হিংস্রতায় ভালোবাসা পর্ব ৬

#হিংস্রতায়_ভালবাসা
#পর্ব_০৬
#রীমা_শারমিন

রান্না করছিলাম তখনই আহিল পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে। আচমকা এমন ঘটায় হাতে থাকা কাচের বাটি নিচে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। ভয়ে ভয়ে আহিলের দিকে ঘুরতেই দেখি উনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

— সরি, আসলে আমি বুঝতে পারি নি কি হয়ে গেল।
— ইটস ওকে জান। তুমি এক কাজ করো, জলদি রেডি হয়ে নাও আমরা বেরোবো।
— কোথায় যাব?
— সেটা তোমার না জানলেও চলবে। আমি বলেছি রেডি হতে এটাই এনাফ তোমার জন্য!
— হুম। আপনি যান,আমি কাচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করে আসছি।

আহিলের ফেভারিট কালার ব্ল্যাক, যার জন্য আমার আলমারির ম্যাক্সিমাম ড্রেস আর শাড়ি ব্ল্যাক কালারের।কিন্তু আমার ব্ল্যাক কালার মোটেও পছন্দ না কিন্তু আহিলের জন্য বাধ্য হয়ে পড়তে হয়। কিন্তু আহিল আজ ওর পছন্দের কিছু পড়তে বলেনি তাই আমি একটা নেভিব্লু কালারের থ্রিপিস পড়লাম। হালকা করে সাজলাম। রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলাম আহিল খেলা দেখছে টিভিতে। আমি সামনে যেতেই আহিল কেমন করে যেন তাকাল আমার দিকে। তারপর উঠে এসে আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো।

— কি হয়েছে আহিল,আপনি এভাবে কি দেখছেন?
— দেখছি,তোমার সাহস অনেক বেড়ে গেছে।
— মা মানে কি বলছেন আপনি, আ আমি কি করেছি?
— আমি তোমার জন্য একটা শাড়ি নিজে চুজ করে রেখে এসেছিলাম কিন্তু তুমি সেটা না পড়ে আমার সামনে দাড়িয়ে আছো অন্য একটা ড্রেস পড়ে।
— আ আমি আসলে দেখতে পাইনি বিশ্বাস করুন। কোথায় রেখেছেন আমি এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসছি।

আহিল এগিয়ে এসে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল।

— আজ তোমার জন্মদিন বলে তোমাকে কোন শাস্তি দিলাম না। যাও গাড়িতে গিয়ে বসো।

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি। আহিল কোন কথা বলছে না আমার সাথে। কিন্তু দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে,উনি রেগে আছেন। কিন্তু এতে আমার কি দোষ আমি দেখিনি উনি যে ড্রেস রেখে এসেছেন।এসব কথা ভাবতে ভাবতে মনে হয় আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। হঠাৎ করে মনে হলো আমাকে কেউ ধাক্কাচ্ছে। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। দেখলাম আহিল ই ডাকছে আমাকে। আহিল আমাকে ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বলছে। একটা একতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছি।আগে কখনো এখানে এসেছি বলে মনে হচ্ছে না, কোথায় নিয়ে এসেছে আমাকে? কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে আহিলকে জিজ্ঞেস করলাম।

— আহিল আমরা কোথায় এসেছি?

আহিল আমার কোন কথার উত্তর দিল না, মনে হচ্ছে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি বা উনি শুনেন নি এমন একটা ভাব নিয়ে বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে কলিং বেল চাপলেন।দরজা খুলতেই আহিল আমাকে চোখের ইশারায় ভিতরে যেতে বলে। ভিতরে গিয়ে আমি একদম শকড হয়ে গেলাম।এতদিন পরে মাকে দেখতে পেয়ে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছিল বুঝাতে পারব না। প্রিয়ু আমাকে দেখেই দৌড়ে এলো আমার কাছে।। মা-বাবা দাদি সবার চোখে আনন্দের রেখা দেখছিলাম আমি। আনন্দে আমার চোখেও পানি চলে এলো।। আর আহিল দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল সব।। আমি আহিলের কাছে গেলাম ওনাকে ধন্যবাদ জানাতে, আমার এই খুশির দিনে আমার স্পেশাল মানুষগুলোর সান্নিধ্যে নিয়ে আসার জন্যে।।

