মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -২৬

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_২৬
জাওয়াদ জামী

ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনিতে চারপাশ মুখরিত হতেই তানিশা সাদিফকে ডেকে তোলে। আড়মোড়া ভেঙে সাদিফ উঠে বসে। ফ্রেশ হয়ে অজু করে মসজিদের দিকে রওনা দেয়। গেইটের বাইরে পা দিতেই দেখল সাইফ পাঞ্জাবি, টুপি পরে কোথাও যাচ্ছে। সাইফের পিছুপিছু হাঁটছে সাদিফ। একটু পর বুঝতে পারে সাইফও মসজিদের দিকেই যাচ্ছে। সাইফের এই পরিবর্তনে অবাক হয় সাদিফ।

সাদিফ মসজিদ থেকে এসে আবার ঘুমিয়ে পরেছে। অবশ্য এটা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
তিয়াসা রান্নাঘরে রহিমা খালার সাথে ব্যস্ত। তানিশা রান্নাঘরের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ওদের খুটিনাটি দেখিয়ে দিচ্ছে। সাইরা ড্রয়িংরুম পরিস্কার করছে। বাচ্চারা কেউ ঘুম থেকে উঠেনি।
সাইফ বাহিরে থেকে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে এসেছে। ওর দু’হাতে ব্যাগ ভর্তি বাজার। ব্যাগগুলো তানিশার সামনে রাখে।
” ভাবি, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখো তো। বড় দেখে চিংড়ি মাছ কিনেছি। তূর্ণার নাকি পছন্দের মাছ। আর নোয়েল-নিরোর জন্য আছে বোয়াল মাছ। বাবার জন্য হাওরের পাবদা এনেছি। আরও কিছু মাছ আছে দেখ। ”
তানিশার এতসব বাজার দেখে চোখ কপালে উঠে।
” এসব কি করেছ তুমি! এতগুলো বাজার একসাথে করেছ! তোমার ভাইয়া গতকাল একগাদা মাছ,মাংস সবজি কিনেছে। এতসব মাছ, মাংস খাবে কে! ”
” এখন থেকে ভাইয়াকে বাজার করতে নিষেধ কর। এই দ্বায়িত্ব আমিই পালন করব। ”
” তোমার আপাতত কোন দ্বায়িত্বই পালন করতে হবে না। তুমি নিজের ক্যারিয়ারে মনযোগ দাও৷ ”
” ক্যারিয়ারে মনোযোগ দিব আবার সংসারেও দিব। কোন টেনশন নিওনা, দেখ আমি ঠিক উতরে যাব। ”
” আচ্ছা, যাও ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো। আজ তো তোমার নতুন অফিসে জয়েনিং ডে। প্রথম দিন একটু তারাতারি বের হতে হবে। ” তানিশার কথায় সায় জানিয়ে সাইফ রুমে আসে।
সাদিফ আজও খেতে নিচে আসেনি। তানিশা ওর খাবার উপরে নিয়ে আসে।
সাইফ নাস্তা করে বাবা-মা’র কাছে আসে দোয়া নিতে। জামিল চৌধুরী, শায়লা চৌধুরী ছেলেকে প্রাণভরে দোয়া করেন। এরপর সাইফ আসে তানিশার দরজার সামনে। বাইরে থেকে ডাক দেয়।
” ভাবি, একটু তুমি কি ব্যস্ত আছ? একটু আসবে? ”
তানিশা সাইফের ডাক শুনে দরজার কাছে আসে।
” তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন! ভেতরে এসো। ”
” এখন নয় ভাবি। আমি অফিসে যাচ্ছি। দোয়া করো, সবকিছু ঠিকঠাক মত যেন মিটে যায়। ভাইয়াকে দোয়া করতে বল। ” সাইফ বেশিক্ষণ দাঁড়ায়না। ভেতর থেকে সাদিফ শুনতে পেয়েছে সাইফের কথা।
সবশেষে সাইফ, সাইরা ও রাতুলের কাছে দোয়া চায়। এমনকি রহিমা খালাকেও বলে৷
ড্রয়িংরুমে আসতেই তিয়াসার মুখোমুখি হয় সাইফ। কিন্তু কেউই কারো সাথে কথা বলেনা। সাইফ বেরিয়ে গেলে তিয়াসা দরজা লাগিয়ে দেয়।

সাইফ এসেছে তিনমাস হল। সে নিয়মিত অফিস করছে আবার সংসারের সব দ্বায়িত্ব ঠিকমত পালন করার চেষ্টাও করছে। এতে করে সাদিফের ঝামেলা অনেকটাই কমেছে৷ জামিল চৌধুরীর শারিরীক অবস্থার আরও উন্নতি হয়েছে। তিনি এখন পুরোদমে হাঁটতে পারছেন। কথাও বলছেন কিন্তু জড়িয়ে যাচ্ছে। ডক্টর বলেছেন আস্তে আস্তে এই জড়তাও কেটে যাবে। তিয়াসা মাঝখানে কয়েকদিন ভার্সিটিতে যেয়ে ক্লাস করেছে।
