শাওয়াম পর্ব -১৫+১৬

#শাওয়াম
পর্ব ১৫
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

‘হুম কিন্ত।দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন আমি ফেসবুক আইডি খুলি।নতুন স্কুল নতুন বন্ধু বান্ধব।আর সাদাফ নামটা ভুলতে না পারলেও ভোলার চেষ্টা করতাম।মা বাবা সাপোর্ট করতো।নিজের মতো বাঁচতে শিখতে হবে।ফেসবুকে অনেকদিন থাকার পর একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়।আমি মোটামুটি পরিচিত অপরিচিত সবারই রিপলাই করতাম।ছেলেটার নাম ছিল সায়েম।সায়েমের সাথে টুকটাক কথা হতো।এক সময় আমরা ভালো বন্ধু হয়ে যাই।ভিডিও কলে অবধি কথা হয়েছে।এক সময় সায়েম আমাকে প্রপোজ করে।আমি অবাক হই।সত্যি বলতে সায়েমকে নিজেও মনে মনে পছন্দ করা শুরু করেছিলাম।আমরা সেম ক্লাস ছিলাম।স্কুল আলাদা।একটা সময় পর আমি সায়েমকে একসেপ্ট করি।অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে।আমার খুব কেয়ার করতো।খুব সাপোর্ট করতো।একি এলাকায় আমরা থাকতাম পরে সেটাও জানতে পারি।দেখা সাক্ষাৎ হলো।কিন্ত আমার কপাল এবার ও ধোঁকা খেলাম।

‘আবার ধোঁকা?কিন্ত উনি না তোমাকে নিজেই প্রপোজ করলো।’

‘সে আর বলে লাভ আছে? আমি তিন মাস পর জানতে পারি সায়েম মূলত আমার ঐ স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড কে পছন্দ করতো।আনিশা আর আমি সব সময় একসাথে পড়তে যেতাম আসতাম।ও আমাদের দেখে নেয়।সত্যি বলতে জন্ম থেকেই তো সুন্দরী উপাধি পেয়েছি,আনিশা আমার থেকেও সুন্দরী ছিল।একদম বলিউডের নায়িকা বলতে পারো।তিন মাস পর হুট করে সায়েম কেন যেন আমাকে ইগনোর করে।আগের মতো মেসেজ করেনা।কল করেনা।আমি খুব কাদতাম।একদিন আনিশার থেকেই হুট করে জানতে পারি সায়েমের সাথে ও রিসেন্টলি রিলেশনশিপে গেছে।আগে কাছের বন্ধুদের থেকে ধোঁকা খেয়েছি।এজন্য আনিশা যত ক্লোজ হোক ওকে কখনো সায়েমের ব্যপারে কিছু বলিনি আমি।এজন্য ঐদিন শুনে কি রিয়েক্ট করব বুঝতে পারছিলাম না।সায়েমকে মেসেজ করতেই ও সব স্বীকার করে।ও আনিশাকে অনেক পছন্দ করতো।যেহেতু আমি আর ও একসাথে থাকি এই হিসেবে ও আনিশার সাথে সাথে আমার ফেসবুক আইডিতে ও এড হয়।ও ভেবেছিল আমার মাধ্যমে ও আনিশার সাথে ক্লোজড হতে পারবে।কিন্তু ঘটে অন্য কিছু।আনিশা ওকে ইগনোর করতো।এজন্য সায়েম ভেবেছিল আনিশা যদি না হয় তবে আমার সাথে ও রিলেশনে আসবে।ও নিজেই অনুভব করেছিল আমি ওর প্রতি উইক হয়ে পরেছিলাম।সেটাই ঘটলো।আনিশার পাত্তা না পেয়ে ও আমাকে প্রপোজ করে।এর মধ্যেও আনিশার সাথে ঠিকই যোগযোগ করে।আমাদের রিলেশনের তিন মাস।তখন আনিশা সায়েমের প্রস্তাবে রাজি হয় এই কারণে সায়েম আমার সাথে ব্রেকাপ করে।’

‘তারপর।’

‘জানো সুবহান ঐদিন এত কান্না করেছিলাম আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না।বার বার মনে হচ্ছিল কি দোষ ছিল আমার যাকেই ভালোবেসে ভালো থাকতে চাই সেই আমাকে ধোঁকা দেয়।সাদাফের বিশ্রী হাসিটাও এক সময় হজম করতাম,ভালোবাসার চেষ্টা করব বলে।সে তো গেল।সায়েম এলো।বিশ্বাস করো ও আমার এত ভালো বন্ধু হয়েছিল এটলিস্ট কেউ বলবে না সে আমার সাথে এমন করবে।ও আমাকে বিয়ে করতে চাইতো।এমনকি সাদাফ আমার সাথে যা যা করেছে ,রেপড হওয়ার ঘটনাও আমি সায়েমকে বলি।কারণ আমি ওকে ঠকাতে চাইনি।আমি ভেবেছিলাম সে সব জেনে আমাকে ভালোবেসেছে।সে ব্যতিক্রম।কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হলাম।’

‘তারপর কি করলে? তুমি না বলেছিলে সায়েম আবার ফিরে এসেছিল তোমার জীবনে?’

