হিয়ার মাঝে পর্ব ২৩+২৪

#হিয়ার_মাঝে
২৩.
#WriterঃMousumi_Akter

মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে কেউ একজন বলছে কবুল বল, বল বলছি।সামনে হুজুর মতো একটা লোক তার মাথায় ও পিস্তল ঠেকিয়ে ধরে রেখেছে কয়েকজন বিয়ে পড়াতে।আমি ভয়ে থরথর করে কেঁপে যাচ্ছি।সবার মুখে একটাই কথা আগে কবুল বল।মরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েই বললাম আমি কবুল বলবো না।কবুল না বলাতে পিস্তল আমার কপালে সুট করবে করবে এমন সময়ে খানিক টা দূর থেকে আমার চিরচেনা হৃদয়ের স্পন্দন নিরব কবুল বলে উঠলো।আমি রক্ত বিন্দু গুলো যেনো জেগে উঠলো।আমার অনুভুতিও বলছিলো হয়তো সে আসবে।

নিরবের কবুল বলা শুনে আমি তাকিয়ে দেখি আমাদের থেকে খানিক টা দূরে দুই প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে নিরব।খুব গম্ভীর একটা মুড নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।একটা ছেলে আমার হাত খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছে নিরবের দৃষ্টি সোজা আমার হাতের দিকে।নিরব হয়তো ওই ছেলেটার হাত ই কেটে ফেলবে।নিরব এসে গিয়েছে মানে আমার রক্ষাকারী এসে গিয়েছে আমার আর কোনো চিন্তা নেই।

“ছেলেগুলো নিরব কে দেখে নিরবের দিকে পিস্তল তুলতেই নিরব বলে ওঠে অফিসার সবাই কে এরেস্ট করুন।ছেলে গুলো আশে পাশে তাকিয়ে পুলিশের ভয়ে ছুটে পালালো।আর আমি ভয়ে ছুটে গিয়ে নিরব কে জড়িয়ে ধরলাম।ভয়ে আমার হৃদপিন্ড ধড়ফড় করছিলো।নিরব আমাকে ওর বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে এত ভয় পাচ্ছিলে কেনো আমি থাকতে।”

“আপনি কোথায় ছিলেন আমি তো ভেবেছি আপনি বাসে করে চলে গিয়েছেন।।”

“হুম আমি গিয়েছিলাম সত্যি কিন্তু হঠাত দেখি বাসে তুমি নেই দেখেই আমার মাথা ঘুরে গেছিলো।চলন্ত বাস থেকে লাফ মেরে তো আরেক টু হলে বিধবা হয়ে যেতে তুমি।”

“লাফ দেওয়ার কি দরকার ছিলো।”

“লাফ না দিলে তো আমি বিধবা হয়ে যেতাম ম্যাডাম।”

“ইস হাত টা কিভাবে কেটে ছুলে গিয়েছে নিরবের এমন অবস্থা দেখে বুকের মাঝে ভীষণ খারাপ লাগছিলো।নিরব কে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বললাম আপনি আমার জন্য কেনো এমন করেন।”

“সিম্পল উত্তর ভালবাসি তাই।”

“আচ্ছা পুলিশ কোথায়?”

“আরে ধূর এখানে কোথাও পুলিশ টুলিশ কেউ নেই।ওদের সাথে মারামারি করে পারতাম না তাই ভোকাস দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছি।”

“আপনি না সত্যি পারেন ও।”

“তুমি এখানে নবনিতার সাথে এলে কেনো?জানোনা ওর হাতে পায়ে শিরা উপশিরাতে ইবলিশ ভরপুর।আমার তো তক্ষনি সন্দেহ হচ্ছিলো কিছু না কিছু কাহিনী আছেই এইভাবে আদর করে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে।”

“আপু একবার ও ভাবলো না আমি এইখানে হারিয়ে যাবো।”

“তোমার মা আর আপুর সময় ঘনিয়ে এসেছে ম্যাডাম।এবার পাবে উপযুক্ত শাস্তি।”

“এখন আমরা মামাবাড়ি কিভাবে যাবো।।।”

