মায়ার বাঁধন পর্ব -১৩+১৪

#মায়ার_বাঁধন🍂
১৩.
বিছানার ওপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ুয়া নয়নকে দেখে দুর্বোধ্য হাসল টিয়া। মনে মনে বলল,

-“বেয়াই মশাই, টিয়া এসে গেছে। এবার বুঝবেন মজা। যাওয়া আগে ঠিক সেদিনের ঝগড়ার প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়ব।”

ক্রুর হেসে সেখান থেকে প্রস্থান নেয় টিয়া। রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। না চাইতেও তার অধর কোণে মিটমিটি হাসির রেখা ফুটে উঠছে। হিয়া সবেই একটু চোখ বন্ধ করেছিল। টিয়ার আগমনে ব্যঘাত ঘটে তার। পাশ ফিরে দেখতেই ভেসে ওঠে টিয়ার মিটিমিটি হাসি। হিয়া ভ্রু কুঁচকায়। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

-“কী হয়েছে? এভাবে হাসছিস কেন? সত্যি করে আবার কী আকাম করেছিস?”

টিয়া হিয়ার কথা শুনে মনে মনে বলল,”এখনো কিছুই করিনি তবে শীঘ্রই করব।” তবে মুখে বলল,

-” তোর কী মনে হয় আমি কী শুধু আকামই করি?”

-“মনে হওয়ার কী আছে? যা চোখে দেখা যায় তা মনে করার দরকার পড়ে না।”

টিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু বলতে যায় কিন্তু থামিয়ে দেয় হিয়া। হাই তুলতে তুলতে বলে,

-“বাজে বকা বন্ধ করে রেস্ট কর আর আমাকেও রেস্ট নিতে দে।”

হিয়া উল্টোদিক ফিরে শুয়ে পড়ে। টিয়া মুখ ভেংচি কেটে অনত্র তাকায়।

—–
খেয়েদেয়ে শুয়ে বসে দিনটা বেশ ভালোই কেটে যায় তুরানের। তবে আজ বউটা তার বড্ড বেইনসাফি করছে তার সঙ্গে। একটু সময়ও তাকে দিচ্ছে না। এই যে এখন ঘুমানোর সময়। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বেজে দুই মিনিট চলছে অথচ এখনো তার ঘরে ফেরার নাম নেই। অজানা এক আতঙ্কে খচখচ করছে তুরানের অন্তরিক্ষ। তার ধারণা যদি সত্যি হয় তবে আজ রাতটা তার জন্য হারাম হয়ে যাবে হয়তো। বউ ছাড়া কী ঘুম নামবে চোখে? এই যে এই কয়েকটা দিন বউটা তার পাশেই গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে থাকে। ক্ষনে ক্ষণে সে একটু উঁকিঝুঁকি মে’রে দেখে নেয় তার ঘুমন্ত পরীটাকে। সেই সুযোগ বোধহয় আজ আর পাবে না। ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুরান। একটা সিগারেট ধরিয়ে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে।

তুরানের সমস্ত উদ্ভট ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে কিছুক্ষণ বাদেই নীরা প্রবেশ করে ঘরে। আশেপাশে তাকিয়ে তুরানকে না দেখতে পেয়ে এগিয়ে যায় বেলকনিতে। তুরান টের পায় তবু ফেরে না। নীরা কিছুক্ষণ সেভাবেই দাড়িয়ে থেকে তুরানের এটেনশন পেতে চেষ্টা করে কিন্তু ফলাফল শূন্য। অবশেষে খুকখুক শব্দ করে ওঠে। তুরান তবুও ফিরে তাকায় না। সিগারেটে টান মে’রে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,

-“কিছু বলবে?”

-“একটা কথা ছিল। রাখবেন?”

-“হুম, শুনছি বলো।”

-“ছাদে যাবেন?”

