গল্পটা_আমারই পর্ব : ১০

#গল্পটা_আমারই

পর্ব : ১০
(সুরমা)

একটা রিকশা ডেকে আমরা কমলাপুর স্টেশনে চলে যাই। আমার আনন্দ সব শেষ। ট্রেন আসার কথা ৮.৩০ টায়। এখন বাজে ৯.৪৬ । এখনও ট্রেন আসার কোনো নাম গন্ধ নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ের বারোটা বেজে গেছে।

রেল স্টেশন হলো আজব জায়গা। কতো রঙ বেরঙের মানুষের সন্ধান মিলে এখানে। অনেক পথশিশুদের জায়গা এই স্টেশনে। অর্ণব আমাকে জিজ্ঞেস করে,,,,,

– মীরা, খারাপ লাগছে? আমি অর্ণবের দিকে তাকিয়ে একবার ওকে দেখি। ওর বাহু চেপে ধরে ওর বাহুতেই আমি আমার গাল ঠেকিয়ে বলি,,,,
– না
– ওখানে জায়গা আছে বসো। অর্ণব আগেও আমাকে বলেছিল বসতে। পিলারের নিচে বসার মতো জায়গা আছে। লোকজন এখানে এসে বসে থাকে। বাট যেটুকু জায়গা ফাঁকা আছে ঐটুকু জায়গায় একজন বসা যাবে। আমি বসবো আর ওও দাঁড়িয়ে থাকবে এ কেমন কথা। ওকে রেখে আমি বসতে পারবো না। দাঁড়িয়ে যদি থাকতে হয় দুজনেই দাঁড়িয়ে থাকবো। তাই যাইনি। কিন্তু আমি দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিলাম না। পা ব্যথা করছিল।

১০টায় ট্রেন আসে স্টেশনে। শোভন চেয়ার। তাই ভিড়ের মধ্যে আমাদের ঠেলাঠেলি করতে হয়নি। স্টেশনে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে আমার ভাল রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে চট্টগ্রাম থেকে একটা ট্রেন এসে থামতেই দেখলাম কিছু লোক দৌঁড়াদৌঁড়ি করে ট্রেনে উঠলো। কার আগে কে উঠবে এই নিয়েও ঠেলাঠেলি। এটা দেখে আমি বিস্মিত হলাম। অর্ণবের হাত ঝাকিয়ে বললাম,,,,,

-ট্রেন থামার আগেই সবাই এমন ছুটাছুটি করছে কেন? লাফিয়ে লাফিয়ে ট্রেনে উঠার কি দরকার? এখনতো ট্রেনটা এমনি থামবে। কেউ যদি ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে যায়।

আমি খেয়াল করে দেখলাম ট্রেনের এক একটা বগি বেশ উচু। প্লাটফরম থেকে ট্রেনে লাফ দিয়ে উঠতে হয়। ওদের এমন ঠেলাঠেলি দেখে আমারই ভয় ভয় লাগছে। অর্ণব বলে,,,,,

-আগে উঠে সিট না নিলে সিট পাবে না। তখন দাঁড়িয়ে থেকে যেতে হবে। এবার আমি হা হয়ে গেলাম। তার মানে আমাদেরও এভাবে লাফিয়ে উঠতে হবে? নাহলে সারাটা পথ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে???

ওর কথা শোনে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে। আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। তাছাড়া আমি কখনও এভাবে লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে পারবো না। অর্ণবকেও এভাবে লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে দিবো না। ওও যদি ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্লাটফরম আর ট্রেনের ফাকা জায়গায় পড়ে যায়। না না। কিছুতেই না। আমি অর্ণবের হাত চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,,,,

-আমি তোমাকে কিছুতেই এভাবে লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে দিবো না। আমিও উঠবো না। আমার ভয় করে। আমার কথা শোনে অর্ণব হেসে দিয়ে বলে,,,,,