তানিশার শরীরে রক্ত স্বল্পতা এখনো আছে। সাদিফ ওকে কড়া নজরদারিতে রেখেছে। কোন কাজ করতে বারন করে দিয়েছে। শায়লা চৌধুরীও ওকে কুটোটি নাড়তে দেয়না। তূর্ণা এখন সাইফ চাচ্চু বলতে পাগল। এতকিছুর পরও দুই ভাইয়ের সম্পর্কে শিথিলতা এখনো আছে। সাইফ সব সময়ই চেষ্টায় থাকে সাদিফের সাথে কথা বলার কিন্তু সাদিফ পাত্তা দেয়না।

সাইরার শ্বাশুড়ি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি সাইরার কাছে ক্ষমা চেয়ে ওদের নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়েছেন। সাইরাও উনার মতামতকে সম্মান জানিয়েছে। এখন আর তিনি সাইরাকে কটু কথা বলেননা। সাইরার জীবনে অধরা সুখ অবশেষে ধরা দিয়েছে।

সাদিফ তানিশাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে গিয়েছে। তানিশার চিকিৎসার বিষয়ে সকল দ্বায়িত্ব সাদিফ পালন করে। ওর যতই কাজ থাকুক না কেন পনের দিন পরপর ডক্টরের কাছে নিতে ভুল করেনা। তূর্ণাকে তিয়াসার কাছে রেখে গেছে। তিয়াসা বিকেলে তূর্ণাকে নিয়ে ছাদে এসেছে। তূর্ণা ছাদ জুড়ে ছুটাছুটি করছে। তিয়াসা ওকে চোখেচোখে রেখেছে। অনেক সময় ধরে খেলে তূর্ণা৷ মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেছে কিন্তু তূর্ণা নিচে যাবেনা। তিয়াসা ওকে মানাতেই পারছেনা।
” পুতুল সোনা, তুমি এখনো ছাদে কেন! এখনই আজান দিবে। নিচে যাও। ” কারো কথার আওয়াজে পেছনে তাকায় তিয়াসা। তিয়াসা লক্ষ্য করেছে সাইফ কখনোই ওর সাথে কথা বলেনা। এমনকি ওর দিকে তাকায়না পর্যন্ত। তিয়াসা সাইফের সম্পর্কে যা যা শুনেছে তাতে এই সাইফের সাথে সেসব মেলাতে পারেনা।
” চাচ্চু আরেকটু থাকি না। ” আহলাদী আবদার করে তূর্ণা।
” না সোনামণি, এখন নিচে যাও। কাল আবার আসবে। তুমি না গুড গার্ল? আর গুড গার্লরা কারো কথার অমান্য করেনা৷ তোমার জন্য চকলেট, আইসক্রিম এনেছি। নিচে যেয়ে সেগুল খাও। ”
” ঠিক আছে চাচ্চু। ” তূর্ণা এখন বেশ ভালোভাবেই কথা বলতে শিখেছে।
” ওকে নিয়ে যান। ” ছোট্ট করে তিয়াসাকে বলে সাইফ৷ তিয়াসাও মাথা ঝাঁকিয়ে চলে আসে।

সাদিফ তানিশাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। এত চিকিৎসা করানো , যত্ন নেয়ার পরও তানিশার শরীর সুস্থ হয়নি। ডক্টরও বেশ চিন্তা করছে ওর শারীরিক কন্ডিশন নিয়ে। এমন অবস্থা থাকলে বাচ্চার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই ডক্টর ওকে বেড রেষ্ট দিয়েছে। এবং সেই সাথে নানারুপ বিধিনিষেধ জারি করেছে। সাদিফ বাসায় এসে ডক্টরের নির্দেশনাগুলো জানিয়ে দেয়। তানিশার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি খুবই চিন্তিত হয় সমস্যাগুলো শুনে। তারা চান অতিদ্রুত তানিশা এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠুক। তারা সবসময় তানিশার পাশে থাকবেন।
তিয়াসা বড় বোনের এরূপ অবস্থা দেখে কেঁদে একাকার। সে তানিশার সকল দ্বায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। সাদিফ তিয়াসা থাকায় নিশ্চিতবোধ করে। সাইরা মাঝেমধ্যে এসে তানিশাকে দেখে যায়। তানিশার বাবা-মা ‘ ও আসে মেযেকে দেখতে। নিজের জন্য সবার মনে এত ভালোবাসা দেখে তানিশার চোখে সুখের অশ্রুরা হানা দেয় বারবার। এত সুখও তার ভাগ্যে ছিল!