“আমরা এখন ভিন্ন জায়গা যাবো।জায়গা টার নাম নড়াইল।বস মাসরাফির এলাকা,আর ওখানে আমার একটা ফ্রেন্ড আছে যার নাম মুনতাহা।ও খুব রিকুয়েষ্ট করছে। নবনিতা বেশী চালাকি করতে গিয়ে আমাদের সুযোগ করে দিলো তাইনা।নবনিতা চেয়েছিলো তুমি আমার থেকে হারিয়ে যাও কিন্তু উপর ওয়ালা চাইছেন আমরা কাছাকাছি থাকি।আর নড়াইলে ঠিক এ কারনেই যাবো দুজনে আলাদা সময় কাটাতে পারবো।”

“বাট ওরা আমাদের খুজবে না।”

“খুজুক।বিয়ের আগে ঠিক ই পৌছে যাবো।”

সেখান থেকে আমরা নড়াইলের দিকে রওনা হলাম।এই জায়গার টার নাম ই কখনো শুনিনি।এই প্রথম বার শুনছি।জানিনা কোন অচেনা জায়গা যাচ্ছি।পরের দিন ভোরে পৌছে গেলাম নড়াইল এ।আহা!কি প্রাণ খোলা হাওয়া এ শহর টায়।সকালের আলোতে চারদিক টা কেমন ফুট ফুটে হয়ে উঠেছে।

চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পরা গায়ে সাদা থ্রি পিছ পরে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের রিসিভ করতে মুনতাহা।।মেয়েটির সাথে আমার চেহারার বেশ খানিক টা মিল আছে।মেয়েটি অবাক করা নয়নে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।মেয়েটি যেনো অন্য জগতে পা দিয়েছে।ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো।কি দেখছে আমার মুখপানে তাকিয়ে।নিরব মেয়েটি কে ইশারা করে বলে হ্যালো মুনতাহা ও মিথু।

এতক্ষনে মুনতাহার ঘোর কাটলো।

“কি দেখছো হা করে আমার বৌ এর দিকে।”

“না ওকে না দেখতে হুবহু আমার ফুপ্পির মতো।তাই হঠাত আমার ফুপ্পির কথা মনে পড়লো।”

“ঠিক আছে আমার আম্মুকে ফুপ্পি আর আম্মুর বৌমাকে ফুপাতো বোন বানিয়ে নাও না।
চলো এবার যায় তাহলে।”

শহরের ফাঁকা রাস্তা দু একটা অটো রিক্সা মাত্র রাস্তায় বেরিয়েছে।অন্য শহরের তুলনায় এ শহরে বিশাল বিশাল বিল্ডিং নেই।তবে নজর কাড়া প্রকৃতি।পাঁচ মিনিট হাঁটার পরেই মুনতাহাদের দুইতলা বিশিষ্ট বাসা।বাসার পিছনে সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজ।কলেজ টা বেশ বড় সড়।

মুনতাহাদের বাড়িতে প্রবেশ করতেই প্রতিটা মানুষ ভূত দেখার মতো চমকে যায়।সবাই একে একে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার মুখ পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।জানিনা কি দেখছে তারা।নিরব ও রিতীমতো অবাক এরা সবাই এভাবে কি দেখছে।

হঠাত বয়স্ক একটা লোক এস আরু বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।আমার আরু ফিরে এসেছে।ওই আমার আরু।মা আরু এতদিন কোথায় ছিলো।আমাদের কথা কি একটা বার ও তোর মনে পড়ে নি।আর কোথাও তোকে যেতে দিবো না আরু।

মুনতাহা নিরব কে বলে দাদু মেয়ের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছে আর মৃথিলাকে দেখতে হুবহু ফুপির মতোই তাই দাদু আরো ভেঙে পড়েছেন।প্লিজ কিছু মনে করো না নিরব।।
নিরব হেসে দিয়ে বলে আরে না এটাতে মনে করার মতো কিছুই নেই।লোকটা মৃথিলাকে জড়িয়ে ধরলে মৃথিলা ও লোকটাকে জড়িয়ে ধরে।মৃথিলা ও লোকটাকে জড়িয়ে ধরে খুব জোরে কেঁদে দেই।যেনো দীর্ঘ দিন পরে আপন জনের সাথে দেখা দুজনের।

মুনতাহার পুরো পরিবার ই তাদের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ভেবেই নিয়েছে।