এ পর্যায়ে তুরান পেছনে ঘুরে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় নীরার দিকে। নীরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

-“ন না মানে আসলে রাতের আকাশটা আজ বড্ড বেশিই সুন্দর। থালার মতো বিশালাকারের চাঁদ উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে বসে চন্দ্রবিলাশ করলে মন্দ হতো না।”

তুরান রাজি হয়। একটু আগেই যার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ছটফট করছিল এখন তার ডাকে সারা দেবে না তাই আবার হয় নাকি। তবে প্রকাশ্যে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল সে কিন্তু ভেতরে ভেতরে উত্তেজনার ত্রুটি নেই। সিগারেটে শেষ টান মে’রে বেলকনি থেকে ফেলে দিতে দিতে বলল,

-“চলো তবে। মন্দ না হলে আমারও আপত্তি করার কিছু নেই।”

নীরার মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। তুরান আড়চোখে উপভোগ করে নেয় সে দৃশ্য। আড়ালে নিজেও মুচকি হাসে।

—–
ভর জ্যোৎস্না রাত। এক জোড়া কপোত-কপোতী মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে উপভোগ করছে গোটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দুজনেই প্রকৃতিতে বিভোর। কারোও মুখে রা শব্দটুকু নেই। বিশালাকৃতির চন্দ্রের চতুর্দিকে বিস্তৃত ঝিকিমিকি তারকার ঝাক। জ্বলছে মিটিমিটি। মৃদু হাওয়ায় দুলছে গাছপালা। দুলছে কপোত-কপোতীর হৃদয়। অকস্মাৎ তুরান মুখ খোলে। আকাশের দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে,

-“গাইতে পারো?”

নীরা চমকে উঠল। ছটফটে চাহনিতে তাকালো তুরানের পানে। বেশ দ্রুতই বলল, “নাহ, নাহ।”

তুরান কিঞ্চিৎ হাসল। নীরার আতঙ্কিত মুখপানে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

-“জানি মিথ্যে বলছ। গেয়ে শোনাও ঝটপট।”

নীরা নড়েচড়ে বসল। পুনরায় আর্তনাদ করে বলল,
-“সত্যি বলছি পারি না।”

তুরান অভয় দিয়ে বলল,
-“ভয় কীসের?শুরুটা তুমি করো শেষটা না হয় আমিই করলাম।”

নীরা দ্বিগুণ চমকায়। সত্যি সত্যি তুরান গাইবে? তবে সে খুব করে চাইছে তুরানই আগে সুর তুলুক। সে না হয় শেষটুকু ধরবে। কিন্তু তার সেই ভাবনায় ভাটা পড়ে তুরানের মিহি কন্ঠের আকুতিভরা বাক্যে।

-“এই পূর্ণিমা তিথি। তারকা ঝিকিমিকি। মৃদু পবনে দুলছে হৃদয়। এমন পরিবেশে বধুরুপী সুন্দরীর নিকট ছোট্ট একটা আবদার তো করাই যায়। নিশ্চয়ই সে আশাহত করবে না?”

নীরা কী বলবে ভেবে পায় না। খানিকক্ষণ যাবৎ যু’দ্ধ চালায় নিজের মনের সঙ্গে। মানুষটাকে ফিরিয়ে দিতে মন সায় দিচ্ছে না। এমন আকুতি কী অবজ্ঞা করা যায়? তবুও
ওই যে ইতস্তততা। কিয়ৎক্ষণ চলল নিরবতা। পরপরই শোনা গেল ধীরুজ গতিসম্পন্ন মিহি কন্ঠের গান,

(((নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে

নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে

বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নেবেন)))

কথা মতো ঠিকই তুরান শেষটায় সুর মিলিয়েছিল। নীরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছে তার বরের মাধুর্যপূর্ণ কন্ঠস্বরে সঙ্গীত। আবেশে ছেয়ে গেছে হৃদয়। প্রশান্তি মিলেছে অন্তঃকোণে। কতবার যে দুজনের দৃষ্টি একত্রে হয়েছে তার কোনো হিসেবে নেই। প্রতিবারই নীরা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেলেছে কিন্তু তুরান এক চুলও নড়ে নি। বরং পুরোপুরি উপভোগ করেছে নীরার লজ্জারাঙা মুখশ্রী। অদ্ভুত শান্তি খুঁজে নিয়েছে সে মুখশ্রীতে। আলতো হাতে কতবার যে ছুয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু শেষমেশ হয়ে ওঠেনি। সময়, সম্পর্কের বেড়াজালে কঠিন ভাবে আটকে গেছে সে।
না পারছে গিলতে না পারছে ওগরাতে।