আট মাসের ভরা পেট নিয়ে তানিশার শুয়ে থাকা যেমন কষ্টের তেমনি হাঁটাচলাও কষ্টের। সাদিফ যতটা পারে সময় দিতে চেষ্টা করে৷ শায়লা চৌধুরীও খুব খেয়াল রাখছেন ছেলের বউয়ের।
সাইফ নিয়মিত ভাবির খোঁজ রাখে। তানিশা না চেষ্টা করলে ও এই বাড়িতে আসতে পারতনা, ভাইয়া ওকে মেনে নিতনা। তানিশার জন্যই এসব সম্ভব হয়েছে বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞ সাইফ।

রাতের খাবারের পর তিয়াসা ছাদে আসে। ওর সেমিষ্টার ফাইনাল শেষ হয়েছে মাসখানেক আগেই। পরিক্ষার সময় এখানে ছিলনা সে। পরিক্ষার আগেরদিন গিয়েছে হলে। তখন তৃষ্ণা এসে ছিল তানিশার কাছে। তিয়াসা পরিক্ষা শেষ করে পরদিনই ফিরেছে ঢাকায়। তখন তৃষ্ণা গ্রামে ফিরেছে।
ছাদের কার্নিসে বসে নানান চিন্তা করছে তিয়াসা। তানিশার চিন্তায় ও ঘুম হারাম হয়েছে। সামনে আরো দুইটা মাস কিভাবে কাটবে তানিশার সেটা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে তিয়াসার।
” এত রাতে ছাদের কার্নিসে বসে আছেন কেন? পরে যান যদি! ” আবারো সেই ছোট্ট করে বলা কথায় তিয়াসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। যেমনটা তাকিয়েছিল অনেকদিন আগে। সাইফের নজর অন্যদিকে। তিয়াসা লক্ষ্য করল সাইফ আজও ওর দিকে তাকায়নি। এমন কেন এই লোকটা!