মুনতাহা সবাই কে বুঝিয়ে বলে এটা তাদের বাড়ির মেয়ে না এটা তার বন্ধুর বউ এখানে ঘুরতে এসেছে।

মুনতাহার বাবা বলেন,

“কোথায় বাড়ি মা তোমার। ”

“ঢাকা।”

“বাড়িতে কে কে আছে।”

“মা বাবা বোন।।”

“ওর সাথে কত দিন বিয়ে হয়েছে এইতো কিছুদিন।”

“আমার বোন ছিলো মা একদম তোমার মতো দেখতে।ওর নাম আরু। একটা মানুষের সাথে আরেক টা মানুষের হুবহু কিভাবে মিল হতে পারে।”

“উনি কি মারা গিয়েছেন।”

“আমাদের ধারণা যে ও মারা গিয়েছে এখনো শিওর আমরা জানিনা।”

“কেনো কি হয়েছিলো?..”

“আমার বোন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়তো।খুব সুন্দরী ছিলো একদম পরীর মতো ছিল দেখতে।আমরা সে আমলের জমিদার ছিলাম বলা চলে।বাবার অনেক সম্পত্তি ছিলো।আমাদের দুই ভাই বোনের নামে লিখে দিয়েছিলো বাবা।আমার বোন গাড়িতে করে চলাফেরা করতো।হঠাত একটা সময় বোন কে কেমন দুঃচিন্তা করতে দেখতাম।বোন সারাদিন ঘরে সুয়ে থাকতো। বোনের কোনো সমস্যার কথা কাউকে জানাতো না।তখন আমার ওয়াইফ জানতে পারে আমার বোন মা হতে চলেছে।তখন আমরা আর আমার বোন কে প্রেসার দেই নি।বাবা বলেছিলো ওই বাচ্চাটা নষ্ট করে দিয়ে ভুল গুলো শুধরে নিতে।বোন তাতে রাজি ছিলো না।বোন বলেছিলো সে তার সন্তানের বাবা কে নিয়ে আসবে বলেই ঢাকায় গিয়েছিল।তারপর আর ফিরে আসে নি।অনেক দিন পর একটা চিঠি এসেছিলো ঢাকা যাওয়ার পথে অজ্ঞাত কোনো মানুষ বা ডাকাত দল বোন কে মেরে তার সব সম্পত্তি তাদের নামে করে নিয়েছে।তারপর এ নিউজ শুনে আমার মা মারা গেলেন।আর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন বাবার চিকিৎসা করাতে প্রায় সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিলাম।আজ ও আমার বোনের শোক আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি নি।এই জীবনে যদি একটা বার বোনের কোনো অস্তিত্ব পেতাম বুকের মাঝে আগলে রাখতাম।মা আমাকে তুমি মামা ডাকবে।”

“তখন ই পেছন থেকে বৃদ্ধ লোকটি বলে মামা ডাকবে কিরে ওই তো তোর ভাগনি।আমার আরুর একটা মেয়ে থাকলে আজ হুবহু এমন ই হতো।”

আমি কাঁন্নায় ভেঙে পড়লাম আজ যদি আমার মামা বাড়ি খুজে পেতাম তারাও আমাকে এভাবেই বুকে টেনে নিতো।আমি মুনতাহার বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিয়ে বললাম আজ যদি আমার ও মামা বাড়ি থাকতো তাহলে ঠিক এতটাই ভালবাসতো।ছোটবেলা থেকে ভালবাসা নামক জিনিস আমি পাই নি।আমার মা নেই।মামা বাড়ি কোথায় তাও জানিনা।কেউ আমাকে কোনদিন ভালবাসে নি মামা।

সম্পূর্ণ সিসুয়েশন টা আবেগময় আর হৃদয়বিদারক হয়ে গেছিলো।এক সন্তানহারা ফ্যামিলির আর্তনাদ এর সাথে মিশে গেছিলো মা হারা মৃথিলার কষ্টের আর্তনাদ।

