মাফিয়া ক্রাশ বর ২ পর্ব -১৫+১৬

#মাফিয়া_ক্রাশ_বর_২
#পর্বঃ ১৫
#লেখিকাঃ_মার্জিয়া_রহমান_হিমা

সেই অর্ধ বয়স্ক মহিলার মাথার সব ফাকা হয়ে গেলো। যেই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য সে গা ঢাকা দিয়েছিলো সেই বিপদ যে আবার তার আশেপাশে চলে আসবে সেটা নিমিষেই বুঝে নিলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি অভিদের কথা ভাবলেন। তিনি আতংকিত গলায় বললেন
” তুমি অভিদ ? তুমি তো সোহাদ রায়জাদার কাছে ছিলে। তার মানে তোমার সাথে সোহাদ রায়জাদা ও এসেছে ?”
অভিদ উত্তর না দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে এক দৃষ্টিতে কৌশিকা রায়জাদার দিকে তাকিয়ে থাকে। অভিদের মনে হলো কৌশিকা রায়জাদা একদম অভিদের মায়ের প্রতিচ্ছবি। অভিদ কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না। রায়হানেরও নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। রায়হান রুহি আর মিশুকে অন্যরুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলে। কৌশিকা রায়জাদা একজনকে ইশারা করতেই তারা তাদের নিয়ে যায়। রায়হান কৌশিকা রায়জাদাকে উদ্দেশ্য করে বললো
” আমরা ভেতরে গিয়ে বসে কথা বলতে পারি না ?”
কৌশিকা রায়জাদা ঢোক গিলে বলে
” হ্যা এসো সবাই।” কৌশিকা রায়জাদা সবাইকে নিয়ে গিয়ে বসায়। কৌশিকা রায়জাদা তার স্বামীকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলে।
কৌশিকা রায়জাদা অভিদ সামনে গিয়ে বসে আদুরে স্বরে বলে
” কেমন আছিস অভি ?” অভিদ ঠোঁট ভেঙে তার ফুপিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কৌশিকা রায়জাদার চোখ ছলছল করে উঠে। যেই ছোট ছেলেকে ছেড়ে এই সুদূর দেশে পারি জমিয়ে ছিলো সেই ছেলে আজকে তার সামনে রয়েছে। অভিদ কাঁদতে কাঁদতে বলে
” তুমি আমাকে ছেড়ে কেনো এসেছিলে ফুপি ? আমাকে এভাবে রেখে চলে আসতে কি তোমার একটা বারও বুক কাঁপেনি ? আমার কথা কি তোমার মনে পড়ে না ? ফুপি ! অন্যের দোষের শাস্তি তোমরা আমাকেও কেনো দিলে ? আমি কি এটার প্রাপ্য ছিলাম?” কৌশিকা রায়জাদা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” তখন কি করতাম আমি ? তোকে নিয়ে চলে আসলে আজ না তুই থাকতি আর না আমরা। তোকে আর আমার পরিবার বাঁচানোর জন্যই এতো কিছু করতে হয়েছে আমাকে। তোকে ছেড়েই চলে আসতে হয়েছে আমার।”
অভিদ চোখ মুছে জড়ানো গলায় বললো
” তাই বলে কি একবারও আমার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করোনি ? জানো সেই ছোট বেলা থেকে মনে কতোটা কষ্ট নিয়ে আমি বড় হয়েছি ? কতো রাত আমার নির্ঘুমে কেটেছে তোমাদের জন্য। প্রতিদিন ভাবতাম তোমাদের যদি একবার দেখতে পেতাম ! আমার কলিজাকে যদি একবার কাছে পেতাম ! কিন্তু কিছুই হতো না। তোমরা সবাক স্বার্থপর।”
কৌশিকা রায়জাদা মুখে ওড়না গুঁজে কাঁদতে থাকে। রায়হানের চোখ বেয়েও পানি পড়তে থাকে। কৌশিকা রায়জাদার রায়হানের দিকে চোখ পড়তেই রায়হান চোখ মুছে মাথা নিচু করে নেয়। কৌশিকা রায়জাদা কান্নার মাঝে হেসে রায়হানের মাথায় হাত রেখে বলে
