হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ১৪+১৫

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৪ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২২. জোৎস্নার অপরূপ ছায়ার সমারোহে আলোকিত হয়েছে চারিপাশ। চলন্ত ট্রাকে চড়ে মৌনি আর নিভ্র আপনমনে সে দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। দুধারে দিগন্তজোড়া বিস্তৃত প্রান্তর ; মাঝখান দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাওয়া ট্রাক।অনুভূতিটাই অন্যরকম। ক্ষণে ক্ষণে ট্রাকের পাশ দিয়ে গাড়ি বাসও চলে যাচ্ছে নিজ গতিতে। মৌনির কাছে সব কিছু কেমন যেন বিস্ময়ের মতো লাগছে। মৌনি জীবনেও কল্পনা করতে পারেনি এত গহীন রাতে কোনো একটি ছেলের সাথে সে এভাবে ট্রাক জার্নি করবে। কৌতুহলতার গাছটি যেন আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে। নিভ্র এবার চিৎ হয়ে বস্তার ওপর শুয়ে পড়লো। চোখে-মুখে যেন প্রাণোচ্ছলতার খেলা। নিভ্র ইশারায় মৌনিকে বলে নিভ্র পাশে বস্তার ওপর শুয়ে পড়তে। কিন্ত মৌনি প্রথমে দ্বিধা জানায়। একে তো বস্তাগুলো বেশ ময়লা দেখাচ্ছে আবার নিভ্রর পাশে শুতেও অন্যরকম লাগছে। যদিও এর আগে নিভ্রর সাথে বেশ দূরত্ব নিয়ে শুয়েছিলো। কিন্ত তখনকার ব্যাপার আর এ ব্যাপারটি অন্যরকম।
নিভ্র মৌনিকে আগের মতোই হাটুগেড়ে বসে থাকতে দেখে এবারওর হাত টান দিয়ে পাশে শুয়িয়ে দিলো। ঘটনাটি ঘটেছে হঠাৎ করে। তাই পরিস্থিতি মৌনি বুঝে উঠতে না পেরে বস্তায় শুয়ে পড়লেও মৌনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নিভ্রর দিকে। নিভ্র অপার বিস্ময়ের সাথে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে রয়েছে স্মিত হাসি। জোৎস্নার মায়াবী আলোর খেলায় নিভ্রকে এখন কোনো রাজপুত্র থেকে কম লাগছে না। রাজপুত্র যেমন ঘোড়া চড়ে তার প্রেয়সীকে নিয়ে যায় ; নিভ্র নিয়ে যাচ্ছে ট্রাকে করে। ব্যাপারটা ভিন্ন ধরনের বটে।
নিভ্র এবার মৌনির দিকে তাকাতেই দেখলো মৌনি ফ্যালফ্যাল চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিভ্র তাই ওর মুখের সামনে চুটকি বাজিয়ে বললো………….
—এই যে ম্যাডাম ! আমায় দেখার জন্য এখনও দিন পড়ে আছে। এখন এই আকাশটির দিকে একবার তাকান তো !
নিভ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে মৌনিও তাকালো খোলা আকাশের দিকে। তাকাতেই সে যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। এ তো কোনো আসমান না যেনো এক মায়াস্বর্গ। নিশিরাতের এই গুমোট পরিবেশে মনমাতানো জোছনার আমেজে চারিদিক হয়ে উঠেছে প্রাণমুখর। মৌনি অস্পষ্টস্বরে বলে ওঠলো…………
—মাশাল্লাহ !
.
মৌনির জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। সে কখনও ভাবেনি যে নিশিরাতে এভাবে খোলা আকাশের অভূতপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে। নিভ্র উদাসীনভাবে মৌনির দিকে মনোনিবেশ করে। মেয়েটার মায়াবী মুখে টানটান উত্তেজনা। হাসিটি যেন মুক্তার মতো ঝরে পড়ছে। নিভ্র এবার বললো………
—মানুষকে অবাক করতে আমার বড্ড বেশি ভালোলাগে।
—তো সেই ভালোলাগাটা পরিহার করেন। এখন থেকে আপনি শুধু আমাকে অবাক করবে। অন্য কাউকে না।
—কেন?
.