—–
রাত করে ঘুমোনোর ফলে সকালে ঘুম ভাঙতে বেশ দেড়ি হয় তুরান-নীরার ৷ ছাদ থেকে নেমে এসে দু’জনে ঘুমতেই পারছিল না। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে শিউরে উঠছিল সর্বাঙ্গ। দু’জনের প্রতি দু’জনের তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিল। লজ্জা, সংকোচ জেঁকে বসছিল। আগের রাতগুলো তো এতোটা আকর্ষিত ছিল না তবে আজ কেন এমন লাগছে? ভাবনা চিন্তার মধ্যে দিয়েই একপ্রকার কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ল তারা। ঘুম ভাঙল কারো বিকট চিৎকারে। নীরা ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। তুরানও উঠে বসেছে। একে অপরের চোখ চাওয়াচাইয়ি করে বলল,

-“এটা টিয়ার গলা না?”
#মায়ার_বাঁধন🍂
১৪.
নয়নের ঘরের দরজার ঠিক সামনে কোমরে হাত রেখে পড়ে আছে টিয়া। ক্ষণে ক্ষণে “মা গো, বাবা গো” বলে চিৎকার করে উঠছে। তাকে ঘিরে দাড়িয়ে বাড়ির সকলে। হিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে কপালে হাত রেখে দাড়িয়ে। চোখ মুখ কুঁচকে রেখেছে। নয়ন সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করছে টিয়াকে। এরই মধ্যে নীরার মা মালা শিকদার কোমর ঝুকিয়ে মেঝেতে আঙুল ঘষা দিলেন। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকে নিয়ে হাঁক ছেড়ে উঠলেন,

-“এখানে তেল পড়ল কী করে?”

সকলেই ওনার কথায় ভীষণ আশ্চর্যন্বিত। এখানে তেল পড়ার বিষয়ে কেউ-ই অবগত নয়। মালা শিকদারের কথা নীরার ছোট চাচি হেনা শিকদার প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলেন,

-“কী তেল আপা?”

-“সরিষার তেল।”

-“কিন্তু এখানে এভাবে তেল ফেলল কে? নিশ্চয়ই কোনোটায় গায়ে মাখতে গিয়ে এমন আকাম করেছে।”

হেনা শিকদারের কথায় সহমত পোষণ করে মালা শিকদার বললেন,

-“হুম, হতেই পারে তবে তা স্বীকার করছে না কেন কেউ?কে ফেলেছ দ্রুত বলো। আর ফেললেই যখন পরিষ্কার কেন করোনি? দেখলে তো কত বড় একটা দূ’র্ঘ’ট’না ঘটে গেল।”

হেনা শিকদার সন্দিহান দৃষ্টিতে নয়নকে পর্যবেক্ষন করলেন। বললেন,

-“নয়ন তুই করিস নি তো? বকা খাওয়ার ভ’য়ে চুপ করে আছিস? নয়তো তোর দরজার সামনেই বা এলো কেন?”

আচমকা আ’ক্র’মণে নয়ন বেকুব বনে গেল। এটা কোনো যুক্তি হলো? তার ঘরের সামনে অন্য কেউ ফেলতে পারে না নাকি? অদ্ভুত! নয়ন নিজেকে তটস্থ হয়ে কিছু বলতে নেবে কিন্তু তখনই মালা শিকদার হেনা শিকদারকে ধমকে বলে ওঠেন,

-“আহ ছোট, অযথাই ছেলেটাকে দোষারোপ করার কী মানে আছে? তারচেয়ে বরং মেয়েটাকে টেনে তোল।”

হেনা শিকদার কিছু বললেন না৷ শুধু মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলেন। জোরাজুরি করে টেনে তুললেন টিয়াকে। টিয়ার শরীরের একপাশ পুরো তেলে মাখামাখি অবস্থা। সোজা হয়ে দাড়াতে পারছে না অব্দি। প্রচুর লেগেছে মেয়েটার। ওকে দেখে পাশ থেকে যে যার মতো আহাজারি করল। হেনা শিকদার ওকে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরের দিকে। এখনই জামাকাপড় পাল্টে ঔষধ খায়িয়ে দিতে হবে। হিয়াও গেল পেছন পেছন। নয়ন ধপ করে দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেল। মালা শিকদার বাড়ির কাজের মেয়েটিকে বললেন, সুন্দর করে সবকিছু পরিষ্কার করে ফেলতে। তিনি ব্রেকফাস্ট সার্ভ করতে যাচ্ছেন।

