বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ৩২+৩৩

পর্ব ৩২+৩৩
#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ৩২

ইনায়ার বাবার কথাগুলো শুনে রুহান প্রচণ্ড রেগে গেলো কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও বললো না। একি ভুল ও দ্বিতীয়বার করতে চায়না তাছাড়া রোয়েন শুধুমাত্র এখন ওর ওয়াইফের বাবা নয় বরং ওর ফুফাও তাই তার সাথে সম্মানের সাথে কথা বলা উচিৎ। আর একটা জিনিস ও সবসময় বিশ্বাস করে

‘যে জিনিস তোমার খুব প্রয়োজন কিন্তু ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব নয় তার জন্য হয় আশা ছেড়ে দাও নয়তো মাথা ঝুকাও’

আর ওর যা চাই তা কোন জিনিস নয় বরং ওর ভালোবাসার মানুষ ওর স্ত্রী। এমন নয় যে ও ছিনিয়ে নিতে পারবে না কিন্তু তাতে অনেকগুলো মানুষকে কষ্ট দেয়া হবে যারা নিজেরই লোক আর অন্যকে কষ্ট দিয়ে সুখি হওয়া যায়না। তাই ও যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে কথা বলার চেষ্টা করলো কারণ ইনায়ার বাবাকে কনভিন্স করা মানে ইনায়াকে কনভিন্স করা। তাই ও কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে ইনানকে নরম স্বরে বললো

“ফুফা আপনি তো জানেন আমরা দুজন দুজনকে পছন্দ করি তাহলে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া কি ঠিক হচ্ছে?”

রুহানের কথা শুনে ইনান মুখ ফিরিয়ে নিলো তারপর কঠিন স্বরে বললো,

“আমি তোমার সাথে এখানে কথা বলতে আসিনি, আমি আমার বেস্টফ্রেন্ড এবং সামুর ভাইকে আমার মেয়ের বিয়ের খবর দিতে এসেছি। আশাকরি তুমি আসবে না আর না কোন সিনক্রিয়েট করবে”

ইনানের কঠিন জবাব শুনে রুহান আরো কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু সায়ান হাতের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললো তাই রুহান কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, কারণ এই মুহুর্তে ওর সকল প্রশ্নের জট শুধু একজনের কাছে গেলে ছুটবে আর তা হচ্ছে ইনায়া।ও বিড়বিড় করতে করতে কারের কি নিয়ে বেরিয়ে গেলো,,

“ইনু জাস্ট প্রে আমি যা শুনছি তা মিথ্যে, নাহয় আমি কি করবো আমি নিজেও জানিনা। তুমি শুধু আমার সেটা জানার পরেও তুমি অন্যকারো হতে চাও!নট ফেয়ার, আমি আমার যে রুপ তোমায় কোনদিন দেখাতে চাইনি তা দেখাতে বাধ্য করোনা”

রুহান বেরিয়ে যেতেই সায়ান ইনানের দিকে তাকিয়ে ওর মুড দেখার চেষ্টা করলো, তারপর ইনানকে প্রশ্ন করলো

“এমনটা করা কি খুব জরুরি ইনান?আমি জানি তুই রুহানকে পছন্দ করিস না কিন্তু তাই বলে নিজের মেয়ের খুশিও দেখবি না?”

“আমার মেয়ের কোনটাতে ভালো আর কোনটাতে খারাপ আমি ভালো বুঝি সায়ান। আমি শুধু তোকে জানাতে এসেছি যে আমার মেয়ের বিয়ে শুক্রবারে আর তোর ছেলে যাতে এইবার কোন তামাশা না করে”

“তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে না ইনান? আমি ওর ভালো চাইনা?”

সায়ানের পাল্টা প্রশ্নে ইনান কিছুটা দমে গেলো তারপর কিছু একটা ভেবে বললো

“আমি জানি তুই আমার মেয়ের ভালো চাস কিন্তু নিজের ছেলের ভালোই তো বেশি চাইবি তুই তাইনা? যাইহোক আমি ওসব নিয়ে কথা বলতে চাইনা”

“আমার ছেলে, তোর মেয়ে এসব কি শুরু করেছিস ইনান?আমি সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ওদের আলাদা চোখে দেখেছি?”

“দেখার প্রয়োজন পড়েনি তাই দেখিস নি কিন্তু এখন বিষয়টি তোর ছেলেকে নিয়ে আর তুই তোর ছেলের স্বার্থ…”

“আমার ছেলেকে নিয়ে এতো সমস্যা কেনো তোর?”