মৌনি এতক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলো। নিভ্রর ”কেন” শুনে মৌনি এবার নিভ্রর সাথে ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। নিভ্র এখনও কিছুটা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আছে। মৌনি তা দেখে নিভ্রর কানের কাছে নিজের মুখ নিয়ে নেয়। তারপর বললো………..
—কারন। আপনার অবাক করার মতো অস্বাভাবিক গুণের প্রেমেই আমি প্রথমে পড়েছিলাম। আপনি এমন একজন মানুষ যে সহজেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে। আকৃষ্ট করতে পারে নিজের দক্ষতা দিয়ে। এখন যদি অন্য মেয়েরাও আপনার প্রেমে পড়ে বিড়ালের মতো আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো ; তবে আমার কি হবে? আপনি শুধু আমার মালাইয়ের কৌটা। অন্য করো জংলী বিড়ালকে আমার মালাইয়ের কৌটার কাছে ঘেঁষতে দিবো না।
.
মৌনির নির্লিপ্ত কন্ঠ শুনে নিভ্র কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে। নিজেকে মালাইয়ের কৌটার সাথে তুলনা করা দেখে নিভ্র হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছে না।
—নিভ্র ভাই !
—হুমমম !
—আপনি কি আমার মতোই প্রথম এমন জোছনা উপভোগ করছেন?
—না।আমার এটা কত নম্বর অভিজ্ঞতা তা আমার জানা নেই।
—এর আগেও তবে উপভোগ করেছিলেন?
—অনেক । তবে যেটা আমার স্মরণীয় হয়ে ছিলো সেটা হলো বান্দরবানের নীলগিরির সেই রাতটি। প্রায় দেড় বছর আগে আমি আমার ব্যাচমেটদের সাথে গিয়েছিলাম। সময়টা ছিলো শীতকাল। মেঘ আর কুয়াশা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জরিয়ে নিয়েছিলো। সেই অভিজ্ঞতাটা আমি কখনও মুখে বলতে পারবো না।
.
নিভ্রর চোখে মুখে দেখা যাচ্ছে একরাশ প্রশান্তি। মৌনি তা দেখে মলিন হাসে। নিভ্রর মতো ওর জীবনটা এত সুন্দর ছিলো না। কঠিন সংগ্রাম করে ঢাকার মতো এক অচেনা শহরে পড়াশুনা চালিয়েছে সে। তার কোনো ফ্যামিলি পাওয়ার ছিলো না বিধায় পড়াশুনাসহ ছাত্রাবাসে থাকার ক্ষেত্রেও বাঁধা পড়েছে বিভিন্নভাবে। সাংবাদিকতা পেশাটা আজ অনেকের কাছেই হাস্যের ক্ষেত্র কিছু অসাধু সাংবাদিকদের মিথ্যে খবর প্রচারের ফলে। তবে মৌনি সেসব এড়িয়ে নিজের সর্বোস্ব দিয়ে পড়াশুনা চালিয়েছে।
—কি ভাবছো?
নিভ্রর ডাকে মৌনির ধ্যান ভাঙ্গে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে প্রতিউত্তরে বললো……….
—তেমন কিছু না। আমাদের যেতে আর কতক্ষণ লাগবে।
—উমমম। বলতে পারছি না। চিন্তা নেই ট্রাকওয়ালা মামা ঠিকঠাকমতো জায়গায় নামিয়ে দিবে। আর বাকি পথ তো তুমি জানো।
—হ্যাঁ।
.
.
দুজেই এখন নীরব। নিভ্র কি করছে মৌনি তা জানেনা তবে মৌনি অনুভব করছে নিভ্রর নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের খেলাটি। মাঝে মাঝে তো মৌনির মনে হয় যে এটা অনুভব করতে করতেই মৌনি জীবন পার করে ফেলবে। এখন একটু ঠান্ডা লাগছে। একে তো হাওয়ার প্রকট তার ওপর গাছগাছালি ঘেরা পরিবেশ বলে তাপমাত্রার নিম্নতা। নিভ্র সামনে মামার থেকে একটি চাদর নিয়ে মৌনির দিকে এগিয়ে দেয়। মৌনিও কোনো কথা না বলে চাদরটি নিজের গায়ে জরিয়ে নিলো। এখন একটু হলেও ঠান্ডা কম লাগবে। কিন্ত হঠাৎ মৌনি কি মনে করে নিভ্রর সাথে মিশে গিয়ে দুজনের ওপরই চাদরটা পেচিয়ে নিলো। নিভ্র কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছে মৌনির এরূপ আচরণে ।
—আরে ! এটা কি হলো?