— থ্যাংক ইউ! আজকের দিনটা আরও স্পেশাল করে দেয়ার জন্য।
— হুম। আমাকে এখন যেতে হবে। অফিসে কাজ আছে। তুমি চাইলে আজকের দিনটা এখানে থাকতে পারো।

আহিল চলে গেল। এখানে আজ থাকতে পারব এর থেকে আর খুশির খবর কি হতে পারে। মা-বাবার সাথে কথা বলতেই হবে আহিলের ব্যাপারে।। কিন্তু বাবা মা নতুন বাড়িতে এসেছে আমাকে তো জানাল না।

মা দুপুরের জন্য রান্না করছিলেন আর আমার জন্য পায়েস বানিয়েছে। যেটা প্রতি জন্মদিনেই করে আমার জন্য।। কতদিন পরে মায়ের হাতে খেতে পারলাম।।রান্না ঘরে মাকে কাজে হেল্প করছিলাম। এটাই সুযোগ সবকিছু বলার।

— মা,এই বাড়িতে কেন তোমরা?
— এই বাড়িতে গত মাসে আমরা শিফট করেছি।
— আমাদের আগের বাড়ির কি হয়েছে?
— ওইটা ব্যাংকের লোনের জন্য নিয়ে নিয়েছে।
— লোনের জন্য নিয়ে নিয়েছে? আর আমি এইসবের কিছুই জানি না।
— আহিল সব জানে। বাড়ি চলে যাওয়ার পরে তোর বাবা অনেক অসুস্থ হয়ে পরে। তখন আহিল আমাদেরকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তোকে হয়তো জানায়নি তুই চিন্তা করবি সেজন্য।।

মায়ের কথা শুনে যতটা না অবাক হয়েছি, তার থেকে বেশি অবাক হয়েছি এটা ভেবে। আহিল বাবা-মা সবার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে আমাকে জানায়নি পর্যন্ত কারণ আমি চিন্তা করব।তাহলে আমার সাথে এত বাজে ব্যবহার কেন করেন? কি কারন এর পেছনে, আমাকে জানতেই হবে।। যতক্ষণ না আহিলের সত্যিটা জানতে পারছি মাকে কিছু বলা যাবে না।।

বাবার সাথে বসে গল্প করছিলাম তখনই প্রিয়ু এলো।।

— আপু চলনা!
— কোথায় যাব?
— আইস্ক্রিম খেতে যাই চল না আপু? কতদিন তোর সাথে বেরোই না।
— আমি যাব না। তুই একা যা তোর ভাইয়া শুনলে রাগ করবে।
— কিচ্ছু হবে না। আমি বলে দেব। চল না, চল না আপু, প্লিজ।
— এত করে যখন বলছে যা না প্রানো। (বাবা)
— কিন্তু বাবা
— কোন কিন্তু নেই আপু,চল।

প্রিয়ু হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো বাইরে।।অনেক দিন পরে নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে। কতদিন এমন মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেইনি। প্রান ভরে শ্বাস নিলাম।। প্রিয়ু আর আমি অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম বাইরে। সন্ধ্যার দিকে বাসায় গেলাম। বাসায় যেতেই মা বলল আহিল ফোন করেছিল। আহিল কল দিয়ে আমাকে পায়নি, যদি শুনে আমি বাইরে গিয়েছিলাম আর ওনাকে বলিনি।

— মা তুমি কি বলছো আমরা বাইরে গিয়েছিলাম?
— না, আমিতো জানতাম না তোরা বাইরে ছিলি আমি বললাম হয়তো তুই ছাদে গিয়েছিস।

মায়ের কথা শুনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম।যাক মা কিছু বলেনি।

ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল আমার দিকে কেউ অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে।। খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষন করছে আমাকে। চোখ মেলে সামনে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে গেলাম।।আবছা আলোয় আহিলকে চিনতে সমস্যা না হলেও হঠাৎ করে দেখে চমকে গেছি।