ফ্রেশ হয়ে এসে মায়ের মুখে এসব কাহিনী শুনে পুরোই হতবাক নীরা। কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি। কুটুম বাড়িতে এসে একরাতের মধ্যেই এমন ঘটনা ঘটে গেল। তুরানের কানে গেলে তাকে কতটা ছোট হতে হবে? ভাগ্যিস তুরান এখনো ওয়াশরুমে। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে এসে যখন শুনবে টিয়ার সেসময়ে করা চিৎকারের কারণ তখন কী হবে? ভেবেই আঁতকে উঠছে নীরা।

—–
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। শুরু হয়ে গেছে নীরাদের বাড়ি ফেরার তাড়া। নীরার বাবা, মা সহ বাড়ির সকলেই ওদের ছাড়তে নারাজ। কিন্তু তুরান সকলকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে। কথা দিয়েছে সময় করে এসে বেড়িয়ে যাবে অনেকদিন। সেই সঙ্গে জানিয়েছে ভার্সিটির ঝামেলার কথা। সব শুনে সকলে কোনো রকমে বুঝেছে। তবে নীরার মা, চাচি মেয়েকে ছাড়ার কষ্টে পুনরায় কান্না জুড়ে দিয়েছেন। নীরারও মন কাঁদছে তবে এই ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে সকালের ঘটনা তুরান কিছু জানতে পারেনি। টিয়া নিজেই তুরানকে কিচ্ছুটি বলেনি। নীরা বলতে নিলেও নিজে থেকে কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। চঞ্চল হলেও মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি আছে। মনে মনে টিয়ার ওপরে কৃতজ্ঞ সে। এভাবে তাদের বাড়ির সম্মানটা বাচিয়ে দিল। কিন্তু নীরা তো আর জানে না টিয়া কেন সব দোষ নিজের কাঁধে নিল। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়েছে সে। এখন উপায় আছে অনত্র পালাবার? না চাইতেও নয়নের ওপর তার ক্ষোভ পাহাড়সম হচ্ছে। সেই যে রিসেপশন পার্টিতে এক্সিডেন্টলি ধাক্কাটাকে টিয়া সিরিয়াসলি নিয়ে নিল। তারপর এই যে আজ নিজে থেকে তেল ফেলে নয়নকে জব্দ করতে গিয়ে নিজেই জব্দ হয়ে গেল। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হলেও টিয়ার সকল ক্ষোভের চূড়ায় গিয়ে নয়নের নামটিই ঠেকছে। কোমরে চোট নিয়ে সে সবকিছু সামলে নিচ্ছে আর মনে মনে নয়নের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে।

——
চলন্ত গাড়িতে সকলের মনের মধ্যে একেক রকম উত্তেজনা। টিয়ার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। নয়নকে জব্দ করার আরেকটা কলকাঠি সে নেড়েছে। কৌশলে সুমনের কাছ থেকে নয়নের ফোন নম্বরটা জোগার করে নিয়েছে। এবার শুধু বাড়ি ফেরার অপেক্ষা। হিয়ার মনটা উদাসীন। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে সে। মনে হচ্ছে তীব্র দামী কিছু থেকে নিজেকে বিচ্যুত করছে। তুরান -নীরা একে অপরের পানে চোখাচোখিতে ব্যস্ত। তুরান তাকালেই নীরা চটজলদি চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার তুরানের অগোচরে পুনরায় উঁকি দিচ্ছে। গাড়ির মিররে স্পষ্ট সেই দৃশ্য চোখে ভাসছে তুরানের। আনমনেই মুচকি হেসে ফেলছে সে।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছাতে রাত নেমে এলো। হিয়া-টিয়া হৈ হৈ করতে করতে ঢুকে গেল ভেতরে। নীরাও ধীর পায়ে এগোলো। একটু যেতেই পুনরায় থেমে গিয়ে দেখল তুরান পাশে নেই। সে চটজলদি পেছন ঘুরল। তুরান গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু একটা করছে। নীরা ভ্রু কুঁচকায়। ব্যাক করে পেছনে। একেবারে তুরানের মুখোমুখি দাড়ায়। সম্মুখে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তুরান চকিতে তাকায়। ভনিতা ছাড়াই বলে,

-“দাড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে যাও।”

নীরা অপ্রস্তুত হয় খানিক। আসলেই, সে দাড়িয়ে আছে কেন? কুল-কিনারাহীণ হয়ে অবশেষে বলেই ফেলে,

-“আপনি যাবেন না?”