—হুশশশ! একটা কথাও না। চাদরটা বড় আছে। অনায়াসেই আমাদের দুজনের হয়ে যাবে। তবে আমি একা পেচিয়ে রাখবো কেনো?
.
নিভ্র নীরব হয়ে যায়। কিছুটা অস্বস্তিতে ; কিছুটা দ্বিধায়। মৌনির এভাবে হুটহাট করে কাছে আসাটা নিভ্রকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তোলে। যত কিছুই হোক না কেন ; নিভ্র একজন যুবক । আশেপাশে এমন আবেদনময়ী যুবতী যদি নিজ থেকে কাছাকাছি এসে পড়ে যেকোনো ছেলে একটুর জন্য হলেও নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। নিভ্র একটা লম্বা শ্বাস নিলো। এসব কু চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্য কিছুতে মনোনিবেশ করতে হবে। মৌনি একহাত দিয়ে নিভ্রর বাহু জরিয়ে রেখেছে। হঠাৎ মৌনি বলে ওঠলো……..
—আমি সত্যিই কি কখনও আপনাকে ভুলে যাবো?
.
এমন প্রশ্নে নিভ্র কিছুটা অবাক। সবকিছু তো ঠিকঠাকই ছিলো তবে হুট করে মৌনির মাথায় এ প্রশ্ন কেনো আসলো এটা নিভ্র ভেবে পেলো না। ঠোঁটে একটি স্মিত হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো নিভ্র বললো…………
—কি মনে তোমার?
—আমার মনে হয় ভুলে যাবো।
—কেনো?
—আমার Disorder এর কারনে………
—থামো।
মৌনির কথার মাঝখানেই নিভ্র মৌনিকে থামিয়ে দেয়। বাতাসের দাপটের কারনে মৌনির কেমন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু। নিভ্র এবার মৌনির দিকে কোমল চোঁখে তাকায়। ঠোঁটদুটো হালকা নাড়িয়ে বলে উঠলো…………
—মানসিক রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বড় আর শক্তিশালী উপায় কি জানো? তোমার রোগটিকে ভুলে যাওয়া। সাধারনত ডাক্তাররা অন্য রোগের ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার জন্য বারবার বিষয়টিকে মনে রাখার জন্য বলে। কিন্ত সাইক্রেটিস্ট ডিপার্টমেন্টটি অন্য মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে যেমন ভিন্ন ; তেমনি ট্রিটমেন্টও ভিন্ন।
তাই তুমি সবসময় মনে করবে তুমি সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষ। এখন তুমি যদি তোমার রোগের জন্য চারিদিক থেকে নিজেকে বদ্ধ করে রাখো তবে তোমায় কষ্ট তাড়া দিবে। তুমি বাধ্য হবে তোমার স্মৃতিগুলো ভুলতে। এখনকার উদাহরণটাই দেই। এইতো এতক্ষণ আমার সাথে দিব্যি ছিলে আর হঠাৎ তোমার মনে হলো ”আরে ! তুমি তো স্বাভাবিক না” ।ব্যাস ! দুঃখ আর মানসিক যন্ত্রনাটি তোমার তাড়া দিয়ে দিলো। তাই আমি একটাই কথা বলবো ; যতই তোমার সমস্যা থাকুক না কেন ; তুমি তা ভুলে থেকে লাইফটা ইন্জয় করার চেষ্টা করবে। অতীত মানুষের জীবনে ভালো-খারাপ দুটোই হতে পারে । তবে উপভোগ কখনও খারাপ হতে পারে না। জীবনে অভিজ্ঞতা যত বেশি থাকবে জীবন সেসব কঠিন স্মৃতি ভুলে যাবে। আর তোমার কথা শুনলেই বোঝা যায় যে তুমি একটা লম্বা সময় ফ্যালিলির সাথে স্পেন্ড করোনা। তাই তোমায় কুমিল্লায় তোমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি।
.