-আমরা শোভনে যাবো। এটা মেইল ট্রেন। আমি বললাম,,,,,
-মেইল ট্রেন কি?
-টিকিট ছাড়া ট্রেন। ভাড়া কম। ১০০ থেকে ১২০টা। এখানে নির্দিষ্ট কোনো টিকিট নাই। যে যেখানে বসতে পারে। বাট আমাদেরটা এমন না। আমি টিকিট কিনে নিয়ে এসেছি। আমাদের এভাবে সিট নেওয়ার জন্য দৌঁড়াতে হবে না।

অর্ণবের কথায় আমি বেশ স্বস্তি পেলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ট্রেন চলে আসে। তবে আমি ট্রেনে উঠতে ভয় পাচ্ছিলাম। অর্ণব প্রায় আমাকে কোলে করে ট্রেনে তুলে।

ট্রেনে উঠার দশ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেয়। ইশ! ইন্টারেস্টিং ফিলিংস। আমি জানালার পাশের সিটটায় বসেছি। অর্ণব আমার পাশেরটায়। স্টেশনে যে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে বোরিং হচ্ছিলাম, এতো কষ্ট লাগছিল তার সমস্ত ক্লান্তি এক মিনিটেই শেষ হয়ে গেলো। ট্রেন ছাড়তেই খুব ভাল লাগছিল।

প্রথমবার ট্রেনে উঠলাম। চারপাশের সবুজ গাছপালা দৌঁড়ে পিছনে চলে যাচ্ছিল। আমার খুব ভাল লাগছিল এগুলো দেখতে। আমি অর্ণবের কথা ভুলে গেলাম। বাহিরের প্রকৃতি দেখার নেশায় পড়ে গেলাম। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে হাত বের করে দিলাম। জানালার পাশে বেশ বাতাস। আমি সেগুলো অনুভব করতে লাগলাম। হঠাৎ অর্ণব বললো,,,,,

-কি করছো? হাত বাহিরে কেন? ভেতরে আনো। অর্ণব একমতো আমার হাত টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। আমি অবাক হয়ে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলি,,,,,

-কি হয়েছে?
-হাত বাহিরে নিবে না। এম্নি প্রকৃতি অনুভব করো।
-হাত বাহিরে নিলে কি সমস্যা?
-ট্রেনটা কতো স্পিডে চলছে দেখেছো? হঠাৎ হাত কিছুর সাথে বাড়ি খেলে? এখানে খাম্বা, বা রাস্তায় কোনো দেয়াল থাকতে পারে। হুট করে চলে আসলে হাতে লাগবে।

-আমি তো খেয়াল করছি। বাহিরে কিছু নেই। লাগবে না।
-খেয়াল করছো কি? হঠাৎ চলে আসলে? হাত বাহিরে দেওয়া যাবে না। ভেতরে রাখতে হবে। আমার মনটা খারাপ হলো। অর্ণব এমন কেন? আমার কতো ভাল লাগছিল। আমি মন খারাপ করে বসে থাকলে অর্ণব বলে,,,,,,

-রাগ করছো কেন? আমি তো ভালর জন্যই বললাম। হঠাৎ কিছু একটা হলে কি হবে বলতো? তাছাড়া তোমাকে নিজের দায়িত্বে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার কিছু হলে আমার দোষ হবে। নিজেকে অপরাধী মনে হবে। তাছাড়া কষ্ট টা আমার বেশি হবে। আমি অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম অর্ণবেরও কষ্ট লেগেছে।

ওও সত্যি আমায় নিয়ে অনেক ভাবে। তাছাড়া আমি নিজেও বাসায় বলে আসিনি। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সব দোষ অর্ণবের উপর পড়বে। আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম,,,,,,

-আচ্ছা ঠিক আছে। আর হাত বের করবো না। আমি অর্ণবের কাধে মাথা রেখে বাহিরের দৃশ্য গুলো উপভোগ করতে লাগলাম।