“কারণ ও মাফিয়া আর আমি মাফিয়াদের ঘৃণা করি। তাদের জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি”

“তাহলে আমার ছেলে মাফিয়া আর এটাই তোর সমস্যা তাইতো? যদি ও এই পথ থেকে ফিরে আসে তাহলে তুই ওদের সম্পর্ক মেনে নিবি?”

“নাহ কারণ তুইও ওই পথ থেকে ফিরে এসেছিলি কিন্তু কোন লাভ হয়েছে কি?তোর শত্রুরা তোকে সারাজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আর শেষ পর্যন্ত অলমোস্ট তুই তোর ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছিস হয়তো ভাগ্যের জোরে আবার ফিরে পেয়েছিস। তোর সাথে রুশি ভাবির সম্পর্ক সেই একটা কারণে একুশটা বছর অস্বাভাবিক ছিলো। তাই তোর ছেলে ফিরে আসলেও সে শান্তিতে থাকতে পারবে না, না আসলেও পারবে না। আর সে শান্তিতে থাকতে না পারা মানে আমার মেয়েও অশান্তিতে থাকা। আর বাবা হিসেবে মেয়ের সুখের জন্য স্বার্থপর হওয়াটাকি খুব বেশি অন্যায়?”

সায়ান কিছুক্ষণ চুপ থাকলো, ইনান যা বলছে তা একদণ্ডও মিথ্যে নয় তবে সবসময় স্বার্থপর হওয়া যায়না। তাছাড়া যার সাথে বিয়ে দিতে চাইছে!তারপর কিছু একটা ভেবে বললো

“তুই যখন সামুকে বিয়ে করতে চেয়েছিলি তখন তোর অনেক কিছুই অপছন্দ ছিলো আমার সাথে তোর না বুঝে করা ভুল। আমার ছেলেকে হারানোর পেছনে তোর মিসআন্ডার্স্টেন্ডিং ও দায়ি ছিলো, শত্রুপক্ষ এতোসহজে টার্গেট করতে পারতো না আমায় যদি তুই অজান্তেই তাদের সাহায্য না করতি। কিন্তু সামুর বিয়ের সময় আমি কিন্তু স্বার্থপর হইনি বরং তোদের ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাই তোরও ওদের অনুভুতি বোঝা উচিৎ”

“আমি ওকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিনা, আর এসব আবেগ বিয়ের পর কেটে যাবে। আমার মেয়ের এখনো ভালোবাসা বোঝার বয়স হয়নি তাই এসব আবেগকে আমি প্রাধান্য দিতে চাইনা”

“কোনটা আবেগ আর কোনটা ভালোবাসা সেটা নিশ্চই এই বয়সে তোকে শিখাতে হবে না, ওরা এখন যথেষ্ট এডাল্ট তাই…যাইহোক আমি এতোক্ষন একজন নিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে কথা বললেও এরপর কিন্তু আমার ছেলেরটা বুঝতে বাধ্য হবো তাই ওদের বুঝার চেষ্টা কর।বাবা হিসেবে নিজের মেয়েকে এভাবে শাস্তি দিস না। ইনুকে এমন পরিস্থিতে যেখানে ওকে রুহান বা তোর মধ্যে যেকোন একজনকে চুজ করতে হয় কারণ এই বোঝা সহ্য করার বয়স ওর হয়নি। কারণ ও তোকে হয়তো চুজ করবে কিন্তু মনে রাখিস যেই সম্মান ও তোকে আজ করে তা হয়তো আর কোনদিন করতে পারবে না আর না ক্ষমা করতে পারবে”

ইনান কিছুনা বলে উঠে দাঁড়ালো, ওর হয়তো এরপর আর কিছু বলার নেই তবে নিজের সিদ্ধান্তে সে অটল তা সায়ান ওর চাহনি দেখেই বুঝলো। বিচার যেমনই হোকনা কেনো তালগাছটা ওর চাই এমন একটা ভাব নিয়ে ও সায়ানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ইনানের হঠাৎ এই কঠিন রুপ কেনো যেনো মেনে নিতে পারছেনা সায়ান যে সবার পুর্বে অন্যের কথা ভাবে সে হঠাৎ স্বার্থপর কি করে হয়ে গেলো!এই ইনানকে ও চেনে না, বড্ড অচেনা লাগছে ওকে সাথে কিছুটা খটকাও। আজকাল সবকিছুতে সন্দেহ করা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে হয়তো। প্রথমে জেইন শেখকে নিয়ে সন্দেহ হলো কিন্তু ইনভেস্টিগেশন করে কিছুই পায়নি আর এখন সামুর পুরোটা সময় জুড়ে চুপ করে থাকাও সন্দেহ লাগছে। সায়ান একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, তখনি কেউ কাঁধে হাত রাখলো। পাশ ফিরে দেখে রুশি চিন্তিত ভংগিতে তাকিয়ে আছে,,

“এখন কি করবে?”