সবার চোখে মুখে শুধু কাঁন্নাই ছিলো।

আমার সব থেকে বেশী কাঁন্না পাচ্ছিলো এটা ভেবে যে এই পরিবারে আমার কেনো জন্ম হলো না।এরা দীর্ঘদিন হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে আজ ও কত টা ভালবাসে।আর আমার বাবা আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাই।আসলে ঘরের বাইরে বেরোই নি বলেই জানিনা এই জগতে অনেক মানুষ আছে যারা ভালবাসতে জানে।যারা ভালবাসার জন্যই জন্মেছে।

মুনতাহা বলে বাবা মিথুর সাথে না হয় পরে গল্প করো ওদের একটু রেস্ট নিতে দাও।মামা বলে হ্যা মা যাও একটু ঘুমিয়ে নাও।মুনতাহা তার ফুফু আরুর রুম টাই দিলো নিরব আর মৃথিলাকে।

“ঘরের দরজা বন্ধ করতেই মৃথিলা বলে মিথ্যা বলতে বললেন কেনো?আমরা বিবাহিত।”

“সেটা যদি না বলতাম ওরা আমাদের এখানে এলাউ করতো না।আর আমাদের খুব বাজে ভাবতো।মনে করতো ফূর্তি করতে বেরিয়েছি।”

“শুনুন এটা কিন্তু ঠিক না আমরা এক ঘরে থাকবো।”

“তাহলে তো এক দেশে,এক জেলা এক পৃথিবী কোথাও থাকা ঠিক না তাইনা।চলো মরে যায়।।”

“এমন সময় আহ উহ করে উঠলাম ব্যাথায়।গলায় হাত দিয়ে ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলাম।”

“নিরব গলা থেকে ওড়না টা আগলা করে বলে ওহ নো এটা কি হয়েছে গলায়।এভাবে ফুলে গিয়েছে আর হাতের আঙুল বসে গিয়েছে।ওই গুন্ডা গুলো এমন করেছে তাইনা।”

“আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়ে বললাম নাহ নিরব বাবা। বাবা আমাকে মেরে ফেলতে চান।”

“উনি কখন তোমাকে এভাবে মেরেছে।আমি উনাকে খুন করে ফেলবো মিথু।উনি কোন সাহসে তোমার গায়ে হাত তোলেন।যে জন্মের পর কোনো দায়িত্ব পালন করে নি।জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না।”

“আমার অপরাধ আমি জানতে চেয়েছিলাম কেনো জন্ম দিয়েছেন আমায়।আর কেনো এত অতিষ্ট জীবন দিয়েছেন?”

“তুমি এখন থেকে রেগুলার এভাবেই প্রতিবাদ করবে।ওয়েট আমি ফোন দিচ্ছি।”

“নিরব ফোন দিতেই বাবা ফোন টা রিসিভ করে বলেন তুমি কোথায় বাবা নিরব।”

“আমি কোথায় এই প্রশ্ন না করে বলুন আপনার মেয়ে মৃথিলা কোথায়?”

“ওই মেয়ের কথা বলো না।ও মাঝ পথে খাম খেয়ালি পানা ভাবে থেকে গিয়েছে ঢাকা ফিরে ওকে আর জীবীত রাখবো না।”

“আপনার একবিন্দু চিন্তা নেই যে আপনার যুবতি একটা মেয়ে মাঝ পথে কোথায় হারিয়ে গেলো আর আপনি আপনার ফ্যামিলি নিয়ে আরামে বিয়ে খাচ্ছেন।”

“বাবা ওই মেয়ে কোথাও হারিয়ে গেলে দূর হয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত হয়।”

“আপনি ওকে মেরেছেন কেনো আশরাফ আঙ্কেল।”

“ও তোমার থেকে গহনা নিয়েছে তাই মেরেছি।”

“আমার ভাল লেগেছে আমি দিয়েছি আপনি দিলে তো আর আমি দিতাম না।”

“আমি আমার সম্পত্তির কানাকড়ি ও ওর পেছনে খরচ করবো না।”

“আঙ্কেল আদেও কি সম্পত্তি আপনার।দেখা গেলো উত্তরাধীকারী ঠিক ই নিজের জিনিস বুঝে নিতে হাজির হবে।শেষ ভাল যার সব ভাল তার”
#হিয়ার_মাঝে
২৪.
#WriterঃMousumi_Akter