— আ আপনি এত রাতে?
— কেন,আমার বউয়ের রুমে আমি আসতে পারি না?
— হ্যাঁ কি কিন্তু এতো রাতে কেন আর আপনি এলেন কিভাবে, আমিতো দরজা লক করে শুয়েছিলাম!
— তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছিল না, তাই চলে এসেছি।কিভাবে এসেছি সেটা বড় কথা নয়, শুধু এটা ভেবে নাও আহিল খান তার প্রানোর জন্য যা কিছু করতে পারে।
— হুম ।
— আমি এসেছি বলে কি তুমি খুশি হও নি?
— না তা তা হবে কেন? আমি খুশি হয়েছি, হ্যাঁ খখুশি হয়েছি অনেক।
— আমি জানতাম আমাকে দেখে আমার জান অনেক খুশি হবে। চলো এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়ো বেশি রাত জাগলে কাল সকালে উঠতে পারবে না।
— ম মানে কাল সকালে কেন উঠতে হবে?
— বাসায় যেতে হবে না?এখন কোন কথা না বলে ঘুমাও।

কালকেই চলে যেতে হবে ভেবে মুহুর্তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।। কতদিন পরে মা-বাবার সাথে একটু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু উনি কালই আমাকে নিয়ে আবার বন্দিনী করে রাখবে ।। ভাবতেই একটা চাপা কষ্টে বুকটা ভারি হয়ে এলো। সারারাতে আর এক ফোটা ঘুম এলো না চোখে।। নির্ঘুম কাটিয়ে দিলে আজকের রাতটা। কিন্তু আহিল কি সুন্দর ঘুমাচ্ছেন। একটা মানুষ কিভাবে পারে এমন করতে?

ওই বাড়ি থেকে আসার প্রায় দুইসপ্তাহ হয়ে গেছে।। নিশার বিয়েতে যাওয়ার জন্য আহিল আজকে আমাকে শপিংয়ে নিয়ে এসেছে।।আহিল একটা একটা করে শাড়ি পছন্দ করছে আর সেটা আমাকে বার বার পড়ে ওকে দেখাতে হচ্ছে।। আমি একটা শাড়ি পড়ে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। শাড়িটা জরজেটের ছিল যার কারণে বারবার কাধ থেকে পরে যাচ্ছিল আর আমার কাছে কোন সেফটিপিনও ছিল না। আমি একহাত কাধে দিয়ে শাড়িটা যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম। ট্রায়াল রুমের দরজা খুলতেই দেখলাম আহিল একটা অরেঞ্জ আর অ্যাশ কালারের কম্বিনেশনের শাড়ি আমার সামনে ধরে আছে।আমি হাত বাড়িয়ে শাড়িটা ধরলাম তখন আমার একদমই মনে ছিল না আমার পড়নের শাড়িটা পিন দিয়ে আটকাই নি।আচল টা হঠাৎ করেই পড়ে যায়।ভীষণরকম অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম এমন একটা ঘটনায় । আমি আচল টা আবার উঠিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম যাকে আমি আহিল ভেবেছিলাম আসলে সে আহিল না,অন্য কেউ।। হাতের শাড়ি ফেলে তৎক্ষনাৎ সেখানে থেকে ছুটে পালাতে গেলে ঘুরেই আহিলের সাথে মুখোমুখি হই। আহিল ভয়ংকর ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দিয়ে যেন জ্বলন্ত লাভা বের হচ্ছে। কপালের সব রগ ফুলে উঠছে রাগে। আজ হয়তো আহিল আমাকে মেরেই ফেলবে।আহিল কাউন্টারে ওর কার্ড দিয়ে জিনিসগুলো ঠিকানামতো পৌঁছে দেয়ার জন্য বলল। তারপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গাড়িতে বসালো। আহিল পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। আমি আহিলকে এত স্পিডে গাড়ি চালাতে নিষেধ করতে চাইছি কিন্তু ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না।কথাগুলো ভয়ে গলার কাছে মনে হচ্ছে দলা পাকিয়ে আটকে আছে।।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here