শাওয়াম পর্ব -১৯+২০

#শাওয়াম
পর্ব ১৯
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

১৯

ঘড়িতে প্রায় এগারোটা ত্রিশ ছুঁইছুঁই। নিউমার্কেটের এক নম্বর গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে শাওয়াম। চেহারায় বিরক্তির ছাপ। সেই সকাল সাড়ে দশটা থেকে এসে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে সে। ফাইরাজের আসার নাম গন্ধ নেই। শাওয়ামের নিজের আসার কথা ছিল দশটায়। ইচ্ছাকৃতভাবেই আধ ঘন্টা দেরী করে এসে উপস্থিত হয়েছে। ফাইরাজকে আধ ঘন্টা অপেক্ষা করাবে ভেবে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছিল সে। কিন্ত আসতে না আসতেই হলো উল্টটা। নিজের জালে নিজেই আটকে পড়ার মতো অবস্থা। ফাইরাজকে এতবার টেক্সট করছে প্রতিবাদ এক উত্তর আসছে, আসছি আর মাত্র দশ মিনিট। দশ মিনিট করতে করতে এক ঘন্টা পেরিয়ে গেল।

দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে যাচ্ছে শাওয়ামের। কোথাও বসার জায়গা নেই। তার মধ্যে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে শাওয়াম কখনো দু পা সামনে এগিয়ে গেল টের পেল না। ঘটলো আরেক বিপত্তি। বেশ মাঝবয়সী একটা লোক তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে পাশ কেটে হেঁটে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় শাওয়াম হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। পিছু ঘুরে একবার দেখলো লোকটার গতিবিধি। এতক্ষণে বেশ দ্রুত পা চালিয়ে তার থেকে দূরে চলে গেছে লোকটা। শাওয়াম আশ পাশ ফিরে একটু নিজের অবস্থান দেখার চেষ্টা করল। না ধাক্কা লাগার মতো কোন কারণ খুঁজে পেল না সে। নিউমার্কেটের গেটের সামনে বসা এক ফুলের দোকানের কাছে দাড়িয়েছে সে। বেখেয়ালিভাবে দু কদম এগিয়ে গেলেও কোন পথচারীর সাথে ধাক্কা খাওয়া সহজ না। আর লোকটা যেভাবে তাকে ধাক্কা দিয়েছে সেটাকে ইচ্ছাকৃত বলা যায় নয়তো ধাক্কা লাগলে সর্বোচ্চ তার হাতের সাথে লাগতে পারে স্পর্শকাতর অঙ্গের সাথে কেন? একদম বুকের ডান পাশের দিকে। মুহূর্তেই মুখটা মলিন হয়ে যায় শাওয়ামের। ইটস নট এন এক্সিডেন্ট বাট অন কাইন্ড সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট। শুধু শাওয়াম নয় প্রতি নিয়ত প্রতিদিন প্রতি মিনিটে কত মেয়েরা রাস্তাঘাটে এমন বিশ্রী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় সেটা বর্ণণা করা সম্ভব নয়। যেখানে লোকের সমাগম বেশি সেখানেই যেন একদল হায়েনারে ঘাপটি মেরে থাকে, সুযোগ খুঁজে আর সুযোগ পেলেই তাদের বিবেকে বাধেনা এরকম জঘন্য কাজ করতে। একে তো নিজের অতীত, শাওয়ামকে প্রতি রাতে স্বপ্নের মাঝেও হাতছানি দিয়ে যায় তার পর সকাল সকাল এমন বিশ্রী ঘটনা, শাওয়ামের মুডটাই খারাপ হয়ে গেল।