” আমি এখানে আর কিছুক্ষণ থাকব। রাতকে প্রান ভরে উপভোগ করব। তারপর যখন ঘুম আসবে তখন নিচে যাব। ” ত্যাড়াভাবে উত্তর দেয় তিয়াসা। সাইফ ওর কথার প্রত্যুত্তর না করে ছাদের অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ একমনে তাকিয়ে থাকে সূদুর পানে। তারপর চলে আসে। তিয়াসা এতক্ষণ উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছিল সাইফের কর্মকান্ড।
” পাগল নাকি লোকটা! হুহ, তাতে আমার কি! ”
একা একা কিছুক্ষণ বিরবির করে মনযোগী হয় আকাশ দেখায়।

শায়লা চৌধুরী বসে আছে তানিশার পাশে। বিছানার আরেক পাশে তূর্ণা খেলছে। শায়লা চৌধুরী অপেক্ষা করছেন তার বড় ছেলের। সাদিফ বাসায় এসে নিজের রুমে মা’কে দেখে ভুরু কোঁচকায়।
” সাদিফ এসেছিস। আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি। কিছু কথা ছিল তোর সাথে। ”
” আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, মম। তুমি আরেকটু বস। ” মেয়েকে আদর করে ওয়াশরুমে যায়।
তানিশাও অপেক্ষা করছে শ্বাশুড়ির কথা শোনার। সাদিফ ফ্রেশ হয়ে এসে মায়ের পাশে বসে। তার আগে তূর্ণাকে কোলে নিয়েছে।
” মম, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব জরুরি কিছু বলবে। ”
” হুম, তোদের দুজনের সাথে আলোচনা করা দরকার। তোর ছোট চাচ্চুর বন্ধু একবার তোর বাবাকে দেখতে এসেছিল। তখন তিনি তিয়াসাকে দেখেছিলেন। গতকাল তিনি তার ছেলের জন্য তিয়াসাকে চেয়ে বসেছেন তোর চাচ্চুর কাছে। সে আমাকে জানিয়েছে কাল রাতেই। ছেলে নাকি অষ্ট্রিয়ায় পড়াশোনা করেছে। তোরা নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাস। আমি তোর চাচ্চুকে জানাব। ”
সাদিফ জানায়, ও শ্বশুর বাড়িতে কথা বলবে। তাছাড়া তিয়াসারও পছন্দের একটা ব্যাপার আছে। তানিশাও সাদিফের কথার সাথে একমত হয়। শায়লা চৌধুরী রুম ত্যাগ করেন।
” শুনুন, আগে তিয়াসার সাথে কথা বলুন। ও রাজি থাকলেই তারপর বাবা-মা’র সাথে কথা বলবেন। ”
” ওকে বউ। কিন্তু তুমি এখন কেমন আছো? খেয়েছ কিছু? পর্যাপ্ত পানি পান করেছ? মেডিসিন নিয়েছ ঠিকঠাক? ”
” আস্তে। একে একে প্রশ্ন করুন। আমি এখানেই আছি। সব কিছু ঠিকঠাক মতই করেছি বুঝেছেন। ” সাদিফ তানিশার পাশে এসে একহাতে জড়িয়ে ধরে। আরেক হাতে জড়িয়ে রেখেছে মেয়েকে।

রাতে খাবার পর তিয়াসাকে রুমে ডাকে সাদিফ।
তিয়াসা রুমে আসলে সাদিফ জানায় ওর বিয়ের ব্যাপারে। তানিশাও সাদিফের পক্ষে কথা বলে।
কিন্তু তিয়াসা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে তাদের কোন কথার উত্তর না দিয়ে।
” তিয়াসা, তুমি চাইলে আমরা বাবা-মাকে জানাব, ছেলের খোঁজ নিব। এখানে তোমার ইচ্ছেতেই সব ঘটবে। ”
এবারও চুপ থাকে তিয়াসা।
সাদিফ, তানিশা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ওরা বুঝে গেছে তিয়াসা অন্য কাউকে পছন্দ করে।
” তিয়াসা, তুমি কি কাউকে পছন্দ কর? কারও সাথে কমিটেড আছো? ” সাদিফ জানতে চায়।
তিয়াসা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
তানিশা বোনের এমন আচরণে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে।
” তিয়াসা, কি বলছিস এসব! তোর মাথা ঠিক আছে? বাবা জানলে কি হবে চিন্তা করেছিস একবারও! ”
” আহা, তানিশা, আমি কথা বলছিত ওর সাথে।
তিয়াসা কে সে? আমাকে বল। তার সম্পর্কে ডিটেইলস বল। আমি প্রয়োজনে তার সাথে কথা বলব। ”
তিয়াসা এবার রীতিমত ঘামছে। কি জবাব দিবে সে।
” তিয়াসা, চুপ করে আছো যে? তুমি কি আমাকে বলতে চাওনা? আমাকে কিন্তু কালই মমকে জানাতে হবে। ”
বোনের এরূপ অবস্থা দেখে চিরকালের শান্ত তানিশার রা*গ হচ্ছিল। কিন্তু সাদিফের জন্য চুপ করে আছে।
” ভাইয়া, আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে আমাকে পছন্দ করে কিনা জানিনা। ”
” এটা কেমন কথা তিয়াসা! আরেকজন তোমাকে পছন্দ করে কিনা তা না জেনেই তুমি তাকে ভালোবেসেছ! কে সেই ছেলে? ”
” তার নাম সাইফ। সাইফ ভাইয়া। ” তিয়াসার কথা শুনে সাদিফের মাথায় আ*গু*ন ধরে যায়।
” তিয়াসা পাগলামি করার বয়স এখন তোমার নয়। সাইফের সম্পর্কে কোন কিছু তোমার অজানা নয়। যেখানে আমিই নিজের ভাইকে মানতে পারিনি সেখানে তুমি আশা কর কিভাবে ওর সাথে তোমার যে কোন সম্পর্কে আমি রাজি হব? ও যতই আমার নিজের ভাই হোকনা কেন তার সাথে তানিশার বোনের বিয়ে দেয়ার কথা আমি কিছুতেই ভাবতে পারিনা। ”
তানিশাও বোনের এরূপ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়ে গেছে। কি বলছে এই মেয়ে!