নিভ্রর কথার রাজ্যে মৌনি এতক্ষণ যেনো হারিয়ে গিয়েছিলো। এসব বিষয় নিয়ে কখনোই সে গভীরভাবে চিন্তা করেনি তাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে নিভ্রর কথাগুলো সে ভাবতে থাকে। বিষয়টা আসলেই সত্যি……..”Mind is related with heart & soul” অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্ক হৃদয় আর আত্নার অধীনে থাকে। নিভ্র নামের এই ছেলেটা যেমন ঝড় হয়ে ওর জীবনে এসেছিলো তেমনি বৃষ্টির মতো এখন ওর জীবনে ছড়িয়ে দিয়েছে জ্ঞান। নিভ্রর কাছেই মৌনি ভালোবাসার সংজ্ঞা শিখেছে , শিখেছে উপভোগ মানে কি , আনন্দে থাকা মানে কি।
মৌনির কাছে সবকিছু অনেক সুন্দর লাগছে শুধুমাত্র এই নিভ্রর কারনে। এই নিভ্র হারিয়ে গেলে ওর জীবনের অস্তিত্বও হয়তো মৌনি হারিয়ে ফেলবে। আচমকা মৌনি বললো……
.
—নিভ্র ভাই ! তোমার কথার ছলে আমি একদিন মনে হয় হারিয়েই যাবো।
নিভ্র আলতো হেসে বলে……..
—মোটেও না। এই নিভ্রর শিরায় উপশিরায় মৌনির বিচরণ থাকবে।
.
নিভ্র এই কথাগুলো মৌনির খুব কাছে এসে বললো। যার দরুন নিভ্রর উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছে। উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো মৌনি। নিভ্রর সংস্পর্শটা ওর হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। নিভ্র নিজের মাতাল করা চাহিনীর সাথে এক নতুন অনুভূতির সংস্পর্শ দিলো যেনো। সবজায়গায় অজান্তেই ও নিভ্রকে অনুভব করতে পারছে। মানসিক রোগটা কখনও মৌনির কাছ থেকে যাবে কি-না এ ব্যাপারে ও অনিশ্চিত তবে নিভ্র নামক এই প্রেমরোগে মৌনি আজীবন ভুগতে চায়। অনুভব করতে চায় নিভ্রর শীতল স্পর্শগুলো।
.
.#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ১৫ [থ্রিলার+রোম্যান্টিক]
#কায়ানাত_আফরিন
.
২৩.সকালের এই সময়টা মৌনির কাছে লাগছে অনেক বিষাক্ত। সময়ের প্রবাহ যেন কোনো ক্রমেই কেটে উঠছে না। মৌনি কাচুমাচু করে সোফায় বসে আছে আর পাশে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে নিভ্র। মৌনির ঠিক সামনের সোফাতেই মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ওর বাবা আশরাফ হাসান। চোখের দৃষ্টি বরাবরের মতোই তীক্ষ্ণ। আশরাফ হাসান মেয়ে মৌনিকে অনেক আদর করলেও মৌনি তাকে অনেক ভয় পায়। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে কথা।
এদিকে মা পরী বানু আর বোন নিধাও বসার ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। মৌনির সাথে একটা ছেলেকে দেখে সবার মনেই বেশ প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক। নীরবতা কাটিয়ে আশরাফ হাসান মৌনিকে বললো,
.
—ছেলেটা কে মৌনি?
মৌনি নীরব। আসার আগে নিভ্র ওকে বলে দিয়েছিলো কোনো কিছুর উত্তর না দিতে। নিভ্র কিছু একটা ভেবে রেখেছে আর পরিস্থিতি সামলানোর জন্য নিভ্রই সব কিছু ম্যানেজ করবে। নিভ্র প্রচন্ড তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। কোন পরিস্থিতিতে ঠিক কি কথা বলতে হবে এ জ্ঞানটা নিভ্রর বেশ ভালো আছে। আর তাই মৌনি নিভ্রর ওপর আস্থা ছেড়ে দিয়ে নীরবে বসে থাকলো।
—আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি মৌনি? হঠাৎ করে তুমি এলে সাথে একজন ছেলেকে নিয়ে। কে ছেলেটা?
এবার ধমকের স্বরে বলে ওঠলেন আশরাফ সাহেব। মৌনি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে বাবার এমন ক্ষীপ্ত কন্ঠ শুনে। এবার নিভ্র বলে ওঠলো………
—আমি সামনেই বসে আছি আঙ্কেল। আমাকেই জিজ্ঞেস করতে পারেন।মৌনি ভয় পেয়ে যাচ্ছে আপনার ধমকের কারনে।
.