” তুই রায়হান তাই না ?” রায়হান মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী স্বরে বললো
” আমাকে কারো মনে আছে নাকি ? নিজের ভাতিজাকেই মনে রাখে না সেখানে আমি তো পরের ছেলে।”
কৌশিকা রায়জাদা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” তোরা একবার আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতি কেনো আমি এমন করেছি। আমার হাত,পা বাধা ছিলো শুধুমাত্র ওই S.R. এর জন্য। তোরা তো আজও কিছু জানতে পারিসনি। তোদের সবচেয়ে আপনজনই তোদের পুরো পরিবার শেষ করে দিয়েছে। তোরা এখনও অন্ধকারে রয়েছিস। এতোগুলো বছর পর আমার প্রাণের মানুষ গুলোকে দেখছি। আজ তোদের সব বলবো আমি।”
অভিদ চোখ মুখ মুছে তাছিল্য ভরা হাসি দিলো। কৌশিকা রায়জাদা অবাক হয় অভিদের হাসি দেখে। রায়হান অভিদের দিকে তাকিয়ে বললো
” তুমি কি বলবে ফুপি ? তুমি জানো কি জানো ? তোমরা আমাদের দূড়ে ঠেলে দিলেও আমরা আজ তোমাদের জন্যই এখানে। আমরা এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। তুমি যা জানো তার চেয়ে দশগুণ আমরা জানি। তোমাদের অজানা সব কথাও আমরা জানি।”
কৌশিকা রায়জাদার চেহারায় হাজারো বিস্ময়ের রেশ দেখা গেলো। অভিদ মলিন হেসে তার ফুপির হাত ধরে বলে
” আমরা অনেক বড় হয়ে গিয়েছি ফুপি। তোমাদের সঙ্গ ছাড়াই অনেক দূড় এসে পৌঁছেছি।”
কৌশিকা রায়জাদা বিস্ময় স্বরে বললেন
” তোরা জনিস কি বলছিস ? সব জানিস মানে ? তোরা জানিস S.R. কে ?” অভিদ আর রায়হান দুজনই মুচকি হাসি দিলো। কৌশিকা রায়জাদা হতবাক হয়ে মুখে হাত দিয়ে বসে রইলো। অভিদ হেসে বললো
” ভয় পাচ্ছো ? আমি কিন্তু তারই আদর্শ !” কৌশিকা রায়জাদা অভিদের কথা শুনে আরো চমকে গেলো। অভিদের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো। অভিদ হেসে বলে
” ভয় পেয়ো না ! আমি তার আদর্শ হলেও আমি S.R. নই। আমি অভিদ রায়জাদা। আমি আমার আদর্শের তৈরি।”
কৌশিকা রায়জাদা ঢোক গিলে বলে
” তোর আদর্শের মানে ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোর কথা।”
অভিদ বাকা হাসি দিয়ে বলে
” সব জানতে পারবে। একসাথে এতো চমক দিলে সহ্য করতে পারবে না তাই সময় নিয়ে নিয়ে চমক দেবো। যাই হোক তুমি তো আমাকে চিনতে পারলে না দেখি তোমার বুড়ো বরটা আমাকে চিন্তা পারে কিনা !”
কৌশিকা রায়জাদা চোখ রাঙিয়ে বলে
” এই তুই কাকে বুড়ো বলছিস ? তোর ফুপাকে দেখলে তুই অবাক হয়ে যাবি। তোর ফুপা এখনও তোর মতো হ্যান্ডসাম মানে কিছুটা বুড়োর ছাপ পড়েছে। এছাড়া তার সঙ্গে দাঁড়ালে তাকে তোর বড় ভাই মনে করবে সবাই।”
রায়হান এক ভ্রু উঁচু করে হেসে বলে
” বাহ ফুপি ! তা তুমি কি বাচ্চা ছেলেকে বিয়ে করেছিলে নাকি ?” কৌশিকা রায়জাদা রায়হানের পিঠে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। অভিদ আর রায়হান হা হা করে হেসে দেয়। কৌশিকা রায়জাদা ভ্রু কুঁচকে বলে
” কিন্তু তুই বললি আমি তোকে চিনতে পারিনি। আমি কেনো চিনতে পারিনি তোকে ?”