” ভাইয়া, আমি জানি তার ওপর আপনার রা*গে*র কারন৷ আপনারা যে সাইফকে ঘৃণা করেন, আমি এতদিনেও সাইফের সেই রুপ দেখিনি। এমনকি আমার দিকে তাকাতেও দেখিনি আজ পর্যন্ত। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আর যে কোন ভুল করেনা, অন্যায় করেনা সে মানুষ নয় মহা মানব। আমি এতদিনের জীবনে কোন মহা মানব দেখিনি ভাইয়া। সে হয়তোবা একদিন ভুল করেছে, অন্যায় করেছে কিন্তু তার প্রায়শ্চিত্তও করেছে এমনকি এখনো করছে। এই যে আপনি তার সাথে কথা বলেননা, তার আশেপাশে থাকেননা, এতে কিন্তু সে প্রচন্ড কষ্ট পায়। এমনকি তার চোখে পানিও দেখেছি আমি। এটা কি প্রায়শ্চিত্ত নয়? আপনি তার টাকায় কেনা কোন কিছু ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেননা এটা কি তার প্রায়শ্চিত্ত নয়? আপনি তার সাথে এক টেবিলে বসে খাননা সেজন্য আংকেলও তার সাথে খায়না এটা কি প্রায়শ্চিত্ত নয়? একটাদিনও সে পেট ভরে খায়না, একদিনও কেউ কি খেয়াল করেছে সেটা! দিনের পর দিন অনুশোচনায় ভুগেন তিনি, কেউ কি তার পাশে আছে! আমি তাকে দেখেছি অনুশোচনার অ*ন*লে দ*গ্ধ হতে। আপনার সাথে একটাবার কথা বলার আকুলতা তার মাঝে দেখেছি। এগুলো কি প্রায়শ্চিত্ত নয়? রাতের পর রাত ছাদে বসে একটা মানুষ নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়। শুধু তার অপরাধের বোঝা হালকা করতে। এটা কি প্রায়শ্চিত্ত নয়? এরকম আরও হাজারটা কারন আমি দেখাতে পারি। তবুও কেন ভাইয়া, তাকে ক্ষমা করতে পারেননি আপনি! আমি শুনেছি সে নাকি এডিক্টেড ছিল। কিন্তু এই কয়মাসে একবারও তাকে সিগারেট পর্যন্ত খেতে দেখিনি। যে ভালো হতে চায়, তাকে সুযোগ দিতে হয় ভাইয়া। দূরে ঠেলে দিয়েই যদি সব সমস্যার সমাধান করা যেত, তাহলে পৃথিবীতে কাছের বলে কেউ থাকতনা। আমি শুধু একজন নিঃসঙ্গ মানুষের হাত ধরতে চেয়েছি। তার সাথে আজন্ম হাঁটতে চেয়েছি এই স্বার্থপর দুনিয়ায়। আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছি ভাইয়া? ”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তিয়াসা। সাদিফ স্তব্ধ। রা*গ কি তার থেকে তার ভাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে! তানিশা অবাক তার ছোট বোনের কথায়। এত বড় কবে হল সে! একটা মানুষকে কতটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করলে তার আদ্যোপান্ত জানা যায়! তিয়াসা কি এতটাই নিবিড়ভাবে দেখেছে সাইফকে!