আশরাফ সাহেব বিস্ময়ের চোখে একবার মৌনির দিকে তাকালো তো একবার সামনে বসে থাকা সুদর্শন আর মার্জিত এই ছেলেটার দিকে। মৌনির ব্যবহারে হঠাৎ পরিবর্তনে তিনি যেমন হয়েছেন অবাক ঠিক তেমনি ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিতে চোখে-মুখে ফুটিয়ে তুলেছেন বিস্ময়। ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি আসলেই খুব সুন্দর। খুব সহজেই এমন তীব্র কন্ঠ দ্বারা পরিবেশ সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আছে ছেলেটার মধ্যে যা আশরাফ সাহেব কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন। কিছুটা শান্ত হলেন তিনি। গম্ভীর কন্ঠে নিভ্রকে বললেন………..
—কে তুমি?
—আমি নিভ্র আহমেদ। পেশায় একজন সাইক্রেটিস্ট আর কিছুদিন হলো মেডিক্যাল কলেজে একজন লেকচারার হিসেবে জয়েন হয়েছি। আর আমি জানি যে আপনি আপনার পরিচয় জানতে চাননি। আপনি মূলত জানতে চেয়েছেন যে মৌনির সাথে আমার সম্পর্ক কি যা আপনি না বলা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পেরেছি। সম্পর্ক এখনও আমাদের হয়নি তবে আমি মৌনিকে ভালোবাসি।
.
নিভ্রর নিঃসংকোচ কন্ঠ। আশরাফ সাহেব এবার অবাক । প্রচন্ড রকমের অবাক। এতটাই অবাক যে তিনি ফ্যালফ্যাল করে নিভ্রর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কখনও কোনো ছেলেকে এতটা আত্নবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে দেখেননি। তাও আবার ভালোবাসার ব্যাপারে। মৌনির মা পরী বানু আর নিধাও এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব। মৌনি মাথা নিচু করে বসে আছে।নিভ্র আসলে কি করতে চাচ্ছে কিছুই ওর মাথায় আসছে না। আশরাফ সাহেব এবার আরও গম্ভীর হলেন। নিভ্রকে প্রতিউত্তরে কি বলা উচিত এটা উনার মাথায় আসছেনা।তবুও কন্ঠস্বর কিছুটা ভারী রেখে নিভ্রকে বললেন………..
.
—তোমার সাহস আছে বলতে হবে। এভাবে খোলামেলাভাবে কখনও কোনো ছেলে আমার মেয়ের জন্য আমায় এ ব্যাপারে বলেনি। বেশিরভাগ সময়ে ছেলেরা তার প্রেমিকার বাবার সামনে এসে নার্ভাস হয়ে পড়ে। তবে তুমি ভিন্ন।
.
বিনিময়ে নিভ্র একটা সৌজন্যমূলক হাসি হাসে। আশরাফ সাহেব কিছুটা ইমপ্রেসড হয়েছেন নিভ্রর ওপর। ছেলেটার কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে বেশ মার্জিত আর তীক্ষ্ণ বিচক্ষণতাসম্পন্ন মানুষ। মনে মনে নিজের মেয়ের জন্য এমন একটা ছেলেকেই তিনি চাইতেন। কিন্ত মৌনির ব্যবহারে কিছুটা হতাশ তিনি। বিগত চার মাস আগেও মৌনি ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলো। কিন্ত তখনকার মৌনি আর এখনকার মৌনির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আশরাফ সাহেব ঠিক অনুমান করতে পারছেন না মৌনির সমস্যাটা কোথায়। নিভ্র উনার সব বিষয়ই পর্যবেক্ষণ করছিলো। হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে তার সমস্যাটা। তাই নীরবতা কাটিয়ে নিভ্র এবার বললো………
.
—আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাচ্ছি আঙ্কেল ! সুযোগটা কি পাওয়া যাবে?
—অবশ্যই। আমার সাথে ছাদে এসো।
.
.
.