“আগে রুহান ফিরে আসুক তারপর ওর সাথে কথা বলে দেখি কি করা যায়। এই কয়দিন ধরে মনে হচ্ছিলো ও কিছু বলতে চায় কিন্তু জড়তার কারণে বলতে পারেনি। বুঝলে তোমার ছেলে শরীরেই বড় হয়েছে কিন্তু সেই ছোটবেলায় খেলনার কথা যেমন বলতে পারেনি এখন গার্লফ্রেন্ডের কথাও বলতে পারছেনা। হাউ রিডিকিউলাস! মানে আমি তোমাকে আমার কাছে রাখার জন্য চুক্তি পর্যন্ত বানিয়েছিলাম কিন্তু এ দেখো কিছুনা বলেই চলে গেলো। এ আমার ছেলে!”

বলেই পাশে তাকাতেই দেখে রুশি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, নিজের প্রশংসা করতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলো কার সামনে করছে। এভাবে বাশ খাবে ভাবতে পারেনি, রুশি দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“আর যাইহোক আমার ছেলে তোমার থেকে ভালো আছে, কথায় কথায় থ্রেড দেয়না। আর এই তুমি কি সন্দেহ করছো যে ও তোমার ছেলে কিনা?”

“নাহ নাহ আসতাগফিরুল্লাহ সন্দেহ করবো কেনো। আমি বলেছিলাম আমার কোন গুন পায়নি আরকি”

“ভাগ্যিস তোমার মতো হয়নি, আমিতো ভয়ে ছিলাম যে চেহারার সাথে সাথে স্বভাবও না তোমার পায়। আমার ছেলে আমার স্বভাব পেয়েছে হুহ”

“তো আমার মেয়েও আমার স্বভাব পেয়েছে তাতে কি!”

“সেটা নিয়েই তো জালায় আছি, বাব বেটি মিলে আমার জীবল হযবরল করে দিচ্ছো”

বলেই রুশি সায়ানকে কয়েকদফা শাশিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো আর সায়ান হেসে উঠলো,,

“বয়স হলেও স্বভাব বদলায়নি মহারাণির, ভালোই ক্ষেপেছে মনে হচ্ছে।সায়ান লেগে যা মিশন বউয়ের রাগ ভাঙানোতে। এই বয়সেও কত পরিশ্রম করতে হচ্ছে আমার। এখন ওনার পছন্দের ফুল খুজে বের করে তারপর ওনাকে দিতে হবে। তবে যদি মহারাণির রাগ কমে!”

🌸🌸🌸

বদ্ধরুমে কেউ একজন বসে রেড ওয়াইন একের পর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে আর আশে পাশে গভীর দৃষ্টিতে কিছু দেখছে। পুরো রুমের দেয়াল জুড়ে একটা মেয়ের ছবি,খুব সুন্দর ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা বা কোনটিতে ইউনিভার্সিটির ইউনিফর্ম পরা। হাল্কা সাজেও জেনো অপরুপা লাগছে, সেই মুগ্ধ করা হাসি আর মায়াবী চোখ। কোন কিছুর থেকেই যেনো চোখ ফিরানো দায়, মনে ওই চোখের দিকে হাজারো বছর চেয়ে থাকলেও তৃষ্ণা মিটবে না। নেশা ধরেছে বড্ড নেশা, তাকে একটু পাওয়ার একটু ছুয়ে দেখার কিন্তু পারছেনা তাই রাগ যেনো উপচে পড়ছে তার চোখ থেকে। হাতে থাকা গ্লাস ফ্লোরে ছুড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বাজা গান যেনো সেই রাগকে ঘৃণায় পরিণত করছে

“নিকুশ আধার আর চারে পাশে
তুমি নেই বলে কাছে
ভাষাহীন ভালবাসা
কুয়াশায় ঢেকে আছে

মেঘে পোড়া রোদ আর রোদে ভেজা মেঘ
ছুয়ে ছুয়ে যায় আজও আমার আবেগ

আমি আছি শেষের পথে
তুমি সূচনায়
স্মৃতি এসে এক করে দেয়
তোমায় আমায়”