” আপু তোমরা চাইলে তোমাদের পছন্দের ছেলেকে আমি বিয়ে করব। তোমাদের অবাধ্য কখনোই ছিলামনা আর হবওনা। কিন্তু তবুও সেই মানুষটাকে দূরে সরিয়ে রেখোনা। ”
” তুই কি সাইফের ব্যাপারে নিজের সাথে বোঝাপড়া করেছিস তিয়ু? আবেগের কাছে নিজেকে সঁপে দিসনি তো? জানিসতো আবেগ একবার কেটে গেলে সারাজীবন তোকে কাঁদতে হবে। ”
” আমি নিজের সাথে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করেই তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখানে আবেগের কোন ঠাঁই নেই। ”
” তিয়াসা আমি তোমাকে আবারও ভেবে দেখতে বলছি। আমি চাইনা তুমি এমন কোন সিদ্ধান্ত নাও যাতে তোমার বাবা-মা কষ্ট পাক। আমার একটা কথায়ই তারা তোমাকে এখানে রাখতে রাজি হয়েছে। এখানে তানিশার সম্মানও জড়িয়ে আছে। ”
তিয়াসা সাদিফের দুইহাত ধরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, ” ভাইয়া আপনি চাইলেই সব ঠিকঠাক হবে। বাবা-মা কখনোই আপনার সিদ্ধান্তকে অসম্মান করবেনা। তাদের কাছে আপনি তাদের আরেকটা ছেলে। তেমনি আমিও নিজের বড় ভাই হিসেবে আপনাকেই গন্য করি। শুধু আপনি আর আপু রাজি হয়ে যান। তখন দেখবেন তারাও রাজি হবে। ”
সাদিফ কি করবে সেটা ভেবে বিভ্রান্তিতে পরে যায়। তিয়াসা মাথা নিচু করে আছে। তানিশাও হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছে সাদিফের দিকে। সাদিফও একঝলক তানিশার দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়। ওরা কি করবে ভেবে পায়না। অনেক সময় ধরে নিরবতা বিরাজ করে রুমটাতে। শেষে মুখ খোলে তানিশা।
” কিন্তু সাইফ যদি রাজি না হয়? ” তিয়াসার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। তিয়াসা ঝট করে মুখ তোলে। বোনের দিকে তাকিয়ে বুঝে নেয় তার সম্মতিসূচক মন্তব্য। ওর মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তানিশা রাজি হলে সাদিফও যে রাজি হবে সে এটা ঠিকই জানে। সাদিফ তানিশার দিকে তাকালে তানিশা চোখের ইশারায় নিরব সম্মতি জানায়। কিন্তু সাদিফ তখনও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে। তিয়াসা অপেক্ষা করছে সাদিফের সম্মতির।
” ঠিক আছে তোমরা যখন চাইছ তখন আমি এ ব্যাপারে বাবার সাথে কথা বলব। দুই পরিবার রাজি হলেই তবে এ সম্পর্ক সামনে এগোবে। কেউ একজনও যদি অসম্মতি জানায় তবে তখনই এ বিষয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে। ”
” ঠিক আছে ভাইয়া। আমি আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। ” তিয়াসা বেরিয়ে গেলে সাদিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। এসব কি হচ্ছে ওর মাথায় ধরছেনা।
” তানিশা তুমি সবকিছু ভেবে রাজি হয়েছ তো? তোমার পরিবারের কাছে আমি প্রস্তাবটা রাখব কেমন করে! তারা কি ভাববে। এসব ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। ”
” আপনি চিন্তা করবেননা। আমার বাবা-মা এতটাও অবিবেচক নয় যে তারা আপনাকে ভুল বুঝবে। আপনি এখন নিচে যেয়ে বাবা-মা’ র সাথে কথা বলুন। তারা রাজি থাকলে কাল সকালে আমার বাড়িতে কথা বলবেন। ”
সাদিফ বাবা-মায়ের কাছে এসে বিষয়টি জানালে কেউই অমত করেনা। তাদেরও তিয়াসাকে খুব পছন্দ। কিন্তু একটা ভয় তাদের মনে যদি তালিব শেখ রাজি না হয়।