———————————————
আজ আকাশটা বেশ মেঘলা। সকালের এই সময়টা রৌদ্দুরের রশ্নিতে উত্যপ্ত হওয়ার কথা। কিন্ত মেঘের হাতছানিতে সেই উষ্ণতাটি এখন শীতলতায় রূপ নিয়েছে।বর্ষার মৌসুম বিধায় আশপাশ থেকে ধেয়ে আসছে বনফুলের আবছা ঘ্রাণ। মৌনির বাড়িটা আসলেই চমৎকার। একপাশে রয়েছে সুবিশাল দিঘি আর অপরপাশে গ্রামীন মেঠো পথ। সেই পথটা শেষে সুবিশাল প্রান্তরের সাথে মিশে যায়। ছাদেও বেশ কয়েকটা ফুলের গাছ রয়েছে। নিভ্রর ধারনা এগুলো সম্ভবত মৌনির স্কুল পড়ুয়া বোনটাই দেখাশুনা করে।
.
—কি বলতে চাও তুমি?
আশরাফ সাহেবের কথায় নিভ্রর তার দিকে মনোনিবেশ করে। উনি তাকিয়ে আছেন নিভ্রর দিকে। চেহারায় মোটামুটি বার্ধক্যের ছাপ পড়লেও প্রচুর কর্মঠ বিধায় একচুল পরিমাণও নুয়ে পড়েননি তিনি। নিভ্রর বিষয়টা ভালোলাগলো।
—মৌনির ব্যাপারে কথা বলতে চাই? (নিভ্র)
—মৌনির ব্যাপারে? কি কথা? (আশরাফ হাসান)
.
নিভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো……………….
—মৌনি সুস্থ না আঙ্কেল। ও মেন্টালি ডিপ্রসড হয়ে আছে একটা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারনে। এটাকে Disorder ও বলা যেতে পারে।
আশরাফ হাসান এবার হতভম্ব। যেনো নিভ্রর কথা তিনি বিশ্বা করতে পারছেন না। তবে কিছুক্ষণ ধরে পরিচিত এই ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছেনা যে সে অবিশ্বাসের পাত্র। কিছুটা ভাঙ্গা গলায় নিভ্রকে বলতে চেষ্টা করলেন,
—এসব………..কি ব-বলছো তুমি?
—আমি যা বলছি সবই সত্য আঙ্কেল। এই দেখুন রিপোর্ট।
নিভ্র নিজের সাথে থাকা ব্যাগের থেকে একটা রিপোর্ট এগিয়ে দিতেই আশরাফ হাসান কাঁপাকাঁপা হাতে সেই রিপোর্টটি নিয়ে নেন। রিপোর্ট পড়ে তিনি স্তব্ধ। নিজের মেয়ের এমন ভয়াবহ অসুস্থতা ক’জন বাবাই বা সহ্য করতে পারবে? আশরাফ সাহেব এবার ছাদে থাকা চেয়ারটিতে কিছুটা দুর্বল হয়ে বসে পড়েন।নিভ্র বরাবরের মতোই শান্ত।
—মৌনি জানে এ ব্যাপারে?
—জানে। তবে পুরো সত্য জানে না।
—মানে?
নিভ্র কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। তারপর মিহি কন্ঠে বললো……….
—তিন মাস সময় আছে ওর কাছে। যদি ঠিকঠাকমতো চিকিৎসা না করা যায় তবে ওর মেমোরি লস হওয়ার চরম সম্ভাবনা আছে। শুধু তাই না ; যদি ও প্রেশার না নিতে পারে তবে লাইফ রিস্কও আছে।
.
টুপ করে আশরাফ সাহেবের চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। মেয়েটার জন্য বুক হাহাকার করে উঠছে তার। নিভ্রর কিছুই করার নেই। কিন্ত এসময় সান্তনা দেয়ার বদলে শক্ত থাকা প্রয়োজন। শুধুমাত্র মৌনির জন্য।
—আমি তাই মৌনিকে আপনাদের কাছে নিয়ে এসেছি যাতে ও কিছুটা হলেও টেনশন মুক্ত থাকতে পারে।
—মৌনির Disorder এর কারন কি?
—হঠাৎ এ প্রশ্ন?
—আমি জানি যে কোনো মানিসিক রোগ শনাক্ত হয় কোনো পরিবেশের ওপর ভিত্তি করে। তাছাড়া আমি কখনও আমার মেয়েকে এতটা টেনশনে দেখিনি। ওকে সেরকম চাপের মধ্যেও বড় করিনি। তাছাড়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ও যে বিভাগে পড়ছে সে বিভাগটাও ওর রোগের সাথে সংযুক্ত না। তবে?
