বিরহ শ্রাবণ ২ পর্ব – ৩৩

#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_সারা মেহেক

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এহেন কথায় আমি বিমূঢ় দৃষ্টিতে উনার দিকে চেয়ে রইলাম। এতোদিন পর আজ উনি আমাকে এভাবে দোষারোপ করবে তা কখনো চিন্তা করিনি।
আমি শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
” তাহলে এসবের জন্য আপনি আমাকে দোষারোপ করছেন? আপনার আর অভ্র ভাইয়ের কোনো দোষ নেই এতে? সম্পূর্ণ দোষ আমার?”

প্রোজ্জ্বল ভাই আর কথা বললেন না। উনার সে ঔদ্ধত্যপূর্ণ চাহনি, ভাব মুহূর্তেই বদলে গেলো। স্থির হয়ে চেয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি কয়েক সেকেন্ড উনার দিকে চেয়ে কণ্ঠ চড়াও করে বললাম,
” কে বলেছিলো আপনাকে বিয়ে করতে প্রোজ্জ্বল ভাই? কে বলেছিলো? এতোই যখন বন্ধুত্ব নিয়ে চিন্তায় ছিলেন, কেনো বিয়ে করলেন আমাকে? আমি তো কখনো জোর করিনি আপনাকে। বিয়ের দিন এমনকি বিয়ের পরেও বলেছিলাম আমাকে ডিভোর্স দিন। কিন্তু আপনি দেননি ডিভোর্স। তাহলে আজ দু মাস পর এসে আমাকে এসব কথা শোনাচ্ছেন কেনো?”
কথাগুলো বলতে গিয়ে অনুভব করলাম আমার গলা ধরে আসছে। কণ্ঠনালীতে শক্ত কিছু আটকে আছে যেনো। কথা বলতে পারছি না ভালোভাবে৷

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের চেহারা এবার বিভ্রান্ত দেখালো। কিছুক্ষণ পূর্বের সে কঠোর ভাব এখন একেবারে নমনীয় পর্যায়ে চলে এলো। উনি কিছুটা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মুহূর্তেই চেহারায় অসহায় ভাব ফুটিয়ে বললেন,
” চন্দ্রি- চন্দ্রিমা, আমি আসলে, এমন কিছু বলতে চাইনি। মেজাজ…… ”

এতোক্ষণে বোধহয় উনার হুঁশ ফিরে এলো। অনুশোচনা বোধ করছেন হয়তো। কিন্তু এখন এ অনুশোচনা বোধ করে কি লাভ হবে! উনি যে উনার কথার বাণে আমাকে ভীষণভাবে আঘাত করে ফেলেছেন। এখন এ আঘাতের ক্ষত কি উনার অসহায়ত্বের কথা শুনে শুকিয়ে যাবে! মোটেও না। উনি যেভাবেই হোক, উনার মনের সুপ্ত রাগ, সুপ্ত কথা বলে ফেলেছেন।
আমি বললাম,
” বলতে চাননি কিন্তু বলে ফেলেছেন। স্বীকার করে নিন, আপনার মনে এটাই ছিলো। আপনি যে আমায় এখনও সেদিনের দোষী ভাবেন তা বুঝতে দেরি নেই আমার। আমি জানি না, বিয়ের দু মাসের মধ্যেই যেখানে আপনি এমন করেছেন সেখানে বাকিটা জীবন আপনি আমায় কতবার দোষারোপ করবেন, তাই ভাবছি। ”
এ বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে উনার মুখপানে চাইলাম৷ উনি আমার এরূপ কথা শুনে আচমকা আমার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলেন। বিবশ গলায় বললেন,
” চন্দ্রিমা, আমাকে মাফ করে দে প্লিজ। আমি ইচ্ছে করে এমনটা বলিনি। আজ অভ্রর সাথে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো বিধায় আমার মেজাজ গরম হয়েছিলো। এজন্য ভাবনাচিন্তা বিহীন তোকে ওসব বলে দিয়েছি৷ ”

আমি প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কঠোর গলায় বললাম,
” মানুষ রাগের মাথায় যা বলে আসলে সেটাই তার মনে থাকে। জানেন তো এটা?”

প্রোজ্জ্বল ভাই বিরক্ত মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,
” এসব ফা’উ’ল কথা কে বলেছে তোকে? এতোদিনে কি তোর এমন কিছু মনে হয়েছে যে আমি তোকে দোষ দেই সবসময়? ”

” এতোদিন মনে হয়নি। কিন্তু আজ মনে হয়েছে। আর মনে হওয়ার কি আছে। আপনি নিজ মুখেই তো বলেছেন। কি দরকার ছিলো প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে বিয়ে করার! আমি শুধু শুধু আপনার জীবনটা নষ্ট করলাম তাই না? সবচেয়ে ভালো হতো, সেদিন যদি আমি পালিয়ে যেতাম৷ আমার মতো আপদ বিপদ আপনার ঘাড়ে এসে জুটতো না। ”
এ বলতে বলতেই আমি অনুভব করলাম আমার দু চোখজোড়া সিক্ত হয়ে আসছে। সামনের সবকিছুই ঝাপসা দেখছি।
আমি দেরি না করে দ্রুত দু হাত দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিলাম। নিজেকে শক্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে আবারও বললাম,
” আপনি এক কাজ করুন প্রোজ্জ্বল ভাই, চন্দ্রিমা নামক এই আপদকে যেভাবে পারুন আর যত দ্রুত পারুন বিদায় করুন৷ আমি এভাবে সারাজীবন কাটাতে পারবো না। আজ যেমন হুট করে বলেছেন এসব, নিশ্চয়ই ভবিষ্যতেও এমন আরো দিন আসবে। আমি সেসব সহ্য……..”
আমার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই প্রোজ্জ্বল ভাই আচমকা একটি কাজ করে বসলেন। আমায় অবাক করে দিয়ে উনি হঠাৎ আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আর আলতোভাবে নয়, একদম জাপটে জড়িয়ে ধরলেন। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবো আমি৷ উনার আকস্মিক কাজে বিস্ময়ে আমার কান্না বন্ধ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, উনি কি বাস্তবেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন নাকি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছি আমি!