অভদ উত্তরে শুধু হাসলো। কৌশিকা রায়জাদা কিছুই বুঝতে পারছে না।

কিছুক্ষণ পর দরজায় নক হতেই কৌশিকা রায়জাদা দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই পুলিশের পোশাক পড়া একজন লোককে দেখা গেলো। অভিদ ভেতর থেকে তাকে দেখে সত্যিই অবাক হলো। চেহারায় তেমন কোনো বয়স্কতার ছাপ নেই একদম ফিটফাট। কৌশিকা দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই তিনি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে
” কি ব্যাপার বলো তো ? আজকে কি সবার জিন্য বাঙালী খাবার রান্না করেছো নাকি ? তুমি তো স্পেশালি এই খাবার রান্না না হলে আমাকে এই সময়ে বাড়িতে ডাকো না। আজকে আমার সাথে সাথে তোমার ছেলে মেয়েরাও এসে পড়েছে।”
কৌশিকা রায়জাদা কোনো কথা বললো না শুধু হাসতে থাকে। সিদ্দিকুর রহমান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কৌশিকা রায়জাদার দিকে তাকিয়ে বলে
” কি হলো মুচকি মুচকি হাসছো কেনো তুমি ? কি হয়েছে ?” কৌশিকা রায়জাদা অভিদ আর রায়হানের দিকে তাকালো। সিদ্দিকুর রহমান তার চোখ অনুসরণ করে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। হা করে তাকিয়ে থাকে অভিদ আর রায়হানের দিকে। অভিদ আর রায়হান মুখ টিপে হাসতে থাকে যদিও তিনি বুঝতে পারলেন না।
সিদ্দিকুর রহমান অবাক স্বরে বলে উঠে
” অভিদ রায়জাদা আমার বাড়িতে ?”
অভিদ আর রায়হান এগিয়ে এসে একসঙ্গে বলে
” কেমন আছো ফুপা ?” সিদ্দিকুর রহমান চমকে গেলো দুজনের কথা শুনে। কৌশিকা রাজদারা দিকে তাকাতেই তিনি জড়ানো গলায় বলে
” আজ পর্যন্ত আমি আমার যেই ছেলের কথা তোমাকে বলে এসেছি এই সেই ছেলে। অভিদ রায়জাদা আমার ভাইয়ের ছেলে।”
সিদ্দিকুর রহমান আরো বিস্মিত হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে বলে
” তোমার ভাইয়ের ছেলে ? তার মানে তোমার ভাইয়ের ছেলেই এতোবড় বিজনেসম্যান ! দ্যা গ্রেট অভিদ রায়জাদা ! তোমাকে যে আমি এতোদিন ধরে বলতাম একটা অল্প বয়সি বাংলাদেশি ছেলের অফিস বর্তমানে টপ ৪ লেভেলে রানিং করছে এই সেই অভিদ রায়জাদা।”
কৌশিকা রায়জাদা চমকে অভিদের দিকে তাকায়। অভিদ মুচকি হাসি দিলো যার মানে যা বলছে সত্যি। কৌশিকা রায়জাদা অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলেও আর বলতে পারলো না। সিদ্দিকুর রহমানের পেছন থেকে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এসে দাঁড়াল।
অভিদ এক দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা কৌশিকা রায়জাদার কাছে গিয়ে রাগে ফুসফুস করতে করতে বলে
” মনি দেখো তোমার ছেলে আবারও আমার ফ্রেন্ডদের সামনে আমাকে বকেছে। আমি কিন্তু আবারও তোমার ছেলের মাথা ফাটিয়ে হসপিটালে পাঠিয়ে দেবো !”
ছেলেটা হাসতে হাসতে এসে মেয়েটার চুল টেনে দিয়ে বলে
” আমার মাথা ফাটালে আমি তোকে ফাটিয়ে দেবো।” মেয়েটা ফিকফিক করে হেসে দিয়ে বলে
” আমাকে ফাটিয়ে দেবে তুমি ? একবারও তো দেখলাম না আমাকে ফাটাতে। শুধু বলতেই পারো কিন্তু করতে তো পারবে না কোনোদিন।”
কৌশিকা রায়জাদা কড়া গলায় বলে উঠে
” চুপ করবে তোমরা নাকি বকা দেওয়া লাগবে ?”