রাজিব চলচিত্রকর নাট্যকর শ্বশুর মশাই কে একটু ফুউউ দিয়ে দিলাম, শালা আস্ত ভিলেন সাথে বাটপার।আমি উনার এই উদ্ভট কথা শুনে তাকিয়ে রইলাম কে রাজিব কাকে কি বলছেন উনি।আমি নিরবের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে বললাম এই যে হ্যালো কে রাজিব।নিরব কপালের চামড়া কয়েক ভাজ দিয়ে বললো তোমার বাবা ভিলেন রাজিব।মনে চাই গুলি করে দেই এক্কেবারে।কিন্তু গুলিটা করতস পারছি না পিস্তলের অভাবে।

এই শুনুন বাবা আপনার কি করলো।

আমার কি করলো মানে বলেই নিরব আমার গলায় হাত বুলোতে বুলোতে বললো অনেক কষ্ট পেয়েছিলে তাইনা।এত সুন্দর একটা ফুল কিভাবে মানুষ ছিড়তে চাই।যে ফুল থেকে আমি শুধু সুবাস নিয়ে রোজ যত্ন করছি সারাজীবন সুবাস নেওয়ার জন্য সেই ফুলের উপর এত বড় আঘাত।এর পরেও জানতে চাও উনি কি করেছেন।

আমি বুঝতে পারছিলাম নিরব অনেক কষ্ট পাচ্ছে।আমার যে কোনো কষ্ট আমার থেকে নিরব ই বেশী অনূভব করে।আমি নিরব কে বললাম আমি ঠিক আছি।একটুও ব্যাথা নেই।

নিরব কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,নিজের কষ্ট টা সারাজীবন লুকিয়ে গেলে বলেই দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিলেন।আমার গলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেন মালা টা নিয়ে নিয়েছে তাইনা।আমি ঝামেলার ভয়ে বললাম যে ঢাকায় রেখে এসেছি।কিন্তু নিরবের ঠিক বিশ্বাস হলো না।

নিরব আমার দুই গালে হাত দিয়ে গলায় আলতো একটা চুমু দিয়ে বলে তোমার ভাল থাকার মেডিসিন দিয়ে দিলাম।আর ১৫ দিনের মাঝেই আম্মু আসছে এইবার বউ সাজার জন্য রেডি হয়ে নাও।নিরব আমার মাথায় ওড়না দিয়ে বলে এমনি তে যা মিষ্টি লাগে তোমায় বউ সেজে বউ হয়ে ঘুরে বেড়ালে কেমন লাগবে ভাবতেই আদর করতে ইচ্ছা করছে।

ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম নিরব আমাকে চুমু দিচ্ছিলো সেই মুহুর্তে মুনতাহা রুমের ভেতরে প্রবেশ করে ফেললো।মুনতাহা কে দেখে খানিক টা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়লাম আমি।নিরব মুনতাহা কে বললো একটু কাশি দিয়ে আসবে না বুঝতেই পারছো প্রাইভেট টাইম।মুনতাহা হেসে দিয়ে বলে আমি তো কিছুই দেখি নি শুধু দেখলাম একজন একজন কে কিছু মিছু দিচ্ছিলো।আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম।

মুনতাহা ভারী মিষ্টি একটা মেয়ে, আমাকে দেখেই বোন ডেকে ফেললো।মুনতাহা আমাকে বললো মিথু তোমাকে দেখা মাত্র আমার ফ্যামিলির মানুষ অনেক টা মানসিক শান্তি পেয়েছে কেনো জানো।এই যে রুম টা দেখছো এটা আমার ফুপির ঘর।এই ঘরে আমার ফুপি থাকতো।মিথু রক্তের সম্পর্ক না হলেও এই পরিবারের মানুষ গুলোর মানসিক শান্তির জন্য আত্মীয় হয়েই থেকে যাও না প্লিজ।আসলে মুনতাহা দের সবার এত যত্নে আমি অবাক হয়ে গেলাম।আমার কেনো জানিনা মনে হচ্ছে এ বাড়িতে আমার অনেক কিছু।এখানে থেকে যেতে ইচ্ছা করছে।আত্মার এক টান কাজ করছে।হঠাত বাইরে থেকে মুনতাহার দাদু আর বাবা আমাকে ডাকছে নিরব ইশারা দিয়ে বাইরে যেতে বললো।আমি বাইরে যেতেই ইয়া বড় একটা চেইন আমার গলায় পরিয়ে দিলেন দাদু। আমি রিতীমত অবাক আসলে কি হচ্ছে আমার সাথে এক টা মানুষের সাথে আরেক টা মানুষের হুবহু কতটা মিল থাকলে তারা এতটা পাগলামি করতে পারে।মানুষ গুলার এই আবেগ কে উপেক্ষা করতে পারলাম না আমি।যে যা ভালবেসে দিচ্ছে গ্রহন করছি।ওরা সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে থাকছে একভাবে।ওদের বাড়ির হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা আমি হলে কতই না ভাল হতো কিছু না হলেও অন্তত ভালবাসার জন্য একটা পরিবার পেতাম।