#পর্বঃ৩৩

রুহান বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনে থাকা বিস্তর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখছে, চারদিকে নিশ্চুপতা ছেয়ে আছে। ফাল্গুনের দিন শুরু হয়েছে মাত্র কয়েকদিন তাই শীতের রেশটা এখনো যায়নি। বেলা প্রায় একটার কাছাকাছি হলেও সুর্যের তেমন একটা দেখা মিলছে না, আকাশ জুড়ে মেঘের ভেলা ভাসছে। খুব সুন্দর দৃশ্যে ছেয়ে আছে চারপাশ তবুও প্রকৃতির এই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারছে না ও। মনে হচ্ছে হৃদয়ের মাঝে ভারী কোন পাথর চেপে আছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

নিজেকে আজ পুরুষ ভাবতে লজ্জা হচ্ছে, কি করে পারলো এমন জঘন্য একটা কাজ রাগের মাথায় করে ফেলতে!
শক্ত হাতে বারান্দার গ্রিল চেপে ধরলো ও, শার্টের বাটন খোলা থাকায় বাতাসের বেগে উদরের এবস গুলো দৃশ্যমান হচ্ছে সাথে ঘাড়ে থাকা নখের দাগও যাতে রক্ত জমাট বেধে আছে। দাঁতে দাঁড় চেপে পকেট থেকে সিগারেট বের করলো, স্মোকিং করার খুব একটা অভ্যস নেই ওর তবে মন খুব খারাপ থাকলে একটা বা দুইটা টানার অভ্যস আছে।
আর আজ মন শুধু খারাপ নয় প্রচণ্ড খারাপ,বাইরে বয়ে যাওয়া বাতাসের ন্যায় মনের মাঝে মন খারাপের ঝড় বইছে। ইনায়া ওকে ক্ষমা করতে পারবে কিনা ওর জানা নেই তবে ও নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।

বারান্দার জানালা দিয়ে ঘরে একবার উঁকি দিলো, ইনায়া সেই পুর্বের ন্যায় ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে সুয়ে আছে। ব্লাংকেটটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আর ফুঁফিয়ে কান্নার মৃদু আওয়াজ এখনো কানে আসছে। যাতে নিজের প্রতি ঘৃণাটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। এমনটা হয়তো না করলেও পারতো কিন্তু ও করতে বাধ্য হয়েছে। ইনায়ার কথাগুলো এখনো শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়,রুহান সকালের কথা ভাবছে।

যখন জগিং থেকে ফিরে ইনায়ার বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো, আর ইনায়ার বিয়ে…
ও সেখান থেকে সরাসরি ইনায়ার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে কার পার্ক করে নিজের ড্রেস চেঞ্জ করে নেয় আর সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে নেয়। ও জানে ইনায়া এখন বাসায় একা তাই সরাসরি সেখানে যায়, বাড়িতে থাকা গার্ডরা ঢুকতে দিতে না চাইলে রুহানের বডিগার্ডরা ম্যানেজ করে নেয়। ও সোজা ঘরে ঢুকে দেখে ইনায়া বেডে শুয়ে আছে তাই কিছুনা বলে ওকে টেনে তুলে বসায় আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকায় মুখটা কেমন শুকিয়ে আছে। ও কিছুনা বলে ওকে কোলে তুলে নেয় তারপর বাসা থেকে বের হয়ে যায় কিন্তু অদ্ভুতভাবে ইনায়া কোন রেসিস্ট করেনি বরং গাড়িতে বসানোর পর পুরোটা সময় চুপচাপ ছিলো। ও ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার তাকিয়েছে ইনায়ার দিকে কিন্তু ইনায়ার স্থির দৃষ্টি বাইরে থাকা দৃশ্যের উপর। হঠাৎ এই নিশ্চুপতা ওকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছিলো, কালকের সেই চঞ্চল মেয়েটি আজ আচমকা শ্রোতহীন পানির ন্যায় স্থির! এই ইনায়াকে ওর চেনা নেই, বড্ড অচেনা লাগছে যেন যা হচ্ছে তা জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে ও।

“কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব,
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব, সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে৷
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা,
চেনা লোককে দেখলাম অচেনার গাম্ভীর্যে”
(রবি ঠাকুর)