এদিকে আকাশ মেঘলা। নীল আকাশ ক্রমশ কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করে চলেছে, অনেকক্ষণ ধরে মেঘ গুড়গুড় করছে। বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। শাওয়াম ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে। শাওয়ামের পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না।অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিল, আর এক মিনিট ও না এখনি ফিরে যাবে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। শাওয়াম ফেরার জন্য পা বাড়িয়ে মোড় নিতে যাবে তার আগেই তার সম্মুখে বৃষ্টি নামার আগেই আরেক বর্ষার আগমন। প্রায় ছয় ফিটের কাছাকাছি শ্যাম বর্ণের একটা লোক দাড়িয়ে আছে। প্রশস্ত কপাল, মৃদু বাতাসে মাথার খাড়া খাড়া চুলগুলো উড়ছে,মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরণে একটা খয়েরি বর্ণের চেক শার্ট, জিন্স প্যান্ট, চোখে কালো রঙের মোটা ফ্লেমের চশমা আর ঠোঁটে হাসি। লোকটিকে চিনতে শাওয়ামের অসুবিধা হলো না, ফেসবুকে প্রফাইলে দেখেছে। শাওয়াম হাত জোড়া কোমড়ে বেধে দাঁত কিড়মিড় করে ফাইরাজের দিকে তাকালো। শাওয়ামের বিরক্তি দৃষ্টি দেখে ফাইরাজের জোড়া আরো প্রশস্ত হলো, একেবারে দাঁত কেলিয়ে হেসে দিল ফাইরাজ। ফাইরাজের হাসি দেখে শাওয়াম আরো রেগে আগুন। কর্কশ কন্ঠে বলল,

‘ফাজলামি পেয়েছেন হ্যাঁ? এটা কোন আসার সময় হলো? এক ঘন্টা পুরোপুরি এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করিয়েছেন আমাকে। সমস্যা কি আপনার হ্যা?’

কথা বলতে বলতে কোমড় থেকে হাত নামিয়ে ফাইরাজকে ভেঙচি কেটে হাত নাচাতে নাচাতে শাওয়াম আবার বলল,

‘কি যেন বলেছিলেন? আপনি খুউউব পানচুয়াল। হোয়াট আ পানচুয়ালিটি! আমি শিহরিত, আমি আবেগে আপ্লুত, আমি মুগ্ধিত, খুশিতে কষ্টিত।’

শাওয়ামের কথা শুনে ফাইরাজ কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। বোকার মতো তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করলো,

‘মুগ্ধিত কষ্টিত এগুলো কি বাংলা ব্যাকরণের নতুন শব্দ ? আমি আগে শুনিনি তো।’

‘ইউউউ শাট আপ। যাস্ট শাট আপ। দশ মিনিট আর মাত্র দশ মিনিট, বেটা খবিশ এই আপনার দশ মিনিট?’

শাওয়ামের ঝাড়িগুলো ফাইরাজের বেশ লাগছে। মন খারাপ করার বদলে তার ভীষণ হাসতে ইচ্ছে করছে। একদম হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাওয়ার মতো। কিন্ত এই পরিস্থিতিতে হাসলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিজেকে সংযত করলো ফাইরাজ। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শাওয়ামকে পর্যবেক্ষণ করলো। এই প্রথম সামনাসামনি শাওয়ামের সাথে তার সাক্ষাৎ। শাওয়াম হলুদ রঙের ওয়ান পিসের সাথে কালো রঙের প্লাজু গলায় কালো রঙের স্কার্ফ বেধেছে। চুলগুলো উঁচু করে বাধা। কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো, চোখে চশমা। রাগের কারণে শাওয়ামের ধবল নাকের ডগা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শাওয়ামের রাগ ভাঙাতে ফাইরাজ একটু রসিকতার সূরে বলল,

‘হোয়াট আ কানেকশন? মিস মাই ডে আপনি দেখেছেন আমাদের মাঝে কত্ত মিল। আই কান্ট বিলিভ ইট।’

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়াম নিজের রাগ ভুলে অন্য কথা ভাবছে। এই বিদ্যুতের খাম্বার সাথে তার কি মিল থাকতে পারে।

‘মানে?’

‘ইউ চাশমিশ, আই অলসো চাশমিশ,
ইউ নিরামিষ, আমি আমিষ,
মাঝখানে গড়াগড়ি খাচ্ছে কিছু কিসমিস। ”

“হোয়াট দ্য,,,,,”

“আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমার তো মনে হচ্ছে এখনি আপনার প্রেমে পড়ে যাই।”

“ফালতু কথা বলতে আসবেন না। আপনি থাকুন আমি হলে গেলাম। ”

“আরে আমার ট্রিট!”

“এত কিছুর পরেও আপনি মনে করছেন আমি আপনাকে ট্রিট দেব!”

“আমার অপরাধ?”

“এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করিয়ে এখনো অপরাধ খুঁজে পাচ্ছেননা। আজব মানুষ তো আপনি।”

“আমি তো আপনাকে অপেক্ষা করাইনি। পরীক্ষা করেছি বলতে পারেন।”

“মানে?”

ফাইরাজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে শাওয়ামকে রাস্তার অপর পাশে তাকাতে ইশারা করলো। শাওয়াম তাকিয়ে দূরে একটা চায়ের দোকান, রাস্তা দিয়ে চলন্ত যানবাহন ছাড়া বিশেষ কিছুই দেখতে পেল না।

“আপনি কি দেখাচ্ছেন বলুন তো? এখন কি এখানে দাড়িয়ে রাস্তা দিয়ে কটা অটো, রিকশা যায় সেসব গুনবেন?”

“উহুম। ঐ যে চায়ের দোকান দেখেছো?”

“হুম।”

“দশটা বাজার আরো পনেরো মিনিট আগে আমি এসে ওখানে বসে ছিলাম। চায়ের কাপ ধরলাম, চুমুক দিতে দিতে এই গেটের কাছে নজর রাখলাম। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল আপনি আসবেন না। আবার কোথায় যেন মনে হচ্ছিল আপনি না চাইলেও আপনাকে ঠিকই উপস্থিত হতে হবে। ঐ যে একটা টান আছেনা চাশমিশ কানেকশন। সাড়ে দশটা নাগাদ রিকশায় চড়ে এসে আপনি এখানে পদার্পণ করলেন। তারপরেও আপনাকে দেখা দেইনি। কেন জানেন? আপনি সব সময় একটা কথাই বলেন আমার কোন ইম্পরটেন্স নেই আপনার জীবনে। কেন যেন আপনার কথা গুলো মেকি মনে হতো। তাই ভাবলাম একটু পরীক্ষা করি। আমি তো আপনার অপরিচিত, কাছের বন্ধু নই, না আত্নীয় তো আমার আসা না আসায় আপনার অপেক্ষা করা অসম্ভব। কিন্তু কি হলো বলুন তো? আমি তো একেবারে টাস্কি খেয়ে গেলাম ঘড়ির কাটা তখন এগারোটা পেরিয়েছে আপনি এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছেন, সমান তালে ফোনে টেক্সট করছেন। তারপর ও ভাবলাম আপনি চলে যাবেন। কিন্তু না এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। সবই ঠিকঠাক ছিল এই অবধি।কিন্তু যখন দেখলাম আমার বাগানের শোভা ছড়ানো গোলাপটাকে যখন কেউ ছেড়ার চেষ্টা করছে কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারলাম না। মনে হলো গোলাপটার পাশে এসে দাঁড়াই, আমার ছায়া থাকুক তাকে জুড়ে, তারপর দেখি কে আসে আমার গোলাপে নজর দিতে। আপনি আমার ভীষণ প্রিয় একজন জানেন? ”

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়ামের চোখ কপালে। এই লোকটা এত কিছু করে তাকে বোকা বানাল আর সে টের পেল না!

“আপনি এইভাবে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, আর নিজে বসে বসে চা গিলেছেন। এখন আবার প্রিয় প্রিয় করছেন?”

“দাঁড় করাইনিতো। বললাম না পরীক্ষা। অপেক্ষার প্রহর কেবল প্রিয়জনদের জন্যই। আপনার অপেক্ষা আমার পরীক্ষা। আচ্ছা সব বাদ দিন প্রিয় কথাটা শুনলেন তবু কি কিছু বুঝলেন না?”

“দেখেন ভাই আপনার এই ফাউল লেকচার শোনার সময় আর নেই আমার কাছে। বৃষ্টি পড়লো বলে। তাড়াতাড়ি কি খাবেন বলুন? খেয়ে বিদেয় হন।”

“আপনি এত কষ্ট করেছেন এতক্ষণ চলুন আপনাকে কিছু খাওয়াই।”

“সরি ভাই, আমি আপনার টাকায় খেতে ইচ্ছুক নই।”

“নিজের কষ্টে উপার্জন করা টাকা, ব্যাংক ডাকাতি করা না যে খেতে পারবেন না।”

ফাইরাজের কথা শুনে রাগে শাওয়ামের নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। কোন আক্কেলে যেই এই প্যাচাল মার্কা পাবলিকের সাথে দেখা করতে রাজী হয়েছিল সে। এর সাথে কথা বললে কথা বাড়তেই থাকবে। এদিকে আবহাওয়ার যে অবস্থা কিভাবে হলে ফিরবে সে সেই চিন্তায় যায় যায় অবস্থা। তাই আর ঝামেলা না করে ফাইরাজের সিদ্ধান্তের সাথে সম্মতি দিল,

“ঠিকাছে চলুন।”

“কি খাবেন?”