মুনতাহা নিরব কে বলে মিথু আসলে খুব লাকি নিরব।ভেবো না আমি জেলাস।আমি দূর থেকেই ভালবেসে যাবো তোমায় এই জীবনে ইচ্ছা ছিলো একবার তোমার মুখে ভালবাসি শোনার।কিন্তু মিথুর মতো ভাগ্য আমার নেই।আমি জানি তুমি মিথুতেই সীমাবদ্ধ।

নিরব একটা কষ্টের নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,মুনতাহা মিথু লাকি নয়।ও বড্ড অভাগী।ওর জীবনের সব থেকে দামী জিনিস টাই নেই।সেটা ওর মা বাবার ভালবাসা।মা ছোট বেলা ই মারা গিয়েছে।আর বাবা তার আরেক পক্ষ নিয়ে বিজি।ওর জীবনে আমি ছাড়া কেউ নেই।ওই মেয়েটা জন্ম থেকে শুধু কষ্ট ই পেয়েছে।খুব ভাল হতো যদি এমন একটা পরিবার সত্যি ওর থাকতো।আমি সারাজীবন ভালবেসে ওকে পূর্ণতা দিতে পারবো না।কারণ পরিবার থেকে ও কখনো কিছুই পাই নি।নিরব সব কিছু খুলে বললো আমার জীবনের সব ঘটনা।মুনতাহা শুনে কেঁদে দিলো।মুনতাহা কেঁদে দিয়ে বললো মেয়েটা এইটুকু বয়সে এত টা কষ্ট কিভাবে সহ্য করে বেঁচে আছে।প্লিজ নিরব তুমি ওই মেয়েটার জীবনের সব অধিকার ফিরিয়ে দাও। চরম শাস্তি দাও ওই ফ্যামিলি কে।এত টুক একটা মেয়ে এত কিছু কিভাবে সহ্য করছে।আমার ইচ্ছা করছে মিথুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেই।

মুনতাহা তুমি একটা মেয়ে হয়ে তোমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে তাহলে আমি ওকে ভালবাসি আমার কতটা কষ্ট হয় বুঝতে পারো।
মিথুর জন্য যতদূর যেতে হয় আমি যাবো। আমি এর শেষ টা দেখে নিবো।

বাবা নিরবের ফোন টা কেটেই মায়ের সাথে অশান্তি শুরু করলো।

আপু বললো মা নিরব দিন দিন মিথুর দিকে ঝুকে যাচ্ছে। মা তুমি এক্ষুনি কিছু করো।নিরব মনে হয় মৃথিলার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।

মা বললো খুলনা থেকে ফিরেই তোর আর নিরবের বিয়ে দিবো তুই একদম ই চিন্তা করিস না মা।তোর আর নিরবের বিয়ের পরে আমি মৃথিলার আসল জায়গা বুঝিয়ে দিবো।

নবনিতার বাবা কই তুমি নিরবের সাথে ফোনে কথা শেষ হলো।কখন আসছে সে।

বাবা রেগে বললেন আচ্ছা তোমাদের কি খুব বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়েছে বাসে যখন দেখলে মৃথিলা নেই তখন ওখানে নেমে গেলে না কেনো?ওকে না নিয়ে আসাটা উচিত হয় নি।

