পেতেই স্পর্শিয়া চোখ খুলে তাকালো।

আরাধ্যকে ওর এত কাছে দেখে ও চমকে গেল। স্পর্শিয়া হন্তদন্ত হয়ে উঠতে গিয়েই আরাধ্যর কপালের সাথে বেশ জোরে ধাক্কা খেল। দুজনেই নিজ নিজ কপাল ধরে “আউ” করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। আরাধ্য বুঝতেই পারেনি যে স্পর্শিয়া ঘুমায় নি, বরং জেগে আছে। দুজনেই কপাল ধরে কিছু সময় চুপ করে আছে।

স্পর্শিয়ার চোখেমুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। আরাধ্য জিজ্ঞেস করলো ,
– তুমি কি খুব ব্যথা পেয়েছ?
– নাহ। খুব বেশি না। আপনি ব্যথা পেয়েছেন?
– একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
– হুম।
– তুমি কি রাগ করেছ?
– কি করছিলেন আপনি?
– খারাপভাবে নিচ্ছ? আসলে আমি ভেবে ছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ। তাই নক না করেই ভেতরে ঢুকে পড়ি। তোমাকে ডিস্টার্ব করতে চাই নি। তাই চুপচাপ বসে তোমাকে দেখছিলাম। ছোট চুলগুলি তোমার মুখের উপর পড়ছিল, ওগুলো সরাতে গিয়েই…

স্পর্শিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইলো। লজ্জা লাগছে ওর খুব। এত ডিটেইলস জানতে চেয়েছে নাকি ও। ছেলেটা একটা পাগল। সব কিভাবে বলে ফেলে।

স্পর্শিয়া এখনো খাটেই বসে আছে, আর আরাধ্য ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা কাটানোর জন্য স্পর্শিয়া বললো,
– আপনি বসুন। আমি কিছু নিয়ে আসি খাওয়ার জন্য।
বলেই স্পর্শিয়া খাট থেকে নেমে বাইরে যেতে লাগলো। আরাধ্য পেছন থেকে স্পর্শিয়ার হাত ধরে ফেলল।
– স্পর্শ।
স্পর্শিয়া ঘুরে পেছনে তাকালো।
– বললে না, রাগ করলে নাকি? আমি কিন্তু ইচ্ছে করে কিছু করিনি। জাস্ট…জাস্ট হয়ে গেছে। খারাপ কোন ইন্টেনশন ছিল না।
বলেই আরাধ্য স্পর্শিয়ার হাত ছেড়ে মাথা নিচু করে ফেললো।
স্পর্শিয়া বলল,
– আমি কিন্তু রাগ করিনি।
আরাধ্য চোখ তুলে স্পর্শিয়ার দিকে তাকাতেই স্পর্শিয়া একটা মুচকি হাসি দিল। সেই হাসি যেন আরাধ্যর কলিজায় গিয়ে লাগলো। আরাধ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই স্পর্শিয়া এক প্রকার দৌড় দিয়েই রুম থেকে চলে গেল। আর আরাধ্য ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে। স্পর্শিয়া এভাবে হাসলো কেন সেটাই ওর মাথায় ঘুরঘুর করছে।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার রুমটা দেখছিল খুটেখুটে । রুমটা অগোছালো। বিছানায় বই, জামা কাপড় ছড়িয়ে আছে। চাদরটাও ঠিক নেই। পাশে বড় ফুলদানিটা বাকা হয়ে আছে। কিন্তু ড্রেসিং টেবিলটা খুব সুন্দর ভাবে গুছানো। হয়তো শখের জিনিসগুলো সব এখানে বলেই এত সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। আরাধ্য বুঝতে পারলো স্পর্শিয়ার কাজ করে অভ্যাস নেই। নয়তো মেয়েদের রুম সাধারণত এমন থাকে না। আরাধ্য স্পর্শিয়ার খাট থেকে বই খাতা সব নিয়ে গুছিয়ে টেবিলে রাখল, জামা কাপড় সব ভাজ করলো, কিন্তু ইচ্ছে করেই কাবাডে রাখলো না। কারন, একটা মেয়ের পার্সোনাল জিনিস এভাবে ধরা ওর ঠিক মনে হলো না।

রুমে ঢুকে স্পর্শিয়া এসে আরাধ্যকে কাজ করতে দেখে ওর চোখ ছানাবড়া। করছে কি এই ছেলে! আবার লজ্জাও পেল ওর রুম আগোছালো বলেই আজ ওর ফিওন্সে ওর রুম ক্লিন করছে। স্পর্শিয়া পেছন থেকে বলল,
– কি করছেন আপনি?
আরাধ্য লজ্জা পেয়ে গেল। ও চায়নি স্পর্শিয়া ওকে কিছু করতে দেখুক।
– না, তেমন কিছু না। তোমার বেড টা ওলটপালট ছিল। তাই ঠিক করছিলাম।
– এটা কি ঠিক? অন্য কেও এসে দেখলে তখন কি হত?
– কেন? নিজের বউয়ের বেড ক্লিন করা কি খারাপ কিছু? আংকেল কে তো আমি গতকাল দেখেছিলাম আন্টিকে হেল্প করতে। সেটা নিয়ে কি কারও কোন অবজেকশন ছিল?
– না, সেটা নিয়ে কেন থাকবে অবজেকশন?
– তাহলে আমার কাজ করা নিয়ে অবজেকশন কেন থাকবে?
স্পর্শিয়া কিছু বললো না। কিন্তু আরাধ্যর কথায় ও মুগ্ধ হলো ।
আরাধ্য আবার নিজেই বলল,
– টেনশন করো না। টুকটাক কিছু কাজ আমিও পারি। বিয়ের পরে রুম গুছানোর দায়িত্বটা না হয় আমিই নিব।