“আপনার যা ইচ্ছে। ”

“চলুন তাহলে একটা রেস্তরায় যাই।”

“কোথাও যেতে পারব না। এখানে দাড়িয়ে কিছু খাওয়াতে পারলে খাওয়ান নইলে বিদায় হন।”

ফাইরাজ এদিক ওদিক তাকিয়ে আইসক্রিমের ভ্যান খুঁজে পেল। আইসক্রিম খাওয়াটাই এখন ঠিক হবে।

“মিস মাই ডে আপনি এখানে দাঁড়ান। আমি আইসক্রিম আনছি।”

শাওয়ামকে দাঁড় করিয়ে রেখে ফাইরাজ আইসক্রিমের পেছনে ছুটলো। এদিকে শাওয়াম ভাবছে অন্য কথা। এসেও ফাইরাজ একবার তাকে মিস মাই ডে বলে ডেকেছে। এখন আবার। এর মানে টাকি? শাওয়ামের বোধগম্য হচ্ছে না। শাওয়ামের ভাবনার মাঝে দু হাতে দুটো কোন আইসক্রিম নিয়ে ফাইরাজের আবির্ভাব। ফাইরাজ শাওয়ামের হাতে একটা আইসক্রিম দিল আরেকটা নিজের কাছে।

দুজনে আইসক্রিম খাওয়া শুরু করবে তার আগেই আচমকা বৃষ্টি নামলো। শাওয়াম তো ঠাই হয়ে দাড়িয়ে আছে। যেই ভয়টা পেয়েছিল সেটাই হলো। ফাইরাজ শাওয়ামের হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকলো। একটা দোকানের চালার নিচে দাড়ালো। আচমকা ফাইরাজের হাত ধরাটা শাওয়ামের মনে অন্য অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে। এদিকে ফাইরাজ টিসু হাতে নিয়ে আইসক্রিম খেতে ব্যস্ত। শাওয়ামকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“কী হলো? আপনি কি আইসক্রিম না খেয়ে শরবত খাবেন বলে ঠিক করেছেন মিস মাই ডে?”

“আগে এটা বলুন তো এসে থেকে কি মাই ডে মাই ডে করছেন হ্যাঁ?”

“আপনি আমার দিনলিপি হয়ে গেছেন শাওয়াম। আমার প্রাত্যহিক রুটিন। এজন্য মাই ডে বলি আপনাকে। আচ্ছা আপনি কখনো প্রেম করেছেন? ও সরি আপনার তো বি এফ আছে। কেন যে ভুলে যাই।”

“আপনি করেছেন?”

“হ্যাঁ। আমার গফ আছে। তিন বছরের রিলেশন।”
#শাওয়াম
পর্ব ২০
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

ফাইরাজের গফ আছে! তাও কিনা তিন বছরের রিলেশন! মুহূর্তেই শাওয়ামের মুখে আঁধার নেমে এলো। গফ থাকতেও এই ছেলেটা তার সাথে ফ্লার্ট করে আসছে! কতটা ক্যারেক্টার লেস না হলে এইভাবে দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে পারে মানুষ। শাওয়াম ভেবে পায়না। শুধু চোখ বুজে কল্পনা করে সাদাফের নিকৃষ্ট মুখমণ্ডল, যার ছাড়া ফাইরাজের মুখমণ্ডলে আছড়ে পড়েছে।

শাওয়ামের চুপ থাকার কারণ অনেক আগেই আচ করেছে ফেলেছে ফাইরাজ।

“হেই, মাই ডে! ইউ নো পাস্ট ইজ পাস্ট। ইসে উসপাল রেহনে দো।”

ফাইরাজের কথায় শাওয়ামের হুশ ফেরে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকায় ফাইরাজের দিকে।

“মানে কি?”

“একদা এককালে আমার একখান গফ্ফেন ছিল। কালের বিবর্তনে সে বিয়ে করে ফেলিয়াছে আমায় ফেলে। সেই শোকে বেশ কিছুদিন ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে বসে থাকতাম। তবু আজকাল আর ব্যাকা থাকতে পারিনা। একজন চাশমিশ আমার মাই ডে হয়ে গেছে। ব্যাকা থাকার উপায় নেই!”

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়াম নিরব রইল। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে নিজের ওপর রাগ প্রকাশ করছে। কি থেকে কিভেবে নিল এই মানুষটাকে? সাদাফের সাথে তুলনাও করে ফেললো!