প্রায় ৪টার দিকে আমরা সিলেট পৌঁছালাম। ওখান থেকে অর্ণব সিএনজি নিলো। লোকাল বাস পাওয়া যায়। কিন্তু অর্ণব বাসে উঠলো না। বললো, বাসে অনেক ঠেলাঠেলি। তাই সিএনজি দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হবে।

রাত ৯টার দিকে আমরা অর্ণবের বাসায় পৌঁছালাম। অর্ণবের মা তখনও জেগে আছে। তিনি আমাদের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। অর্ণব আগে আগে আমি পেছনে পেছনে অর্ণবের বাসায় ঢুকি।

দরজা ভেতর থেকে লাগানো। রাত্রিবেলা চারপাশ অন্ধকার। বাসাটা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। অর্ণব দরজা ঠুকা দিলে অর্ণবের মা দরজা খুঁলে দেয়। অর্ণব ব্যাগটা মাটিতে রেখে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আন্টিও অর্ণবের কপালে চুমু দেয়। আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আন্টি আমাকে দেখে বলেন,,,,,,,
-আরে মা, তুমি এতো দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আসো আসো। আমি একটু এগিয়ে এসে আন্টিকে সালাম করলাম। আগে সালাম করার রীতি ছিল। এখন নেই। এখন লোকজন সচেতন। হাদিসে আছে পা ছুঁয়ে সালাম করলে নাকি পাপ হয়। অন্য সময় হলে হয়তো আমি মুখে সালাম দিতাম। কিন্তু গ্রামে এসব কুসংস্কার মনে করে।

মায়ের বয়সি একজনকে এটুকু সম্মান করতে যদি পাপ হয় হোক। আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। একদম নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে। আন্টির এমন আচরণে আমিও শান্তি পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরেছি।

মনে মনে ভয় ছিল। আন্টি কেমন মানুষ? কিভাবে আমাকে একসেপ্ট করবে। এখন শান্তি লাগছে।

কিছুক্ষণ পর আন্টি আমাকে ছাড়লেন। আমিও সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। আন্টি আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,,,,

-আমার ছেলের পছন্দ বরাবরেই ভালো। আমি জানতাম আমার ছেলে লক্ষ্মী একটা মেয়েকেই পছন্দ করবে।

আন্টির কথা শোনে আমি আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। অর্ণবও অন্যদিকে ফিরে তাকালো। আন্টি বললেন,,,,,

– আসো, সারাদিন জার্নি করেছো। এখন একটু রেস্ট করবে। হাত মুখ ধোয়ে আসো, খেয়ে একবারে শুয়ে পড়বে। কাল অনেক গল্প করবো। আমি আন্টির সাথে গেলাম। অর্ণব অন্য একটা রুমে গেলো।

আমি আর অর্ণব ফ্রেশ হয়ে আসলে আন্টি আমাদের খাবার দেন। আন্টি কয়েক রকম খাবারের আয়োজন করেছেন। আমি সব কিছুর নাম জানি না। তবে খেতে খুব মজা। আন্টি নিজের হাতে রান্না করেছেন। ছোট ছোট মাছ রান্না করেছেন। তরকারি টা এতো ভাল লাগলো। এই জীবনে হয়তো এত ভাল তরকারি আর খাই নি। প্রথমে আমি ভেবেছি হয়তো খেতে পারবো না। কিন্তু পরে চেটেচুটে খেয়েছি। অনেকদিন পর তৃপ্তির একটা খাবার খেলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমরা শুতে গেলাম। অর্ণবদের ঘরে দুটো রুম। একটায় ওও বাড়ি আসলে থাকে আর একটায় ওর মা থাকে। তাই আমি আন্টির সাথেই ঘুমাতে গেলাম। তবে বাড়িটা বেশ পুরোনো ভেতর থেকে বুঝা যাচ্ছে।

চলবে———-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here