____________________

“স্যান্টা ক্রুজ” ক্যালিফোর্নিয়ার সি বিচ গুলোর মধ্যে একটি যা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি এখানের ওয়েদারও খুব ওয়ার্ম। তাই টুরিস্ট কিংবা গেস্টরা এইখানে আসতে বেশ পছন্দ করে, এখানে থাকা এমিউজমেন্ট পার্ক খুব আকর্ষণীয় আর সাশ্রয়ী।
গাড়ি এসে থামলো এক বিলাশ বহুল হোটেলের সামনে, ক্যালিফোর্নিয়ার দামি হোটেলগুলোর একটি এটি যার পাশেই স্যান্টা ক্রুজ সমুদ্র সৈকত।

রুহান গাড়ি থেকে নেমে পেসেঞ্জার সিটের দরজা খুললো তারপর আলতো করে ইনায়ার হাত ধরে ওকে বের করে আনলো, রিসেপশনিস্ট থেকে রুমের কি নিয়ে সোজা বুক করা রুমে চলে এলো। যতোটা রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলো তা পুরোপুরি পানি হয়ে গিয়েছে, এখন রাগের বদলে চিন্তা কাজ করছে ওর। ইনায়াকে খাটে বসিয়ে ও সামনে চেয়ার টেনে বসলো, এখন ওদের প্রপার্লি কথা বলা উচিৎ। অনেক্ষন পরও ইনায়ার সাড়া শব্দ না দেখে ও গম্ভীর দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকালো, সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মাথা নিচু করে বসে আছে। তাই নরম স্বরে ইনায়ার হাত চেপে ধরে বললো

“ইনু!”

কথাটা কানে যেতেই ইনায়ার চোখের জমে থাকা বাধ্য জলগুলো অবাধ্য হয়ে গড়িয়ে পড়লো, যেনো বহুপ্রয়াশ করেও আটকিয়ে রাখতে পারলো না। রুহান আলতো করে চোখের পানি মুছে থুতনি চেপে ধরে ইনায়ার মুখ উঁচু করে ধরলো যদিও ইনায়া পুর্বের ন্যায় নিচের দিকে তাকিয়ে নেই তবে চোখ বন্ধ করে আছে।

“তাকাও আমার দিকে, তুমি ঠিক আছো!”

রুহানের কন্ঠ শুনে ইনায়া আধোআধো চোখ খুলে তাকালো রুহানের দিকে, এই বাদামি চোখগুলোতে ছেয়ে আছে অনেক মায়া আর ভালোবাসা সাথে একটু চিন্তা। ইনায়া রুহান হাত হাল্কা করে সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে বললো

“হুম”

“তাহলে এমন করছো কেনো? আজকে ফুফা এসে এসব কি বলে গেলো! কিসব বিয়ের কথা বলছিলো, তুমি কালকে রাতে আমায় এ ব্যাপারে বলোনি কেনো?”

ইনায়া রুহানের দিকে তাকালো, কি করে বলবে ও যেখানে নিজেই আজ সকালে জানতে পেরেছে!কিন্তু এখন এসব বলে লাভ নেই যা বলতে এসেছে তা বলে ফেলতে হবে।

“এখন এসব বলে লাভ নেই তাই এসব না বলাই ভালো, আমি বলার প্রয়োজন বোধ করিনি তাই বলিনি।আমাদের এটাই শেষ দেখা তাই এই শেষ দেখা আমি তিক্ততার মাঝে শেষ করতে চাইনা। যেহেতু আপনি আমার মামাতো ভাই তাই আমাদের ভবিষ্যতে কাজিন হিসেবে আবারও দেখা হবে। তাই আমি চাই সম্পর্কটা ভালো থাকুক”

“কি আবল তাবল বকছো তুমি বলোতো?কি সব মামাতো ভাই, কাজিন! তুমি কি ভুলে গেছো যে তুমি আমার ওয়াইফ?”

কিছুটা চিল্লিয়ে কথাগুলো বললো রুহান, ও যতোই কন্ট্রোল করতে চাইছে কিন্তু ইনায়ার কথাগুলো সহ্য হচ্ছে না, ওকে বলার প্রয়োজনই বোধ করেনা ও! কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো

“তোমার উপর কি তোমার বাবা প্রেশার ক্রিয়েট করছে?তুমি সেই আগের মতো চাপে পড়ে রাজি হয়েছো?আমাকে বলো ইনু! দেখো এই সমস্যার সমাধান আমরা মিলে খুজে বের করবো, দরকার হয় আমি ফুফাকে রাজি করাবো কিন্তু তারজন্য আমাকে সময় দিতে হবে। তুমি বলেছিলে ওয়েট করবে আমার জন্য আর…”