আসলে দুনিয়াটাই এমন। মানুষ জীবনের অভিজ্ঞতা চায়, কিন্তু খারাপকে এড়িয়ে। যে মানুষটার শুরুটাই হয় খারাপ অভিজ্ঞতা দিয়ে তার শেষ অবধি শুধু ঐ খারাপটাই স্মরণে আসে, গুলিয়ে ফেলে বাস্তবটাকে। খারাপটাই হয়ে যায় তার জীবনের কাল, আতঙ্ক। আমরা যতোই বলি পজেটিভ ভাবতে হবে আসলে সবাই চাইলেই পজিটিভ ভাবতে পারেনা। নেগেটিভ দিয়ে সূত্রপাত তার চিন্তাভাবনা ও সেই নেগেটিভই হয়ে যায়।

এদিকে বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে। শাওয়ামের চোখ আকাশের দিকে। খোলা আকাশের অশ্রু বিসর্জন শেষ হলে সে পালাবে এখান থেকে। আর ফাইরাজের চোখ শাওয়ামের মুখপানে। ফাইরাজ এত কথা বললো শাওয়াম টু শব্দটি করলো না! ব্যাপারটা ফাইরাজের কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। হুট করে চোখের পলকেই শাওয়াম দৌড় দিল । এক দৌড়ে গিয়েই একটা রিকশাতে উঠে পড়লো। শাওয়ামের এমন কান্ডে ফাইরাজ অপ্রস্তুত। সে শুধু নির্বাক চাহনিতে শাওয়ামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।

২০

“সেদিনের ঘটনা সেই অব্দি থাকলেই পারতো। এতদূর না গড়ালেও চলতো। কি জানি এই গড়িয়ে যাওয়া আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো নাকি ভালো!”

আমি শুধু আপুর কথাই শুনে যাচ্ছি। বেচারীর মুখে হতাশার ছাপ, একেকটা নিঃশ্বাসই একেকটা চাপা দীর্ঘশ্বাস। কিছুটা থেমে আপু আবার বলতে শুরু করলো,

“রুমে পৌছেই মন মেজাজ কেন যেন ভালো ছিল না আমার। ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখি ফাইরাজের অনেক গুলো মিসড কল। কতগুলো টেক্সট। আমি ভেবেছিলাম আমার আচরণে এই ছেলে এবার অন্তত আমার পিছু ছাড়বে। কিন্তু ছাড়েনি। উল্টা নতুন রসিকতা শুরু করলো। আমি নাকি ওনাকে ফাকি দিয়েছি। আমার ট্রিট দেওয়ার কথা ছিল আমি দেইনি। আমাকে হাড়কিপ্টা বলতে লাগল। জীবনে কোন কালে কিপ্টা ছিলাম বলে মনে পড়ছে না। মা বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়াতে কখনো অভাবের মুখ দেখেছি বলে মনে হয়না। বরং যখন যা চেয়েছি বলার আগেই যেন পেয়েছি। ফাইরাজের কথাগুলো আমি মজার ছলে নিতে পারিনি। ইগোতে লাগল। ব্যস ফাইরাজের কথামতো আবার রাজী হলাম মিট করতে। এটাও বললাম এটাই শেষ, লাস্ট এন্ড লাস্ট। এবার লোকেশন ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।”

টিএসসির মোড়ে এসে দাড়িয়ে আছে ফাইরাজ। আজ আগে আগেই এসে দাড়িয়ে আছে ফাইরাজ। গতদিন নিউমার্কেটে একবার শাওয়ামকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আজ আর না। ফাইরাজ রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় একটা রিকশা এসে থামলো ফাইরাজের থেকে কিছু দূরে। ভাড়া মিটিয়েই শাওয়াম গটগট করে হেটে আসলো ফাইরাজের দিকে। এসেই হুংকার ছাড়লো,

“এই যে মিস্টার! স্টাচু হয়ে না দাঁড়িয়ে দ্রুত হাটুন। যা গেলার গিলে আমাকে উদ্ধার করুন। অসহ্য লোক একটা।”

শাওয়াম পুরো দমে কথাটা বলে দাঁড়িয়ে হাফ ছাড়লো।

“বাপ্রে বাপ। এমনভাবে কথা বললেন মনে হচ্ছে আপনার পেছনে বাঘ দাড়িয়ে আছে। সিরিয়াসলি মিস মাই ডে আপনি ইউনিক, টোটালি ইউনিক। এজন্য আপনাকে আমার এত ভালো লাগে।”