‘হুম।সায়েম চলে যাওয়ার পর আমি পড়াতেই মনযোগ দিলাম।আনিশার সাথে ইচ্ছা করে সম্পর্ক খারাপ করলাম।যাতে ভালো থাকতে পারি।এস এসসির রেজাল্ট ভালো হলো।জানো সায়েমকে কিছুতেই ভুলতে পারতাম না।অনেক বেশি ভালোবাসতাম।না হলে বলো আমি যে রেপড হয়েছি সেটা আমার মা বাবাকে ও জানাইনি সায়েম ছাড়া।একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার সময় বিপত্তি ঘটে।’

‘কিসের বিপত্তি?’

‘প্রথম দিন ক্লাসে গিয়েই আমি চমকে যাই।আমি যেই কলেজে ভর্তি হয়েছি সায়েম ও একি কলেজে।আর আমাদের বিভাগ একি ছিল।পুরানো ঘায়ে কেউ যেন খোচা দিল।ওর সামনে দিয়ে যেতে কষ্ট হতো।তবে একটা বিষয় খেয়াল করলাম সায়েম ইচ্ছে করে আমার আশেপাশের সিটে বসতো।মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতো।আমার মনে হতো সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।কথা বলার বাহানা খুজতো।একদিন টিফিন পিরিয়ডে ও আমার হাত ধরে বসে।আমি বাধা দিতে চাইলে ও শুধু দশ মিনিট সময় চায়।ও একটা কথাই বলে ক্ষমা করে দিতে।আনিশা নাকি পরে ওর থেকে ভালো ছেলে পেয়ে ব্রেকাপ করে দেয় ওর সাথে।ও বুঝতে পারে আমি ওকে সত্যি ভালোবাসতাম।ও ব্যাক করতে চায়।সত্যি বলতে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম ওকে সুযোগ দিতে।ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়।আর ব্যক্তিটি যদি হয় মনের মানুষ তাহলে তো সাত খুন মাফ।’

‘এটাই যদি হয় তবে সায়েম নামটা কেন আজ তোমার সাথে যুক্ত নেই?’

‘ভালোবাসা কয়বার হয় বলোতো?’

‘শুনেছি একবার।কিন্তু আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত নই।আমার জীবনের প্রতিটি বসন্ত ভালোবাসাহীন একাকিত্বের।তাই ভালোবাসার ব্যখা জানা নেই।’

‘কে বলেছে ভালোবাসা একবার হয়?
আমি যদি বলি একবার না বারংবার,
যতদিন না মানুষটা সঠিক নির্বাচন করা হয়।’

‘বুঝলাম না।’#শাওয়াম
পর্ব ১৬
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

১৭

শাওয়াম নামের আড়ালে থাকা সেই মায়াবতী আবার বলতে শুরু করলো আপন গতিতে। আর আমি? কেবল শ্রোতা হয়েই বসে আছি।একের পর এক শব্দমালার খেলা মাথায় গেঁথে চলেছি।