দুজন মুখ ফুলিয়ে ফেলে। কৌশিকা রায়জাদা মেয়েটার আর ছেলেটার হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে আসে। অভিদের সামনে এসে ছেলেটাকে দেখিয়ে বলে
” ও তোর ভাই তুষার। আর এই মেয়েটা কে জানিস ?”
অভিদ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো। কৌশিকা রায়জাদা মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” তোর কলিজা পাখি। যাকে এতোবছর ধরে আমি আমার আমানত হিসেবে বড় করেছি। হৃদিয়া অনি রায়জাদা।”
অভিদের বুক ধক করে উঠে। তার সেই দুই বছরের ছোট পাখিটা আজ এতো বড় হয়ে গিয়েছে ? অভিদের চোখ ছলছল করতে থাকে। অনি অভিদের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করব তাকিয়ে থেকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে
” এই তুমি অভিদ রায়জাদা না ? আল্লাহ ! তুমি আমার বাড়িতে কি করছো ? এতোবড় একটা সেলিব্রিটি আমার বাড়িতে ? জানো তোমার জন্য আমার ফ্রেন্ডরা একেকজন পারলে তো মরে যায়। কিন্তু তুমি আমার বাড়িতে কি করছো ? আচ্ছা তুমি জানো আমার আর তোমার টাইটেলটা একই। আমারও রায়জাদা আর তোমারও রায়জাদা। তাই না ?”
কৌশিকা রায়জাদা অনির মাথায় হাত রেখে জড়ানো গলায় বলে
” অনি ! এটা তোর ভাই। তকে আমি বলতাম না ! তোর একটা ভাই আছে যে হাড়িয়ে গিয়েছে ? তোর আপন রক্তের ভাই অভিদ রায়জাদা।”
অনি স্তব্ধ হয়ে গেলো। অভিদ কাঁপা কাঁপা হাতে অনির গালে হাত রাখে। ঢোক গিলে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে হেসে বললো
” আমার কলিজা পাখি !” অনি ঢোক গিলে অভিদের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে। অভিদ অনি বলে ডাকলেও অনি পেছন ফিরে তাকালো না।
#মাফিয়া_ক্রাশ_বর_২
#পর্বঃ ১৬
#লেখিকাঃ_মার্জিয়া_রহমান_হিমা

অভিদ কাঁপা কাঁপা হাতে অনির গালে হাত রাখে। ঢোক গিলে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে হেসে বললো
” আমার কলিজা পাখি !” অনি ঢোক গিলে অভিদের হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেলো সেখান থেকে। অভিদ অনি বলে ডাকলেও অনি পেছন ফিরে তাকালো না। অভিদ ছলছল চোখে কৌশিকা রায়জাদার দিকে তাকায়। কৌশিকা রায়জাদা নিশ্বাস ফেলে শান্তনা দিয়ে বলে
” তোর উপর অভিমান করে আছে। তুই কথা বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।” অভিদ নিশ্বাস ফেলে তুষারের দিকে তাকায়। তুষার হেসে অভিদকে জড়িয়ে ধরে। অভিদও তুষারকে জড়িয়ে ধরে। তুষার তার মায়ের উদ্দেশ্যে বল
” মম ভাইয়াকে খুঁজে পেলে কিভাবে তুমি ? এতোদিন তো শুধু ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে আর খোঁজার কথা বললেই চুপ করে যেতে।” অভিদ আর রায়হান হেসে দেয় তুষারের কথা শুনে। কৌশিকা রায়জাদা রাগি গলায় বলে
” বেশি কথা বলিস তুই। আর আমি খুঁজে পাইনি অভিদই আমাদের খুঁজে বের করেছে।”
তুষার রায়হান আর অভিদের দিকে তাকিয়ে বলে