শোনো তোমার ওই অবৈধ মেয়ের জন্য আমাদের ঠেকা পড়ে নি বাস থেকে নেমে যাওয়ার।তোমার মেয়ে কি জন্য বাস থেকে নেমে থেকে গেলো শুনি।এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে।পারলে নিজের মেয়েকে শাষন করো।এটা আমার বাবার বাড়ি এখানে আমার ঠেকা পড়ে নি তোমার মেয়েকে নিয়ে আসার।তাও আমি বলে নিয়ে এসছি অন্য কেউ হলে আনতো না।আমাকে কত মানুষের কত কথা হজম করতে হয় ওই পাপের জন্য।

বাবা বললো, নবনিতা তোমার আম্মুকে সামলাও রোজ এক খোটা ভাল লাগে না শুনতে।আজ এত বিলাশিতা কিভাবে করছো শুনি।ঢাকায় দামি ফ্ল্যাট,গাড়ি, রাজকীয় চাল চলন এ সব কিভাবে হলো সে খবর আছে।মহিলা মানুষ একদম চুপচাপ থাকবে।পুরুষ মানুষের কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।আজ ও মানুষ আমাকে নানা প্রশ্ন করে মৃথিলার মায়ের মৃত্যুর জন্য।আমি তার কোনো উত্তর দিতে পারিনা।

মা বললো, অদ্ভুত সে যে সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গিয়েছে সেটা জানোনা তুমি।

আমি কিভাবে জানবো আমি তো তখন বিদেশ ছিলাম।এক দিক সামলাতে গেছি এসে দেখি আরেক দিকে ঝামেলা আমাকে কিভাবে কি সামলাতে হয় তা আমি জানি মহিলা মানুষ সব ব্যাপারে ঘ্যান ঘ্যান না করলেই কি নয়।

নিরব আর আমি সে রাতে আবার সুয়ে পড়লাম।

আমাকে খাটে দিয়ে নিরব ফ্লোরে সুয়ে পড়লো।নিরব ঘুমিয়ে পড়লে হঠাত রুমের মাঝে সাদাকালো লম্বা চুল ছেড়ে দেওয়া ফ্রেমে একটা ছবি দেখে ফুপিয়ে কেঁদে দিলাম আমি।হাউ মাউ করে কেঁদে দিলাম।কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে গড়াগড়ি শুরু করে দিলাম।নিরব সহ বাড়ির সবার ই ঘুম ভেঙে গেলো আমার এ কাঁন্নায়।সবাই এসে দেখে আমি একটা ছবি জড়িয়ে ধরে মা মা করে কাঁদছি।নিরব অবাক হয়ে যায় বাকিরা সবাই অবাক হয়ে যায়।আমি এ ছবিটা নিয়ে কেনো কাঁদছি।
মুনতাহার মা, বাবা, দাদু নিরব সবাই আমাকে ঘিরে বসে আছে আর সবাই অনুনয়, বিনয় করছে মিথু কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?কাঁদতে কাঁদতে আমার হেচকি উঠে গেলো।কেউ কোনোভাবে কাঁন্না আটকাতে পারছে না।সবার খেয়াল হয় আমি এ বাড়ির মেয়ে আরুর ছবি বুকে নিয়ে মা মা করে কাঁদছি। এটা মৃথিলার মা কিভাবে সম্ভব হলো।নিরব আমাকে বলে মৃথিলা কে এই মহিলা।

আমি নিরব কে জড়িয়ে ধরে ভীষণ জোরে আবেগ ময় কাঁন্না করে বলি নিরব এটা আমার মা।এটাই আমার মা নিরব।এই ছবিতে যিনি আছেন উনিই আমার মা হন।আমার মায়ের ছবি এখানে কিভাবে এলো নিরব।

মুনতাহার দাদু চিৎকার দিয়ে বলেন কি বললি তুই।তার মানে তুই সত্যি আমার আরুর মেয়ে।ওরে কে কোথায় আছিস দেখে যা আমার আরুর মেয়ে ফিরে এসেছে।দিদি আমার তোকে দেখেই মনে হয়েছিলো তুই আমার আরু।কারণ চেহারার সাথে যে হুবহু মিল।আমার আরুর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে আছে আর এতদিন আমরা জানতে পারি নি।আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন মনে হয় আমার আরুর খোজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য।।