ছুটির দিন থাকায় আজ সাদিফ দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছে। সাইফ ব্যাগ ভর্তি বাজার এনে রহিমা খালার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। রহিমা খালা সেগুলো সামলাতে ব্যস্ত। তিয়াসা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে রুমে এসেছে। শায়লা চৌধুরী সবাইকে খেতে দিবেন।
তিয়াসার খুব চিন্তা হচ্ছে। যদি আংকেল, আন্টি রাজি না হয়। অথচ ও জানেইনা রাতেই সাদিফ বাবা-মা’র সাথে কথা বলেছে। আবার ওর বাবা-মা’র ব্যাপারটাও মাথা থেকে ঝাড়তে পারছেনা।
সাদিফ, তানিশা একসাথে নাস্তা করেছে। তূর্ণাকে সাদিফ খাইয়ে দিয়েছে। খাবার পর তানিশা ওর বাবার সাথে কথা বলতে বলে সাদিফকে। সাদিফ ইতস্তত করে শেষে রাজি হয়।
তালিব শেখকে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানায়। তালিব শেখ তৎক্ষনাৎ উত্তর না দিয়ে সময় চায়। সবার সাথে আলোচনা করে তিনি জানাবেন।
তালিব শেখ বাড়িতে আলোচনা করে। তার আগে তিয়াসাকে ফোন দিয়ে ওর মতামত জানতে চায়। তিয়াসা নিজের সম্মতি জানিয়ে দেয়। অনেক বাকবিতন্ডার পরে বাড়ির সবাই সস্মতি দেয়।
যেখানে তিয়াসা রাজি সেখানে তাদের অসম্মতির প্রশ্নই আসেনা। আবার যে বাড়িতে নিজেদের বড় মেয়ে আছে সেখানে আরেক মেয়ের বিয়ের জন্য না করে দেয়া মানে এ বাড়ির সবাইকে অপমান করা। আর যেখানে তানিশা সুখে আছে সেখানে তাদের আরেক মেয়েও নিশ্চয়ই সুখে থাকবে। এরমধ্যে তানিশার সাথেও তাদের কথা হয়েছে। তানিশা নিজের মতামত জানিয়েছে।
পরদিন সকালে তালিব শেখ সাদিফকে ফোন দিয়ে তাদের মতামত জানায়।
সাদিফ তিয়াসাকে ডেকে সবকিছু জানিয়ে দেয়। তিয়াসা এবার একটু লজ্জাই পায়। ওর মন চাচ্ছে কদম তলী যেতে কিন্তু তানিশার এই অবস্থায় যাওয়ার কথা বলতেও বাঁধছে।
তানিশা সাদিফের কাছে এক অদ্ভুত আবদার করল। ও চায় সাদিফ নিজে গিয়ে সাইফকে প্রস্তাবটা দিক। সাদিফও ইতিউতি করে রাজি হয়।
রাতে অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে সাদিফ যায় সাইফের রুমে। সাইফ একটা উপন্যাস পড়ছিল। সাদিফকে নিজের রুমে দেখে সাইফের চোখে পানি আসে। কতদিন পর ভাইয়া নিজ থেকে ওর সামনে এসেছে!
” একটা কথা বলতে এসেছিলাম। তোর সময় হবে? ”
” আমি ফ্রি আছি ভাইয়া, তুমি বল। ” সাইফের উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বর৷
” অতীতে যা হবার হয়েছে। আমরা সবাই চাই তুই এবার থিতু হ। সব পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু কর। সেজন্য একটা পিছুটান প্রয়োজন। আন একারনেই আমরা তোর বিয়ের কথা ভাবছি। মেয়েও ঠিক করাই আছে। এবার শুধু তোর সম্মতির অপেক্ষা। ” সাইফ অবাক হয়ে তাকায় ভাইয়ের দিকে। ওর মোটেও ইচ্ছে নেই আবার বিয়ে করার। জীবনে অনেক ভুল করেছে। এই ভুলে ছাওয়া জীবনের সাথে আর কাউকে জড়ানোর ইচ্ছা নেই ওর। কিন্তু যেখানে ভাইয়া নিজ থেকে এসেছে সেখানে ভাইয়াকে ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছেনা। আজ কতদিন পর ভাইয়া ওর সাথে কথা বলেছে ভাবতেই মনটা খুশিতে ছেয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে, নিজের সাথে বোঝাপড়া করে সম্মতি জানায় সাইফ। একবার জানতেও চায়না মেয়েটা কে। ও কিছুতেই চায়না ওর অসম্মতিতে সাদিফের সাথে দূরত্ব আরও বেড়ে যাক।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here