” তোমরা এসেছো দেখে নাহলে মম ফ্যামিলির করহা তুললেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদা শুরু করে। এবার তাহলে আর ফ্যাচফ্যাচ কান্না শুনতে হবে না। কানটা রেহাই পাবে।” কৌশিকা রায়জাদা রেগে কিছু বলার আগেই তুষার দৌড়ে চলে গেলো তার রুমে। অভিদ আর রায়হান হেসে উঠে আবারও। সিদ্দিকুর রহমান এখনও দাঁড়িয়ে আছে অভিদ আর রায়হানের দিকে তাকাচ্ছে বারবার। কিভাবে এসেছে ওরা বুঝতেই পারছে না তিনি। কৌশিকা রায়জাদা বুঝতে পেরে বললো
” ফ্রেশ হয়ে এসে লাঞ্চ করার পর একে একে সব জানতে পারবো। তাই এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যাও আর আমাদের ছেলেদেরও একটু ফ্রেশ হতে দাও।” সিদ্দিকুর রহমান মাথা নেড়ে তার রুমে চলে গেলো। কৌশিকা রায়জাদা অভিদ আর রায়হানের কাছে এসে হেসে বললো
” তোরা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েনে। আমি আজকে সারাদিন তোর কথা শোনার অপেক্ষা করবো।”
অভিদ অনির রুমের দিকে তাকিয়ে বলে
” কিন্তু অনির কাছে যাবো না ?” কৌশিকা রায়জাদা চোখের পলক ফেলে বললেন
” তোর বোনের কাছে গেলেও এখন কাজ হবে না। খিদে পেলে নিজে নিজেই বের হয়ে আসবে। এখন তুই তোর বউ কাছে যা। মেয়েটার সাথে আমার কথাও হলো না। রায়হান তোর রুমও দেখিয়ে দিচ্ছি তোকে তুইও ফ্রেশ হয়েনে।”
কৌশিকা রায়জাদা অভিদ আর রায়হানকে তাদের নিজেদের রুম দেখিয়ে দেয়।
অভিদ রুমে এসে দেখতে পেলো রুহি, মিশু সোফায় বসে আছে। রুহি মিশুর কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। অভিদ ওদের কাছে গিয়ে চিন্তিত হয়ে বলে
” কি হয়েছে রুহির ?”
মিশু রুহিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাধে হাত রেখে বলে
” ওর মাথা ব্যাথা করছিলো তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
অভিদ রুহিকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিলো। রুহি নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। মিশু দুই পা এগিয়ে এসে ধীর গলায় বলে
” ভাইয়া আপনি যাকে ফুপি বলে কাঁদছিলেন তিনি কি আপনার ফুপি ?”
অভিদ মিশুর দিকে ঘুরে মুচকি হাসি দিয়ে বলে
” হুম আমার ফুপি। যাকে খুঁজছিলাম এতোদিন তাকে পেয়ে গিয়েছি। ফুপির কাছেই আসা এখানে। আরো অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। এখন তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।” মিশু মাথা নেড়ে চলে গেলো। অভিদ দরজা বন্ধ করে দিয়ে রুহির পাশে এসে বসলো। রুহির কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে মুচকি হেসে বলে
” আজকে অনেক খুশি আমি রুহি। তুমি যদি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকতে তাহলে আমার থেকে তুমিই বেশি খুশি হতে। আজকে আমি আমার বোন আমার কলিজাকে দেখেছি। ছোট ছোট হাত দিয়ে আমার আঙুল আকড়ে ধরে গুটি গুটি পায়ে হাটতো আমার সাথে। সেই কলিজাটা আজ কতো বড় হয়ে গিয়েছে। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে আমি আমার কলিজার থেকে কি করে এতো দূড়ে ছিলাম ? খুব আফসোস হচ্ছে সেই দিনগুলোর জন্য।” অভিদ দীর্ঘনিশ্বাস নিয়ে রুহির পেটের উপর হাত রাখলো। রুহির পেটে আলতোভাবে চুমু দিলো। রুহি ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠলো অভিদ তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ফ্রেশ হয়ে এসে রুহির পাশে বসতেই দরজায় নক হয়। অভিদ দরজা খুলে দেখে তার ফুপি দাঁড়িয়ে আছে। অভিদ হেসে বলে
