বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ৩

#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্ব-৩

সকাল থেকে প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটছে ইনায়ার, যাকে বলা হয় নাকে মুখে দৌড়ানোর মতো অবস্থা। বারবার সবকিছুর দিকে নজর রাখতে হচ্ছে, ফুলগুলো ঠিকঠাক লাগানো হয়েছে কিনা! ডেকোরেশন কতদুর এগিয়েছে, সবকিছু নিট এন্ড ক্লিন আছে কিনা! আজকে ওদের ভার্সিটিতে প্রদর্শনী অনুষ্ঠান যা প্রতিবছর একবার হয় লন্ডনে আর যেকোন ভার্সিটির জুনিয়ার ফাস্ট এর স্টুডেন্টরা এরেঞ্জ করে। এতে বিভিন্ন নতুন বিখ্যাত জিনিস একত্র করা হয় এবং সেটা প্রদর্শন করা হয় পরিশেষে তা নিলামে উঠানো হয়।শহরের নাম করা ব্যক্তিবর্গ এতে উপস্থিত থাকে এবং নিলামে অংশগ্রহণ করে, প্রতিবারের মতো এবারো অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে পেইন্টিং, শহরের নামকরা পেইন্টারদের পেইন্টিং এখানে জড়ো করা হয় যার খেয়ালও ওকে রাখতে হচ্ছে।

আমাদের বাংলাদেশে চিত্রকরদের কদর ওতোটা নেই, চিত্র অংকন যে একটা পেশা সেটা এদেশের মানুষ মানতে নারাজ, যেহেতু কদর নেই তাই এর দ্বারা টাকা রোজগার ও তেমন হয়না, তাই যুব সমাজের মানুষ এর প্রতি খুব একটা আগ্রহী নয় আর হলেও বাবা মায়ের কাছে নিতান্তই তা সময় নষ্ট করা ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়না, তবে পশ্চিমা দেশের চিত্র সম্পুর্ণ ভিন্ন। এখানে ব্যাক্তি স্বাধীনতা যেমন বেশি তেমনি গুনি মানুষদের কদর করতে এরা জানে তাই এখানের চিত্রগুলো অনেক ক্ষেত্রে মিলিয়ন ডলারও বিক্রি হয়, কারণ তারা চিত্রগুলোকে শুধু রঙের খেলা ভাবে না বরং সেই চিত্রটির অর্থ খুজে বেড়ায়, ভাবার্থ খুজে বেড়ায় যেন চিত্রকরের মনের আকুতি বুঝার চেষ্টা করছে।
তাই এক একটা পেইন্টিং অনেক মুল্যবান। তাছাড়া আজকে আজকে লন্ডনের তরুণ পেইন্টার “রোয়েন লিউস ” স্বয়ং হাজির হচ্ছেন চিফ গেস্ট হিসেবে এইখানে। তরুণ চিত্রকর হিসেবে হয়তো এই প্রথম হয়তো কেউ এতো প্রসিদ্ধ বিশেষ করে মেয়েদের কাছে। তার চিত্র কেমন সেটা কেউ না জানলেও তার ফেস কতোটা সুন্দর এটা সবাই জানে,, সকাল থেকে মেয়েদের কথাবার্তা আর সাজগোছ দেখে তাই মনে হচ্ছে ওর। অথচ এই নাম জীবনের প্রথম শুনলো বলে মনে হচ্ছে ওর,,
এএকজনকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই এমনভাবে তাকালো যেন নাম না জেনে মহা ভুল করে ফেলেছে।
চেয়েছিলো একবার নেটে সার্চ দিয়ে দেখবে এই সুদর্শন পুরুষকে কিন্তু ব্যাস্ততার কারণে হয়ে উঠেনি যাইহোক সামনাসামনি তো দেখেই নিবে।

চিফ গেস্টের জন্য আলাদা রুম ঠিক করা হয়েছে, সেই রুমেই তদারকি করেছিলো ইনায়া তখনি ওদের ক্লাস টিচার এসে বললো

“ইনা অল সেট?এই গেস্ট আমাদের জন্য অনেক ইম্পর্টেন্ট তাই সবকিছু পার্ফেক্ট হওয়া চাই ”

“জী স্যার অল সেট, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখছি ”

“তুমি আছো বিদায় ভরসা পাচ্ছি,মনে রেখো ভার্সিটির সম্মান কিন্তু তোমার হাতে ”

“বুঝতে পেরেছি স্যার ”

ইনায়া সবকিছু গুছাচ্ছিলো তখনি দেখে চিফ গেস্টের যে চেয়ারে বসার কথা সেটার ঠিক বরাবর একটা টিকটিকি আছে, আর টিকটিকির অভ্যাস বড্ড খারাপ যেকোন সময় হুট করে গায়ে টপকে পড়তে পারে তাই এটা সরিয়ে দেয়াই ভালো নাহয় হুট করে মি.লিউসের কোলে পড়ে গেলে?তখন তো নাক কান সব কাটা যাবে তারপর লোকটি নাকি সুন্দর! টিকটিকি নিজেও তো চাইবে তার কোলে পড়ে যেতে বলা তো জায়না!