“অসহ্য।”

ফাইরাজকে ঝাড়ি দিয়ে শাওয়াম গটগট করে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে। ফাইরাজ ও তার পিছু নিল।

বেশ কিছুক্ষণ কর। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক উঁচু জায়গায় বসে আছে শাওয়াম। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে ফাইরাজ, হাতে পাচটি লাল গোলাপ।

“আই ইন লাভ উইথ ইউ শাওয়াম। আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ। তুমি কি আমার জীবনসঙ্গী হবে? হবে আমার জান্নাতের ও সাথী?”

ফাইরাজের কথা শুনে শাওয়াম মুচকি হাসল। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

“আর কিছু?”

“আমার উত্তর?”

“আপনার নাটক এখনো শেষ হয়নি?”

“আই রিয়েলি লাভ ইউ শাওয়াম।”

“হাহ! এই কথা আগে অনেকে বলেছে।”

“আমি সত্যি তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই।”

“আমার সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? শুধুমাত্র অনলাইনে পরিচয় হলো আর আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেলেন! আমার জীবন সম্পর্কে কোন ধারণা আছে আপনার? আমার অতীত বর্তমান কিছু জানেন আপনি? বিয়ে করতে চাওয়া কোন সস্তা কথা না। আপনি ফ্লার্ট করতেন জানতাম। তাই এতদূর যাবে ভাবিনি।”

“মানুষকে ভালোবাসতে হয় তাকে যতটুকু দেখেছি, যতটুকু বুঝেছি সেই অনুভূতি থেকে। অতীত, বর্তমান নিয়ে কি এসে যায়? ভালোবাসাটা তো ভবিষ্যতের জন্য হওয়া উচিত তাই নয় কি?”

“মুখে অনেক কথাই বলা যায় ফাইরাজ। ”

“তোমার অতীত, বর্তমানে কি থাকলো সেটা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। আমি তোমার ভবিষ্যত হতে চাই ব্যস।”

“মাথা ব্যথা নেই! আমার অতীত শুনলে হয়তো আমার নাম মনে করলেই আপনি থুথু ছিটাবেন। মুখে অনেক বড় বড় কথা বলা যায়।”

শাওয়াম নিজের ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি বের করলো। কালো মলাটের একটি ডায়েরি। যার ভেতর লুকিয়ে আছে তার জীবনের কালো অতীত, কালো কালিতে ঠাসা ঠাসা অক্ষরে লেখা এক কালো অতীত। ডায়েরিটাকে কখনো হাতছাড়া করেনা শাওয়াম। বরং মাঝে মাঝে একাকীত্বের সময়টা তার এই ডায়েরির পাতায় চোখের পানি ফেলেই কাটে। ফাইরাজ ছেলেটা অনেক বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে এটা শাওয়াম বেশ বুঝতে পেরেছে। তাই আগে ভাগেই ফাইরাজের মন থেকে তাকে নিজের নাম মুছে ফেলতে হবে। এটা কোন রূপকথার জগত নয় যে আমার অতীত নিয়ে কারোর মাথা ব্যথা থাকবে না। তার আগ্রহ থাকবে শুধু আমিতেই। কাপা কাপা হাতে শাওয়াম ডায়েরিটা এগিয়ে দিল ফাইরাজের দিকে।

“এই ডায়েরিটা রাখুন। এক সপ্তাহ পর এটা আমি ফেরত নেব আপনার থেকে। ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে। হয়তো সেদিন আপনি আর আমার মুখের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। যেমন ড্যাপড্যাপ করে চেয়ে আছেন এখন।”

“কি এমন আছে এই ডায়েরিতে?”

“আমার অতীত। আর কিছু বলার নেই আমার। এক সপ্তাহ পরেই না হয় দেখা হোক?”

শাওয়াম কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। রওনা হলো নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এদিকে ডায়েরি হাতে নিয়ে ফাইরাজের তর সইছে না। ওখানে বসেই ডায়েরিটা খুললো। দুটো পাতা উল্টাটেই একটা লেখা দেখে ফাইরাজের চোখ ছানাবড়া।

“হয়তো পুরো দুনিয়া ভাবে আমি শুদ্ধ, পবিত্র। কিন্তু আমি জানি আমি অপবিত্র, আমি একজন ধর্ষিতা।”

চলবে————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here