” ভেতরে এসো ফুপি !” কৌশিকা রায়জাদা হেসে ভেতরে ঢুকে বলে
” তোর বউ এর সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। তখন তো চিনতাম ও না আর কথাও হয়নি।”
অভিদ রুহির দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে
” আসলে ফুপি রুহির মাথা ব্যাথা করছিলো তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।” কৌশিকা রায়জাদা বেডের দিকে তাকালো। রুহি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। কৌশিকা রায়জাদা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে
” অসুস্থ লাগছিলো তাই ঘুমিয়ে গিয়েছে ! তুই এভাবে আমতা আমতা করে কথা বলছিস কেনো ? ”
অভিদ মুচকি হাসলো। কৌশিকা রায়জাদা হেসে বলে
” আয় লাঞ্চ টাইম হয়ে গিয়েছে সবাই এখন খেতে বসবে।” অভিদ মাথা নেড়ে বলে
” আমার এখন খিধে নেই। তোমরা খেয়ে নাও আমি পরে রুহির সাথে খাবো।”
কৌশিকা রায়জাদা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। রুহি পরে একা একা আনইজি ফিল করতে পারে সেটা ভেবে কৌশিকা রায়জাদা কিছু না বলে হেসে চলে গেলো।
অভিদ রুহির দিকে এক পলক তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। অনির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সাহস নিয়ে অভিদ দুইবার দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে অনি রাগি গলায় বলে উঠে
” মনি আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। আমি কাজ করছি। আমি কারো সাথে দেখা করতে চাই না।”
অভিদ কথা শুনেও আবার দরজায় নক করে। এবারও অনি একই কথা বলে। অভিদ এবার ইচ্ছেমতো দরজায় নক করতে থাকে। অনেক্ষণ পর অনি দরজা খুলে রেগে চেঁচিয়ে বলতে থাকে
” মনি তোমাকে বলছি না ? আমাকে ডিস্টার্ব করবে না !” অনি কথা শেষ করে তাকিয়ে দেখে অভিদ দাঁড়িয়ে আছে। অনি কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে ধপ করে দরজা লাগিয়ে দিতে নিলে অভিদ দরজা ধরে নেয়। অনি ঠেলতে থাকে দরজা লাগানোর জন্য অভিদও খোলার জন্য ঠেলতে ঠেলতে শান্ত ভাবে বললো
” কিছু কথা বলবো তোমার সাথে শুনবে ?” অনি দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে
” আমি কারো কথা শুনতে চাই না। এখান থেকে চলে গেলে খুশি হবো।”
অভিদ এবার শরীরের জোড় দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বলে
” আমি তো আমার কথা বলেই যাবো।” অনি রেগে অভিদের দিকে তাকিয়ে দরজায় লাথি মারে। দরজাটা জোড়ে শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো। অভিদ পুরো রুমে একবার চোখ বুলালো। পুরো রুম এলোমেলো হয়ে আছে বাচ্চাদের মতো।
অভিদ হেসে বলে
” তুমি এতো অগোছালো ?”