মামা মানে মুনতাহার বাবা বলেন মা মিথু তুই আমার আরুর মেয়ে আমার ভাগ্নি।তোর মা কোথায় মৃথিলা।কোথায় বল আমরা যাবো।আমাদের আরু কেনো এতদিন আমাদের সাথে দেখা করতে আসে নি।আমাদের উপর কিসের মান অভিমান ছিলো আরুর।একটা বার আরুর সাথে দেখা করতে চাই আমরা।

আমার কষ্টে দম আটকে আসছিলো।কিভাবে এই বয়স্ক মানুষ টাকে বলি যে তাদের মেয়ে আর এই পৃথিবীতে নেই।মুনতাহা অঝরে কেঁদে চলেছে।সবাই বার বার জিজ্ঞেস করাতে কেঁদে দিয়ে সবাই কে বলে দিলাম মা আর এই পৃথিবীতে নেই।তোমাদের আরু আর বেঁচে নেই।তোমাদের আরুর কোনো রাগ ছিলো না কিন্তু সে এই পৃথিবীতে নেই তাই তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি।দাদু তোমার আরু আর নেই দাদু।

দাদু বুকে হাত দিয়ে খুব কষ্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।দীর্ঘ বিশ বছর অপেক্ষা করার পর বৃদ্ধ বাবা যদি জানেন তার মেয়ে আর এই পৃথিবীতে নেই তাহলে কতটা কষ্ট লাগে।

নিরব তখন মামা আর দাদু কে বোঝায় আপনারা তো এতদিন এই ভেবেই ছিলেন আপনাদের আরু নেই কিন্তু আজ দেখুন আরু নেই আরুর মতোই দেখতে আরুর মেয়ে এসেছে।ওকে বুকে জড়িয়ে নিন।দেখবেন অনেক হালকা লাগবে।মামা আর দাদু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে তোকে আর আমরা কোনদিন যেতে দিবো না।তুই আমাদের সাথেই থাকবি।আমি দাদু আর মামাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আমি কোথাও যাবো না তোমাদের ছেড়ে।আমি অনেক খুজেছি আমার মামা বাড়ি কিন্তু কোনদিন খুজে পাই নি।হাজার চেষ্টা করেও জানতে পারিনি আমার মায়ের পরিবার কোথায়?আমার বাবা কোনদিন আমাকে ঠিকানা দেই নি।

তখন মামা বলেন কে তোর বাবা মা,বল আমাদের কে সে যে এত বড় সেল্ফিস।তার মুখ আমরা একটা বার দেখতে চাই।দাদু বললো কে সে যে আমাদের সাথে তোর যোগাযোগ করতে দেই নি।নিরব বলে আপনাদের আমি সব বলবো আজ আর কোনো প্রশ্ন নয়।আজ মিথুর জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন।ওর জীবনে এত টা খুশি ও কোনদিন হয় নি।মামি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে মা মিথু আমাকে তুই মা বলে ডাকবি। মুনতাহা আমাকে বোন বলে জড়িয়ে ধরে।আমি বলে বোঝাতে পারবো না আমার জীবনের এই চরম সুখের মুহুর্তের কথা।এক জীবনে আমার এই বিশেষ সুখ পাওয়া টা আমার মনে হচ্ছিলো বন্দি করে রাখি।আমাকে এত বেশী ভালবাসার মানুষ এই পৃথিবীতেই ছিলো।

নড়াইলের ছোট্ট এই পরিবারে বিশাল এক আনন্দের কারণ হয়ে উঠলাম আমি আর নিরব।দাদুদের সব আত্মীয় রা চলে আসলো পরের দিন ই।আমাকে ঘিরে যেনো সবার আনন্দের বিশাল কারন।মায়ের সব আত্মীয় গোল্ড ছাড়া আমার মুখ দেখে নি।

পরের দিন রাতে নিরব আর আমি রুমে সুয়ে রইলাম।এখানের সবাই জানে আমরা বিবাহিত।নিরবের বুকে মাথা রেখে ভীষণ ভাবে কাঁদলাম।নিরব আমাকে কাঁদতে একটুও নিষেধ করলো না।কারণ ও জানে এ কাঁন্না আমার পরম সুখের কাঁন্না। নিরব না থাকলে আমি আজ জীবনের এত বড় পাওয়া টা পেতাম না।

চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here