শেষের কথাটায় একরাশ আকুতি দেখতে পেলো ইনায়া কিন্তু নাহ এই রুপে ও গলতে পারবে না। ওকে শক্ত হতে হবে।

“আমি আপনার মতো জঘন্য লোকের জন্য ওয়েট করতে চাইনা। আপনার সবচেয়ে দোষ হচ্ছে আপনি মাফিয়া যে মানুষ খেকো আর আমি ডাক্তার যে মানুষ বাচায় তাই আপনার সাথে আমার কোনদিন যায়না। আর তাছাড়া আমি আপনাকে আর ভালোবাসি না, এই কয়দিন শুধুমাত্র আমাকে জোর করে বিয়ে করার প্রতিশোধ নিয়েছি। এখন আমরা ইভেন, যে কষ্ট আমি পেয়েছি তা আপনিও পাবেন। আপনার জন্য এটাই ব্যাটার যে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিন”

রুহান চোয়াল শক্ত করে চোখ বন্ধ করে আছে, হয়তো নিজের রাগ কন্ট্রোল করার ট্রাই করছে, ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো

“কি বললে! আবার বলো শুনতে পাইনি”

“আমি বলেছি আমাকে ডিভোর্স দিতে, শুনতে পেয়েছেন নাকি আরো জোরে বলতে হবে। আমার বিয়ে আর তিনদিন পর তাই এই তিনদিনের মধ্যে ব্যাবস্থা করেন”

“একটা মানুষের তাই বলা উচিৎ যার ভার সে নিতে পারবে, তুমি যা বলেছো তার ভার তুমি নিতে পারবে তো? আর কি যেনো বলেছিলে… আমাকে কষ্ট দিবে! কিন্তু আমিতো একা কষ্ট পাবোনা বেবি সাথে তোমাকেও পেতে হবে। আফটার অল আমার বেটার হাফ তুমি!ডিভোর্স তো তোমাকে আমি মরে গেলেও দিবো না আর বাকি রইলো তোমার বিয়ে! যে আমার সে আমার আর যে শুধু আমার, আমার জিনিসে আমি অন্যকারো হস্তক্ষেপ কখনোই এলাউ করিনা সেটা যাই হোকনা কেনো ”

বলেই ইনায়ার অধর যুগল আবদ্ধ করে নিলো, তবে খুব রাফভাবে হয়তো নিজের ভেতরের ক্ষোভ গুলো মিটাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে মুচকি হেসে ইনায়ার কানে কাছে গিয়ে বললো

“ইউ আস্কড ফর ইট”

কিন্ত রুহানের মুখের হাসি বেশিক্ষণ টিকলো না, ইনায়া খুব জোরে রুহানের থাপ্পড় মারলো। রুহান যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইনায়া এতোটা রেগে যাবে ভাবতে পারেনি রুহান আর না প্রস্তুত ছিলো। ও ইনায়ার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে ওকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো, রাগে ওর চোখ লাল হয়ে আছে যাতে ইনায়া চিল্লিয়ে বলে উঠে

“সব কিছু জোর করে পাওয়া যায় না, আর ইনায়া চৌধুরী সস্তা না যে তাকে পাওয়া এতো ইজি। বেটার উই বেক অফ! এই বিয়ে আমি করবোই যেকোন মুল্যে”

“তুমি যেহেতু নিজের কথায় অটল থাকবে তাই আমিও তোমাকে নিজের কাছে রাখার জন্য সব করতে রাজি আছি। আর তাছাড়া তুমি ইনায়া চৌধুরী নও বরং মিসেস ইনায়া খান তাই তোমার উপর সম্পুর্ণ অধিকার কাছে আমার”

দরজায় নকের শব্দে রুহান বাস্তবতায় ফিরে আসলো, রুম সার্ভিসের একজন খাবার দিতে এসেছে। ও খাবার নিয়ে দরজা লক করে দিলো তারপর ইনায়ার দিকে তাকালো, ও জানে ও যা করেছে তা ঠিক নয় কিন্তু ওর কাছে আর কোন অবশন ছিলো না।ও যা করেছে তাতে ওর অধিকার রয়েছে কারণ ও হালাল সম্পর্কে রয়েছে আর মেয়েটি তার স্ত্রী কিন্তু হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। তবে যাকে ভালোবাসে তাকে বেঁধে রাখার আর কোন রাস্তা ও খুজে পায়নি…

#চলবে
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখিবেন আর লেট করে দেয়ার জন্য স্যরি😥)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here