অনেক কিছু মারার পরও যখন ওই টিকটিকে একচুল ও নড়াতে পারলো তখন সিদ্ধান্ত নিলো এটাকে নিজের হাতে সরাবে। অবশ্য নড়ার কথাও না কারণ একটা কিছুও টিকটিকি অবদি পৌছেই নি। তাই চেয়ারের উপর টুল দিয়ে দাঁড়িয়ে টিকটিকি টাকে খপ করে ধরে বিশ্ব জয়ের হাসি দিলো ও, সকল মেয়ে আরশোলা আর টিকটিকি ভয় পেলেও ওর এগুলো একদম ভয় লাগে না বরং ছোট থেকেই এগুলো দিয়ে অন্য কাউকে ভয় দেখিয়ে এসেছে ও, কথাগুলো ভাবতেই হাসি পেলো ওর, সায়রাকে কতো নাকানিচোবানি খাইয়েছে ও তার হিসাব নেই!

যেই নিচে নামতে যাবে তখনি দরজাটা খুলে গেলো, আর প্রিন্সিপাল ওনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, আচমকা ঘটনায় ও বেলেন্স হারিয়ে ফেললো আর ঠাস করে নিচে পড়ে গেলো। পায়ে হালকা ব্যথা পেলো ও, তাই পায়ে হালকা ঘষে উঠে দাঁড়াবে তখনি কেউ চিৎকার করে উঠলো আর দেখলো একটা ছেলের নাক বরাবর ওই টিকটিকি বসে আছে আর ওই ছেলেই চিৎকার দিয়েছে। ও তাড়াতাড়ি এসে টিকটিকিটাকে সরিয়ে ফেললো আর ডাস্টবিনে ফেলে দিলো,, বাকি সবাই এখনো আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু এর মতো। ছেলেটি যেন এখনো শক হয়ে তাকিয়ে আছে,,
কিছুক্ষণ পর গলা ঝেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আর সাথে থাকা লোকজন ও। এতোক্ষন হাসি আটকে রাখলেও এখন আর পারেনি ও। হু হা করে হেসে দিলো, কোন ছেলে টিকটিকিকে ভয় পায় তা আজ প্রথম দেখলো। তারপর রুমের সবকিছু ঠিকঠাক করে বেরিয়ে এলো,,

“স্যার পানি খাবেন? ” বলেই পানি এগিয়ে দিলো একজন বডিগার্ড আর ছেলেটি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো,, ফেস দেখে বুঝাই যাচ্ছে এমন ভয় কোনদিন পায়নি ও।

“বেশি ভয় পেয়েছেন স্যার?”
“শাট আপ এন্ড গিয়ে দেখো সব ঠিক আছে কিনা, রোয়েন যেখনো পৌঁছাবে এখানে।আসার আগে সব পার্ফেক্ট দেখতে চাই ”

বডিগার্ড যেতে কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিলো আরাভ, ভয়ে হৃদপিন্ড এখনো লাভডাভ শব্দ করে যাচ্ছে মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ থাকলে হার্ট এটাক করতো, জীবনে বড় বড় অস্ত্রের সম্মুখীন হয়েও এতো ভয় পায়না যতটা এই টিকটিকি দেখে পায়ও। ছোট থেকেই টিকটিকি আর ওর সাথে সাপেনেউলে সম্পর্ক, এই নিয়ে বন্ধুমহলে অনেক হাসিঠাট্টার সম্মুখীন হয়েছে। তবে যেটা বাকি ছিলো সেটাও হয়ে গেছে, একটা মেয়ের সামনে কিনা ও ওর ভয় প্রকাশ করেছে। ছিহ! মেয়েটা ওকে কাপুরুষ ছাড়া অন্যকিছু ভাবছে না হয়তো। শুধুমাত্র রুহানের জন্য ওর এই অবস্থা! রুহানের বেস্ট ফেন্ড ও, সেই ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে দুজন, ক্লাস ওয়ানে দেখা হয় ওর সাথে খুব গম্ভীর ছিলো ও। যেখানে সব বাচ্চা খেলাধুলা করতো সেখানে ও বসে বসে ছবি আকতো। প্রথমে ওর সাথে কথাই বলতে চায়নি কিন্তু পরে ধীরেধীরে বন্ধুত্ব হয়ে যায় আর সেই থেকে দুজন একসাথে। রুহানের আসল নাম ও ছাড়া আর কেউ জানেনা। রুহান লাইফে অনেক সাকসেসফুল হলেও সম্পুর্ণ বিপরীত হচ্ছে ও, গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে বাবার টাকায় চলছে যা নিয়ে রোজ কথা শুনে আর রাগ করে প্রায় রুহানের কাছে চলে আসে আর রুহান সাদরে গ্রহণ করে,, ওকে বাহির থেকে যতোটা কঠোর মনে হয়, ভিতর থেকে ঠিক ততটাই নরম কিন্তু কঠোরতায় সেটা ঢাকা পড়েছে আর ছোট্ট রুহান থেকে এখন সে রোয়েন লিউস!