—ডেঙ্গু, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগের যেমন এন্টিভাইরাস থাকে ঠিক তেমনি ভাইরাসের ডোজও থাকে। কিছু অসৎ মানুষ তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের ওপর এসব ভাইরাস প্রয়োগ করে। মৌনির এই Disorder এর জন্য ওর অজান্তেই এরকম একটা ডোজ দেওয়া হয়েছিলো।
—কিন্ত কেন? কে আমার মেয়ের ক্ষতি করতে চাইবে?
—সাংবাদিকতা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ঝুঁকি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। একটা বড় গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে মৌনির কাছে কিছু এভিডেন্স ছিলো। আর ঘটনাটি ছিলো সেটাকে কেন্দ্র করেই…………
এরপর একে একে মৌনির সব ঘটনা নিভ্র আশরাফ হাসানকে বলে। মৌনির পায়ে গুলি হওয়া থেকে শুরু করে ওর অস্বাভাবিক কাজকর্ম , হুট করে নিভ্রকে আক্রমণ , মৌনির কিডন্যাপ সবকিছু। মেয়েটার জীবনে এতকিছু হয়ে গিয়েছিলো যা আশরাফ সাহেব জানতেন না বিধায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়ে তো আর ভুল পথে যায়নি। বাবার ইচ্ছে পূরণের জন্যই মৌনি সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা বেছে নিয়েছিলো। তবে কি এই ক্ষেত্রটাই কাল হয়ে দাঁড়ালো মেয়েটার জীবনে?
—চিন্তা করবেন না আঙ্কেল ! আমি থাকতে মৌনির কিছুই হবে না। আমি ওর ট্রিটমেন্ট করবো। তবে এখন ওর ঢাকা যাওয়া কিছুটা রিস্কি। তাই এখানেই রেখে গেলাম। ওই জহির আর রিদান শেখকে আমি দেখে নিবো।
নিভ্রর কন্ঠে একরাশ তীক্ষ্ণতা আছে। যার জন্য কিছুটা হলেও আশরাফ সাহেব আশ্বস্ত হলেন। নিভ্র ছেলেটাকে তার ভালোলেগেছে। নিভ্রর আচার-আচরণ , বাচনভঙ্গি আর পরিবেশ সামলে নেওয়ার মতো ক্ষমতাগুলো সবাইকেই আকৃষ্ট করে তুলবে। মৌনির এই অগোছালো জীবনটাকে গুছিয়ে তুলতে নিভ্রর মতো একজন ছেলেই প্রয়োজন। তিনি কখনও ভাবতে পারেননি যে তার মেয়ের জন্যও এমন কোনো প্রেমিক থাকবে যে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তাকে আগলে রাখলেন। নিভ্রর কাধেঁ একটা চাপড় দিয়ে মুচকি হেসে আশরাফ সাহেব চলে গেলেন নিচে।
নিভ্র তখনও সেখানে ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অনুভূতিতে জর্জরিত হয়ে। মৌনিকে প্রচন্ডরকম ভালোবাসলেও মনে একটা ভয় আছে। মৌনিকে হারানোর ভয়। হয়তো মৌনি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে কিন্ত নিভ্র জানে ও স্বাভাবিক না।
সময়টাও কেমন যেন বহমান। বৃষ্টির ছোট ছোট কণা নিভ্রর গায়ের ওপর পড়লেও নিভ্রর সেদিকে হুসঁ নেই। আনমনে নিভ্র বলে ওঠলো………..
.
—তোমার প্রতি প্রেমটা আমার তীব্র মৌনি। এতটাই তীব্র যে আমি চাইলেও যেই তীব্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না। হয়তো আমাদের সম্পর্কের সূচনাটি বেশ অদ্ভুদভাবে হয়েছিলো। কিন্ত আমি চাই তোমায় আজীবন আঁকড়ে ধরে বাঁচতে।চাই অন্তিমে একে অপরের হৃদয়সিদ্ধুর পাড় হয়ে থাকতে।❤
.
.
.
~চলবে
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।
.
.
~চলবে
আমি একটু কনফিউজড আছি যে আপনাদের ভালোলাগছে কি-না। তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছিনা। পজেটিভ-নেগেটিভ কিছু একটা বলবেন অপেক্ষায় থাকলাম। আপনাদের সাড়া না পেলে গল্প লেখার মনমানসিকতাটা চলে যায় তবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here