‘আমার জীবনের কোন স্বপ্নই পূরণ হয়নি জানোতো। এডমিশন পরীক্ষার সময় কতোইনা কষ্ট করলাম। আমার মা বাবার খুব শখ ছিল আমার নামের পাশে ছোট্ট করে ডা: শাওয়াম লেখা থাকবে। বন্ধ কেবিনে আমি চেয়ার টেবিলে বসে একটা দুটা করে প্রেসক্রিপশন লিখতে থাকব। দরজার বাইরে থাকবে এক ঝাঁক রোগীর সিরিয়াল।আমার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেল।যাস্ট এক পয়েন্টের জন্য আমি মেডিকেলে চান্স পেলাম না।পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। কোনো কিছুই ভালো লাগতো না।সায়েমের সাথে তখন আমার সম্পর্ক ও বেশ চলছে।ও নিজেও তখন এডমিশন পরীক্ষার্থী। মা বাবা আর সায়েমের পুরো সাপোর্টে ভাবলাম আরেকবার সুযোগ দেই জীবনকে। আমি নামাজের পাটিতে বসেও কাদতাম।আমার মা বাবা আমার জন্য ব্যর্থ হলো! আমি ডাক্তার হতে পারলাম না। সত্যি বলতে আল্লাহ যা চান তার বাইরে তুমি চাইলে কখনোই তা পাবেনা।কারণ আল্লাহ চান বান্দার জন্য উত্তম কিছু। সেটাই হয়তো ঘটে গেল। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম ডি এমসির ক্লাসরুম, অপারেশন থিয়েটার, ঘাড়ে স্থেতিস্কোপ ঝুলানো। অথচ আল্লাহ চাইলেন আমি হাটব শাহবাগের অলিগোলির মাঝে,কলাভবনের বট গাছতলায় বসব, সামাজিক বিজ্ঞান ভবনের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াব আর কখনো বা আমার দুপুরের লান্চ হবে হাকিম চত্বরের খিচুড়ি, ডাকসুর ২০ টাকার এক প্লেট ভাত, ভর্তা, ডাল আবার এক টাকার চা ও। আমি কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখিনি। অথচ সেই মরীচিকার মাঝেই লেখা ছিল আমার ভবিষ্যত। ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। আশা করিনি চান্স পাব।পেয়েও গেলাম। অবশেষে যুক্ত হলাম সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে।আমার নতুন পথ চলা আর সুফিয়া কামাল হলে কাটানো দিন।আমার সেকেন্ড হোম হলো সুফিয়া কামাল হল। এর মাঝেও ডাক্তার হবার স্বপ্ন আমার পিছু ছাড়েনি। আমি কোন মতেই খুশি ছিলাম না।পড়াশোনাতেও তেমন মনযোগ দিতে পারতাম না।সায়েম অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু ও কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলোনা। ঢাকার ই এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। এর মধ্যে আত্নীয় স্বজন কারো কাছে আমার মা বাবা মুখ দেখাতে পারতোনা। কারণ আমি ডাক্তার হতে পারিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাও কিনা সমাজবিজ্ঞানে চান্স পেয়েছি শুনলেই যেন নাক সিটকাতো। অথচ ঐ আত্নীয় স্বজনগুলো কলা ভবনের গেট টা পার হয়ে ভেতরে কখনো এসেছে কিনা সেটাই সন্দেহ। মানুষের এই স্বভাব অন্যের সমালোচনা করা।নিজের কি আছে সেটা একবার ও দেখার চেষ্টা করেনা এরা। ‘

‘আপু তুমি বললে না ভালোবাসা আবার এসেছিল তোমার জীবনে? কিভাবে?’

‘সাদাফ আমার জীবনের এক কালো অধ্যায়।তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছিলাম। আর সায়েম আমার প্রথম ভালোবাসা। সে আমার জীবনে জোর করে আসেনি এসেছিল হুট করে। সায়েম ভারসিটিতে ভর্তি হবার পর কেমন যেন পাল্টে যেতে লাগল। ওর তুলনায় আমার ক্লাস পড়ার চাপ বেশি থাক তো। সারাদিন ক্লাস করে হলের গণরুমে আসার পর মন চাইতোনা ফোন করে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রেমালাপ করি। ও আমাকে শুধু সন্দেহ করতো।অথচ দেখো আমার এখনো অবধি একটা ফ্রেন্ড সার্কেল ই নেই। সেখানে ও ভাবতো আমি নতুন কাউকে বেছে নিয়েছি। ‘

‘দূরত্ব ভালোবাসায় ভাঙন ধরায়। হয়তো এজন্যই। ‘

‘ভাঙন না। তবে ওর আসল রূপ শুধু চিনলাম। আর জানলাম সায়েম নয় আমার ভালোবাসার মানুষটিকে আমি এখনো জীবনে পাইনি। ‘

‘ফাইরাজ ভাই কি তবে,,,,’।

‘বলতে দে আমাকে।’

‘বলো।’

‘সায়েম কে এত বছরেও ভালোবেসে ভালোবাসাটা পেলাম না। অথচ দেখ এক মাসের ভালোবাসা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ভারসিটিতে ওঠার পর তখন রুমমেট কিছু আপুদের দেখি টিকটক নামক একটি এপ নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকে তারা। দিন নেই রাত নেই যখন তখন হুটহাট ভিডিও বানিয়ে আপলোড করে।আমার বেশ লাগতো। আমিও একদিন শখের বসেই এপটা নামিয়ে ফেলি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি, এক ভগ্ন হৃদয়ের সাথে আরেক ভগ্ন হৃদয়ের জোড়া লাগানোর পর্বের সূত্রপাত।’

চলবে————

চলবে—————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here