🌸🌸🌸

ফুলের বুকি নিয়ে একের পর এক গেস্টকে সাদরে আমন্ত্রণ ইনায়া এবং তার বন্ধুরা, সবাই তারা আজ একি কালারের ড্রেস পড়েছে, ছেলেদের জন্য ব্লাক কম্পলিট সুট আর মেয়েরা সবাই রেড গাউন। সবাইকে খুব অপুর্ব লাগছে, ক্লাস মনিটর হওয়ার সুবাদে ওকে সামনে দাঁড়াতে হয়েছে আর ছেলেদের মধ্যে রাফিন,,

প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও যখন “রোয়েন লিউসের দেখা মিললো না তখন খুবই বিরক্ত হয়ে নিজের বুকিটা এনার হাতে দিয়ে রেস্টরুমের দিকে চলে গেলো ও, ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই এনা হতদন্ত হয়ে বেরুলো আর বললো

“তুই কোথায় ছিলি বলতো! স্যার কবে থেকে খুজছে তোকে,, চিফ গেস্ট এসে গেছে আর তার চার্জে তো তুই আছিস, গো ফাস্ট!”

“আম ভেরি আনকম্ফর্টেবল উইথ ম্যান, তুমি আমার পরিবর্তে যেতে পারবে?”

কথাটি শুনেই এনা ওকে থ্যাংকস বলে গালে কিস করে চলে যায় যেন এই শব্দের অপেক্ষায় ছিলো ও, ইনায়া হেটে একটা রুমে যায় যেখানে নানা ধরনের পেইন্টিং টাংগানো আছে, একটার পর একটা কি অপুর্ব পেইন্টিং! তবে রোয়েন লিউসের চিত্রগুলো সত্যিই আকর্ষণীয়, মানুষটি কেমন হয়তো জানা নেই তবে একেকটা চিত্র হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো, নো অউন্ডার হি ইজ ফেমাস!

ঘুরতে ঘুরতে একটা পেইন্টিং এর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো, খুব সুন্দর এক বাঙালি নারীর ছবি এটি, শাড়ি পড়া, চোখে কাজল আর মায়াবী দুটো চোখ যেন জীবন্ত কোন ছবি। ছবিটি খুব চেনা লাগলো ওর মনে হচ্ছে এই নারীটি খুব চেনা ওর, কারো সাথে মিলে যাচ্ছে তবে হুবহু নয় কিন্তু মিলাতে পারছে না তবে নারীটি নিঃসন্দেহ খুব সুন্দর, যাকে বলে মায়াবী সুন্দর। তবে তার নিচে আর্ট বাই “RJK” দেখে চমকে উঠলো, কারণ এখানে ছবি গুলোতে এই নাম একটাও পায়নি, সব চিত্রকরের অনেক চিত্র আছে এইখানে শুধু এই ট্যাগের চিত্র মাত্র একটা। এবং নামের পরিবর্তে অক্ষর লিখা, ওই চিত্রের ছবি তুলি নিলো ও যদিও এটা যুক্তিসংগত নয়।

রুম থেকে বেরিয়ে হলের দিকে যাবে তখনি স্যার বললো ফাংশনের যে সিংগার আসার কথা তারা এখনো আসেনি আর একটু পরেই গান পরিবেশন করতে হবে। সিংগারকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি এদিকে ক্লাস মনিটর হিসেবে ওর খেয়াল রাখা উচিৎ ছিলো তাই স্যার এটা ওকে হ্যান্ডেল করতে বললো। অনেক খুজেও কাউকে গান গাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলো না তাই ও আর রাফিন ডুয়েট সং গাইবে বলে ডিসাইড করলো।

এতক্ষণ খুব মনোবল নিয়ে স্টেজে উঠলেও এখন ক্রমশ নার্ভাস লাগছে ওর। একেতো ইংলিশ সং গাইতে হবে তার উপর স্টেজের সামনে বিশাল মানুষের সমারোহ! কয়েকবার লম্বা শ্বাস নিয়ে ও চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করলো

I love it when you call me señorita
I wish I could pretend I didn’t need ya
But every touch is ooh la la la
It’s true, la la la
Ooh, I should be running
Ooh, you keep me coming for ya (ইনায়া)

Land in Miami
The air was hot from summer rain
Sweat dripping off me
Before I even knew her name, la la la
It felt like ooh la la la
Yeah, no
Sapphire moonlight
We danced for hours in the sand
Tequila sunrise
Her body fit right in my hands, la la la
It felt like ooh la la la, yeah (রাফিন)

I love it when you call me señorita… (একসাথে)

গান গাওয়ার পুরোটা সময় ইনায়া চোখ বন্ধ করে ছিলো, যদি চোখ খুলতো তাহলে হয়তো বুঝতে পারবে দুটো চোখ ওকে নেশাক্ত চোখে পর্যবেক্ষণ করছে, এক মিনিটের জন্য দৃষ্টি সরায়নি…

#চলবে

(হ্যাপি রিডিং🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here