প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরেই অস্থির কণ্ঠে বললেন,
” আমি তোকে কখনো ছাড়তে পারবো না চন্দ্রিমা কখনো না। তুই চাইলেও আমি তোকে ছাড়বো না। তোকে সারাজীবন এভাবে নিজের কাছে রাখবো। সে তুই যতই আপত্তি দেখাস না কেনো।
আর তুই আমার জন্য আপদ না চন্দ্রিমা। তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। তুই আমার জীবনে পাওয়া সেরা অমূল্য উপহার। ”
এই বলেই উনি আমার মাথায় চুমু দিলেন।
বিস্মিত আমি আরেকদফা বিস্মিত হলাম। এবার রীতিমতো আমার চক্ষুজোড়া বৃহদাকার ধারণ করলো। অদ্ভুত অজানা অনুভূতিতে আমি পুরোপুরি বাকহারা হয়ে পড়লাম।

প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে ছাড়লেন না। বরং পূর্বের ন্যায় বললেন,
” অনেকদিন থেকেই আমি মনে মনে প্ল্যান করছিলাম কালচারাল প্রোগ্রামে আমি ইনডিরেক্টলি তোকে আমার মনের কথা বলে দিবো। আজ আমি সেটারই পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু অভ্র এসে সবটা বিগড়ে দিলো। ও যখন গান গাইছিলো আমি পুরোটা সময় ওকে লক্ষ্য করেছি। ও তোর দিকেই তাকিয়ে ছিলো৷ ওর ঐ চাহনি আমার সহ্য হয়নি। কিন্তু তারপরও নিজেকে শান্ত রেখে আমি গানটা গেয়েছিলাম। এরপর স্টেজ থেকে নেমে আমি ওকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ও একদম অবুঝের মতো কথা বলে। আমাকে বলে, ও অন্য কোনো অর্থ মনে নিয়ে ঐ গান গায়নি। ওর মনে তোর জন্য কোনো অনুভূতি নেই। কিন্তু আমি তো চিনি ওকে। ওর চাহনি, চেহারা দেখেই আমি বলে দিতে পারবো, ওর মনে এখনও তোকে নিয়ে অনুভূতি আছে। কিন্তু এখন আমি এসব সহ্য করতে পারবো না। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যেভাবেই হোক, তুই আমার হয়েছিস। তোকে সারাজীবনের জন্য আমি নিজের করে নিয়েছি। এখন এ মুহূর্তে এসে আমি তোর প্রতি অভ্রের অনুভূতি প্রকাশ কি করে সহ্য করবো। বল।”

এই বলে প্রোজ্জ্বল ভাই আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার সোজাসুজি দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোনে মৃদু মুচকি হাসি এনে প্রগাঢ় গলায় বললেন,
” আমি এখন তোকে কারোর পাশে সহ্য করতে পারি না চন্দ্রিমা। তোর কষ্ট দেখলে আমার কষ্ট হয়। তোর হাসি দেখলে আমি খুশি হই। আর তোর সেই মিষ্টি হাসির কারণ যদি আমি হই তাহলে বাঁধভাঙা এক খুশির জোয়ার বয়ে যায় আমার মাঝে। ”
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের মুখ নিঃসৃত প্রতিটি বাক্য আমার কানে ঝংকার তুললো। সাজানো অনুভূতি আবেগকে মুহূর্তেই অগোছালো করে দিলো। ভেতরের সবকিছু উথাল-পাতাল করে দিলো। আমাকে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণ হতে মুক্ত করে দেওয়ার জন্যই বোধহয় উনি আমায় পুনরায় স্পর্শ করলেন। নিজের বলিষ্ঠ দু হাত দিয়ে আলতোভাবে আমার দু গাল ধরে প্রগাঢ় অতলস্পর্শী কণ্ঠে বললেন,
” তুই আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি চন্দ্রিমা। তুই আমার জন্য কখনো আপদ ছিলি না। বরং তুই আমার জন্য অমায়িক এক আশীর্বাদ। আমার দীর্ঘস্থায়ী, অজানা এক অনুভূতি ছিলি তুই। যা উপলব্ধি করতে আমার সময় লেগেছিলো অনেক। কিন্তু আমি সেই অনুভূতি উপলব্ধি করতে পেরেছি। উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমি তোকে ভালোবাসি। অশেষ ভালোবাসি তোকে। ভালোবাসি চন্দ্রিমা তোকে।”
এই বলে আমার কপালে গাঢ় ঠোঁটের স্পর্শ দিলেন উনি। অকল্পনীয়ভাবে উনার এ স্পর্শ পেয়ে আমি তৎক্ষনাৎ অসার হয়ে গেলাম। হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক হয়ে এলো। অনুভব করতে পারলাম না আমার আপন হৃৎস্পন্দন। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য।
প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এ স্বীকারোক্তি আমায় আপাদমস্তক অবশ করে দিলো। বারংবার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উনার অনুভূতি শোনার পরও আমি শেষোক্ত দুটি কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। মনে হচ্ছে, এখনও গভীর কোনো দিবাস্বপ্নে আচ্ছন্ন আমি, যে স্বপ্ন পরবর্তী নিঃশ্বাসেই অতলে তলিয়ে যাবে।
®সারা মেহেক

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here