অনি গম্ভীর গলায় বলে
” আপনি কি এসব বলার জন্য এখানে এসেছেন ? কথা বলে বেড়িয়ে জান এই রুম থেকে।”
অভিদ মাথা নেড়ে সোফা দেখিয়ে বলে
” এখানে কি বসতে পারি নাকি এতেও রাগ করবে ?” অনি আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অভিদ হালকা হেসে সোফায় বসে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভিদ বলা শুরু করে
” ছোট বেলায় আমার মা, বাবা আর আমি খুব খুশিতে দিন কাটাতাম। মা, বাবা দুজনই আমাকে খুব ভালোবাসতো। একদিন বাবা বললো আমার নাকি একটা ছোট বোন আসবে হসপিটাল থেকে। আমিও খুব খুশি হয়েছিলাম আমার একটা নতুন বন্ধু হবে বলে। ধীরেধীরে সময় যেতে থাকে আমিও দেখলাম আমার মা বাবা এখন আর আগের মতো আমাকে বেশি আদর করে না। শুধু ছোট বোনের কথা বলে। আমার মনেও হিংসে জন্মালো আমার ছোট বোন আসলে আমার ভালোবাসা কমে যাবে ভেবে। আমি রেগে বলতাম ছোট বোনকে আমি একদম ভালোবাসবো না। সময় যেতে যেতে একদিন আমার ছোট বোন চলে আসার সময় এসে পরে। মা, বাবা যখন আমাকে ফুপির কাছে রেখে হসপিটালে গিয়েছিলো তখনও আমার রাগ হয়েছিলো। কিন্তু যখন কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে তখন আমার মনে রাগের বদলে কেনো জানি আনন্দের ঢেউ বেশি ছিলো। আমি আমার বোনকে নিয়ে অনেক কিছুই করতাম। বোনকে সত্যি ভালোবাসতাম।কিন্তু হঠাৎ এক ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিলো। মা, বাবা আকাশের তারা হয়ে গেলো। ফুপি সেই ঝড় থেকে বাঁচার জন্য আমার বোন আর তার পরিবার নিয়ে পালিয়ে গেলো। আমাকে নিজের সাথে নিতে চেয়েও পারলো না কারণ সে অসহায় ছিলো। আমাকে রেখেই অন্য দেশে পার জমায়। ছোট বেলা থেকে আমি আমার এই অবশিষ্ট পরিবার আর ছোট কলিজা বোনকে দেখার কতো ছটফট করেছি সেটা একমাত্র আমি আর রায়হান জানি। এতোগুলো বছর পর আমি আমার পরিবারের খোঁজ পেয়েছি কিন্তু আমার সেই কলিজা পাখিই আমার উপর অভিমান করে আছে।” অনি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। অভিদ হেসে তার দিকে তাকায়। অনি কাঁদতে কাঁদতে বলে
” তুমি খুব পচা। আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে তুমি। কেনো রাখলে না আমাকে তোমার কাছে?” অভির উঠে অনিকে দুই হাতে বুকে জড়িয়ে নেয়। জড়ানো গলায় বলে
” পরিস্থিতির স্বীকার আমরা সবাই। তোকে ছেড়ে থাকতে আমার কম কষ্ট হয়নি। তোদের খুঁজে বের করার জন্য কতো পাওয়ার আমার হাতে আনলাম কিন্তু কোনো কাজ হলো না। but finally i find you.” অনি অভিদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। অভিদ অনির চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলে
” আর কাঁদিস না বোন। তোকে পেয়ে আজকে নিজেকে স্বার্থক মনে হচ্ছে। আমি তোকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।”
অনি নাক টেনে কান্নার মাঝেই হাসলো। অভিদ অনিকে বললো
” যাও ব্রেকফাস্ট করে এসো।” অনি আবদার স্বরে বলে উঠে
” নাহ আজকে তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে।”
অভিদ বড় একটা মিষ্টি হাসি দিলো। অনিকে নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসে। সবাই খাচ্ছিলো দুজনকে একসাথে দেখে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অভিদ অনিকে যত্ন সহকারে খাইয়ে দেয়।

সন্ধ্যার পর অভিদ, রায়হান, কৌশিকা রায়জাদা, সিদ্দিকুর রহমান, তুষার আর অনি একসাথে বৈঠকে বসে। কৌশিকা রায়জাদা অভিদের থেকে সব কিছু জানতে চেয়েছে তাই অভিদ বললো পরিবারের সবার সব কিছু জানার সময় চলে এসে তাই সবার সামনেই বলবে। কৌশিকা রায়জাদা ধৈর্যহারা হয়ে বলে
” অভিদ বলা শুরু কর।”
অভিদ স্বাভাবিক ভাবে বলে
” আমার কথা তো পরে, আগে তোমার জানা অতীত গুলো বলো। সবাই সেগুলো আগে শুনুক তারপর নাহিয় বাকি অতীত।”
কৌশিকা রায়জাদা নিশ্বাস ফেলে বলা শুরু করে

চলবে~ইনশাল্লাহ…….
চলবে~ইনশাল্লাহ……..

[দেড়ির জন্য ক্ষমা প্রার্থী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here