স্পর্শিয়া লজ্জা পেয়ে গেল। ইদানীং আরাধ্য বিয়ের কথা বললে ও নিজের অজান্তেই লজ্জা পেয়ে যায়। আর ব্যাপারটা আরাধ্যর নজরও এড়ায় না।
স্পর্শিয়া খাটে বসে নিচে পা রেখে মনের অজান্তেই পা ঝুলাচ্ছে। আরাধ্য ওর সামনে মনে পড়তেই সাথে সাথে পা ঝুলানো থামিয়ে দিল। আরাধ্য বলল,
– স্পর্শ, পা খাটের উপরে উঠিয়ে বসো।
– কেন?
– আই নো তুমি এভাবে কমফোরটেবল ফিল কর না। তুমি পা তুলে বস।
– আপনি কি করে জানলেন..
– পা তুলতে বলেছি তুলো । আমার সামনে এত ফরমালিটি দেখাতে হবে না তোমার। যার সাথে সারাজীবন থাকতে হয় তার সাথে ফরমালিটি দেখালে হয় না।

স্পর্শিয়া ভাবতে লাগল কি ছেলেরে বাবা! যা না বলি তাও বুঝে যায়। মানুষ নাকি জ্বিন এটা?

– আচ্ছা স্পর্শ
– হুম।
– তোমার মেকাপ খুব পছন্দ তাই না?
– কি করে বুঝলেন?
– পুরোটা রুম আগোছালো হলেও তোমার ড্রেসিং টেবিল টা বেশ গুছানো, বেশ সুন্দর করে সাজানো সব। মানুষ সবসময়ই নিজের শখের জিনিসের খুব যত্ন করে। ড্রেসিং টেবিলটা এত টিপটপ সেজন্যই বুঝতে পারলাম।
– এত বুদ্ধি!
আরাধ্য নিজের শার্টের কলার নিজে টেনেই বলল “ইয়েস বেবি আম সো ইন্টেলিজেন্ট”

স্নিগ্ধা এসে দরজায় নক করলো।
স্নিগ্ধা : ডিস্টার্ব করলাম?
আরাধ্য হেসে বললো,
-আরে শালিকা! সবসময় ডিস্টার্ব করার পরেই এই প্রশ্নটা করো কেন?
-জাস্ট এ ফরমালিটি ভাইয়া।
-অবশ্য তুমিও তো ভালই। শালি তো আধি ঘারবালি ই হয়।
-তো ঘারবালির জন্য গিফট কই?
-গিফট?
-তোমরা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করে আসলে আর আমাকে গিফট দিবে না?
-শুধু কি কোয়ালিটি টাইম, তোমার বোন তো ছেলেমেয়ের প্ল্যানিংও করে এসেছে।
-কি বলো ভাইয়া!
-হ্যা, সত্যি। তোমার বোনকেই জিজ্ঞেস কর।
স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্পর্শিয়ার দিকে তাকালো।
স্পর্শিয়া: না, না। এমন কিছু না।
আরাধ্য : সত্যিই এমন কিছু না?
স্পর্শিয়া: ইয়ে মানে, বলেছি। কিন্তু সেটা তো প্ল্যানিং ছিল না। আমি তো শুধু…
স্নিগ্ধা : তোকে তো যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক ফাস্ট তুই। ছেলেমেয়ের প্ল্যানিং! ভাবা যায় এগুলা!
স্পর্শিয়া: যাহ উলটা পালটা বুঝছিস।
স্নিগ্ধা: হুমমমমম… এসব চলে তবে। তুই তো…
স্নিগ্ধার হুশ ই ছিল না খুশিতে যে ও আরাধ্যর সামনে এসব বলছে। মনে পড়তেই কথা ঘুরিয়ে ফেললো।

স্নিগ্ধা : দেখো, তোমাদের পাল্লায় পড়ে উপরে কেন এসেছিলাম তাই ভুলে গিয়েছি। ভাইয়া আম্মু আমাকে পাঠিয়েছিল তোমাকে নিচে যেতে বলার জন্য। আব্বু, কাক্কুরা সবাই চলে এসেছে।
স্পর্শিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল শুনে। চোখমুখ বাকা করে বলল,
– এত জলদি কেন?

আরাধ্য আর স্নিগ্ধা দুজনেই অবাক করা দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকালো। স্পর্শিয়া হতভম্ব হয়ে বলল,
-না, মানে.. এত জলদি তো আসে না তারা।
স্নিগ্ধা বললো,
-ছোট চাচী ফোন দিয়ে বলেছিল আরাধ্য ভাইয়া এসেছে বাসায়। তাই চলে এসেছে।

স্পর্শিয়া মনে মনে ওর চাচীকে বকতে লাগলো।
আরাধ্য খুব ভাল মতই বুঝতে পারলো যে স্পর্শিয়ার মন খারাপ হয়ে আছে। ওর প্রেমে পড়ার গল্প শুনার এত ইন্টারেস্ট থাকবে স্পর্শিয়ার ওর ধারনাও ছিল না এটা।

আরাধ্যকে নিয়ে স্নিগ্ধা নিচে চলে গেল। আর স্পর্শিয়া মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো খাটে। কাহিনী শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওর মাথা ঠাণ্ডা হবে নাহ। কি করা যায় ভাবতে লাগলো।

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here