-“আমার একটু কাজ আছে। তুমি এগোও।”

নীরা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে চলে যায়। তুরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিক পানে চেয়ে রয়।

বাড়িতে ঢুকতেই বাজে আরেক বিপত্তি। জাহানারা চৌধুরী এখানে নেই হয়তো এশারের নামাজ আদায় করছেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে রিনা হট্টগোল শুরু করে দিয়েছে। সে সোফায় বসে নেলপলিশ পড়ছিল। নীরাকে দেখা মাত্রই একপ্রকার সবকিছু ফেলে ছুটে আসে। নীরা শুরুতে বেশ অবাক হয়। এই রাতে রিনা নেলপলিশ কেন পড়ছে? অবশ্য অবাস্তব কিছু নয় সে যা মেয়ে এমনটা হতেই পারে। নীরা চুপচাপ ওপরে চলে যেতে গেলে রিনা খোঁচা মে’রে বলে ওঠে,

-“কী অভদ্র মেয়ে রে বাবা! বলি বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে এসে কী সা’পের পাঁচ পা দেখলে নাকি। বড়দের সম্মান টুকু করছ না। এই যে আমি এখানে বসে অথচ একটি কথাও না বলে তুমি গটগটিয়ে ওপরে চলে যাচ্ছ? বাবা-মা এই শিক্ষা দিল বুঝি?”

যেই ভ’য়ে নীরা আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়নি ঠিক হলোটাও তাই। এমনিতেই এতটা পথ জার্নি করে ক্লান্ত এখন আবার এই মেয়ের প্যানপ্যানানি। উফ,জাস্ট অসহ্য।

নীরা মাথা নত করে নেয়। ছোট্ট করে বলে,

-“দুঃখিত বড় ভাবি। আমি ভীষণ ক্লান্ত বিশ্রামের প্রয়োজন।”

-“আহা এমন ভাবে বলছ যেন বাবার বাড়ি নয় ক্ষেতে লাঙল চষতে গিয়েছিলে। তা হবে নাই বা কেন ফকিন্নি জাত বলে কথা।”

নীরার চোয়াল শক্ত হয়। শরীরের প্রতিটি শিরায় শিরায় আগুন জ্বলে ওঠে। এই মেয়েকে তুলে আছাড় মা’রা’র ক্ষমতা সে রাখে কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাকে সব হজম করতে হচ্ছে। নীরা আর একটি কথাও বলে না। চুপচাপ ওপরে উঠতে নেয়। রিনা আবারও গমগমিয়ে বলে ওঠে,

-“আরেহ আরেহ কী অসভ্য মেয়ে! আমি কী তোমাকে যেতে বললাম? এভাবে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছ যে?”

নীরা ঘুরে দাঁড়ায়। নাহ আর সহ্য করা যাচ্ছে না। সে কিছু বলতে মুখ খুলতেই শোনা যায় এক পুরুষালী রাশভারি কন্ঠের চাপা গর্জন,

-“ও না হয় ছোট লোক, ফকিন্নি ঠিক আছে। ওর বাবা -মা ওকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারে নি। কিন্তু আপনি তো যথেষ্ট বড়লোক পরিবার থেকে বিলং করেন তাহলে আপনার ব্যবহার এতো নিন্মমানের কীভাবে? আপনার শিক্ষিত বাবা-মা বুঝি আপনাকে এই শিক্ষা দিয়েছেন? পায়ে পা লাগিয়ে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করতে?”

রিনা তেঁতে ওঠে। চোখ বড বড় করে বলে,

-“তুমি ওই মেয়ের জন্য আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ তুরান? আসলেই ছেলেরা বউ পেলে দিনদুনিয়া ভুলে যায়। বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকে।”

-“যেমনটা আমার ভাইয়ের হয়েছে তাই না?”

-“তুরাননননন। তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ?”

-“নাহ শুধু সঠিক শিক্ষা দিচ্ছি। প্রথম বার চোখে পড়ল তাই শুধু সতর্ক করছি নেক্সট টাইম আমার বউয়ের সঙ্গে এমন বিহেভিয়ার দেখলে আমি কিন্তু ভাইয়াকে জানাতে বাধ্য হবো। মাইন্ড ইট।…চলে এসো নীরা।”

তুরান নীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায়। নীরা আপ্লূত দৃষ্টিতে চেয়ে। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তুরান তার হয়ে কথা বলেছে।

.
চলবে,
®অহমিকা মুনতাহাজ নিশি
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here